ডাকসু নির্বাচনে ছাত্রশিবিরের ভূমিধস বিজয় রাজনৈতিক মহলের অনেককে কেবল বিস্মিতই করেনি; বরং মেনে নিতেও নিদারুণ কষ্টে ভুগছেন অনেকে। এমনকি ফলাফল ঘোষণার পর কেউ কেউ ক্যাম্পাসে মিছিল বের করে এই স্লোগানও দিয়েছে- শিবিরের নির্বাচন মানি না, মানব না। কিন্তু এ কথা কেউ ভাবছে না, একদার প্রগতিশীল রাজনীতির সূতিকাগার হিসেবে পরিচিত এই বিশ্ববিদ্যালয়ে শিবিরের মতো ধর্মীয় মূল্যবোধসম্পন্ন একটি সংগঠন কেন, কিভাবে সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে এতটা জায়গা করে নিলো। কারণগুলো অনুসন্ধান না করে মানি না মানব না স্লোগান কতটা যৌক্তিক সেটি ভাবারও সময় এখন।
মূলত এই মানি না, মানব না- এই স্লোগানের মধ্যে নিহিত রয়েছে ‘সালিস মানি কিন্তু তালগাছটা আমার’ মার্কা একটি গণতন্ত্রের ধারণা, যা এ দেশে বহু বছর ধরে চলে এসেছে। ঠিক এরকমই ধারণাপুষ্ট, এমন একটি গণতন্ত্র আমরা চাই যা কেবল আমাদেরই বিজয়ী করবে। তা না করা হলে ষড়যন্ত্র, সূ² কারচুপি ইত্যাদি অভিযোগ তুলে সহিংস আন্দোলনে দেশ অচল করে দেয়ার ঘটনাও আমরা দেখেছি। এ ক্ষেত্রে নিঃসন্দেহে আওয়ামী লীগ চ্যাম্পিয়ন। তবে ইদানীংকালে বিএনপিরও কিছু নেতা-নেত্রীর মধ্যে এ ধরনের প্রবণতা দেখা যাচ্ছে।
তবে ২০১৬ সালে অনুষ্ঠিত ডাকসু নির্বাচনের ১০ বছর পর ২০২৫-এর বর্তমান নির্বাচনের ফলাফলের মধ্য দিয়ে ছাত্ররাজনীতিতে একটি গুণগত পরিবর্তন পরিলক্ষিত হচ্ছে। অর্থাৎ- ক্যাডারভিত্তিক ছাত্ররাজনীতির প্রভাব থেকে সাধারণ শিক্ষার্থীরা বেরিয়ে আসার চেষ্টা করছে। এটি অনেকেরই জানা যে, সেই পাকিস্তান আমল থেকেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাডারভিত্তিক রাজনীতি প্রাধান্য পেয়ে আসছে। মূলত মুসলিম লীগের ছাত্র সংগঠন ন্যাশনাল স্টুডেন্ট ফেডারেশনের (এনএসএফ) পাণ্ডারা প্রথম এই ক্যাডারভিত্তিক ছাত্ররাজনীতির সূচনা করেছিল। তাদের নেতা সাইদুর রহমান ওরফে পাঁচ পাত্তুরের পকেটে সবসময় দু’টি পিস্তল থাকত। সে এবং খোকা নামে আরেকজনের নেতৃত্বে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সন্ত্রাসের এক মহা রাজত্ব সৃষ্টি হয়েছিল। বিরোধী রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে দমন করাই ছিল এই সন্ত্রাসের মূল লক্ষ্য।
কিন্তু দুঃখজনক ঘটনা হচ্ছে, ঊনসত্তরের প্রচণ্ড গণ-অভ্যুত্থানের মুখে প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খানের স্বৈরশাসনের অবসান এবং পাঁচ পাত্তুরদের গুণ্ডামির ইতি ঘটার পর আব্দুল মালেক নামে একজন ছাত্রনেতা হত্যাকাণ্ড সবাইকে হতবাক করে দিয়েছিল। কারণ একটি আন্দোলনের বিপুল সাফল্যের পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে এ ধরনের হত্যাকাণ্ড অনেকে মেনে নিতে পারেনি। আব্দুল মালেক ছিলেন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র সঙ্ঘের নেতা (বর্তমানের ছাত্রশিবির)। তিনি ইসলামী শিক্ষার পক্ষে কথা বলতেন বলে সে সময়ের বামপন্থীরা তার ওপর ক্ষুব্ধ ছিল। এই প্রেক্ষাপটেই তাকে হত্যা করা হয়। যারা গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছিল, তারাই শুধু মতাদর্শগত পার্থক্যের কারণে ওই হত্যাকাণ্ড ঘটিয়ে হতাশাজনক এক ভবিষ্যতের বার্তা দিয়েছিল, যা স্বাধীনতা-উত্তরকালে আমরা প্রত্যক্ষ করেছি।
অর্থাৎ- ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর দেখলাম এনএসএফের সেই সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের স্থানটি দখল করে নেয় বাংলাদেশ ছাত্রলীগ। এই সংগঠনের কারণেই ১৯৭৩ সালে অনুষ্ঠিত নির্বাচনের ফলাফল আলোর মুখ দেখেনি। কারণ পরাজয়ের আভাস ফুটে উঠলে ছাত্রলীগের মাস্তানরা ব্যালট বাক্স ছিনতাই করে নিয়ে যায়। সেই যে স্বাধীনতার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে মাস্তানি শুরু হয় তা পর্যায়ক্রমে অব্যাহত থাকে। একটা সময় এমন দাঁড়াল যে, শক্তিশালী ক্যাডার বাহিনী ছাড়া ছাত্ররাজনীতি অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়। আশির দশকে তো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে বন্দুকযুদ্ধ স্বাভাবিক ঘটনা ছিল। থেকে থেকেই রণক্ষেত্রে পরিণত হতো এই ক্যাম্পাস।
সাপ্তাহিক ২০০০ নামে একটি ম্যাগাজিনে প্রকাশিত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, স্বাধীনতার পর থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত ৩৮ বছরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে বিভিন্ন ছাত্র সংগঠনের ৭০ জন নেতাকর্মী নিহত হয়। অভ্যন্তরীণ কোন্দল, চাঁদাবাজির টাকার ভাগবাটোয়ারা, পরস্পরবিরোধী দুই ছাত্র সংগঠনের মধ্যে মুখোমুখি বন্দুকযুদ্ধ, আততায়ীর গুলিতে খুন ইত্যাদি নানামুখী সঙ্ঘাতে হত্যাকাণ্ড ঘটে। সেই সব নিহতের পরিবারের খোঁজ হয়তো কেউ আর রাখেনি। তারা এসেছিল উজ্জ্বল ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখে উচ্চশিক্ষা নিতে; কিন্তু বাড়িতে ফেরত গেল লাশ হয়ে। এরকম কত মর্মান্তিক ঘটনার সাক্ষী আছে এই ক্যাম্পাস।
১৯৭৪ সালে মুহসীন হলের সাত খুনের ঘটনা হয়তো এখনো অনেকের মনে আছে। ছাত্রলীগের অভ্যন্তরীণ দ্ব›েদ্বর জের ধরে এক গ্রুপ অন্য এক গ্রুপের সাতজনকে গুলি করে হত্যা করেছিল। হত্যার আগে তাদের লাইন ধরে দাঁড় করায় এবং ঠাণ্ডা মাথায় ব্রাশ ফায়ার করে হত্যা করে।
