সেই যারা অন্ধকার ভেদ করে সত্যের মশাল হাতে সামনে আসে, তাদের নিয়তি প্রায়ই কঠিন হয়। ওসমান হাদি সেই কঠিন নিয়তির সামনে দাঁড়ানো এক যুবক। তার ওপর হামলা বাংলাদেশের নির্বাচনী ইতিহাসের সেই কালো অধ্যায়গুলোর পুনরাবৃত্তি, যেখানে ক্ষমতা দখলের লিপ্সা মানুষকে সব মানবিকতা ভুলিয়ে দেয়। এই ঘটনা শুধু একটি নির্বাচনের ফলাফলের ওপর প্রভাব ফেলে না, গোটা জাতির মনোবলে চিড় ধরায়, যখন তারা দেখে তাদের নির্বাচিত প্রতিনিধি হওয়ার আকাক্সক্ষা গুলিবিদ্ধ হয়ে পথে লুটিয়ে পড়ছে। রাজনীতি যখন জনসেবার মন্ত্র ভুলে গিয়ে কেবল ‘শিকার’ আর ‘শিকারির’ খেলায় মেতে ওঠে, তখনই এমন বীভৎসতা দেখতে হয়। হাদি এই মৃগয়ার শিকার। তবে এ তো চিরন্তন সত্য যে, বুলেট দিয়ে কখনো প্রতিবাদের কণ্ঠ চিরতরে স্তব্ধ করা যায় না।
গুলিবিদ্ধ একজন প্রার্থীর রক্তাক্ত শরীর যখন হাসপাতালের বিছানায় নিঃশব্দে পড়ে থাকে, তখন তা কেবল একটি দৈব দুর্ঘটনা বা অপরাধের ঘটনা থাকে না। এটি হয়ে ওঠে জাতির সামগ্রিক বিবেক ও রাজনীতির গলিত চেতনার এক মর্মস্পর্শী দর্পণ।
শরিফ ওসমান হাদি, ঢাকা-৮ আসনের স্বতন্ত্র প্রার্থী। নামের সাথে ইনকিলাব মঞ্চের পরিচয় বহনকারী এই তরুণ, দেশের ক্ষয়িষ্ণু রাজনীতিতে এক ব্যতিক্রমী কণ্ঠস্বর। তার ওপর আক্রমণ তাই এক ব্যক্তির ওপর আক্রমণ নয়; এটি যেন বাংলাদেশের বুকে সদ্য অঙ্কুরিত এক প্রতিবাদী তারুণ্যের ওপর বুলেট বর্ষণ।
ওসমান হাদি দেশের ঘুণে ধরা, জীর্ণ রাজনীতির কদর্য কোলাহলের মধ্যে একটি বিরল ব্যতিক্রম। তার কথা বলার ধরন ছিল মেদহীন, তীক্ষè এবং নির্ভীক। রাজনীতির প্রচলিত দূষিত ধারার বাইরে গিয়ে তিনি যে ভাষায় কথা বলতেন, তাতে ছিল কোটি মানুষের না বলা ক্ষোভের প্রতিধ্বনি। তার প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর ছিল কেবল কথার ফুলঝুরি নয়, ছিল গভীর উপলব্ধির প্রকাশ। তিনি মেধা ও সাহস দিয়ে একটি বশংবদ সমাজে বিদ্রোহের বীজ বুনে দিচ্ছিলেন। এ কারণে তার মতো তারুণ্যের বড্ড বেশি প্রয়োজন ছিল বাংলাদেশের রাজনীতিতে। তার সাহসিকতা বহু মানুষকে আকৃষ্ট করেছিল, যারা দীর্ঘদিন ধরে হতাশা আর দ্বিধায় ভুগছিলেন। কিন্তু তার মতো সাহসী এক প্রতিবাদী কণ্ঠের স্তব্ধ হয়ে পড়া সত্যিই এক মর্মান্তিক বিষাদলিপি রচনা করল।
হাদি নিশ্চিত মৃত্যুর মুখে দাঁড়িয়েও বেঁচে আছেন। কিন্তু তার এই ফেরা প্রমাণ করল, নোংরা রাজনীতিতে আদর্শের উচ্চারণ কতটা বিপজ্জনক। রাজনীতিতে মতভেদ থাকা স্বাভাবিক, কিন্তু ভিন্নমতকে বুলেটের মাধ্যমে স্তব্ধ করে দেয়ার এই সংস্কৃতি কেবল বর্বর নয়, সভ্যতা ও গণতান্ত্রিক চেতনার ঘোরবিরোধী। প্রতিটি বুলেটের আঘাত যেন বাংলাদেশের গণতন্ত্রের কপালে লেখা গভীর ক্ষতচিহ্ন। এই ক্ষতচিহ্ন আমাদের বারবার মনে করিয়ে দেবে, যখন বাকস্বাধীনতা রুদ্ধ করতে সহিংসতার আশ্রয় নেয়া হয়, তখন রাষ্ট্রকাঠামো দুর্বল হয়ে পড়ে। হাদির মতো একজন প্রতিবাদী কণ্ঠকে থামিয়ে দেয়ার প্রচেষ্টা আসলে গোটা জাতিকে নীরব করে দেয়ার এক ঘৃণ্য চক্রান্ত।
