জুলাই চব্বিশের ছাত্র-জনতার ঐতিহাসিক গণবিপ্লবের মর্মবাণী যদি আমরা ঈমানের সাথে অন্তরে ধারণ ও লালন করতে পারতাম, তাহলে এ দিনটি দেখতে হতো না যে তরুণদের নতুন দল-এনসিপি নেতাদের উপর পতিত স্বৈরাচারী গুণ্ডারা হামলা করেছে কিংবা দেশের বৃহত্তম রাজনৈতিক দল বিএনপি জুলাই চব্বিশ বিপ্লবের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে কিংবা সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের জাতীয় সমাবেশে (১৯ জুলাই) আর সব জাতীয় নেতাদের সারিতে বিএনপি নেতাদেরকে দেখা যায়নি। দেশটি এখনো যে খুনি হাসিনার স্বৈরাচার এবং ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’-এর দুরভিসন্ধি ও যন্ত্রজাল থেকে আজাদ হতে পারেনি এসব তারই লক্ষণ।
তাহলে কি বীরের এ রক্তাস্রোত, মাতার এ অশ্রুধারা সবই ধরার ধুলায় হবে হারা? আবু সাঈদসহ দুই হাজার তরুণ শহীদের সর্বোচ্চ আত্মত্যাগের সাথে আমরা কী করে পারলাম এত বড় বিশ্বাসঘাতকতা করতে? লেন্দুপ দর্জির যেমন স্রেফ ক্ষমতার জন্য দিল্লিকে কেবলা বানাতে দেরি হয়নি, আমাদের রাজনীতিবিদরাও কি তেমনই ক্ষমতা পাওয়ার জন্য দিল্লিকে কেবলা বানিয়েছেন? মানুষ অবাক বিস্ময়ে এসব দেখছে। শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়া, গণতন্ত্রের জননী খালেদা জিয়া ও বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের দুর্গরক্ষক তারেক জিয়ার দল বিএনপির প্রথম সারির বিবেক বিক্রি করা নেতারা জুলাই বিপ্লবকে পাশ কাটিয়ে যাচ্ছে এবং বৃহত্তর ইসলামী মূল্যবোধ ও বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের আদর্শিক মৈত্রীকে খুন করতে উদ্যত হয়েছে। তাদের মুখেই এখন ‘রাজাকার’ প্রতিরোধের আপ্তবাক্য! সত্যই বিস্ময়কর!
কথা প্রসঙ্গে একটি কথা এখানে বলতেই হবে, আমরা এখনো যে রাজাকার-সংস্কৃতির বিষ ছড়াচ্ছি, সেই রাজাকাররাই এই দেশ ও জাতির অনিবার্য ভারতীয় লুণ্ঠন ও সেবাদাসত্বের পরিণতি সবার আগে ঠাহর করেছিল। তারা জানত ভারত আমাদের জন্য আদৌ কোনো কল্যাণ করবে না; বরং আমাদের গলায় ঝুলাবে রাজনৈতিক সামরিক ও সাংস্কৃতিক দাসত্বের শিকল। ঠিক সেটিই প্রমাণিত হয়েছে গত ৫৪ বছরে। একটি স্বাধীন ও মুসলিম বাংলাদেশের গলায় পরানো হয়েছে ভারতীয় বৈদিক সংস্কৃতি, ভারতীয় পুঁজিপতিদের নতুন এই বাজার দখলের উদগ্র বাসনা এবং বাংলাদেশের গর্বিত প্রতিরক্ষা মনস্তত্ত¡ ধ্বংস করার সুদূরপ্রসারী ষড়যন্ত্রের শৃঙ্খল, যার অকাট্য প্রমাণ বিডিআর হত্যাকাণ্ড। আওয়ামী বাকশালী-বাম-নাস্তিক চক্র বিশ্বাস করে, ভারতকে পূজা না করে কোনো উপায় নেই। অথচ রাষ্ট্রবিজ্ঞান বলে, এ নিতান্তই রাষ্ট্রদ্রোহিতা। বাংলাদেশের যে ব্যক্তি বিশ্বাস করে ভারত আমাদের বন্ধু দেশ, ভারত আমাদের বড় প্রতিবেশী সেই লোকটিই রাষ্ট্রদোহী এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতাবিরোধী। কারণ স্বাধীন বাংলাদেশ এবং ভারতের বাংলাদেশ নীতি ও ভারতীয় সেবাদাস আওয়ামী বাম নাস্তিক চক্র মূলত রাসায়নিকভাবেই পরস্পরবিরোধী; বলতে পারেন চধঃযড়ষড়মরপধষ ধহঃরফড়ঃব! আপনি হয় ভারতের হিন্দুত্ববাদী আগ্রাসন এবং টাটা বিড়লা বাজাজ গোয়েঙ্কা আদানির পক্ষে নতুবা বাংলাদেশের পক্ষে। এখন আপনাকেই বেছে নিতে হবে আপনি বাংলাদেশী না ভারতীয় বয়ানে চিহ্নিত বাঙালি ধর্মনিরপেক্ষ বস্তাপচা সমাজতন্ত্রী বা বিশ্বব্যাপী অচল সমাজতন্ত্রী? বাংলাদেশ জাতিরাষ্ট্রের এই সাংবিধানিক মূল স্তম্ভগুলো ভেঙে গুঁড়িয়ে দেয়া এখন সময়ের দাবি কি না এ নিয়ে কি দ্বিধা-সংশয়ের কোনো অবকাশ আছে?
