আলমগীর মহিউদ্দিন মূলত মোগল সম্রাট আওরঙ্গজেবের নাম। আমাদের সহকর্মী আহমদ মতিউর রহমান এবং দৈনিক নয়া দিগন্তের শীর্ষস্থানীয় সাংবাদিক মাসুমুর রহমান খলিলী কলাম লিখে মহিউদ্দিন সাহেবের প্রতি শেষ শ্রদ্ধা জানিয়েছেন। তিনি গত ২৩ আগস্ট আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন।
আলমগীর মহিউদ্দিন ছিলেন আদর্শ মানুষ এবং সত্যিকারের ভদ্রলোক। আমাদের পরলোকগত কলিগ গোলাপ মুনীর ভাই বলতেন, তিনি সত্যিকারের ভদ্রলোক। তিনি থাকতেন মণিপুরীপাড়ায়, খ্রিষ্টান অধ্যুষিত এলাকায়। বিয়েও করেছেন একজন প্রাক্তন খ্রিষ্টধর্মাবলম্বী নারীকে। তিনি দুইবার দৈনিক নয়া দিগন্তের আনন্দভ্রমণে যেতে পারেননি। প্রথমত, ২০০৬ সালে ফেব্রুয়ারির প্রথম দিকে খুব সম্ভবত ৬ তারিখে সোনারগাঁয়ে নয়া দিগন্তের প্রথম বনভোজনে যেতে পারেননি। বাইরের অনেক অতিথি এতে যোগদান করেন। সম্পাদক সাহেব হঠাৎ হৃদরোগে আক্রান্ত হওয়ায় বনভোজনে অংশ নিতে পারেননি। বনভোজনের আগের দিন হৃদরোগ হাসপাতালে দেখতে গিয়েছিলাম। সেদিন তার স্ত্রীর সেবাপরায়ণতা দেখে অবাক হয়েছি। তিনিও বয়স্কা মহিলা ছিলেন এবং অসুস্থ ছিলেন কিছুটা। তিনি কর্মজীবনে সাবেক (বর্তমান বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়) পিজি হাসপাতালের মেট্রন ছিলেন। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে মহিউদ্দিন সাহেব পিজি হাসপাতালে আশ্রয় নিয়েছিলেন। তাকে তার স্ত্রী ওই দিন রোগীদের চাদর দিয়ে রক্ষা করেন। তিনি সারারাত ওই আশ্রয়ে লুকিয়ে ছিলেন।
আমি যখন ঢাকায় আসি, তখন তিনি ‘দৈনিক বাংলাদেশ টাইমস-এর বার্তা সম্পাদক। এরপর তিনি ‘দৈনিক নিউ নেশন’-এর এডিটর হন। সেখান থেকে ‘দৈনিক নয়া দিগন্ত’ এ যোগদান করেন। ১৯৬০ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র থাকাকালীন তিনি সরকারি বার্তা প্রতিষ্ঠান এপিপির (বর্তমান বাসস) রিপোর্টার হিসেবে যোগদান করেন। তখন সোহরাওয়ার্দী সাহেব ছিলেন রাজনৈতিক নেতা। সোহরাওয়ার্দী সাহেবের কাছে গুলিস্তানের ঢাকা বোর্ডিংয়ে তিনি গিয়েছিলেন। তার মরহুম শেখ মুজিব তখন কর্মী। ১৯৭০ সালে তিনি শেখ মুজিবের পুরো নির্বাচনী সফর কভার করেন। গত ফেব্রুয়ারির ১৪ তারিখে দৈনিক নয়া দিগন্তের নৌবিহারেও তিনি যেতে পারেননি অসুস্থতার কারণে। সেদিনও বাইরের অনেকে এতে যোগদান করেন। আমরা ঢাকা থেকে মেঘনা পর্যন্ত গিয়েছিলাম লঞ্চযোগে। অনেক হাসি, আনন্দ, হইহুল্লোড় হয়েছে; কিন্তু সম্পাদক সাহেব ছিলেন না। এটা আমাদেরকে ব্যথিত করেছে।
তিনি ছিলেন খুব সহজ-সরল। শেষ দিকের কয়েক মাস অসুস্থতার কারণে তিনি কাজ করতে পারেননি। কিন্তু ঠিকই এসে অফিসে হাজিরা দিতেন। কম্পিউটারে কোনো তার সুবিধাজনক কার্টুন পেলে তিনি সবাইকে দেখাতেন। তখন তার হাঁটতে অসুবিধা ছিল। তার বয়স ৮০ পেরিয়ে গিয়েছিল। একদিন আমি তার প্রাইভেটকারে তার বাসা হয়ে আমার বাসায় গিয়েছিলাম। ওই দিন খুব যানজট ছিল। তার বাসায় পৌঁছাতে অনেক সময় লেগে যায়। আমার বাসায় পৌঁছাতে প্রায় সন্ধ্যা হয়ে গিয়েছিল। আমরা অনেক জুনিয়র ছিলাম। কিন্তু তিনি আমন্ত্রণ জানাতেন তার সাথে যাওয়ার জন্য। চলনে-বলনে তিনি ছিলেন সহজ সরল। তিনি ছিলেন আদর্শ প্রিয়।
তার আদর্শ ছিল গণতন্ত্র, ইসলাম, স্বাধীনতা-মুক্তিযুদ্ধ, ধর্মীয় সম্প্রীতি। তিনি কয়েক বছর আগে হজ করেছিলেন বৃদ্ধ হওয়ার পূর্বে। তিনি ফটোজেনিক চেহারার অধিকারী ছিলেন। এজন্য হজ করার পর দাড়ি রাখতে অসুবিধা হয়নি। মুখের দাগগুলো ধরা যেত না। এডিটর সাহেব বিপুল অভিজ্ঞতার অধিকারী ছিলেন। শেখ মুজিবের খাবার বাসা থেকে তার স্ত্রী তৈরি করে দিতেন। নির্বাচনী সফরে দলের এক কর্মী ওই খাবার চুরি করেছিল। শেখ মুজিবের হুঙ্কারেও কাজ হয়নি। এটাও এডিটর সাহেব উল্লেখ করেছিলেন।
তিনি ছাত্রজীবনে সাংবাদিকতায় যোগদান করেছিলেন। আজীবন ইংরেজিতে লিখেছেন। বাংলায় প্রথম দৈনিক নয়া দিগন্ততে এসে তিনি হাত পাকান। তার বাংলা হাতের লেখা ছিল সুন্দর। তিনি অসুস্থতা সত্তে¡ও সংবাদপত্রের সব কাজের দেখাশোনা করতেন। সংবাদপত্রের বিভিন্ন মিটিংয়ে অংশগ্রহণ করতেন। শেষ কয়েক মাস সালাহউদ্দিন বাবর ভাই পত্রিকা দেখাশোনা করেছেন।



