স্বৈরাচার রোধের বন্দোবস্তে দেরি কেন

সবার নিয়ত যদি সাফ থাকে কোনো প্রস্তাবেই সমস্যা নেই। এখানে না বলা কথার মধ্যে চাপা পড়ে যাচ্ছে, আর যেন দেশে স্বৈরাচার না গজায় এ ব্যাপারে নিয়ত পরিষ্কার করা। নিজেরা হাসিনা হবেন না, ভবিষ্যতে আর হাসিনা গজাতেও দেবেন না- এ সিদ্ধান্তে আসবেন কি না; এই ছোট প্রশ্নটির নিষ্পত্তি হওয়া চাই।

আমাদের মতো দেশে রাজনীতিতে, সরকারে, শাসনে কাজ করে স্বেচ্ছাচারী হওয়ার মোহ। কেউ বলে কয়ে স্বৈরাচারী হয় না। একা একাও কেউ তা হতে পারে না। শেখ হাসিনাও নিজে নিজে স্বৈরাচারী হননি। তার স্বৈরাচারী হয়ে ওঠার পেছনে অনেকেরই ভূমিকা আছে। এ কাজে রাজনীতিক, সাংবাদিক, ব্যবসায়ী, শিক্ষক, পুলিশসহ সমাজের বিভিন্ন স্তরের বিশিষ্টরা বড় ভূমিকা রাখেন। আলেম-ওলামাও বাদ যাননি। শেখ হাসিনার সব কাজেই বাতাস দিয়েছেন বিশিষ্টজনরা। বলেছেন, আপনিই সঠিক- ‘প্রথমত আমরা আপনাকে চাই, দ্বিতীয়ত আমরা আপনাকে চাই এবং শেষ পর্যন্ত আমরা আপনাকে চাই, জীবনে-মরণে আপনাকেই চাই।’ আপনি ছাড়া এ দেশ চালানোর সক্ষমতা আর কারো নেই। আপনার বিরোধিতা যারা করে এরা সংখ্যায় নগণ্য। এরা উন্নয়নবিরোধী। স্বাধীনতাবিরোধী, কুলাঙ্গার-জঙ্গি। রাজাকারের নাতিপুতি।

তবে, দেশে-বিদেশে, যুগে যুগে স্বৈরাচার চেপে বসার পথপরিক্রমা কমবেশি এমনই। এই স্বৈরাচারেরই পতন হলে দেখা দেয় ভিন্ন দৃশ্যপট। একযোগে জানান দেয়া শুরু হয়, এই স্বৈরাচার পতনে কার কত অবদান।

বর্তমানে দেশে স্বৈরাচার তৈরির রাস্তা বন্ধে জোর আলোচনা চলছে। ফ্যাসিবাদের উত্থান ঠেকাতে সংস্কারের কার্যক্রম চলছে। এটি কতটা স্বৈরাচার ঠেকানো আর কতটা একজন ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা ঠেকানোর চিন্তা- এমন বিশ্লেষণও আছে। এ প্রশ্নে দরকার জাতীয় ঐকমত্য। যেখানে সংস্কার প্রাসঙ্গিক তা অবশ্যই হতে হবে রাজনৈতিক সমঝোতার মাধ্যমে। সে ফয়সালা হয়ে গেলে আগামী বছরের ফেব্রুয়ারি কেন, চলতি বছরের ডিসেম্বরেই সংসদ নির্বাচন সম্ভব।

বর্তমান প্রেক্ষাপটে জনমনে ফেব্রুয়ারিতে জাতীয় নির্বাচন নিয়ে কিছু সংশয় রয়েছে। আবার ঐকমত্যের চলতি পথে এখন কেওয়াস চলছে জুলাই সনদকে ঘিরে। অথচ এই সনদ শুধু রাজনৈতিক সংস্কারের রূপরেখাই নয়, এটি দেশের জন্য দীর্ঘমেয়াদি রোডম্যাপ। যা দেশের গণতন্ত্র ও সুশাসনের ভিত্তি জোরদার করবে। নীতিগতভাবে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে এ নিয়ে বিরোধ নেই। গোলমাল চলছে এর বাস্তবায়ন পদ্ধতি ও উপায় নিয়ে। কাজে রাজি হলে, উপায় নিয়ে সমস্যা হওয়ার কথা নয়। কথা উঠেছে, বিশেষ সাংবিধানিক আদেশ এবং গণভোট নিয়ে। অতীতে বিশেষ সাংবিধানিক আদেশের নজির আছে। এর ইতিহাসও দেশে আছে। আর এ ইস্যুতে দলগুলো একমত হতে না পারলে গণভোটের মাধ্যমে সনদ বাস্তবায়ন হতেই পারে। সরকারের তিনটি প্রতিশ্রুতি ছিল। এর মধ্যে প্রথম ছিল সংস্কার করা। বিগত দিনে রাষ্ট্রব্যবস্থার মধ্যে যে ধরনের ত্রুটি-বিচ্যুতিতে ধ্বংস আবর্জনা তৈরি হয়েছিল, এটি দূর করে বাংলাদেশকে নতুন পথে নিয়ে যাবে। দ্বিতীয় প্রতিশ্রুতি ছিল গণহত্যার বিচার এবং তৃতীয় ছিল নির্বাচন। ফ্যাসিবাদমুক্ত বাংলাদেশ চাইলে এসব বিষয়ে দলগুলোকে ঐকমত্যে আসতেই হবে। শুধু পরাজিত ফ্যাসিবাদী শক্তি তা চায় না। কারণ সংস্কারের পাশাপাশি মানবাধিকার লঙ্ঘনের দায়ে বিচার শুরু হলে তাদের কী দশা হবে, তারা জানে। ন্যায়বিচার মানে কেবল শাস্তি নয়। স্বৈরাচার আর না গজানোর ব্যবস্থা করাও।