হাদির ওপর হামলা প্রমাণ করে, দেশের রাজনীতি এখনো কতটা অন্ধকারে তলিয়ে আছে। যেখানে ভোটের অধিকার, স্বাধীনভাবে প্রচার করার স্বাধীনতা এবং জীবনের নিরাপত্তা- এগুলো সবই অপ্রাসঙ্গিক। নির্বাচন কমিশন তফসিল ঘোষণা করেছে, সরকার সুষ্ঠু নির্বাচনের আশ্বাস দিচ্ছে। ঠিক সেই মুহূর্তে একজন জনপ্রিয় স্বতন্ত্র প্রার্থীর ওপর এমন ন্যক্কারজনক হামলা কেবল অপরাধ নয়, এটি সুদূরপ্রসারী ষড়যন্ত্রের ইঙ্গিত বহন করে। এমন সন্দেহ অমূলক নয়, এ ঘটনা সামগ্রিক নির্বাচনী প্রক্রিয়া বানচালের অপকৌশল হতে পারে। এই আক্রমণ শুধু হাদিকে নয়, নির্বাচনের ওপর সাধারণ মানুষের আশা-ভরসাকেও লক্ষ্যবস্তু করেছে।
আমরা সেই নোংরা রাজনীতির সমালোচনা করি, যা মতাদর্শ দিয়ে মতাদর্শের মোকাবেলা করে না, করে লাঠি আর বুলেট দিয়ে। এই রাজনীতি ভীরু ও কাপুরুষদের, যারা কেবল ক্ষমতা ধরে রাখতে চায়, মানুষের আশা-আকাক্সক্ষাকে নয়। হাদির রক্তাক্ত শরীর এই নোংরা রাজনীতির বর্বরতম অধ্যায়কে প্রতীকী রূপ দিয়েছে। তার পাশে আজ শুধু কিছু কর্মী নয়, দাঁড়িয়ে আছে গোটা বাংলাদেশ। যারা একটি সুন্দর, গণতান্ত্রিক ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখেন।
গণতন্ত্র কেবল ভোটের বাক্সে নয়, এটি টিকে থাকে ভিন্নমতের প্রতি শ্রদ্ধায়। যখন সেই শ্রদ্ধাবোধের অভাবে বুলেটের ব্যবহার হয়, তখন নির্বাচন কমিশনের ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ হয় এবং সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর মানুষের আস্থা হ্রাস পায়। হাদির মতো প্রতিবাদী কণ্ঠ স্তব্ধ করার মাধ্যমে এই বার্তা দেয়া হয়েছে, রাজনীতিতে কেবল ক্ষমতাবানদের কথাই চলবে। কিন্তু জনগণের ঐক্য এবং গণমানুষের সমর্থনই আজ সেই বার্তার বিরুদ্ধে নীরব প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে।
হাদির এই রক্তক্ষরণ যেন আমাদের জাতীয় বিবেকের কাছে এক চিরস্থায়ী প্রশ্ন, যার উত্তর খুঁজতে হবে ভোটের পবিত্রতা রক্ষা করেই। এই বিষাদলিপির মধ্যে একটি চমৎকার ইতিবাচক দৃশ্যপট দেখা গেল। বিএনপির অন্যতম নেত্রী ডা: জুবাইদা রহমান গুলিবিদ্ধ হাদিকে দেখতে হাসপাতালে গেছেন। এটি কেবল একজন চিকিৎসকের মানবিক দায়িত্ব পালন নয়, এর একটি গভীর রাজনৈতিক ও প্রতীকী মূল্য আছে। ভিন্ন রাজনৈতিক মঞ্চের একজন গুলিবিদ্ধ প্রার্থীর পাশে দাঁড়ানো বিএনপির সামগ্রিক রাজনীতিকে একটি নতুন মানবিক ফোকাস দেয়। এটি প্রমাণ করে, নীতিগত বিরোধ বা মঞ্চের ভিন্নতা সত্তে¡ও গণতন্ত্র ও মানুষের নিরাপত্তা প্রশ্নে তারা এক। এটি কেবল হাদির প্রতি সহমর্মিতা নয়, এটি দেশের সব রাজনৈতিক মতাদর্শের মানুষের প্রতি একটি আহ্বান যে, সহনশীলতা ও মানবিকতাই রাজনীতির ভিত্তি হওয়া উচিত।