সর্বোপরি, সমাজতন্ত্র, ধার্মনিরপেক্ষতা ও তথাকথিত বাহুবলী জাতীয়তাবাদ প্রভৃতি সাম্রাজ্যবাদীদের চাপিয়ে দেয়া রাষ্ট্রনীতি আমাদের বিদ্যমান শাসনতন্ত্রের সাথে পুরোপুরি সাংঘর্ষিক। কেননা, সংবিধানের শীর্ষে শোভা পাচ্ছে এ দেশের ৯২ শতাংশ মানুষের আদর্শ ও বিশ্বাসের মূলমন্ত্র ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম’। আমরা কেন এবং আর কতকাল বৈদিক আদর্শে রচিত ধর্মনিরপেক্ষতা ও বাঙালি জাতীয়তাবাদের মতো বেগানা জীবনাদর্শকে রাষ্ট্রীয় মূলনীতি হিসেবে চালু রাখব? জীবনাদর্শ বদল করে ভারতকে তুষ্ট করার রাষ্ট্রাদর্শকে আর কত দিন মাথায় তুলে রাখব, কেন রাখব?
বাঙালি মুসলমান ধর্ম-সংস্কৃতি বাদ দেয়ার জন্য একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধ করেনি কিংবা ৫৪ বছরের অপসংস্কৃতিকে বহাল রাখার জন্য চব্বিশে ছাত্র-জনতার গণ-আন্দোলনও হয়নি। চব্বিশের জুলাই বিপ্লবে শুধু রাজনৈতিক স্বৈরাচারই উৎখাত হয়নি, একই সাথে সাংস্কৃতিক স্বৈরাচার নিপাত ও নির্মূল করারও নৈতিক সম্মতি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। ভারতীয় আধিপত্য ও আগ্রাসনবাদ বিতাড়নের বার্তা দিয়ে গেছে ঐতিহাসিক জুলাই বিপ্লব। একই সাথে এই বার্তাটিও দিয়ে গেছে যে, এ দেশের মানুষ রাজনৈতিক দল-মত নির্বিশেষে জরুরি কিছু আদর্শিক বিষয়ে ঐকমত্য বা একতাবদ্ধ হতে পারলেই কেবল সম্ভব হবে দেশীয় ফ্যাসিবাদ ও ভারতীয় লুটপাটের বিরুদ্ধে দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব এবং গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা।
জার্মানিতে যেমন নাৎসিবাদ, ইতালিতে যেমন ফ্যাসিবাদ গত ৮০ বছরেও পুনর্জন্ম গ্রহণে সক্ষম হয়নি, যেমন ফেরেনি সাম্রাজ্যবাদী জাপানের জেনারেল তোজোর যুদ্ধবাদী সংহারি ধারা। হালাকু-চেঙ্গিসের বিশ্ববিজয়ী মোঙ্গল অশ্বারোহীদের ঠাঁই হয়েছে ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে। যেমন মনে-মননে দার্শনিক চিন্তাই ষোল আনা অসাম্প্রদায়িক হয়েও কেবল মহাযুদ্ধে অক্ষশক্তি বা জার্মান-জাপান-ইতালীয় মোর্চার শরিক হয়েছে বলে ভারতের নেতাজী সুভাষ বসু আজো নির্বাসিত ইতিহাসের পাতা থেকে।
ভারতে পৃথক মুসলিম আবাসভূমির স্বপ্নদ্রষ্টা আল্লামা ইকবাল, হসরত মোহানি, শওকত আলী-মোহাম্মদ আলী ভ্রাতৃদ্বয় এবং ভারতে হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের অ্যাম্বাসেডর তুখোড় কমনওয়েলথ আইনজীবী ও পাকিস্তান রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা কায়েদে আযম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ আমাদের স্মরণ ও মননভূমি থেকে কার্যত নির্বাসিত। অথচ স্যার সলিমুল্লাহ পূর্ব বাংলাকে পৃথক প্রদেশ না বানালে এবং জিন্নাহ সেই পূর্ব বাংলাকে পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলীয় প্রদেশ না বানালে বাংলাদেশের মানুষ আজো চাষাভুষাই থেকে যেত। আমাদের উপর উচ্চবর্ণের হিন্দু জমিদার শ্রেণী আজও শোষণের কারাগার বানিয়ে রাখত। পাকিস্তান হয়েছিল বলেই ঢাকার নবাব খাজা নাজিমুদ্দীন প্রধানমন্ত্রী হতে পেরেছিলেন। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সভাপতি হতে পেরেছিলেন। সেই সোহরাওয়ার্দীর বডিগার্ড শেখ মুজিব হতে পেরেছিলেন গোটা পাকিস্তানের সম্ভাব্য প্রধানমন্ত্রী।
আমাদের মূর্খতার বিশেষ দুঃখজনক দিকটি হলো আমরা অতীত ভোলা এবং ইতিহাস বিস্মৃত একটি অসম্পূর্ণ জাতি। তাই তো আজ আমাদের এত দুর্ভোগ-দুর্যোগ। আমরা ভুলে গেছি একাত্তরের রণাঙ্গনে আমাদের বীর ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের কর্মকর্তা ও সিপাহিদের আত্মত্যাগ এবং বিরল সাহসিকতার ইতিহাস। ভুলে গেছি ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের সফল রাষ্ট্রীয় বিপ্লবের অকুতোভয় বীর দেশপ্রেমিক অফিসার ও সিপাহিদের কথা। তারাই সে দিন এক একজন হাবিলদার রজব আলী হয়ে দেশকে ভারতীয় গোলামির জিঞ্জির থেকে মুক্ত করেছিলেন এই দেশ। ধ্বংস করেছিলেন স্বৈরাচারী আওয়ামী-বাকশালী দুঃশাসনের দুর্গ। সেই বীরত্বের কারণেই ভারতীয় ইন্ধনে নৃশংসভাবে চট্টগ্রাম সার্কিট হাউজে খুন করা হয়েছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষক এবং নতুন বাংলাদেশ নির্মাণের প্রধান স্থপতি রাষ্ট্রপতি জিয়াকে।
আমিই সম্পাদনা করেছিলাম সাপ্তাহিক সচিত্র স্বদেশ পত্রিকার সেই ঐতিহাসিক ‘জিয়া অ্যালবাম’, যে সংখ্যাটি তিন দিনের মধ্যে ১০ বার পুনর্মুদ্রিত হয়ে প্রায় ১০ লাখ কপি পৌঁছে গিয়েছিল পাঠকের হাতে হাতে। দুই লাখেরও বেশি কপি ছাপা হয়েছিল আমার সম্পাদনায় ৬৪টি প্রতিবেদনের তরজমা নিয়ে গ্রন্থিত ‘বিদেশী সাংবাদিকের দৃষ্টিতে শেখ মুজিবের বাংলাদেশ।’ এ সবই আজ বিস্মৃত ইতিহাস। দৈনিক ইনকিলাবে প্রকাশিত নিয়মিত কলাম আমার ‘মঞ্চে ময়দানে’ এবং সাপ্তাহিক ইত্তেহাদে প্রকাশিত কলাম ‘বৈকুণ্ঠের বলপয়েন্ট’এ ফুটে উঠত বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও ভারতীয় আধিপত্যবাদের স্বরূপ সন্ধানের ব্যাকুল প্রত্যাশা। সেগুলোও সব আজ জনশ্রুতি থেকে হারিয়ে যাওয়া ইতিহাস। অথচ ধ্রুব সত্য কথাটি এই যে, অতীতে যা ঘটেছিল সে সম্পর্কে বেখবর থাকা মানেই সর্বদা অবোধ শিশু হয়ে থাকা। অতীত বিস্মৃত কোনো জাতি কখনোই পরিপক্ব জাতি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হতে পারে না। অতীতের ঘটনাপ্রবাহ শুধুই আবেগের কোনো বিষয় নয়; বরং একটি জাতির বুদ্ধিবৃত্তিক পরিপক্বতার স্বাক্ষর। একটি জনগোষ্ঠীর নৈতিক দায়িত্ববোধ এবং জাতীয় ঐক্যের একটি সুস্পষ্ট অভিমুখ। জানি না, কবে আমাদের শিকড় সন্ধানের ক্ষুধা জাগ্রত হবে?



