চিকেন নেক : বাংলাদেশের বিপদ কোথায়

চিকেন নেক তাই শুধু ভারতের দুর্বলতা নয়, এটি বাংলাদেশের জন্য একটি নথিভিত্তিক সতর্কসঙ্কেত।

চিকেন নেক বা শিলিগুড়ি করিডোর নিয়ে নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞদের মধ্যে নতুন করে আলোচনা শুরু হয়েছে। ২০-২২ কিলোমিটার চওড়া এই জমি ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলকে মূল ভূখণ্ডের সাথে যুক্ত করেছে। এটি দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে সংবেদনশীল কৌশলগত ঘুঁটিগুলোর একটি। ভৌগোলিক সঙ্কোচন, আশপাশের আন্তর্জাতিক সীমার ঘনত্ব ও লজিস্টিকনির্ভরতা একই সাথে গতানুগতিক ও নতুন সাইবার-ইন্টেলিজেন্স-বহুল হুমকি এটিকে নিত্যনতুন সঙ্কটের কেন্দ্রে পরিণত করছে।

গত কয়েক মাসে ভারতের উত্তর-পূর্ব সীমান্তে নতুন গ্যারিসন স্থাপন, বহু-এজেন্সির একাধিক নিরাপত্তা মহড়া ও স্থানীয় আইনশৃঙ্খলা নীতির রদবদল- যেখানে উত্তরবঙ্গের চোপড়া, কিশানগঞ্জ, ধুবড়ি ইত্যাদি এলাকায় সামরিক উপস্থিতি বাড়ানো হয়েছে। এসব পদক্ষেপ করিডোরে যেকোনো পরিস্থিতিতে তাৎক্ষণিক পদক্ষেপ নেয়ার ক্ষমতা বাড়ায়।

কেবল সৈন্য মোতায়েন নয়, ভারত রাস্তাঘাট, রেল, অগ্রভূমি রানওয়ে, সাইলোডিং ও সূ²-লজিস্টিক নেটওয়ার্কেও বিনিয়োগ বাড়াচ্ছে। নির্ভরযোগ্য সরবরাহ নিশ্চিত করা এবং দ্রুত নির্দিষ্ট সেক্টরে বাহিনী পৌঁছে দেয়া, এই দু’টি কারণে এখানকার অবকাঠামোতে বিনিয়োগ জরুরি বলে উল্লেখ করা হচ্ছে। তবে বিকল্প কানেক্টিভিটিও (বাংলাদেশ ও নেপাল দিয়ে) এখন কূটনৈতিক-অর্থনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে বলে দিল্লির নীতি প্রণেতারা মনে করছেন।

সর্বশেষ খবর অনুসারে, ‘চিকেন নেক’ এলাকায় নিরাপত্তা জোরদার করতে পশ্চিমবঙ্গের শিলিগুড়িতে একটি উচ্চপর্যায়ের আন্তঃবাহিনী বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে। এই বৈঠকটি অনুষ্ঠিত হয় স্টেট সাবসিডিয়ারি মাল্টি এজেন্সি সেন্টারের-(এসএমএসির রাজ্য শাখা) ব্যানারে, যেখানে ভারতের প্রায় সব গুরুত্বপূর্ণ নিরাপত্তা ও গোয়েন্দা সংস্থার শীর্ষ কর্মকর্তারা অংশ নেন।

এটি ঠিক যে, শুধু সীমান্তে টহল নয়, প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলোর অবকাঠামো ও কূটনৈতিক সিদ্ধান্তগুলোও সরাসরি শিলিগুড়ির নিরাপত্তা প্রভাবিত করে। চীন-বাংলাদেশে বিনিয়োগ ও অবকাঠামো পরিকল্পনায় (লালমনিরহাটে বেস থাকা বা বেস পুনরুদ্ধার সংক্রান্ত সংবাদ) ভারত উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। আর কৃতকৌশলগত শক্তিবৃদ্ধির সাথে কয়েকটি বাস্তব বিষয় থেকে যায়। প্রথমত- ভূগোলগতভাবে জনবহুল অঞ্চল ও নাগরিক অবকাঠামোর মধ্যে সামরিক কর্মসূচি চালানোতে আইনগত-মানবিক জটিলতা রয়েছে। দ্বিতীয়ত, একাধিক সীমানা ও ত্রিপক্ষীয় সম্পর্ক বিবেচনায় নিয়ে অপারেশনাল স্বাধীনতা সীমিত রাখার বিষয় রয়েছে এবং তৃতীয়ত- ‘দ্বিপক্ষীয়-তীব্রতা’ বৃদ্ধি করলে সীমান্তে ভুল ক্যালকুলেশন ও সংঘর্ষের সম্ভাবনা বেড়ে যায়। তাই কেবল সেনা মোতায়েনই যথেষ্ট নয়- ইন্টেলিজেন্স, সাইবার-মনিটরিং, স্থানীয় প্রশাসন ও জনসচেতনতার সমন্বয় প্রয়োজন বলেও দিল্লির নীতি প্রণেতারা মনে করছেন।

চিকেন নেক প্রশস্ত করতে ভারত কি সেনা অভিযান চালাবে

চিকেন নেক প্রশস্ত করতে বাংলাদেশে সেনা অভিযান চালাবে ভারত- এমন কোনো নির্ভরযোগ্য তথ্য বা সরকারি নীতিগত প্রত্যক্ষ ইঙ্গিত নেই। তবে প্রশ্নটি ভূরাজনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ। আর এটিও একটি প্রশ্ন যে, বাস্তবে চিকেন নেক প্রশস্ত করার মানে কী? চিকেন নেক ভারতের ভূখণ্ড। এটি প্রশস্ত করতে হলে ভারতের বাংলাদেশ বা নেপালের ভূখণ্ড দখল নয়, বরং বিকল্প লজিস্টিক ও কৌশলগত করিডোরও তৈরি করতে হবে। আর বাংলাদেশে সেনা অভিযান চালিয়ে করিডোর ‘প্রশস্ত’ করা বলতে বোঝায় : বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চল দখল/নিয়ন্ত্রণ করে সামরিক বাফার জোন বানানো- এটা হবে সরাসরি যুদ্ধ ঘোষণা।

ভারত কি ‘বাংলাদেশে সেনা অভিযান’ চালাবে? বাস্তবতা হলো, ভারত খুব সচেতনভাবে এই পথ এড়িয়ে চলেছে। কারণ এতে আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন হবে, জাতিসঙ্ঘের হস্তক্ষেপের সুযোগ তৈরি হবে, চীন সরাসরি এতে জড়াতে পারে, ভারতের ‘আঞ্চলিক নেতৃত্বের’ ভাবমর্যাদা আরো ভেঙে পড়বে। তাই ফুল-স্কেল সামরিক অভিযানের সম্ভাবনা অত্যন্ত ক্ষীণ বলে অনেকে মনে করেন। কিন্তু ‘অন্য ধরনের হস্তক্ষেপ’ কী হতে পারে? এটাই গুরুত্বপূর্ণ।

ভারতের সম্ভাব্য কৌশলগত বিকল্পগুলোর মধ্যে রয়েছে : সীমান্তে সামরিক শক্তিবৃদ্ধি, গোপন গোয়েন্দা অপারেশন, রাজনৈতিক চাপ সৃষ্টি, প্রতিবেশীর অভ্যন্তরীণ অস্থিতিশীলতা উসকে দেয়ার চেষ্টা, মিডিয়া ও সাইবার ক্যাম্পেইন। এসবকে বলা হয় : হাইব্রিড ওয়ারফেয়ার বা গ্রে জোন অপারেশন।

তাত্তি¡কভাবে ভারত কখন এমন ঝুঁকি নিতে পারে? এটি করতে পারে তিনটি বড় পরিস্থিতিতে। চীন যদি বাংলাদেশে সরাসরি সামরিক উপস্থিতি পায়- যেমন চীনা বিমানঘাঁটি, চীনা নৌঘাঁটি, চীনা সেনা মোতায়েন ইত্যাদি। আর উত্তর-পূর্ব ভারত বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ার পর্যায়ে গেলে এবং যদি করিডোরে বড় ধরনের স্থায়ী হুমকি তৈরি হয়। সেই সাথে বাংলাদেশ রাষ্টীয়ভাবে ব্যর্থ হলে অর্থাৎ : গৃহযুদ্ধ, সম্পূর্ণ বিশৃঙ্খলা, কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ ভেঙে পড়া ইত্যাদি পরিস্থিতির ক্ষেত্রে।

বর্তমানে তেমন কোনো পরিস্থিতি বাংলাদেশে নেই। প্রশ্ন হলো, ভারত তাহলে কী করছে? ভারত এখন সম্ভবত যুদ্ধ নয়, বিকল্প পথ নিচ্ছে। শিলিগুড়ি অঞ্চলে সেনাঘাঁটি শক্তিশালী করছে, সীমান্তে নজরদারি প্রযুক্তি জোরদার করছে, বাংলাদেশে ‘বন্ধুত্বপূর্ণ’ সরকার প্রতিষ্ঠার কৌশল ও রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক চাপের পদ্ধতি গ্রহণ করছে।

অদৃশ্য বা গোপন প্রস্তুতি

ভারতের মানচিত্রে ২০-২২ কিলোমিটার চওড়া এই সরু গলিটি শুধু যোগাযোগ পথ নয়, এটি হয়ে উঠেছে অস্তিত্বগত দুশ্চিন্তার প্রতীক। ফলে প্রশ্ন উঠতেই পারে, এই করিডোরকে ‘নিরাপদ’ বা ‘প্রশস্ত’ করতে একদিন ভারত বাংলাদেশের দিকে সামরিক আগ্রাসনের পথ বেছে নেবে কি না? সাধারণ দৃষ্টিতে বিষয়টি ষড়যন্ত্রতত্তে¡র মতো শোনালেও, ভূরাজনীতির বাস্তবতায় অমূলক নয়। তবে উত্তরটি ‘হ্যাঁ’ বা ‘না’ এর চেয়ে অনেক বেশি জটিল।

‘করিডোর সুরক্ষা’ আর বাংলাদেশের ভেতরে সৈন্য পাঠানো এক নয়, বরং তা হবে সরাসরি আঞ্চলিক যুদ্ধের সূচনা। চীনের কূটনৈতিক ও সম্ভবত সামরিক প্রতিক্রিয়ার দরজা খুলে দেয়া। দক্ষিণ এশিয়ায় নিজেদের ‘স্থিতিশীল শক্তি’ হিসেবে যে ভাবমর্যাদা ভারত বহু দশক ধরে নির্মাণ করেছে, তা এক মুহূর্তে ভেঙে পড়তে পারে।

তবে এখানেই বিষয়টির মূল জটিলতা। ভারত যুদ্ধ না করলেও, তার প্রস্তুতি ও পরিকল্পনা থেমে নেই। তারা বেছে নিয়েছে সরাসরি আগ্রাসনের বদলে ‘ছায়াযুদ্ধ’ বা হাইব্রিড কৌশল। অর্থাৎ ভারত তার নিরাপত্তা বলয় ধীরে ধীরে বাংলাদেশের দিকেও ‘লম্বা’ করতে চায়।

বাংলাদেশ কেবল ভারতের ভৌগোলিক প্রতিবেশী নয়; এটি হয়ে উঠেছে বৃহত্তর ভারত-চীন প্রতিযোগিতার নীরব ক্ষেত্র। ঢাকা যতটা বেইজিংয়ের অর্থনৈতিক বিনিয়োগ গ্রহণ করছে, ততটাই দিল্লি অস্বস্তিতে পড়ছে। অবকাঠামো প্রকল্প, বন্দর উন্নয়ন, এমনকি যোগাযোগ খাতে চীনা উপস্থিতি- সবকিছু দিল্লির দৃষ্টিতে চিকেন নেকের নিরাপত্তার সাথে পরোক্ষভাবে জড়িত।

তবে এটাও সত্য, ভারত এখনো বাংলাদেশের ওপর সরাসরি সেনা অভিযান চালানোর মানসিক পর্যায়ে পৌঁছায়নি। কারণ এর মূল্য অত্যধিক। এই মূল্য শুধু অর্থনৈতিক বা রাজনৈতিক নয়। আঞ্চলিক অস্থিতিশীলতা ও বৈশ্বিক শক্তির হস্তক্ষেপের সম্ভাবনা বহন করে।

অন্য দিকে বাংলাদেশের জন্য এই বাস্তবতা একটি নীরব সতর্কবার্তা। দেশের পররাষ্ট্রনীতি, নিরাপত্তা কৌশল ও আন্তর্জাতিক অংশীদারত্ব আর নিছক ‘উন্নয়ন কূটনীতি’র বিষয় নেই; তা সরাসরি জাতীয় ভারসাম্যের প্রশ্নে এসে দাঁড়িয়েছে। এক দিকে ভারত, অন্য দিকে চীন- এই দ্ব›েদ্বর ভেতর দিয়ে হাঁটতে গিয়ে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো নিজের সিদ্ধান্ত নিজেই নেয়ার সক্ষমতা ধরে রাখা।

দিল্লির চোখে বাংলাদেশ কোনো স্বাধীন ভূরাজনৈতিক সত্তা নয়; অধিকাংশ সময়ে তার দৃষ্টিভঙ্গিতে মনে হয় এটি একটি ‘বাফার জোন’- ভারত ও চীনের মাঝখানে একটি নিয়ন্ত্রিত অঞ্চল। কিন্তু গত এক দশকে বাংলাদেশ যেভাবে চীনা অর্থায়নে অবকাঠামো গড়েছে, বন্দর উন্নয়ন করেছে, সামরিক প্রযুক্তিতে বৈচিত্র্য এনেছে- তাতে দিল্লির নিরাপত্তা চক্রে একটি নতুন শব্দ ঢুকেছে : কৌশলগত প্রবাহ- যাতে বাংলাদেশ ভারতের বলয় থেকে সরে যাচ্ছে। এটাই দিল্লির আসল আতঙ্ক।

এই আতঙ্ক থেকে তাহলে কি ‘অভিযান’ ঘটবে? খোলাখুলি আক্রমণের সম্ভাবনা : খুব কম। ভারত হয়তো বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ‘ট্যাংক পাঠাতে’ চায় না। সে চায় ঢাকার সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষমতা সীমিত করতে। সে চায় কৌশলগতভাবে বাংলাদেশকে এমন জায়গায় রাখতে, যেখানে স্বাধীন সিদ্ধান্ত নেয়া ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে ওঠে। এটাই নীরব অপারেশনের আসল লক্ষ্য।

ভারত হয়তো ট্যাংক নিয়ে বাংলাদেশের দিকে এগোবে না। কিন্তু সে ইতোমধ্যে নীরবে, অদৃশ্যভাবে মাঠ প্রস্তুত করছে। চিকেন নেকের যুদ্ধ যদি কখনো শুরু হয়, সেটা কিন্তু প্রথম গোলাগুলির দিন থেকে শুরু হবে না, তা শুরু হয়ে গেছে অনেক আগেই- শুধু শব্দ ছাড়া।

বাংলাদেশ প্রসঙ্গে নীরব সতর্কতা

চিকেন নেকসংক্রান্ত নথির ভাষায় ভারতের ভয় স্পষ্ট, যা বাংলাদেশের জন্য ভবিষ্যৎ ঝুঁকি। ভারত কখনো প্রকাশ্যে বলবে না, সে বাংলাদেশের দিকে সামরিক নজর বাড়াচ্ছে। কিন্তু সরকারি নীতি-নথি, প্রতিরক্ষা হোয়াইট পেপার, সংসদীয় কমিটির প্রতিবেদন এবং সামরিক গবেষণা প্রতিষ্ঠানের প্রকাশনায় একটি বিষয় নিয়মিতভাবে উঠে আসে, শিলিগুড়ি করিডোর ভারতের ‘সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ কৌশলগত শিরা’।

২০১৭-২০২৩ সময়কালে ভারতের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীন বিভিন্ন থিংকট্যাংকের নথিতে পরিষ্কারভাবে উল্লেখ আছে : ‘উত্তর-পূর্ব কানেক্টিভিটি অবশ্যই সব ধরনের আকস্মিক পরিস্থিতির অধীনে সুরক্ষিত রাখতে হবে।’ এই ‘সব ধরনের আকস্মিক ঘটনার’ মানে কী- সেটা সরকারিভাবে কখনো ব্যাখ্যা করা হয়নি।

ভারতের ন্যাশনাল সিকিউরিটি স্ট্র্যাটেজিতে ‘কনটিনজেন্সি বা আকস্মিক পরিকল্পনা’ শব্দটি সাধারণত তিন ধরনের পরিস্থিতির জন্য ব্যবহৃত হয় : অভ্যন্তরীণ বিচ্ছিন্নতাবাদ, বহিরাগত সামরিক হুমকি ও প্রতিবেশী দেশে ‘অস্থিতিশীলতা’। এই তৃতীয় শব্দটিই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। সরকারি নথিতে বাংলাদেশকে কখনো সরাসরি ‘হুমকি’ বলা হয়নি। কিন্তু উত্তর-পূর্ব ভারতের নিরাপত্তাসংক্রান্ত নথিতে বারবার একটি অস্পষ্ট ফর্মুলেশন আছে যে : ‘শিলিগুড়ি করিডোরের পশ্চিম সীমানা থেকে সম্ভাব্য প্রবাহের ঝুঁকি।’ এই ‘পশ্চিম সীমানা’ মানেই বাংলাদেশ সীমান্ত।

ভারতের সংসদীয় প্রতিরক্ষা কমিটির রিপোর্টে দেখা যায়, শিলিগুড়ি অঞ্চলে অতিরিক্ত মাউন্টেন স্ট্রাইক ইউনিট, ফরোয়ার্ড লজিস্টিক বেস, সীমান্তঘেঁষা বিমানঘাঁটির সম্প্রসারণ ও দ্রুত মোতায়েনযোগ্য সেনা অবকাঠামো- এসবকে কাগজে বলা হয়েছে ‘প্রতিরক্ষামূলক ভঙ্গির আপগ্রেড’। কিন্তু প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকদের মতে, এ ধরনের প্রস্তুতি সাধারণত শুধু প্রতিরক্ষামূলক উদ্দেশ্যে হয় না। এগুলো এমন কাঠামো যা দুই ঘণ্টার মধ্যে আক্রমণাত্মক মোডে রূপান্তর করা যায়।

ভারতীয় নীতি-নথিতে বাংলাদেশ নিয়ে একটি শব্দ নিয়মিত ব্যবহৃত হচ্ছে : ‘কৌশলগত সংবেদনশীলতা’। এটি কোনো কূটনৈতিক স্বীকৃতি নয়। এটি একটি সতর্কসঙ্কেত। কারণ একই নথিতে আরো লেখা আছে : ‘শিলিগুড়ি করিডোরের কাছে যেকোনো বাহ্যিক কৌশলগত উপস্থিতি সক্রিয় নিরাপত্তা প্রতিক্রিয়া ট্রিগার করতে পারে।’

‘বহিরাগত কৌশলগত উপস্থিতি’ বলতে কী বোঝানো হচ্ছে- তা নথিতে নেই। কিন্তু বাস্তবে এটি মূলত চীনের উপস্থিতিকেই ইঙ্গিত করে। এখানেই বাংলাদেশ এক বিপজ্জনক সমীকরণের মাঝে দাঁড়িয়ে। তাহলে কি নথিতে ‘বাংলাদেশে অভিযান’ লেখা আছে? খোলাখুলিভাবে না। কিন্তু ভারত কোনো আগ্রাসন পরিকল্পনা খোলাখুলিভাবে লিখে রাখে না। আধুনিক সামরিক পরিকল্পনা থাকে- কোডেড ভাষায়- বিকল্প পরিস্থিতির ছক হিসেবে। ‘আকস্মিক অপারেশন’ নামে এই ক্যাটাগরির নথিগুলো জনসমক্ষে আসে না। কিন্তু যেটুকু উন্মুক্ত নথিতে আছে, তা থেকে স্পষ্ট : ভারত শুধু ‘রক্ষা’ নয়, আগাম নিয়ন্ত্রণযোগ্য সক্ষমতা তৈরি করছে।

বাংলাদেশের জন্য আসল বিপদ কোথায়

বাংলাদেশের জন্য আসল বিপদ হঠাৎ ট্যাংক ঢুকে পড়া নয়। বরং বিপদটি তিন স্তরে- প্রথমত- ধীরে ধীরে সামরিক চাপের বলয় তৈরি হওয়া; দ্বিতীয়ত- নিরাপত্তা ইস্যুকে অজুহাত বানিয়ে প্রভাব বিস্তার আর তৃতীয়ত- প্রয়োজনে সীমিত, অঘোষিত ‘স্পেশাল অপারেশন’।

চিকেন নেক মানচিত্রে যতটা সরু, নথির ভাষায় ততটাই বিস্তৃত। ভারতের সরকারি নথিপত্রে একটি স্পষ্ট বার্তা লেখা থাকে : এই করিডোরের নিরাপত্তা এমন বিষয়, যার জন্য ‘ব্যতিক্রমী’ পদক্ষেপও বৈধ। বাংলাদেশের জন্য সতর্কতা এখানেই- যে অঞ্চলে ‘ব্যতিক্রমী পদক্ষেপ’ বৈধ হয়ে যায়, সেখানে ছোট দেশের সার্বভৌমত্ব সবসময় পরীক্ষার মুখে পড়ে। চিকেন নেক তাই শুধু ভারতের দুর্বলতা নয়, এটি বাংলাদেশের জন্য একটি নথিভিত্তিক সতর্কসঙ্কেত।

লেখক : নির্বাহী সম্পাদক, দৈনিক নয়া দিগন্ত