তবে সবচেয়ে বেশি হত্যাকাণ্ড ঘটে আশির দশকে এরশাদের শাসনামলে। সে সময় ’৮৭ সালে বোমা বিস্ফোরণে ছাত্রদল নেতা বাবলুর মৃত্যুবরণের ঘটনা তখন খুব আলোচিত বিষয় ছিল। মেধাবী ছাত্র হিসেবে পরিচিত বাবলুর এই অকালমৃত্যু তখন অনেকে সহজে মেনে নিতে পারেনি। কিংবা আততায়ীর গুলিতে ছাত্রদলের প্রভাবশালী নেতা ফজলুর রহমান শহীদ হত্যাকাণ্ডও কম আলোড়ন তোলেনি। সে পাগলা শহীদ হিসেবে পরিচিত ছিল। আরো অনেক হত্যাকাণ্ড, যার ফিরিস্তি রচিত হলে একটি মোটা গ্রন্থ হয়ে যাবে। আমাদের উচিত এ ধরনের একটি গ্রন্থ রচনা করা।
যা-ই হোক, অতীতের রক্তাক্ত ইতিহাস মাড়িয়ে ১৯১৬ সালের ডাকসু নির্বাচনে সাধারণ ছাত্রদের ইস্পাতকঠিন ঐক্যের কাছে বড় বড় রাজনৈতিক দলের ছাত্র সংগঠনের ক্যাডারতন্ত্রের পরাজয়ে ঘটে। সাধারণ ছাত্রদের প্রতীক হিসেবে নুরুল হক নুর বিপুল ভোটে ভিপি নির্বাচিত হন। এর ১০ বছর পর বর্তমান ডাকসু নির্বাচনে ছাত্রশিবিরের বিজয় ক্যাম্পাসে ক্যাডারভিত্তিক ছাত্ররাজনীতি অবসানের ইঙ্গিত বহন করছে। অর্থাৎ- একটি গুণগত পরিবর্তন লক্ষ করা যাচ্ছে।
সবশেষে যে সত্যটির মুখোমুখি আমাদের হওয়া উচিত তা হলো : যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ঊনসত্তর সালে আব্দুল মালেক শহীদ হয়েছিলেন তার ৫৭ বছর পর সেই ক্যাম্পাসে তার উত্তরাধিকারী সংগঠন ছাত্রশিবিরের এই উত্থান এক বিস্ময়কর ঘটনা। এটি আবারো প্রমাণ করে দিলো, ‘ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটে’। এটি নিঃসন্দেহে স্বাধীনতা-উত্তর নেতিবাচক রাজনীতির অবশ্যম্ভাবী ফল।
এভাবে ক্রমাগত ব্যর্থতার ইতিহাসই প্রতি পর্বে পর্বে নতুন অধ্যায় সৃষ্টি করে চলেছে। যে মুসলিম লীগের নেতৃত্বে পাকিস্তান সৃষ্টি হয়েছিল সেই মুসলিম লীগের ভুল রাজনীতির কারণে ’৫৪ সালেই পূর্ব পাকিস্তান গণপরিষদ নির্বাচনে দলটির শোচনীয় পরাজয় ঘটেছিল। ঊনসত্তর সালের গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে আইয়ুব মুসলিম লীগের ধ্বংসস্তূপের ওপর আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের উত্থান ঘটেছিল। আবার ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট একদলীয় বাকশালী শাসনের পতনের পর উত্থান ঘটে বিএনপি ও ছাত্রদলের। আবার নব্বইয়ের গণ-আন্দোলনের মধ্য দিয়ে এরশাদের ৯ বছরের স্বৈরশাসনের অবসান ঘটলে পুনরায় বিএনপির উত্থান ঘটে। ’৮২ সালে জেনারেল এরশাদ অন্যায়ভাবে নির্বাচিত বিএনপি সরকারকে উৎখাত করেছিল। সর্বশেষ ২০২৪ সালের জুলাই বিপ্লবের মধ্য দিয়ে ছাত্রশিবিরের উত্থান ঘটেছে। এটিই ইতিহাসের অমোঘ নিয়ম।