ওসমান হাদির ওপর হামলা দেশের রাজনীতিতে এক গভীর ক্ষত তৈরি করল। এই ঘটনায় আমরা এক দিকে যেমন দেখেছি নোঙরা রাজনীতির চরম রূপ, তেমনি বাংলাদেশের বিভক্ত রাজনৈতিক মানচিত্রে সহানুভূতির একটি ছোঁয়াও স্পষ্ট হলো। এই দৃশ্যপট ভবিষ্যৎ রাজনীতিকদের জন্য একটি নীরব পাঠ হয়ে থাকবে, যেখানে বলা হবে- আঘাতকারী যেই হোক না কেন, আহত মানুষের পাশে দাঁড়ানোই শ্রেষ্ঠ রাজনীতি। হাদি আজ হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে আছেন; কিন্তু তার কণ্ঠস্বর আরো বহু মানুষের মনে অনুরণিত হচ্ছে। তার বিষাদলিপি যেন এক নতুন আশার ইশতেহার হয়ে আসুক। এই লিপি যেন দেশের সব রাজনৈতিক দল ও নির্বাচন কমিশনের প্রতি একটি চূড়ান্ত সতর্কবাণী হয়। আর কোনো প্রতিবাদী তারুণ্য যেন এভাবে শিকার না হয়। জনগণের নিরাপত্তা ও একটি সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিত করার দায়িত্ব রাষ্ট্রকেই নিতে হবে। হাদির এই লড়াই প্রমাণ করে, ক্ষমতার অপব্যবহারের বিরুদ্ধে জনগণের প্রতিরোধ আজো জীবিত।
তরুণ প্রজন্ম এখন আর কেবল নীরব দর্শক নয়, তারা প্রতিবাদী। আমরা আশা করব, এই ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত হবে এবং যারা এই জঘন্য কাজ করেছে তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেয়া হবে, যাতে ভবিষ্যতে কোনো রক্তচক্ষু আর কোনো সৎ প্রার্থীকে ভয় দেখাতে সাহস না পায়। হাদির মতো মেধাবী কণ্ঠস্বরকে রক্ষা করা কেবল গণতন্ত্রের জন্য নয়, এটি আমাদের সম্মিলিত ভবিষ্যতের জন্য অপরিহার্য। তার এই সংগ্রাম কেবল ঢাকা-৮ আসনের নয়, এটি গোটা দেশের অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম। আমাদের দায়িত্ব হলো, তার এই নীরব আত্মত্যাগকে বৃথা যেতে না দেয়া।
হাদির লড়াই আজ একার নয়, এটি বাংলাদেশের প্রতিটি মুক্তচিন্তার মানুষের লড়াই। আমরা আশা করি, তিনি দ্রুত সুস্থ হয়ে উঠবেন এবং তার এই ফিরে আসা দেশের রাজনীতিতে ইতিবাচক পরিবর্তনের বীজ বপন করবে, যেখানে বুলেট নয়, যুক্তি ও মেধার জয় হবে। তার এই বেঁচে থাকা যেন আগামী দিনের জন্য প্রেরণা হয়ে থাকে যে, প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর কখনো থেমে যায় না। হাদির বিষাদলিপি আজ এক জ্বলন্ত দলিল। এই দলিল উপেক্ষা করা মানে, ভবিষ্যতের আরো অনেক তারুণ্যকে রাজনীতির শিকার ক্ষেত্রে উৎসর্গ করা।
যেদিন প্রতিদ্ব›িদ্বতার ময়দানে বন্দুকের ভাষা নয়, কেবল যুক্তির সংলাপ চলবে, সেদিনই বলা যাবে, হাদির এই রক্তপাত অবশেষে ফলপ্রসূ হয়েছে। তার শরীরের প্রতিটি ক্ষতই আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়, গণতন্ত্র এখনো কতটা ভঙ্গুর। বাংলাদেশ কি প্রস্তুত সেই ভার বহনে? নাকি এমন আরো অনেক রাজনৈতিক মৃগয়ার নীরব সাক্ষী হয়ে আমরা কেবল দীর্ঘশ্বাস ফেলব? সময় এসেছে নীরবতা ভেঙে রুখে দাঁড়ানোর, যেন ভবিষ্যতে আর কোনো তারুণ্যকে রাজনীতির কদর্য খেলার বলি হতে না হয়।
লেখক : কথাসাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট



