মুহাম্মদ সা:-এর নাম বনাম স্প্রেঙ্গার-আর্মস্ট্রংয়ের ভ্রান্তিবিলাস

মিসর, পারস্য, ইয়েমেন, বাহরাইনসহ আরব-অনারব রাজদরবারগুলোতে তার নাম উচ্চারিত হচ্ছে মুহাম্মদ নামে? মরুচারী বেদুইন থেকে রোম-পারস্যের সম্রাট অবধি সবার কাছে তিনি ছিলেন মুহাম্মদ। প্রত্যেক মুসলিমের কাছে তো বটেই। আল্লাহর ভাষায়ও তাই। তাহলে কিভাবে এই নাম নকল সাব্যস্ত হলো? প্রাচ্যবিদদের কাছে প্রশ্নগুলোর জবাব নেই। তার কাছে দাবি আছে, দলিল নেই। তাহলে দাবিটার ভিত্তি কী? ভিত্তি হলো কল্পনা। কল্পনা থেকে মানুষ কত কিছু বলে। চাঁদে আছে এক বুড়ি। সে সুতা কাটে। ... এই সব গল্প শিশুদের শোনানো হতো। আর্মস্ট্রংও গল্প হাজির করলেন। গল্পে প্রমাণ লাগে না

প্রাচ্যবিদদের এলাকায় শোনা গেল এক দাবি। তারা হজরত মুহাম্মদ সা:-এর নাম নিয়ে নতুন বয়ান হাজির করলেন। বয়ানটি হলো- আল্লাহর রাসূলের প্রাথমিক নাম মুহাম্মদ ছিল না। মুহাম্মদ সা: নামটি এসেছে চারটি সূরায়, আর সেগুলো হচ্ছে- সূরা আলে ইমরান, সূরা আহজাব, সূরা মুহাম্মদ ও সূরা ফাতাহ। এ চারটি সূরাই মাদানি। অতএব তারা বলতে থাকলেন, রাসূল সা: হিজরতের আগে মুহাম্মদ নামে পরিচিত ছিলেন না। তার অন্য নাম ছিল!

অস্ট্রিয়ান প্রাচ্যবিদ এলয়স স্প্রেঙ্গার তার The Life of Muhammad গ্রন্থে বলেন, রাসূল সা:-এর মূল নাম ‘কাসাম’। তিনি মদিনাতেই, বিশেষত খ্রিষ্টানদের সাথে সংস্পর্শের পর মুহাম্মদ নামে পরিচিত হয়ে ওঠেন। আসলেই কি তাই? প্রমাণাদি কী বলে?

আমরা দৃষ্টি দেবো নবীজির জন্মেরও আগের সময়ে। সূর্যোদয় আসন্ন। মহাকালের প্রতীক্ষা ভোরের পূর্ব মুহূর্তে উপনীত। মানবতার দুঃখ ও দুর্গতির কালোরাত শেষ হতে যাচ্ছে। হজরত মুহাম্মদ সা: এখন মাতৃগর্ভে। জননীর স্বপ্নে মহাপুরুষের শুভবার্তা। ইতিহাসের গ্রন্থাবলি তার স্বপ্নভাষ্য বয়ান করেছে। মা আমেনা বলেন এক আগন্তুকের কথা। যিনি তার নজরে নূরের মতো জ্বলে ওঠেন। মহানবী সা: তাঁর গর্ভে আগমন করলে অচেনা আগন্তুক বললেন, ‘আপনি যাকে গর্ভে ধারণ করলেন, তিনি মানবজাতির মহানায়ক। তিনি যখন জন্ম নেবেন, তখন বলবেন, ‘সব হিংসুকের অনিষ্ট থেকে এ শিশুকে এক ও অদ্বিতীয় প্রভুর আশ্রয়ে সমর্পণ করছি। আর তাঁর নাম রাখবেন মুহাম্মদ সা:।

মা আমেনার এই ভাষ্য ইবনে সাদ বর্ণনা করেছিলেন তার তাবাকাতে, ইয়াজিদ ইবনে আবদুল্লাহর সূত্রে, ইমাম বায়হাকি বর্ণনা করেন মুহাম্মদ ইবনে ইসহাকের সূত্রে।

জন্মের সপ্তম দিনে আবদুল মুত্তালিব নাতির আকিকা করেন। আকিকা অনুষ্ঠানে কুরাইশের সবাইকে দাওয়াত করলেন। সবার সামনে নাতির নাম ঘোষণা করা হলো। আবদুল মুত্তালিব বললেন, আমি তাঁর নাম রেখেছি মুহাম্মদ। মজলিসের কুরাইশরা বললেন, হে আবুল হারিস! (আবদুল মুত্তালিবের উপনাম)। আপনার পূর্বপুরুষ বা সম্প্রদায়ের কেউ তো আগে এমন নাম রাখেনি। আপনি কেন এই নাম নির্ধারণ করলেন? আবদুল মুত্তালিব বললেন, এ নাম রাখার কারণ হলো যেন পৃথিবীর সব প্রাণ যেন এ নবজাতকের প্রশংসা করে। (সিরাতে মুস্তাফা সা:-১/৬৩)

জুবাইর বিন মুতইম রা: থেকে বর্ণিত- রাসূলুল্লাহ সা: ইরশাদ করেন, ‘আমার অনেকগুলো নাম রয়েছে। আমি মুহাম্মদ (প্রশংসিত), আমি আহমাদ (সর্বাধিক প্রশংসিত), আমি ‘মাহি’ (বিদূরিতকারী)। আমার মাধ্যমে আল্লাহ কুফরিকে বিদূরিত করেছেন। আমি ‘হাশের’ (জমাকারী)। কেননা, সমস্ত লোক কিয়ামতের দিন আমার কাছে জমা হবে (এবং শাফায়াতের জন্য অনুরোধ করবে)। আমি ‘আকেব’ (সর্বশেষে আগমনকারী)। আমার পরে আর কোনো নবী নেই’। (বুখারি-৪৮৯৬, মুসলিম-২৩৫৪, মিশকাত : ৫৭৭৬-৭৭, ফাজায়েল অধ্যায়, রাসূল সা:-এর নাম সমূহ অনুচ্ছেদ) এই সব নামের মধ্যে মুহাম্মদ ও আহমাদ হলো রাসূলে খোদার মূল নাম। বাকিগুলো হলো তাঁর গুণবাচক নাম। (মানছুরপুরী, রহমাতুল্লিল আলামিন-৩/১৯৮ পৃষ্ঠা)

মুহাম্মদ নামে তিনি শুরু থেকেই পরিচিত। এই নামে জননী তাঁকে ডাকতেন, দাদা ডাকতেন এই নামেই। পরিবারের অন্যরাও এই নামেই তাকে ডাকতেন, নবীজি যখন ধাত্রী মা হালিমা সাদিয়ার প্রতিপালনে, তখনো তাদের কাছে তিনি ছিলেন মুহাম্মদ। এ নামেই তারা জানতেন, ডাকতেন ও ব্যক্ত করতেন। দ্বিতীয় দফায় হালিমার কাছে আসার পর চার কিংবা পাঁচ বছর বয়সে মুহাম্মদ সা:-এর বক্ষ বিদারণের বিস্ময়কর ঘটনা ঘটে। এই সময় সাথী বাচ্চারা ছুটে গিয়ে হালিমাকে খবর দিলো, মুহাম্মদ নিহত হয়েছে। (মানে তারাও তাঁকে এই নামেই ব্যক্ত করত) (মুসলিম-১৬২, আনাস রা: থেকে; মিশকাত-৫৮৫২, নবুয়তের নিদর্শনসমূহ অনুচ্ছেদ)

খাদিজা রা:-কে বিয়ের পরে জায়েদ ইবনে হারিসাকে লালন-পালন করেন আল্লাহর রাসূল। এ কারণে তিনি পরিচিত হন মুহাম্মদ ইবনে জায়দ বা মুহাম্মদের পুত্র জায়দ নামে। (বুখারি-৪৭৮২) এর মানে পরিষ্কার। মুহাম্মদ নাম নবীজির যৌবনে গোটা মক্কায় বিখ্যাত ছিল। এই খ্যাতি এতই প্রভাবশালী ছিল যে, তার আজাদকৃত গোলামকেও ইবনে মুহাম্মদ বলত লোকেরা!

‘মুহাম্মদ’ নাম শুধু চাচা আবু তালিবের পরম প্রিয় ছিল তা নয়; বরং তিনি নিজের মহান ভাতিজা ও তাঁর নামের মহিমা বয়ানে মুখর ছিলেন। আবু তালিব বলতেন, ‘তাঁর মর্যাদা বৃদ্ধির জন্য আল্লাহ নিজের নাম থেকে তার নাম বের করে এনেছেন। তাই আরশের মালিক হলেন মাহমুদ এবং ইনি হলেন মুহাম্মদ।’ (বুখারি, তারিখুল আওসাত-১/১৩, ক্রমিক-৩১)

এগুলো সবই মক্কি জীবনের বিবরণী। শৈশব, কৈশোর, তারুণ্য, যৌবনে তিনি গোটা মক্কা ও আরবের কাছে ছিলেন মুহাম্মদ। কিন্তু স্প্রেঙ্গার আবিষ্কার করলেন, এই নামে নবীজিকে কেউ জানত না। তিনি নিজের এই নাম প্রচার করলেন তখন, যখন বাইবেলের প্যারাক্লিতস-বিষয়ক ভবিষ্যদ্বাণী জানলেন। মনে মনে তিনি নিজেকে প্যারাক্লিতস ভাবলেন আর এর আরবি অনুবাদ হিসেবে নিজের নামকরণ করলেন মুহাম্মদ।

মজার ব্যাপার হলো- স্প্রেঙ্গারের এই কল্পনাকে সমর্থন করেন আরো বহু প্রাচ্যবিদ। এর মধ্যে ফরাসি-ইহুদি পণ্ডিত হার্টউইগ ডেরেনবার্গ, জার্মান প্রাচ্যবিদ থিওডর নোলডেক এবং ইতালীয় প্রাচ্যবিদ প্রিন্স লিওন ক্যাটানি অন্যতম।

এই সব প্রাচ্যবিদ দেখাতে চাইলেন নবীজির আসল নাম ‘কাসাম’। কিন্তু এই নামকে আসল নাম সাব্যস্ত করতে হলে অন্তত একটি আশ্রয় তো লাগবে। তারা সর্বশক্তি দিয়ে তালাশ করলেন প্রমাণ। অবশেষে হাজির করলেন এমন প্রমাণ, যা আদৌ প্রমাণ নয়। সিরাতে হালবিয়ার বিচ্ছিন্ন একটি বর্ণনাকে তারা আশ্রয় বানালেন। কিন্তু এই বর্ণনা নিজেই তাদের দাবি খারিজ করে দেয়। বর্ণনাতে আছে, জন্মের পর ‘কাসাম’ নাম রাখা হলে আবদুল মুত্তালিব সাথে সাথে সে নাম পরিবর্তন করেন এবং মুহাম্মদ রাখেন। এর মানে হলো জন্মের পরই কাসাম নাম গৃহীত হয়নি।

রোনাল্ড ভিক্টর বডলি স্বীকার করেন, ‘জন্মের পর তার নাম রাখা হয় কাসাম। কিন্তু আবদুল মুত্তালিব পুরুষ নাতি পাওয়ায় কাবায় উপাস্যের কৃতজ্ঞতা জানিয়ে তার নাম রাখেন মুহাম্মদ। পরে মানুষ যখন এ নাম সম্পর্কে জানতে পারল, তারা আবদুল মুত্তালিবকে জিজ্ঞেস করল, ‘পিতৃপুরুষদের নাম এড়িয়ে এমন নাম রাখার কারণ কী?’ আবদুল মুত্তালিব বললেন, ‘আমি চাই সে তার চরিত্রের কারণে এ জমিনে ও আসমানে প্রশংসিত হবে।’ (আর-রসূল, হায়াতে মুহাম্মদ, পৃষ্ঠা-৩২)

ভিক্টরও ভুল বলেছেন। জন্মের পরে কাসাম নাম রাখা হয়নি; বরং নিতান্তই দুর্বল একটি বর্ণনার দাবি হলো- কাসাম নাম রাখার ইচ্ছে করেছিলেন আবদুল মুত্তালিব। আলী ইবনে ইবরামি হালাবি কিতাবুল ইমতা থেকে বিবরণ পেশ করেন, রাসূলুল্লাহর সা: জন্মের আগে আবদুল মুত্তালিবের এক সন্তান ছিলেন কাসাম। তিন বছর বয়সে তিনি মারা যান। আবদুল মুত্তালিব এতে খুবই মর্মাহত হন। নবীজির জন্ম হলে তিনি নাম রাখতে চান কাসাম। মা আমেনা তখন তাকে নিজের স্বপ্নের কথা জানালেন, যে স্বপ্নে বাতলে দেয়া হয় মুহাম্মদ নাম। আবদুল মুত্তালিবও স্মরণ করতে পারলেন তার স্বপ্ন, তাকেও একই নাম বাতলে দেয়া হয়েছিল, নবজাতকের নাম হবে মুহাম্মদ। (সিরাতে হালাবিয়া, প্রথম খণ্ড, অধ্যায়-৬, পৃষ্ঠা-২৪১)

তাহলে দেখা যাচ্ছে, কাসাম নামে নবীজির নামকরণের ঘটনাই ঘটেনি। আবদুল মুত্তালিব ইচ্ছে করেছিলেন মাত্র। সে নাম রাখাই হয়নি। শত শত দলিল বলছে, তিনি ছিলেন মুহাম্মদ সা:। এর বিপরীতে হালাবিয়ার এই বিবরণী দলিল হতে পারে না; বরং এই বিবরণীও বলছে, তাঁর নাম রাখা হয় মুহাম্মদ। বিপরীতে প্রাচ্যবিদরা জোর করে একে দলিল বানিয়ে ছাড়বেন।

কিন্তু সমস্যা এটিই নয়। গুরুতর সমস্যা হলো- প্রাচ্যবিদরা যেখানে সহিহ হাদিসকেও দলিল মানতে রাজি নন, সেখানে তারা নিজেদের দাবির পক্ষে দলিল বানালেন এমন এক বর্ণনাকে, যার শুদ্ধতা নিয়ে স্বয়ং সঙ্কলক সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। (সিরাতে হালবিয়া, প্রথম খণ্ড, পৃষ্ঠা-১১৮) সিরাতে হালাবিয়ার লেখক আলী ইবনে ইবরাহিম ইবনে আহমদ হালাবি নিজেই এই বর্ণনাকে সন্দেহজনক বিবরণী হিসেবেই দেখেছেন।

কাসাম নামটির প্রমাণ না থাকলেও যদি ধরেও নিই এই নামেও তাঁকে ডাকা হতো, তাতে কি প্রমাণ হচ্ছে, মুহাম্মদ নামে তিনি পরিচিত ছিলেন না?

ক্যারেন আর্মস্ট্রং তার বিখ্যাত Muhammad : a Biography of the Prophet গ্রন্থে দাবি করেন, ‘সিরিয়াক চার্চের কতিপয় আরব খ্রিষ্টান এমনভাবে ইঞ্জিলের অনুবাদ করে, যেন তারা মুহাম্মদের নবুয়তের প্রত্যাশা করছে। মসিহ তাঁর অনুসারীদের বলেছিলেন, তার মৃত্যুর পর পরমাত্মা প্যারাক্লিত ‘Paraclete’-কে পাঠানো হবে, যিনি তাদের মসিহের শিক্ষাগুলোই দেবেন এবং তা বুঝতে সহযোগিতা করবেন। আরব খ্রিষ্টানদের সে অনুবাদে ‘Paraclete’-এর অনুবাদ করা হয় মুনাহেমা ‘Munahhema’ যা এ অনুবাদের কিছু দিন পরই মুহাম্মদ হিসেবেই প্রকাশ পেতে থাকে। এ ছাড়া আরো কিছু আরব খ্রিষ্টানের কাছে প্যারাক্লিতস ‘Periklytos’ শব্দের উদ্ভব ঘটতে থাকে, যার আরবি অনুবাদ আহমদ। আহমদ নামটি আরবে পরিচিত ছিল।’

এখানে ক্যারেন যে মতটি দেন, তার সারাংশ হচ্ছে মসিহের উল্লিখিত ‘প্যারাক্লিতস’ শব্দটি বিকৃত অনুবাদে আরব খ্রিষ্টানদের কাছে আহমদ ও মোহাম্মদ নামে প্রকাশ পায়। আর্মস্ট্রং আরো বলেন, ‘নিঃসন্দেহে মুহাম্মদ এ অনুবাদকৃত শব্দেই পরিচিত, কুরআন এ ধারণার প্রতি ইঙ্গিত করে, মসিহ এমন রাসূলের সুসংবাদ দিয়েছেন, যিনি তাঁর পরে আসবেন এবং তাঁর নাম হবে মুহাম্মদ। তিনি মসিহের রিসালাতকে শক্তিশালী করবেন।

কারেনের বক্তব্য ভুল। ঐতিহাসিক মুহাম্মদ ইবনে ইসহাক জোহনের ইঞ্জিলের উদ্ধৃতি দিয়ে এ ভবিষ্যদ্বাণী উল্লেখ করেছেন। যেখানে প্যারাক্লিতসের স্থানে ঈসা আ:-এর মূল সুরিয়ানি শব্দ ‘আলমুনহামান্না’ উল্লেখ করা হয়েছে। শেষে ইবনে ইসহাক বলেছেন, ‘মুনহামান্না সুরিয়ানি শব্দ। এর অর্থ হলো মুহাম্মদ।’ (দ্র: ইবনে হিশাম, আস-সিরাত, প্রথম খণ্ড-২৩৩)

সুরিয়ানি ভাষায় কথা বলতেন ঈসা আ:। প্যারাক্লিতস হলো মুনহামান্নার অনুবাদ মাত্র। রোমান অনুবাদ হলো পারাকালিস্তিস। গ্রিক অনুবাদ হলো পাইরিকিলইউটাস। গ্রিক ভাষায় এর অনুবাদ হলো প্যারাক্লিতস। জোহনের ইঞ্জিলে এসেছে প্যারাক্লিতস প্রসঙ্গ, এটি রচিত হয়েছিল গ্রিক ভাষায়।

আরবি বাইবেল কখনোই প্যারাক্লিতসের অনুবাদ করেনি মুনাহেমা নামে। অতীতে এর নজির যেমন নেই, আধুনিককালেও প্যারাক্লিতসের আরবি করা হয়েছে ফারকালিত ইত্যাদি শব্দের সাহায্যে। ১৮২১, ’৩১ ও ’৪৪ খ্রিষ্টাব্দে লন্ডন থেকে প্রকাশিত আরবি বাইবেলে লেখা হয়েছে, ‘বারাক্লিত বা ফারাকলিত। খ্রিষ্টান লেখক ইউসুফ ইলয়াস আলমারুনি তৎপ্রণীত ‘তুহফাতুল জিল ফি তাফসিরিল আনাজল’ গ্রন্থে- যা ১৮৭৭ সালে বৈরুত থেকে প্রকাশিত, বারাক্লিত শব্দই উল্লেখ করেছেন।

১৮৭৬ সালে মোসেল থেকে প্রকাশিত আরবি বাইবেলেও ওই ফারাকলিত শব্দটিই লেখা হয়েছে। সর্বপ্রথম ১৮২৫, ১৮২৬ সালে এবং আরো পরে ১৮৬৫ ও ১৮৯৭ সালে বৈরুত থেকে প্রকাশিত আরবি সংস্করণ ‘ফারাকলিত’-এর পরিবর্তে (আল-মুআযযি) শব্দটি উল্লেখ করা হয়। (দ্র: ইজহারুল হক, চতুর্থ খণ্ড-১১৮৬)

মুসলিম বিশেষজ্ঞদের যারাই এ প্রসঙ্গ বিশ্লেষণ করেছেন, তারা প্যারাক্লিতসকে মুনাহেমা নামে উল্লেøখ করেননি; বরং বলেছেন ফারকালিত। গ্রিক ভাষার মুনহামান্নাকে আরবি মুনাহেমা বানিয়ে ক্যারেন যে উদ্দেশ্যে পৌঁছাতে চান, তা হলো- মুনাহেমা থেকে মুহাম্মদ নামটি অনুপ্রাণিত হয়েছে! কিন্তু এই অনুবাদের যেমন কোনো ভিত্তি নেই, তেমনি নেই এই বিবর্তনের কোনো প্রমাণ! রাসূল সা: তার জীবনের প্রত্যেকটি সময়ে মুহাম্মদ নামেই পরিচিত ছিলেন। মক্কায় যে কাফিররা ছিল তার প্রতিপক্ষ, সাধারণ কথাবার্তায় তারা তাঁকে মুহাম্মদই বলত।

কুরাইশরা যখন শত্রুতার চরমে, তখন ১৪ জন কুরাইশ নেতা বসল কাবা চত্বরে। বলল, লোক পাঠিয়ে মুহাম্মদকে ডাকো। মাগরিবের পরে আল্লাহর রাসূল সা: কাবা চত্বরে এলেন। তারা বলল, ‘হে মুহাম্মদ! তুমি তোমার বাপ-দাদাকে গালি দিয়েছ, তাদের দ্বীনকে দোষারোপ করেছ, উপাস্যদের গালি দিয়েছ, জ্ঞানীদের বোকা ধারণা করেছ এবং আমাদের সমাজকে বিভক্ত করেছ।’ (ইবনে জারির, ইবনে কাছির, তাফসির সূরা বাকারাহ-১০৮, কুরতুবি-৪০৭৯, সনদ জইফ, ইবনে হিশাম : ১/২৯৫-২৯৮)

একদিন রাসূল সা: কাবায় তাওয়াফ করছিলেন। এমতাবস্থায় মক্কার বিশিষ্ট নেতারা রাসূলুল্লাহ সা:-এর কাছে এসে আপস প্রস্তাব দিয়ে বলেন, ‘হে মুহাম্মদ! এসো আমরা ইবাদত করি তুমি যার ইবাদত করো এবং তুমি পূজা করো আমরা যার পূজা করি। আমরা এবং তুমি আমাদের কাজে পরস্পরে শরিক হই।’ (ইবনে হিশাম-১/৩৬২)

এমন নজির বিস্তর। কাফেররা যখন নবীজিকে গালি দিত, তখনো মুহাম্মদ নাম ব্যবহার করত কিংবা বিকৃত করত। তারা রাসূল সা:-এর বিরোধিতায় নাম বিকৃত করত। বলত ‘মুজাম্মাম’ (নিন্দনীয়) যা মুহাম্মদ শব্দকে বিকৃত করে, উল্টো অর্থ হাজির করে। তারা এই নাম বিকৃত করত, কারণ তারা জানত এটিই তাঁর প্রকৃত নাম। হাদিসে রাসূল সা: বলেন, ‘তোমরা কি অবাক হও না যে, আল্লাহ কিভাবে আমার কাছ থেকে কুরাইশের গালি ও অভিশাপকে ফিরিয়ে রেখেছেন? তারা মুজাম্মামকে গালি দেয় ও মুজাম্মামকে অভিশাপ দেয়। অথচ আমি হলাম মুহাম্মদ।’ (বুখারি-৩৫৩৩)

হুদাইবিয়া সন্ধির ঘটনাপ্রবাহের দিকে দৃষ্টি দিন। এ ঘটনা প্রাচ্যবিদদের নাম সম্পর্কিত সব আপত্তির অপনোদন করে। সন্ধির শর্তাবলি স্থির হয়ে যাওয়ার পরে আল্লাহর রাসূল সা: হজরত আলীকে ডাকলেন। বললেন লেখো- ‘এ হচ্ছে সেসব বিষয় যার উপরে আল্লাহর রাসূল মুহাম্মদ সন্ধি করেছেন।’ সোহায়েল বাধা দিলো। বলল, ‘যদি আমরা জানতাম যে, আপনি আল্লাহর রাসূল, তাহলে আমরা আপনাকে আল্লাহর ঘর থেকে বিরত রাখতাম না এবং অবশ্যই আমরা আপনার হাতে বাইয়াত করতাম।’ অতএব লিখুন ‘মুহাম্মাদ বিন আবদুল্লাহ’।

জবাবে রাসূল সা: বললেন, ‘আমি অবশ্যই আবদুল্লাহর পুত্র মুহাম্মদ এবং আমি অবশ্যই আল্লাহর রাসূল।’ (বুখারি-৩১৮৪) তিনি আলীকে বললেন, ‘রাসূলুল্লাহ’ শব্দ মুছে ‘মুহাম্মদ বিন আবদুল্লাহ’ লিখতে। (বায়হাকি-১৩৪১৬, মুসলিম-১৭৮৪, বুখারি-২৭৩১)

সেকালের সব নথি, চিঠিপত্র ও চুক্তির দলিলগুলোতে নবীজির মুহাম্মদ নামই প্রতিষ্ঠিত ছিল। এ ক্ষেত্রে প্রাচীন সিরাত গ্রন্থগুলোতে এমন কোনো দুর্বল বর্ণনাও নেই, যাতে এটি স্পষ্ট যে, মুহাম্মদ নামটি ইহুদি বা খ্রিষ্টান উৎস থেকে নেয়া।

বরং সাহাবায়ে কেরাম স্পষ্টই জানতেন, এই নাম এসেছে মহান আল্লাহর নাম হতে। হজরত হাসসান বিন সাবিত রা:-এর বিশ্ববিখ্যাত কবিতা- কেন মদিনার জীবনে সংঘটিত সব চুক্তি ও চিঠিপত্রে তাঁর নাম মুহাম্মদ? কেন তার সমীপে যারা হাজির হন, তারা তাকে মুহাম্মদ নামেই জানেন? কেন দূর আরব থেকে আগত বেদুইন গোত্র বনু তামিম তাঁর কক্ষের সামনে এসে দুপুর বেলায় বলতে থাকল, ‘হে মুহাম্মদ! হে মুহাম্মদ! বেরিয়ে এসো।’ (জাদুল মাআদ-৩/৪৪৬, সিরাতে ইবনে হিশাম-২/৫৬২, ৫৬৭)

কেন রোমান সম্রাট হিরাক্লিয়াসের প্রতি প্রেরিত পত্রে লেখা হলো- মুহাম্মদের পক্ষ থেকে হিরাক্লিয়াসের প্রতি ... (বুখারি-৭, অহির সূচনা অধ্যায়, অনুচ্ছেদ-৬, মুসলিম-১৭৭৩, মিশকাত-৫৮৬১)

কেন মিসর, পারস্য, ইয়েমেন, বাহরাইনসহ আরব-অনারব রাজদরবারগুলোতে তার নাম উচ্চারিত হচ্ছে মুহাম্মদ নামে? মরুচারী বেদুইন থেকে রোম-পারস্যের স¤্রাট অবধি সবার কাছে তিনি ছিলেন মুহাম্মদ। প্রত্যেক মুসলিমের কাছে তো বটেই। আল্লাহর ভাষায়ও তাই। তাহলে কিভাবে এই নাম নকল সাব্যস্ত হলো?

প্রাচ্যবিদদের কাছে প্রশ্নগুলোর জবাব নেই। তার কাছে দাবি আছে, দলিল নেই। তাহলে দাবিটার ভিত্তি কী? ভিত্তি হলো কল্পনা।

কল্পনা থেকে মানুষ কত কিছু বলে। চাঁদে আছে এক বুড়ি। সে সুতা কাটে। ... এই সব গল্প শিশুদের শোনানো হতো। আর্মস্ট্রংও গল্প হাজির করলেন। গল্পে প্রমাণ লাগে না।

লেখক : কবি, গবেষক

[email protected]