বাংলাদেশের এসসিও সদস্যপদ

বাংলাদেশের জন্য এসসিও সদস্যপদ একটি আকর্ষণীয় প্যাকেজ। নতুন বাজার, নিরাপত্তা সহযোগিতা, জ্বালানি অংশীদারত্ব ও কূটনৈতিক উন্নতি। তবে, ভারতকে বিচ্ছিন্ন করা বা জোটনিরপেক্ষ অবস্থানের সাথে আপস করা এড়াতে এর সাধনা অবশ্যই সতর্ক এবং সুপরিকল্পিত হতে হবে।

এসসিও একটি ইউরেশীয় সংস্থা। যদিও এর সদস্যপদ ভারত ও পাকিস্তানের মতো দক্ষিণ এশিয়ার দেশকে অন্তর্ভুক্ত করতে প্রাথমিক মধ্য এশিয়ার ফোকাস ছাড়িয়ে প্রসারিত হয়েছে, বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থান সংস্থাটির নাগালে একটি নতুন সম্প্রসারণ হবে। এসসিওর প্রাথমিক ফোকাস নিরাপত্তার দিকে, বিশেষ করে সন্ত্রাসবাদ, বিচ্ছিন্নতাবাদ এবং চরমপন্থার ‘তিনটি অশুভ’-এর বিরুদ্ধে লড়াই করা। যেকোনো নতুন সদস্যকে এ অ্যাজেন্ডার সাথে সামঞ্জস্য রাখতে হয়। পর্যবেক্ষক মর্যাদার জন্য বাংলাদেশের আবেদন এসসিওর অংশ হওয়ার সুস্পষ্ট আগ্রহের ইঙ্গিত দেয়। এটি পূর্ণ সদস্যপদ অর্জন করবে কি না তা সংগঠনের লক্ষ্যগুলোর সাথে এর কৌশলগত প্রান্তিকীকরণ এবং সব এসসিও সদস্য রাষ্ট্রের ঐকমত্যসহ কয়েকটি কারণের উপর নির্ভরশীল।

বাংলাদেশ এখনো সাংহাই কো-অপারেশন অর্গানাইজেশনের (এসসিও) পূর্ণ সদস্য নয়, জুলাই ২০২৪ সালে সংলাপ অংশীদারের মর্যাদা পেয়েছে। পূর্ণ সদস্যপদে উন্নীত হলে বাংলাদেশ উল্লেখযোগ্য অর্থনৈতিক, নিরাপত্তা ও কূটনৈতিক সুবিধা পাবে। তবে এ সুবিধাগুলো ভূ-রাজনৈতিক ঝুঁকির বিরুদ্ধে ওজন করতে হবে, বিশেষত ভারতের সাথে তার সম্পর্ক। আরো যেসব সম্ভাব্য সুবিধা বাংলাদেশ পাবে তার মধ্যে রয়েছে :

১. বর্ধিত আঞ্চলিক সংযোগ এবং বাণিজ্য সম্প্রসারণে এসসিওর পূর্ণ সদস্যপদ বাংলাদেশকে চীন, রাশিয়া, মধ্য এশিয়া, পাকিস্তান ও ইরানের একটি ট্রান্স-ইউরেশিয়ান অর্থনৈতিক নেটওয়ার্কে একীভূত করবে। বাংলাদেশ ঐতিহ্যবাহী সমুদ্রপথ বাইপাস করে মধ্যএশিয়া এবং এর বাইরেও পোশাক ও ওষুধ রফতানির জন্য এসসিও সমর্থিত পরিবহন করিডোর-যেমন সিপিইসি, চীন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডোর বা ট্রান্স-কাস্পিয়ান রুট ব্যবহার করতে পারবে। ইউরেশিয়ান ইকোনমিক ইউনিয়নকে বিআরআই ও এসসিও সদস্য দেশগুলোর সাথে যুক্ত করার রাশিয়ার দৃষ্টিভঙ্গি রাশিয়া ও কাজাখস্তানে বাংলাদেশী পণ্যের নতুন রফতানির সুযোগ উন্মোচন করতে পারে। পূর্ণ সদস্য হিসেবে বাংলাদেশ এসসিও-সমর্থিত প্রকল্পগুলোর আওতায় জ্বালানি, বন্দর ও ডিজিটাল অবকাঠামোর জন্য চীন এবং রাশিয়ার অর্থায়ন আকৃষ্ট করার সুযোগ বাড়াবে।

