আজকের দ্রুত পরিবর্তনশীল বৈশ্বিক ও আঞ্চলিক প্রেক্ষাপটে, কোনো একটি জাতির টিকে থাকা, অগ্রগতি ও সার্বভৌমত্ব কেবল তার সামরিক শক্তির ওপর নির্ভর করে না- এটি নির্ভর করে ওই জাতির জনগণের ঐক্য, প্রতিষ্ঠানগুলোর সহনশীলতা ও জাতীয় উদ্দেশ্যের স্পষ্টতায়। বাংলাদেশের জন্য- যেটি ১৭ কোটি মানুষের একটি রাষ্ট্র, দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সংযোগস্থলে অবস্থিত, জাতীয় নিরাপত্তার বিষয়টি আর সীমান্ত বা ব্যারাকের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। এখন এর মধ্যে সাইবার প্রতিরক্ষা, অর্থনৈতিক স্বাধীনতা, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও আদর্শিক সংহতি অন্তর্ভুক্ত হয়েছে।
১. বাংলাদেশের বর্তমান নিরাপত্তা চ্যালেঞ্জ চিহ্নিতকরণ
বাংলাদেশ এখন যে নিরাপত্তা চ্যালেঞ্জগুলোর মুখোমুখি, তা জটিল ও বহুমাত্রিক। এসব চ্যালেঞ্জ অভ্যন্তরীণ দুর্বলতা এবং বহিরাগত হুমকি থেকে উদ্ভূত- যা আজ একে-অপরের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত।
ক. ভূ-রাজনৈতিক চাপ ও কৌশলগত ঝুঁকি
বাংলাদেশ এমন দুই আঞ্চলিক পরাশক্তির মাঝখানে অবস্থিত- ভারত ও চীন, যাদের কৌশলগত প্রতিযোগিতা দিন দিন তীব্রতর হচ্ছে। চীনের সাথে বাংলাদেশের ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক সম্পর্ক এবং বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের (বিআরআই) আওতায় অবকাঠামোগত প্রকল্পগুলো দিল্লি ও ওয়াশিংটনের উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে, যার ফলে কূটনৈতিক চাপ, প্রভাব বিস্তার কার্যক্রম এবং সূক্ষ্ম বাধ্যবাধকতা তৈরি হয়েছে। এ দিকে ভারতের ইসরাইলের সাথে খোলামেলা কৌশলগত ও গোয়েন্দা সহযোগিতা বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বের জন্য উদ্বেগের কারণ হয়ে উঠছে- বিশেষ করে বাংলাদেশের সংবেদনশীল ভূ-রাজনৈতিক অবস্থান বিবেচনায়।
খ. অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক বিভাজন রাজনৈতিক মেরুকরণ বিপজ্জনক মাত্রায় পৌঁছেছে। প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে অর্থবহ সংলাপের অভাব অভ্যন্তরীণ স্থিতিশীলতা দুর্বল করেছে। রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান-বিশেষ করে গোয়েন্দা ও আইনশৃঙ্খলাবাহিনীগুলো রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত হওয়ায় এদের বিশ্বাসযোগ্যতা ও পেশাদারিত্ব হুমকিতে পড়েছে।
গ. অর্থনৈতিক নির্ভরতা ও কৌশলগত খাত টেলিযোগাযোগ, জ্বালানি ও ব্যাংকের মতো গুরুত্বপূর্ণ খাতগুলো ক্রমাগতভাবে বিদেশী নিয়ন্ত্রণ ও নজরদারির ঝুঁকিতে পড়ছে। যেসব রাষ্ট্রের কৌশলগত স্বার্থ বাংলাদেশের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত, তাদের প্রযুক্তির ওপর নির্ভরশীলতা গুপ্তচরবৃত্তি ও তথ্যচুরির পথ খুলে দিচ্ছে।
ঘ. সাইবার নিরাপত্তায় হুমকি
বাংলাদেশের এখনো কোনো পূর্ণাঙ্গ জাতীয় সাইবার নিরাপত্তা নীতিমালা নেই। সরকারি ও ব্যাংক খাতের বড় প্রতিষ্ঠানগুলো বিশেষভাবে রাষ্ট্র-সমর্থিত হ্যাকিং ও তথ্যচুরির ঝুঁকিতে রয়েছে- বিশেষত আঞ্চলিক প্রতিদ্বন্দ্বীদের কাছ থেকে।
ঙ. ধর্মীয় চরমপন্থা ও আদর্শিক অপপ্রচার
যদিও উগ্রবাদ নিয়ন্ত্রণে আনা গেছে, ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম এখনো তরুণদের উগ্রপন্থায় প্রলুব্ধ করার উর্বর ক্ষেত্র। বিদেশী অর্থায়নে পরিচালিত এনজিও, মিডিয়া এবং থিঙ্ক ট্যাঙ্কগুলো ইতিহাস বিকৃত করছে, জাতীয় পরিচয় দুর্বল করছে এবং নীতি-নির্ধারণে প্রভাব ফেলছে।
২. নিরাপত্তাঝুঁকি, হুমকি ও সঙ্কট চিহ্নিতকরণ
বাংলাদেশের সামনে তাৎক্ষণিক (স্বল্পমেয়াদি) ও কৌশলগত (দীর্ঘমেয়াদি) উভয় ধরনের হুমকি বিদ্যমান, যেগুলোর মোকাবেলায় স্পষ্ট বিশ্লেষণ ও সম্মিলিত উদ্যোগ প্রয়োজন।
ক. স্বল্পমেয়াদি ঝুঁকি
নির্বাচনকেন্দ্রিক সহিংসতা ও রাজনৈতিক অস্থিরতা। সীমান্ত সঙ্ঘাত ও পানি বিরোধ, বিশেষ করে ভারতের সাথে (যেমন- তিস্তা ইস্যু)। লক্ষ্যভিত্তিক প্রচার, মিডিয়া অপপ্রচার এবং হাইব্রিড যুদ্ধের মাধ্যমে জাতীয় ঐক্য বিনষ্টের চেষ্টা। সন্ত্রাসের পুনরুত্থান বা প্রক্সি হামলা, বিশেষ করে আঞ্চলিক উত্তেজনার প্রেক্ষাপটে।
খ. দীর্ঘমেয়াদি হুমকি
জনসংখ্যাগত ভারসাম্যহীনতা এবং তরুণদের হতাশা, যা উগ্রবাদ বা মেধাপাচারে রূপ নিতে পারে। প্রতিরক্ষা ও গোয়েন্দা সহযোগিতার মাধ্যমে প্রতিবেশী ও বহিরাগত শক্তির মাধ্যমে কৌশলগত ঘিরে ফেলা। শিক্ষা, ধর্মীয় বক্তৃতা ও নাগরিক সমাজে বিদেশী প্রভাব, যা জাতীয় আদর্শ ও নীতিনির্ধারণে স্বাতন্ত্র্য হরণ করে। উপকূলীয় এলাকায় জলবায়ু নিরাপত্তাহীনতা, যা অভ্যন্তরীণ বাস্তুচ্যুতি ও বিশৃঙ্খলায় ব্যবহৃত হতে পারে।
৩. কেন জাতীয় ঐক্য ও সংহতি অপরিহার্য
বাংলাদেশের বিভক্ত রাজনৈতিক পরিমণ্ডল এবং প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে আস্থার অভাব দেশকে বহিরাগত শত্রুদের সহজ লক্ষ্য করে তুলেছে। এ প্রেক্ষাপটে, জাতীয় ঐক্য ও সংহতি কোনো কল্পনালব্ধ ধারণা নয়- এটি এক জরুরি বাস্তবতা।
ক. রাজনৈতিক শক্তির মধ্যে ঐক্য আইডিওলজিক্যাল পার্থক্য থাকা সত্ত্বেও প্রধান সব রাজনৈতিক দলের মধ্যে একটি ন্যূনতম জাতীয় নিরাপত্তা নীতির ওপর ঐকমত্য গড়ে তুলতে হবে, যা রাজনৈতিক প্রতিযোগিতার ঊর্ধ্বে থাকবে। জাতীয় সার্বভৌমত্ব কখনো ক্ষণস্থায়ী রাজনৈতিক লাভ বা বিদেশী সমর্থনের বিনিময়ে ত্যাগ করা যাবে না।
খ. নাগরিক সমাজ ও পেশাজীবীদের সম্পৃক্ততা
নিরাপত্তা এখন আর কেবল সামরিক বাহিনীর একক দায়িত্ব নয়। এতে সক্রিয়ভাবে সম্পৃক্ত হতে হবে- সাইবার বিশেষজ্ঞ, প্রকৌশলী, শিক্ষাবিদ, সাংবাদিক, স্থানীয় সরকার প্রতিনিধি, অবসরপ্রাপ্ত প্রতিরক্ষা কর্মকর্তা, কৌশলগত থিঙ্ক ট্যাঙ্ক।
গ. জনসচেতনতা ও শিক্ষা
মানুষকে সচেতন করতে হবে- বিশেষ করে মনোস্তাত্ত্বিক যুদ্ধ ও অপপ্রচারের হুমকি সম্পর্কে। জাতীয় পরিচয়, ১৯৭১ সালের চেতনা ও সার্বভৌমত্ব কেবল অস্ত্র দিয়ে নয়, সচেতনতা, শিক্ষা ও আদর্শিক স্বচ্ছতা দিয়ে রক্ষা করতে হবে।
৪. ভবিষ্যতের পথ : ঐক্য কী অর্জন করতে পারে
ক. একটি শক্তিশালী ও স্বাধীন জাতীয় প্রতিরক্ষা ও নিরাপত্তা নীতি
১. বাংলাদেশের সার্বভৌম স্বার্থকে প্রতিফলিত করে, বাহ্যিক চাপ নয় : যখন জাতীয় ঐক্য রাজনৈতিক নেতৃত্ব, বেসামরিক প্রতিষ্ঠান ও সামরিক ব্যবস্থাকে একটি অভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গিতে একত্র করে, তখন প্রতিরক্ষা নীতি হয়ে ওঠে সার্বভৌমত্বের হাতিয়ার- আনুগত্যের নয়। এ নীতি বাংলাদেশের ভূ-রাজনৈতিক অবস্থান, হুমকির মাত্রা, ঐতিহাসিক অভিজ্ঞতা এবং জনগণের আকাক্সক্ষার ভিত্তিতে গঠিত হবে- বিদেশী শক্তি বা দাতাদের নির্দেশনা অনুযায়ী নয়। এমন নীতি গোপন বৈদেশিক গোয়েন্দা প্রভাব, প্রতিরক্ষাশিল্পের লবি বা আঞ্চলিক ব্লকের দ্বারা প্রভাবিত হওয়ার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলবে।
২. বিদেশী সামরিক জোট থেকে দূরত্ব যা নিরপেক্ষতা ও দীর্ঘমেয়াদি সার্বভৌমত্ব হুমকির মুখে ফেলে : জাতীয় ঐক্য বিদেশ-নির্ভর সামরিক জোট, ইন্দো-প্যাসিফিক অভিযোজন, বিদেশী সামরিক ঘাঁটি বা গোপন গোয়েন্দা সহযোগিতার মতো ঝুঁকিপূর্ণ জড়িত হওয়া থেকে দেশকে রক্ষা করতে পারবে। স্বাধীন প্রতিরক্ষা নীতি কৌশলগত স্বনির্ভরতাকে অগ্রাধিকার দেবে এবং কৌশলগত বহুমুখিতার মাধ্যমে সক্ষমতা বাড়াবে- নির্ভরতা নয়।
খ. একটি সমন্বিত জাতীয় নিরাপত্তাব্যবস্থা
১. সেনাবাহিনী, পুলিশ, র্যাব, ডিজিএফআই, এনএসআই, সাইবার ইউনিট ও বিজিবির মধ্যে বাস্তবসম্মত সমন্বয় : বর্তমানে এ বাহিনীগুলো বিভিন্ন স্তরে বিভক্ত কমান্ড ও স্বল্প সমন্বয়ে কাজ করে। জাতীয় ঐক্য রাজনৈতিক ও প্রাতিষ্ঠানিক সদিচ্ছা সৃষ্টি করবে, যাতে এ বাহিনীগুলো একটি সুরক্ষিত, বাস্তবসম্মত জাতীয় কমান্ড অ্যান্ড কন্ট্রোল কাঠামোতে একত্রিত হয়ে রিয়েল-টাইম তথ্য আদান-প্রদান, হুমকি নিরীক্ষণ ও যৌথ অভিযানের সক্ষমতা অর্জন করতে পারে।
২.গোয়েন্দা সমন্বয় ও দ্রুত প্রতিক্রিয়া ব্যবস্থা
ডিজিএফআই, এনএসআই, সিআইডি ও সাইবার ইউনিটের তথ্যগুলো একত্র করে যৌথ বিশ্লেষণ করতে একটি ফিউশন সেন্টার প্রতিষ্ঠা করতে হবে, যা সন্ত্রাস, সাইবার হামলা ও অর্থনৈতিক নাশকতা পূর্বাভাস দিতে সক্ষম হবে।
৩. অভ্যন্তরীণ হুমকিতে বেসামরিক-সামরিক সমন্বয়
চরমপন্থা, বিচ্ছিন্নতাবাদ, মাদক, রাজনৈতিক সহিংসতা ইত্যাদি অভ্যন্তরীণ হুমকি এককভাবে প্রতিহত করা যায় না। এ ঝুঁকিগুলো প্রতিরোধে বেসামরিক-সামরিক সমন্বয় আবশ্যক, যা জাতীয় জরুরি অবস্থায় আইনি কাঠামো, দায়িত্ব বিভাজন ও পারস্পরিক আস্থার মাধ্যমে কার্যকর প্রতিক্রিয়া নিশ্চিত করবে।
গ. কৌশলগত নিরাপত্তা ব্যবস্থাপনা অবকাঠামো
১. গোয়েন্দাভিত্তিক শাসনব্যবস্থা : নিরাপত্তা নীতি আর প্রতিক্রিয়াশীল হওয়া চলবে না। ঐক্যবদ্ধ বাংলাদেশ ভবিষ্যৎ হুমকির পূর্বাভাস, জাতীয় দুর্বলতার মূল্যায়ন এবং ঝুঁকির মানচিত্রের ওপর ভিত্তি করে নীতি-নির্ধারণ করতে পারবে। এর আওতায় অবকাঠামো পরিকল্পনা, অর্থনৈতিক নীতি এবং বৈদেশিক বিনিয়োগে নিরাপত্তার ইনপুট প্রয়োজন।
২. যোগাযোগ ও সাইবার নিরাপত্তায় প্রযুক্তিগত স্বনির্ভরতা : বিদেশী মালিকানাধীন যোগাযোগমাধ্যম, আমদানি করা নজরদারি যন্ত্রপাতি ও যাচাইবিহীন সফটওয়্যারের ওপর নির্ভরতা বাংলাদেশকে গুপ্তচরবৃত্তি, প্রভাব বিস্তার ও কৌশলগত ব্ল্যাকমেলের ঝুঁকিতে ফেলছে। তাই সুরক্ষিত রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় নিজস্ব প্রযুক্তি অবকাঠামো, দেশীয় সফটওয়্যার ও প্রশিক্ষিত সাইবার সেনাবাহিনী তৈরি অপরিহার্য।
৩. জৈব, পরিবেশগত ও হাইব্রিড হুমকির জন্য দুর্যোগ প্রস্তুতি : আধুনিক হুমকি শুধু যুদ্ধ নয়- এর মধ্যে মহামারী, জলবায়ু বিপর্যয়, জৈব-নিরাপত্তা লঙ্ঘন ও হাইব্রিড যুদ্ধ (যেমন- তথ্য অপপ্রচার, অর্থনৈতিক সঙ্কট) অন্তর্ভুক্ত। এর জন্য বহুস্তরভিত্তিক প্রস্তুতির প্রয়োজন, যাতে বিজ্ঞানপ্রতিষ্ঠান, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা সংস্থা, গোয়েন্দা বাহিনী ও প্রশাসন একসাথে কাজ করতে পারে।
৫. উপসংহার : বাংলাদেশ আজ এক ঐতিহাসিক সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে। প্রক্সি যুদ্ধ, কৌশলগত প্রতারণা ও অর্থনৈতিক চাপের প্রেক্ষাপটে জাতীয় প্রতিরক্ষা শব্দটির অর্থ পাল্টে গেছে। আজ ঐক্যই আমাদের সবচেয়ে বড় শক্তি। জাতীয় ঐক্য মানে মতভেদের অনুপস্থিতি নয়- এটি মানে অভিন্ন লক্ষ্য ও দায়িত্বের উপস্থিতি।
যদি সব রাজনৈতিক দল, রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান, পেশাজীবী, নাগরিক সমাজ ও দেশপ্রেমিক জনগণ একসাথে দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষার শপথ নেয়, তাহলে আমরা নির্দ্বিধায় বলতে পারি-
‘হ্যাঁ, বাংলাদেশ মাথা উঁচু করে দাঁড়াবে- একটি ঘুঁটি নয়; বরং একুশ শতকের একটি স্বাধীন, আত্মনির্ভর ও কৌশলগতভাবে দক্ষ রাষ্ট্র হিসেবে’।
লেখক : নিরাপত্তা বিশ্লেষক