২৮ আগস্ট বিএনপির মহাসচিব মীর্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের একটি বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে আজকের আলোচনা। তিনি ইদানীং মাঝে মধ্যে হতাশ হয়ে পড়েন দুর্নীতির বিস্তার দেখে। তিনি উল্লেখ করেছেন, আগে যেখানে এক লাখ টাকা ঘুষ লাগত এখন সেখানে লাগে পাঁচ লাখ টাকা। তার মতে, দেশের বেশির ভাগ মানুষ নষ্ট হয়ে গেছে; দুর্নীতিপ্রবণ হয়ে গেছে।
২০২২ সালে পরিচালিত পরিসংখ্যানে দুর্নীতিগ্রস্ত ১৮০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান দেখানো হয়েছে ১৪৬। পার্শ¦বর্তী দেশ শ্রীলঙ্কা ও নেপাল ছিল ৩৬ ও ৩৪ নম্বরে। পাকিস্তান ২৭, আফগানিস্তান ২৪, ভারত ও মালদ্বীপ ৪০। ডেনমার্ক, ফিনল্যান্ড এবং নিউজিল্যান্ড যথাক্রমে ১, ২ ও ৩। আমাদের দেশে মূলত, সরকারি ক্ষেত্র, বিচারিক দুর্নীতি- রাজনৈতিক ও স্বাস্থ্যসেবা ক্ষেত্রে দুর্নীতিগুলোকে সর্বাধিক দুর্নীতিগ্রস্ত দেখানো হয়েছে। এ ছাড়া ব্যবসায়িক দুর্নীতির কথাও এখানে বলা হয়েছে। মীর্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর যা উপলব্ধি করেছেন, যা দেখেছেন, যা বলেছেন, এর পরিপ্রেক্ষিতে বিএনপির কর্মসূচিতে দুর্নীতির বিরুদ্ধে সুস্পষ্ট কার্যকর নীতিমালা জাতিকে আশান্বিত করবে নিঃসন্দেহে। একই সাথে অন্যান্য রাজনৈতিক দল ও নেতাদের কাছে অনুরূপ পদক্ষেপ জাতি আশা করে। অসৎ, অনৈতিক, আইনবহিভর্ূতভাবে নিজ স্বার্থসিদ্ধিকে কোনোভাবে মেনে নেয়া যায় না। স্বার্থসিদ্ধির জন্য উন্নয়নশীল দেশের ভেতর একদলীয় ফ্যাসিবাদী শাসনের ছত্রছায়ায় দুর্নীতির ব্যাপ্তি ঘটে। দায়বদ্ধতা, সুবিচার ও আইনের শাসনের অভাব দুর্নীতিকে ছড়িয়ে দেয় সমাজের গভীরে।
বিচারহীনতা, রাজনৈতিক ক্ষমতার প্রশ্রয় দুর্নীতিকে সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে প্রবেশ করিয়ে দেয়। ভোগ ও লালসার, সীমাহিন চাহিদা-নৈতিক অধঃপতন এবং স্বচ্ছতার অভাব দুর্নীতিকে আড়াল করে ফেলে। প্রশাসনিক দুর্বলতা ও রাজনীতির নিয়ন্ত্রণযুক্ত বিচার বিভাগ এবং প্রশাসন দুর্নীতিকে প্রশ্রয় দিতে বাধ্য হয়। দুর্নীতির কাছে যখন পরাজিত হয় সুকুমারবৃত্তিগুলো তখন হারিয়ে যায় মানবিক মূল্যবোধ, সদাচার, সুবিচার ও ন্যায়পরায়ণতা। ফলে ঘটতে থাকে বালিশকাণ্ড, পর্দাকাণ্ড, ছাগলকাণ্ড আর পাথরকাণ্ডের মতো অবিশ্বাস্য ঘটনা। গত ১০-১৫ বছরে ফ্যাসিবাদের শাসনামলে দুর্নীতির ব্যাপ্তি বেড়েছে অস্বাভাবিক দ্রুততার সাথে। শেয়ার মার্কেট কেলেঙ্কারি, অর্থপাচার, ব্যাংক লুট, লুটেরাদের প্রকাশ্য সামাজিক প্রভাব ও রাজনৈতিক আশ্রয়-প্রশ্রয় দুর্নীতিকে ছড়িয়ে দিয়েছে ব্যাপকভাবে। ঘুষ দেয়া-নেয়া, পক্ষপাতিত্ব, ক্ষমতার অপব্যবহারের চিত্র সমসাময়িক উন্নয়নশীল দেশগুলোর চেয়ে বাংলাদেশে অনেক বেশি। বলা যায় দুর্নীতিতে বাংলাদেশ পৃথিবীর রোলমডেল।
বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, সরকারি-বেসরকারি অফিস, করপোরেট অফিস, স্কুল-কলেজ, মাদরাসা, বিশ্ববিদ্যালয়- আইন-আদালত, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, হাসপাতাল- কোথায় নেই দুর্নীতি। দুর্নীতি এখন মসজিদ, মন্দির ও গির্জায়। দুর্ঘটনায় পতিত হয়ে চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে আসা রোগী, মৃতপ্রায় রোগীদের নিয়ে অপচিকিৎসা ও দুর্নীতির কথা প্রায়ই খবরের কাগজের হেডলাইন হয়। সমস্যা কিন্তু তাতে কমে না; বরং লাগামহীনভাবে বেড়েই চলছে। দেশের সামগ্রিক শৃঙ্খলা আজ ভেঙে পড়েছে। দারিদ্র্যের হার যখন ক্রমেই উল্লম্ফনে তখন সরকারের উন্নয়নমুখী পরিকল্পনাও ভেস্তে যায়। আট-দশ গুণ খরচ বেড়ে যায় প্রকল্পের। দুর্নীতি দমন কমিশন ঠুঁটো জগন্নাথের ভূমিকায় যেতে বাধ্য হয়। দুর্নীতির কারণে দেশ ও জাতি আন্তর্জাতিক পরিপ্রেক্ষিতে হেয় হলেও দুর্নীতিবাজদের কোনো যায়-আসে না। তারা ক্ষমতার পক্ষপটে নিরাপদ আশ্রয় খুঁজে পায়। বিদেশে সম্পদের পাহাড় বানায়। পরিবার পরিবজনদের দেশের বাইরে পাঠিয়ে দিয়ে চিকিৎসার জন্য ঘন ঘন বিদেশ সফরের মাধ্যমে তাদের ক্ষমতা ও প্রতিপত্তির প্রকাশ ঘটায়।
ইসলাম রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক, রাষ্ট্রীয়, নৈতিক এবং পরিবেশগত দুর্নীতিকে ‘জিরো টলারেন্স’-এর দৃষ্টিতে বিচার করে। মহান আল্লাহর নির্দেশ- ‘তোমরা ভালো কাজের আদেশ দাও এবং মন্দ কাজকে প্রতিহত করো’ (সূরা আলে ইমরান-১০৪)। এ ক্ষেত্রে শিক্ষাজীবনের সর্বত্রই ইসলাম নৈতিক শিক্ষাকে বাধ্যতামূলক করেছে। এর সাথে সাথে প্রাতিষ্ঠানিক (দুর্নীতি দমন কমিশন) আইনি ব্যবস্থার নির্মোহ প্রয়োগ, দুর্নীতি ঠেকাতে সাহায্য করবে নিঃসন্দেহে। ‘দুর্নীতি রুখব, দুর্নীতিবাজকে ধরব’- এ ধরনের প্রচারণা-ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় গুরুত্বসহকারে প্রচারের ব্যবস্থা করা দরকার। একই সাথে প্রয়োজন রাজনৈতিক দায়বদ্ধতা। দুর্নীতি প্রতিরোধে সামাজিক আন্দোলনের বিকল্প নেই।
লেখক : চক্ষুরোগ বিশেষজ্ঞ