২. সন্ত্রাস দমন এবং সীমান্ত নিরাপত্তা সহযোগিতা জোরদার করতে সহায়তা করবে। বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ উগ্রবাদী গোষ্ঠী এবং আন্তঃসীমান্ত উগ্রবাদের চলমান চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি। এসসিওর আঞ্চলিক সন্ত্রাসবিরোধী কাঠামোতে (আরএটিএস) গোয়েন্দা তথ্য বিনিময়, যৌথ মহড়া এবং সক্ষমতা বাড়ানোর কর্মসূচি আছে। এসসিও কর্মসূচির মাধ্যমে বাংলাদেশের র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন ও সীমান্তরক্ষী বাহিনী আরো প্রশিক্ষণের সুযোগ পাবে। গোয়েন্দা তথ্য প্রবেশাধিকারে আইএসআইএস বা আঞ্চলিক সহযোগী গোষ্ঠীগুলোর উপর রিয়েল-টাইম হুমকি মোকাবেলা সহজতর করবে। দক্ষিণ এশিয়ায় চরমপন্থী নেটওয়ার্ক পর্যবেক্ষণে চীন ও পাকিস্তানের সাথে সমন্বয় বাড়ানো যাবে। এটি বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা জোরদার করতে পারে। আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার প্রতি তার প্রতিশ্রুতি দেখাতে পারে।

৩. বাংলাদেশ দীর্ঘস্থায়ী জ্বালানি ঘাটতিতে ভুগছে। সেই সাথে আমদানি করা এলএনজির উপর ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল। এসসিও সদস্যপদ এ খাতে অনেক সুবিধা নিয়ে আসবে। দীর্ঘমেয়াদি শক্তি নিরাপত্তার মধ্যে রয়েছে মধ্যএশীয় গ্যাস যেমন- তুর্কমেনিস্তান, কাজাখস্তান বা রাশিয়ার। এদের সাথে চুক্তি অনেক সহজ হবে, এসসিও এনার্জি ক্লাবগুলোতে অংশগ্রহণ করতে পারবে, তাতে জ্বালানির বহুমুখীকরণের সুযোগ পাবে। নবায়নযোগ্য ও পারমাণবিক শক্তিতে প্রযুক্তি হস্তান্তর সোজা হবে, যেমন- রাশিয়ার রোসাটম থেকে; যা ইতোমধ্যে রূপপুরে বাংলাদেশের প্রথম পারমাণবিক কেন্দ্র নির্মাণ করছে।

৪. সদস্যপদ বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক প্রোফাইলকে উন্নত করবে। এ ছাড়া একটি প্ল্যাটফর্ম দেবে, সমানভিত্তিতে বৃহৎ শক্তি চীন, রাশিয়া, ভারত ও পাকিস্তানের সাথে সরাসরি সম্পৃক্ত হবে। প্রথাগত অংশীদারদের ভারত, জাপান, যুক্তরাষ্ট্র, ইইউর বাইরে বৈদেশিক নীতিতে বৈচিত্র্য আসবে। একটি বহুমেরু বিশ্বে কৌশলগত স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠা সহজ হবে। দর কষাকষির ক্ষমতা অর্জনের সময় ‘সবার সাথে বন্ধুত্ব’ মতবাদকে শক্তিশালী করবে।

৫. বাংলাদেশী প্রতিষ্ঠানগুলো এসসিও বিজনেস কাউন্সিলে যোগ দিতে পারবে। মধ্যএশিয়ার বাণিজ্যমেলায় অংশ নেয়া সহজ হবে। রুশ ও চীনা সংস্থাগুলোর সাথে ফার্মাসিউটিক্যালস, টেক্সটাইল ও আইটি ক্ষেত্রে যৌথ উদ্যোগের সুযোগ দ্বারপ্রান্তে হাজির হবে। এসসিও উদ্ভাবন তহবিল বা ডিজিটাল অবকাঠামো প্রকল্পে প্রবেশাধিকার পাবে, যেমন- ফাইভ-জি, ই-গভর্নেন্স। বিশেষ করে, কর্ণফুলী টানেল বা সোনাদিয়া বন্দরের মতো বিআরআই-সম্পর্কিত প্রকল্পগুলোর জন্য চীন এসসিও সদস্যকে বিশেষ অগ্রাধিকার দিতে পারে।

৬. এসসিওর সদস্য হলে আফগানিস্তান নিয়ে বাংলাদেশ মানবিক ও পুনর্গঠন সংলাপে অবদান রাখতে পারে। এসসিও চ্যানেলের মাধ্যমে অন্তর্ভুক্তিমূলক শাসন ও নারী অধিকারের পক্ষে কথা বলা সহজ হবে। দক্ষিণ এশিয়ায় চরমপন্থার বিস্তার রোধে আঞ্চলিক কুশীলবদের সাথে সমন্বয় করা কঠিন হবে না। নিকটবর্তী মেয়াদে পূর্ণ সদস্যপদ কঠিন, কেননা ভারতের সম্ভাব্য বিরোধিতা, বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের ওপর টানাপড়েন, ইউক্রেন ও জিনজিয়াং সম্পর্কে এসসিওর পশ্চিমাবিরোধী বাগাড়ম্বর বা অবস্থানের সাথে একতাবদ্ধ হওয়ার জন্য চাপ। এসব কারণে বাংলাদেশ আনুষ্ঠানিক জোট ছাড়া এসসিও ফোরামে সম্পৃক্ত হওয়ার মাধ্যমে ডায়ালগ পার্টনার স্ট্যাটাসের মাধ্যমে সর্বাধিক সুবিধা অর্জন অব্যাহত রাখতে পারে। কয়েকটি রাজনৈতিক, কৌশলগত ও প্রাতিষ্ঠানিক বাধার কারণে এখন পর্যন্ত বাংলাদেশ পূর্ণ সদস্যপদে উন্নীত হতে বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছে। এসসিওর অভ্যন্তরীণ গতিশীলতা, ভূ-রাজনৈতিক সংবেদনশীলতা ও বাংলাদেশের নিজস্ব পররাষ্ট্রনীতির সীমাবদ্ধতা থেকে এসব বিষয় উদ্ভূত হয়েছে :

ক. ভূ-রাজনৈতিক বিরোধিতা সবচেয়ে বড় বাধা হচ্ছে বাংলাদেশের পূর্ণ সদস্যপদ নিয়ে ভারতের সম্ভাব্য বিরোধিতা- অন্তত অদূর ভবিষ্যতে। নয়াদিল্লি এসসিওর যেকোনো সম্প্রসারণের বিষয়ে অত্যন্ত সংবেদনশীল যা দক্ষিণ এশিয়ায় চীনের প্রভাব জোরদার করতে পারে। ভারত ইতোমধ্যে পাকিস্তান (২০১৭) এবং ইরানের (২০২৩) অন্তর্ভুক্তিকে বেইজিং ও তেহরানের দিকে ঝুঁকানো হিসেবে দেখছে। বাংলাদেশকে যুক্ত করা তাই নয়াদিল্লি সহজভাবে নাও নিতে পারে। এসসিওর সদস্যপদের জন্য সর্বসম্মতি প্রয়োজন, তাই ভারত বাংলাদেশসহ যেকোনো নতুন সদস্যপদে ভেটো দিতে পারে। ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় তার অবস্থান ইতোমধ্যে ব্যক্ত করেছে, ‘আমরা আঞ্চলিক সহযোগিতাকে সমর্থন করি, তবে কৌশলগত ভারসাম্যহীনতার মূল্যে নয়।’

খ. এসসিওর বিবর্তিত সদস্যপদ মানদণ্ড যদিও এসসিও সম্প্রসারিত হয়েছে, তবু এটি ইউরেশিয়ার যোগাযোগ এবং নিরাপত্তা প্রান্তিকীকরণকে অগ্রাধিকার দেয়। বাংলাদেশ ভৌগোলিকভাবে দক্ষিণ এশিয়ার এসসিও সদস্যদের কাছাকাছি থাকলেও মধ্যএশিয়ার সাথে সংযুক্ত নয় এবং মূল ‘তিনটি অশুভ’ সন্ত্রাসবাদ, বিচ্ছিন্নতাবাদ, চরমপন্থার সাথে সরাসরি সম্পৃক্ততার অভাব রয়েছে যা এসসিওকে মূলত মোকাবেলায় ডিজাইন করা হয়েছিল। সংস্থাটি আঞ্চলিক নিরাপত্তা কাঠামো যেমন- আফগানিস্তানের সাথে সীমান্ত নিয়ন্ত্রণ বা ট্রান্স-ইউরেশীয় সংযোগে অবদান রাখতে শুরু হয়েছিল। এখানে বাংলাদেশের ভূমিকা সীমিত। ইরান বা বেলারুশের বিপরীতে বাংলাদেশ ভারত ও চীনের বাইরে বিদ্যমান এসসিও সদস্যদের সাথে সীমান্ত ভাগ করে নেয় না বিধায় কৌশলগত উপযোগিতা নেই।

গ. বেইজিংয়ের গণনা করা সতর্কতা যদিও চীন বাংলাদেশের উন্নয়নকে জোরালোভাবে সমর্থন করে। একই সাথে এটিকে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিআরআই অংশীদার হিসেবে দেখে, বেইজিং আপাতত ঢাকাকে সংলাপের অংশীদার হিসেবে রাখতে পছন্দ করতে পারে : ভারতকে অযথা উসকানি দেয়া এড়িয়ে চলার নীতি নিতে পারে। চীন-ভারত প্রতিদ্ব›িদ্বতায় বাংলাদেশের নিরপেক্ষতা বজায় রাখা, সংলাপ অংশীদার স্ট্যাটাসকে লিভারেজ টুল হিসেবে ব্যবহার করা- বেল্ট অ্যান্ড রোড বা ইউএন ভোটিংয়ের মতো ইস্যুতে প্রান্তিকীকরণের বিনিময়ে গভীর সংহতকরণ সরবরাহ করা। পূর্ণ সদস্যপদ বাংলাদেশকে স্পর্শকাতর ইস্যুতে (যেমন- জিনজিয়াং, তাইওয়ান বা রাশিয়ার ইউক্রেন অবস্থান) পক্ষ নিতে বাধ্য করতে পারে, যা ঢাকা ও বেইজিং উভয়ই এড়াতে চাইতে পারে।

ঘ. বাংলাদেশ ‘সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারো সঙ্গে শত্রুতা নয়’ এ পররাষ্ট্রনীতি অনুসরণ করে ভারত, চীন ও পশ্চিমাদের সাথে সম্পর্কের ভারসাম্য বজায় রাখতে চায়। সম্পূর্ণ এসসিও সদস্যপদ হলে চীন ও রাশিয়ার দিকে ঝুঁকে পড়া বলে মনে করা হয়। বাংলাদেশকে এসসিওর এমন অবস্থানকে সমর্থন করতে হবে, যা তার জোটনিরপেক্ষ ঐতিহ্যের সাথে সাংঘর্ষিক। সুতরাং, ঢাকা পূর্ণ সদস্যপদের রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতির চেয়ে সংলাপ অংশীদার মর্যাদার নমনীয়তাকে প্রাধান্য দিতে পারে।

ঙ. প্রাতিষ্ঠানিক এবং পদ্ধতিগত বাধা এসসিও সম্প্রসারণ প্রক্রিয়াকে ব্যাহত করে। নতুন সদস্যদের অবশ্যই একটি বহু বছরের পর্যালোচনা করতে হয়, এসসিওর আইনি ও নিরাপত্তা কাঠামোর সাথে সামঞ্জস্য রাখাও গুরুত্বপূর্ণ। বিদ্যমান সদস্যদের অবশ্যই অন্তর্ভুক্তির কৌশলগত মূল্যের বিষয়ে একমত হতে হবে। এসসিও সবেমাত্র ইরান (২০২৩) এবং বেলারুশকে (২০২৪) সংহত করার সাথে সাথে এটি বিদ্যমান সদস্যদের একীভূত করতে আরো সম্প্রসারণ করা থেকে বিরত রাখতে পারে- যা বাংলাদেশের পথকে বিলম্বিত করতে পারে। যদিও বাংলাদেশ এসসিও সম্পৃক্ততায় মৌলিক মানদণ্ড পূরণ করে- ভৌগোলিক নৈকট্য, সন্ত্রাসবিরোধী উদ্বেগ ও অর্থনৈতিক স্বার্থ, এটি মহাশক্তির রাজনীতিতে শিকড়যুক্ত কাঠামোগত বাধার মুখোমুখি। ভারতের সম্ভাব্য ভেটো, চীনের কৌশলগত সতর্কতা এবং বাংলাদেশের নিজস্ব ভারসাম্য আইনের কারণে স্বল্পমেয়াদে পূর্ণ সদস্যপদ অসম্ভব হয়ে পড়েছে।

এসসিও বিষয়ে ভারতের অবস্থান বাংলাদেশের পূর্ণ সদস্যপদের সম্ভাবনাকে প্রভাবিত করবে। ভেটো ক্ষমতাসহ এসসিওর প্রতিষ্ঠাতা সদস্য হিসেবে- যেহেতু সব সিদ্ধান্তের জন্য সর্বসম্মত ঐকমত্যের প্রয়োজন, ভারত কার্যকরভাবে বাংলাদেশসহ যেকোনো নতুন যোগদানকে বাধা দিতে পারে :

১. ভারত এসসিওকে চীনকেন্দ্রিক লেন্স দিয়ে দেখে, যদিও ভারত ২০১৭ সালে চীন এবং রাশিয়ার সাথে সরাসরি জড়িত হতে ও আফগানিস্তান এবং সন্ত্রাসবাদ সম্পর্কে আঞ্চলিক আলোচনাকে প্রভাবিত করতে এসসিওতে যোগ দিয়েছিল। নয়াদিল্লি এসসিওকে চীন-রাশিয়া অক্ষের ক্রমবর্ধমান আধিপত্য হিসেবে দেখে; যা পশ্চিমাবিরোধী আখ্যানকে উৎসাহ দেয়। সেই সাথে কর্তৃত্ববাদী শাসনকে বৈধতা দেয়। এসসিও ব্যানারে দক্ষিণ এশিয়ায় চীনের কৌশলগত পদচিহ্নকে আরো গভীর করে তোলে এমন পদক্ষেপের বিরোধিতা করে আসছে ভারত ধারাবাহিকভাবে। চীনের সাথে বিআরআই-সংযুক্ত অবকাঠামোগত সম্পর্ক গভীর করার একটি দেশ বাংলাদেশকে যুক্ত করা ভারতের নিকটতম প্রতিবেশী দেশগুলোতে চীনের প্রভাব প্রসারিত হিসেবে বিবেচিত হবে, ভারত এটিকে স্ট্রিং অব পার্ল ঘেরাও কৌশল বলে অভিহিত করেছে।

২. বাংলাদেশের সাথে দুই হাজার ২০০ কিলোমিটার স্থল সীমান্ত থাকায় ভারতের ‘প্রতিবেশী প্রথম’ নীতির কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে ঢাকা। যদিও দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক সাধারণত শক্তিশালী বাণিজ্য, যোগাযোগ এবং নিরাপত্তা কভার করে। চীনা নেতৃত্বাধীন একটি জোটে ঢাকা চলে যেতে পারে এমন যেকোনো লক্ষণের বিষয়ে ভারত অত্যন্ত সংবেদনশীল। যদি বাংলাদেশ জোর দেয়, তার এসসিও সম্পৃক্ততা সম্পূর্ণরূপে অর্থনৈতিক, তবে রাশিয়া-চীন নেতৃত্বাধীন ফোরামে ঢাকা ও বেইজিংয়ের মধ্যে আনুষ্ঠানিক-প্রাতিষ্ঠানিক জোট মেনে নিতে ভারত লড়াই করতে পারে।

৩. ভারত প্রকাশ্যে বাংলাদেশের এসসিও আকাক্সক্ষার বিরোধিতা করেনি, তিয়ানজিয়ানে এসসিও শীর্ষ সম্মেলন চলাকালীন, ভারতীয় কর্মকর্তারা যেকোনো সম্প্রসারণের আগে ‘প্রতিবেশীদের সাথে পরামর্শের’ উপর জোর দিয়েছে। ভারত ধীরে ধীরে, মেধাভিত্তিক সম্প্রসারণ সমর্থন করে- এমন একটি অবস্থান যা বর্তমান সদস্যদের, ভারত ও পাকিস্তানের বাইরে দক্ষিণ এশিয়ার সম্প্রসারণকে কার্যকরভাবে ধীর করে দেয়। নয়াদিল্লি বাংলাদেশকে এসসিওর পরিবর্তে সার্ক ও বিমসটেকের দিকে মনোনিবেশ করতে উৎসাহিত করেছে, যেখানে ভারতের প্রভাব বেশি। যেহেতু বাংলাদেশ সীমান্ত ব্যবস্থাপনা, পানি বণ্টন ও প্রতিরক্ষা সম্পর্কসহ ভারতের সাথে তার কৌশলগত অংশীদারত্বকে মূল্য দেয়। যদি এটি নয়াদিল্লির সদিচ্ছার উপর করে; তবে এসসিওর সদস্যপদের জন্য চাপ দেয়ার সম্ভাবনা কম। ভারতের অবস্থান দ্বাররক্ষী এবং ব্রেক- উভয় হিসেবে কাজ করে, এটি নিশ্চিত করে বাংলাদেশের এসসিও যাত্রা পরামর্শমূলক থাকবে- পরিপূর্ণ নয়।

বিদ্যমান এসসিও সদস্য দেশগুলোর সাথে বিশেষ করে চীন, রাশিয়া, পাকিস্তান এবং কিছুটা হলেও ইরানের সাথে বাংলাদেশের সম্পর্ক এর সদস্যপদ লাভে দ্বৈত ভূমিকা পালন করেছে : তারা মূল শক্তিগুলোর কাছ থেকে শক্তিশালী সমর্থন দেয়, তবে ভূ-রাজনৈতিক জটিলতাও তীব্র করে, বিশেষ করে ভারতের সাথে। যদিও এ সম্পর্কগুলো বাংলাদেশকে ডায়ালগ পার্টনার স্ট্যাটাস ২০২৪ সালে অর্জন করতে সহায়তা করেছে, তবে এসসিওর ঐকমত্যভিত্তিক নিয়ম এবং আঞ্চলিক সংবেদনশীলতায় তারা এখনো পূর্ণ সদস্যপদের একটি সুস্পষ্ট পথে চলতে পারেনি।

চীন : এসসিও সংহতিতে বাংলাদেশের সবচেয়ে শক্তিশালী সমর্থক চীন। বাংলাদেশ চীনের বিআরআই, বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের একটি মূল অংশীদার, কর্ণফুলী টানেল, সোনাদিয়া গভীর সমুদ্রবন্দর এবং পদ্মাসেতু রেল লিংকের মতো বড় প্রকল্পগুলো চীন হোস্ট করছে। বেইজিং প্রকাশ্যে বাংলাদেশের এসসিও আকাক্সক্ষাকে সমর্থন করেছে, ঢাকাকে বঙ্গোপসাগরের কৌশলগত প্রবেশদ্বার এবং ভারত মহাসাগরে ভারতীয় প্রভাবের প্রতিপক্ষ হিসেবে দেখেছে। চীন বাংলাদেশকে সামরিক সরঞ্জাম সরবরাহ করে এবং যৌথ নৌ-মহড়া পরিচালনা করে। তবে এটি ভারতীয় সন্দেহকে আরো বাড়িয়ে তুলেছে।

রাশিয়া : রাশিয়া বাংলাদেশের সাথে সৌহার্দ্যপূর্ণ কিন্তু বাস্তবসম্মত সম্পর্ক বজায় রাখে। এসসিও সম্পৃক্ততার বিরোধিতা করেনি। রাশিয়া বাংলাদেশের প্রথম রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করছে, মিগ-২৯ জেট ও হেলিকপ্টারসহ সামরিক সরঞ্জাম বিক্রি করেছে। রাশিয়া বাংলাদেশের সংলাপ অংশীদার মর্যাদাকে সমর্থন করে; কিন্তু পূর্ণ সদস্যপদের জন্য সক্রিয়ভাবে তদবির করেনি।

পাকিস্তান : ২০১৭ থেকে এসসিও সদস্য পাকিস্তান বাংলাদেশের অন্তর্ভুক্তিকে জোরালোভাবে সমর্থন করে। পাকিস্তান বাংলাদেশের সদস্যপদকে এসসিওতে ‘মুসলিম কণ্ঠস্বর’ জোরদার করতে চিহ্নিত করেছে, ইরানের সাম্প্রতিক অন্তর্ভুক্তিও এ বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ। এসসিওতে পাকিস্তানের প্রভাব সীমিত, বিশেষ করে ভারতের বিরোধিতা করা ইস্যুতে।

ইরান : ২০২৩ সালে এসসিওতে যোগদানের পর থেকে বাংলাদেশের সাথে ইরানের উষ্ণ সম্পর্ক রয়েছে। ইরান বাংলাদেশকে তেল ও গ্যাসের ভবিষ্যতের বাজার হিসেবে দেখে। উভয়-ই সংখ্যাগরিষ্ঠ-মুসলিম দেশ, যাদের ওআইসি ফোরামে অভিন্ন স্বার্থ রয়েছে। ইরান এখনো বাংলাদেশের এসসিও বিডে নির্ণায়ক ভূমিকা নয়। ইরানের সমর্থন বাড়তে পারে, তবে আপাতত এটি একটি মূল কারণ নয়। যতক্ষণ না ভারতের অবস্থান নরম না হয় বা এসসিও তার ঐকমত্যের নিয়ম সংশোধন না করে, ততক্ষণ পর্যন্ত অন্য সদস্যদের সাথে বাংলাদেশের সম্পর্ক মজবুত করার প্রয়োজনীয়তা থাকবে।

বাংলাদেশের জন্য এসসিও সদস্যপদ একটি আকর্ষণীয় প্যাকেজ। নতুন বাজার, নিরাপত্তা সহযোগিতা, জ্বালানি অংশীদারত্ব ও কূটনৈতিক উন্নতি। তবে, ভারতকে বিচ্ছিন্ন করা বা জোটনিরপেক্ষ অবস্থানের সাথে আপস করা এড়াতে এর সাধনা অবশ্যই সতর্ক এবং সুপরিকল্পিত হতে হবে। ভবিষ্যতের সদস্যপদের জন্য নীরবে প্রস্তুতি নেয়ার সময় এখন। এসসিও এমন একটি ক্লাব, যেখানে আমাদের তাড়াহুড়া করার দরকার নেই। সঠিক সময় যখন আসবে তখন আমাদের যোগ দিতে প্রস্তুত থাকতে হবে। সে জন্য প্রস্তুতিও থাকতে হবে।

লেখক : অবসরপ্রাপ্ত যুগ্মসচিব ও গ্রন্থকার