গত বছরের ১ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত প্রায় এক হাজার ৪০০ মানুষকে হত্যা করা হয়েছে। গত ফেব্রুয়ারিতে প্রকাশিত জাতিসঙ্ঘের মানবাধিকার হাইকমিশনের স্বাধীন ও নিরপেক্ষ তদন্তের রিপোর্ট এটি। এই সহিংসতা ছিল পরিকল্পিত, সংগঠিত এবং পূর্ববর্তী সরকারের সর্বোচ্চ স্তর থেকে পরিচালিত। জাতিসঙ্ঘের হাইকমিশন কেবল নিপীড়নের প্রামাণ্য নথি প্রস্তুত করেনি; বরং ভবিষ্যতে এ ধরনের ঘটনা যেন আর ঘটতে না পারে সে জন্য একটি বিস্তৃত সুপারিশমালাও দিয়েছে।

সরকার থেকে বলা হচ্ছে, তারা মানবাধিকার সুরক্ষায় বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নিয়েছে। যেমন দণ্ডবিধির সংশোধন, গুমের শিকার ব্যক্তিদের সুরক্ষা বিষয়ে আন্তর্জাতিক সনদে যোগদান এবং জাতিসঙ্ঘের সাথে সমঝোতাস্মারক স্বাক্ষর। এই গুরুত্ব বিবেচনায় জুলাই আন্দোলন ঘিরে আওয়ামী লীগের মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের আগে কোনো নির্বাচন না হওয়ার পেছনে এটাই যুক্তি। বিচার, সংস্কার ও নির্বাচন একসাথে চলার তাগিদও তাই। সেখানে জুলাই হত্যাকাণ্ডে জড়িত যারা দেশে আছে তাদের খুঁজে বের করা দরকার। বিদেশে পালিয়ে থাকাদের দেশে ফিরিয়ে আনাও প্রাসঙ্গিক। বিচার, সংস্কার, নির্বাচনের সমান্তরালে আর কখনো যেন স্বৈরাচার জন্ম না নেয় সেই বন্দোবস্ত করার বিষয়ও রয়েছে। সময়ে সময়ে স্বৈরাচার জন্ম নেবে। মোটাতাজা হবে। জুলুম-নির্যাতন চালাবে। ছাত্র-জনতা এক হয়ে তাকে তাড়াবে। এটি কত? এ প্রশ্নে প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূসের কথা বেশ পরিষ্কার। তিনি বলেছেন, ‘স্বৈরাচারের প্রথম পাতা মেলার আগেই যেন আমরা তাকে ধরে ফেলতে পারি। ১৬ বছর যেন আমাদের অপেক্ষা করতে না হয়।’

বাস্তবে অপেক্ষার প্রহর শেষ হয়েও হচ্ছে না। স্বৈরাচার যেন আর না জন্মায়- এমন একটি সিদ্ধান্ত কেন এখনো নেয়া গেল না? এর জন্য দায়ী কে?

আন্দোলন কোনো আনন্দের বিষয় নয়। মানুষ শখ করে আন্দোলনে নামে না। পিঠ দেয়ালে ঠেকে গেলে বাধ্য হয়ে রাস্তায় নামে। কিন্তু তা কখনোই চলমান প্রক্রিয়া হতে পারে না। প্রথাগতভাবে দীর্ঘ দিন একসাথে চলা- সবকিছু ভাগাভাগি করে নেয়া রাজনৈতিক দলগুলো পরস্পরের বিরুদ্ধে যে রাস্তায় নামছে, এটি গদি দখলের প্রতিযোগিতা। এ প্রতিযোগিতার মাঝেও শেখ হাসিনাদের জন্ম হয়। শেখ হাসিনা কোনো নির্বাচনে হারতে চাননি- এখন যারা চালকের আসনে তাদেরও কারো কারো মধ্যে সেই উপসর্গ দেখা যাচ্ছে। এটি আইনের সমস্যা নয়। সংবিধানের সমস্যাও নয়। পুরোটাই মনোরোগ।

জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক ড. আলী রীয়াজ বলেছেন, জুলাই সনদ বাস্তবায়নে রাজনৈতিক দলগুলো একাধিক পরামর্শ দিলে সিদ্ধান্ত নেয়া সহজ হবে। আশা করা যায়, দ্রুততম সময়ের মধ্যে রাজনৈতিক দলগুলো জুলাই সনদ পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়নের সিদ্ধান্তে একমত হতে পারবে।

জুলাই সনদের আলোকে নির্বাচনের দাবি জোরদার। নির্বাচনের মধ্য দিয়ে সংসদ গঠনের আগেই সাংবিধানিক ও সংসদীয় কাঠামোর সংস্কারের জন্য সংবিধানের ১০৬ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী রাষ্ট্রপতির মাধ্যমে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের কাছে মতামত চাওয়া যেতে পারে বলে অনেকে মনে করেন। আওয়ামী লীগের পতনের পরে সংবিধানের এই বিধানের আলোকে, অর্থাৎ ১০৬ অনুচ্ছেদের ক্ষমতাবলে আপিল বিভাগের মতামত নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকার গঠন করা হয়েছে বলে দাবি করা হয়। জুলাই সনদের ভূমিকায়ও বিষয়টি উল্লেখ করা হয়েছে এভাবে : ‘বিদ্যমান সংবিধানের ১০৬ অনুচ্ছেদ অনুসারে রাষ্ট্রপতি কর্তৃক প্রেরিত প্রশ্নে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের মতামতের ভিত্তিতে ২০২৪ সালের ৮ আগস্ট অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব গ্রহণ করে রাষ্ট্রব্যবস্থার সংস্কারের বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করেন।’

৫ আগস্টের পর তো সবাই একমত হয়েছিল, বিএনপির নেতৃত্বে একটি জাতীয় সরকার হবে। বিএনপিরও তাতে সম্মতি ছিল। পরে বিএনপি যখন বুঝল, তাদের এককভাবে ক্ষমতা পাওয়ার সম্ভাবনা আছে, তখন তারা সেখান থেকে সরে এলো। এর মধ্যে মঞ্চে আবিভর্ূত হলেন বিএনপির আলোচিত নেতা সালাহউদ্দিন আহমেদ। এর পর থেকে জুলাই সনদ চূড়ান্তকরণে বিলম্ব। জামায়াত-এনসিপিও মোচড় দিয়ে বসেছে। বাস্তবতা হলো, গত বছরের ৫ থেকে ৮ আগস্ট দেশে কোনো সরকার ছিল না। তা ছাড়া ১০৬ অনুচ্ছেদে আপিল বিভাগের যে ক্ষমতা দেয়া হয়েছে সেটি ‘অ্যাবসোলিউট’ নয়। তারপরও জুলাই সনদ বাস্তবায়ন নিয়ে জামায়াত-এনসিপির ঝোঁক বেশি এ প্রস্তাবের দিকে। বিএনপি ও তার সমমনা রাজনৈতিক দল ও বাম দলগুলোর নির্বাচিত সংসদের মাধ্যমে জুলাই সনদ বাস্তবায়নের কথা বলে আসছে। জামায়াত-এনসিপি বিশেষ অধ্যাদেশ বা গণভোটের দাবিতে অটল।

সবার নিয়ত যদি সাফ থাকে কোনো প্রস্তাবেই সমস্যা নেই। এখানে না বলা কথার মধ্যে চাপা পড়ে যাচ্ছে, আর যেন দেশে স্বৈরাচার না গজায় এ ব্যাপারে নিয়ত পরিষ্কার করা। নিজেরা হাসিনা হবেন না, ভবিষ্যতে আর হাসিনা গজাতেও দেবেন না- এ সিদ্ধান্তে আসবেন কি না; এই ছোট প্রশ্নটির নিষ্পত্তি হওয়া চাই। সময়টা কিন্তু কারো জন্যই অ্যাবসোলিউট ভালো নয়। গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে গেলেও সব রাজনৈতিক দল মিলে যথাযথ সংস্কার করতে হবে। জুলাই সনদে সবাইকে আসতেই হবে। এখান থেকে বের হওয়া বা সেই চেষ্টা করা প্রকারান্তরে পুরনো বন্দোবস্ত তথা স্বৈরাচারের আঁতুড়ঘর টিকিয়ে রাখা। ছাত্র-জনতা চব্বিশে স্বৈরাচার তাড়িয়ে গণতন্ত্রের অভিযাত্রার যে সুযোগ করে দিয়েছে এটির খেলাপ যেন না হয়।

লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট