স্বৈরতন্ত্রের বিরুদ্ধে দেশে দেশে জেন-জি

বিশ্বব্যাপী তরুণদের মধ্যে বর্তমানে নতুন এক জাগরণ সৃষ্টি হয়েছে।

বিশ্বব্যাপী তরুণদের মধ্যে বর্তমানে নতুন এক জাগরণ সৃষ্টি হয়েছে। দক্ষিণ এশিয়াসহ বিশ্বের অনেক স্থানে, জেনারেশন জেড বা জেন-জি একটি রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে আবিভর্র্ূত হয়েছে। জেন-জি বলতে নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি থেকে ২০১০-এর দশকের গোড়ার দিকে জন্মগ্রহণকারীদের বোঝায়। প্রায় প্রতিটি মহাদেশে তাদের বিক্ষোভে সরকার উৎখাত হয়েছে অথবা অপশাসনের জন্য যে মূল্য দিতে হবে, তা এই তরুণরা বোঝাতে সক্ষম হয়েছে।

২০২২ সালে শ্রীলঙ্কায় ‘আরগালা’ আন্দোলনের পর থেকে মূলত তরুণদের নেতৃত্বে জনপ্রিয় বিক্ষোভ বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়েছে। ২০২৪ সালে বাংলাদেশে শেখ হাসিনার দীর্ঘমেয়াদি স্বৈরশাসনের পতন ঘটে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে। চলতি বছরের সেপ্টেম্বরে জেন-জি বিক্ষোভের কারণে নেপালের প্রধানমন্ত্রী পদত্যাগ করতে বাধ্য হন। সেই সাথে দেশটির সরকারের পতন ঘটে।

অক্টোবর মাসের শুরুতে তরুণদের নেতৃত্বাধীন প্রতিবাদ বিক্ষোভে মাদাগাস্কার সরকারের পতন ঘটে। গাজার মজলুম মানুষের প্রতি সংহতি প্রকাশ ও ফিলিস্তিনে ইসরাইলের নৃশংস গণহত্যার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ও ধিক্কার জানাতে বিশ্বব্যাপী জেন-জি রাজপথে নেমে আসে। মরক্কো, ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপাইন, কেনিয়া ও পেরুতে জেন-জি রাজনৈতিক স্থিতাবস্থা প্রত্যাখ্যানের ডাক দিয়ে বিক্ষোভ প্রদর্শন করেছে। মুসলিম বিশ্বের বাইরে খোদ যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, অস্ট্রেলিয়াসহ পশ্চিমা বিশ্বের বিভিন্ন দেশে জেন-জি গাজা গণহত্যার বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে রাজপথে বিক্ষোভ প্রদর্শন করে।

বিশ্বব্যাপী তরুণদের অসন্তোষের এ ঢেউয়ের পেছনের কারণ কী? বিভিন্ন দেশে ভিন্ন ভিন্ন কারণে এ বিক্ষোভ দানা বেঁধেছে। কারণ নানা দেশের সমস্যা এবং রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট ভিন্ন। অবশ্য এ বিক্ষোভ ও আন্দোলনের কিছু সাধারণ বৈশিষ্ট্য রয়েছে। এসব বিক্ষোভ মূলত ক্ষমতাসীনদের বিরুদ্ধে। কর্তৃত্ববাদী শাসনব্যবস্থা, অযোগ্যদের শাসন, সমাজের ওপরতলা তথা অভিজাত শ্রেণীর দুর্নীতি, ক্রমবর্ধমান বৈষম্য এবং অর্থনৈতিক অবনতিশীল অবস্থার মধ্যে নিহিত রয়েছে। দেশে দেশে বেকারত্ব বৃদ্ধিও এসব বিক্ষোভের একটি অন্যতম কারণ।

যেসব দেশে তরুণ জনসংখ্যা বেশি, সেসব দেশে বিক্ষোভের ঘটনা ঘটছে বেশি। তাই জনসংখ্যার চিত্র ও এসব প্রতিবাদ বিক্ষোভের পরিণতির একটি বড় কারণ। যেহেতু তরুণরা শক্তি ও তারুণ্যের প্রতীক, তাই তারা এসব প্রতিবাদে শক্তি সঞ্চার করেছে। প্রযুক্তির এই যুগে তরুণরা তাদের আন্দোলন ছড়িয়ে দিতে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে। তরুণসমাজ তাদের বার্তা ছড়িয়ে দিতে ইন্টারনেট ও যোগাযোগ প্রযুক্তি ব্যাপকভাবে ব্যবহার করছে। জেন-জির রাজনৈতিক আন্দোলনে ডিজিটাল প্রতিবাদ বর্তমানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।

জেন-জির ক্রোধের একটি সাধারণ লক্ষ্য হলো, রাজনৈতিক ‘নেপোবেবিস’ বা ‘নেপো কিডস’। রাজনৈতিক নেপোবেবিসকে স্বজনপ্রীতির সুবিধাভোগী হিসেবে বর্ণনা করা হয়। অর্থাৎ- আত্মীয়তা বা স্বজনপ্রীতির মাধ্যমে যাদের রাজনৈতিক সুবিধা দেয়া হয় এমন কারো সন্তান, যিনি স্বজনপ্রীতির কারণে রাজনৈতিক উচ্চপদে আসীন হন। যেমন- বাংলাদেশ, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা এবং কিছু ক্ষেত্রে ভারতেও এসব অবস্থা বিদ্যমান রয়েছে।

পারিবারিক বা বংশানুক্রমিক রাজনৈতিক ধারা- বাংলাদেশে যেমন শেখ মুজিবুর রহমান- তার মেয়ে শেখ হাসিনা, পাকিস্তানে জুলফিকার আলী ভুট্টো- তার মেয়ে বেনজির ভুট্টো ও বেনজিরের ছেলে বিলওয়াল, শ্রীলঙ্কায় বন্দরনায়েকের স্ত্রী সিরিমাভো বন্দরনায়েক, তাদের মেয়ে চন্দ্রিকা বন্দরনায়েক কুমারাতুঙ্গা ও পাকসে পরিবার, ভারতে মতিলাল নেহরুর ছেলে জওয়াহেরলাল নেহরু, জওয়াহেরলালের মেয়ে ইন্দিরা গান্ধী, পরবর্তী সময়ে তার ছেলে রাজীব গান্ধী- রাজীবের স্ত্রী সোনিয়া এবং তাদের ছেলে রাহুল গান্ধী প্রমুখ।

নেপোবেবিসদের মধ্যে স্বামী-স্ত্রী বা ভাইবোন অন্তর্ভুক্ত থাকেন; যারা পারিবারিক সূত্রে রাজনীতিতে আসেন। এটি তাদের সন্তানদের (নেপো কিডস) মধ্যেও বিস্তৃত। পারিবারিক রাজনীতির সুবিধাভোগীরা তাদের মা-বাবার অবস্থান থেকে সুবিধা গ্রহণ করেন। একই সাথে জাঁকজমকপূর্ণ ও বিলাসবহুল জীবনযাপন করেন। সাধারণত গণতান্ত্রিক দেশের জনগণ ও তরুণসমাজ পারিবারিক কারণে রাজনৈতিক ব্যবস্থার ওপর আধিপত্যকে ভালো চোখে দেখে না, তারা এতে বিরক্তি প্রকাশ করে। নতুন প্রজন্ম চায় যোগ্যতা ও মেধার ভিত্তিতে নতুন নেতৃত্ব গড়ে উঠুক।

জেন-জি বিক্ষোভের প্রভাব অন্য দেশেও প্রভাব ফেলেছে। এক দেশের তরুণরা অন্য দেশের প্রতিবাদকারীদের দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়েছে। বিদ্যমান অবস্থার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ এবং পরিবর্তন ও নতুন ব্যবস্থার দাবি স্পষ্টত বিভিন্ন দেশের বিক্ষোভকারীদের সংহতির সাথে যুক্ত করেছে। উদাহরণস্বরূপ, নেপালের বিক্ষোভকারীরা মিডিয়া সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন- তারা বাংলাদেশের ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান এবং ইন্দোনেশিয়ার বিক্ষোভ দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়েছেন। মাদাগাস্কারের তরুণরা নেপালকে অনুকরণীয় উদাহরণ হিসেবে দেখেছেন। কেউ এটিকে সংক্রামক বিদ্রোহ বলে অভিহিত করেছেন।

বাংলাদেশ ও শ্রীলঙ্কাসহ বেশ কয়েকটি দেশের বিক্ষোভ নেপোবেবিসদের প্রতি বিদ্বেষ স্পষ্টভাবে দেখা গেছে। নেপালে রাজনৈতিক নেতাদের সন্তানদের বিলাসবহুল জীবন যাপনের বিরুদ্ধে ক্ষোভ জেন-জিদের বিক্ষোভকে উজ্জীবিত করেছে। সোস্যাল মিডিয়ায় #হবঢ়ড়শরফং হ্যাশট্যাগটি লাখ লাখ অনুসারী পেয়েছে। রাজনীতিবিদদের সুবিধাভোগী সন্তানদের বিলাসবহুল গাড়ি এবং আনুষঙ্গিক নানা আঙ্গিকের পোস্ট করা ছবি ভাইরাল হয়েছে। এতে সাধারণ নেপালিদের জীবনযাত্রার সাথে শাসকগোষ্ঠীর জীবনযাপনের পার্থক্য স্পষ্টভাবে ফুটে উঠেছে। এগুলো বিক্ষোভকারীদের আরো ক্ষুব্ধ করে তোলে। ইন্দোনেশিয়াতেও #হবঢ়ড়নধনরবং একটি সোস্যাল মিডিয়ার ট্রেন্ড হয়ে ওঠে।

বাংলাদেশের ছাত্র নেতৃত্বাধীন গণবিক্ষোভের সূত্রপাতের স্ফুলিঙ্গ ছিল সরকারি চাকরিতে বৈষম্যমূলক কোটা। শেষ পর্যন্ত আদালত কোটা পদ্ধতির সংস্কার করলেও বিক্ষোভ থামেনি। জুলাইয়ের ছাত্র আন্দোলন সরকারের বিরুদ্ধে একপর্যায়ে গণ-অভ্যুত্থানে রূপান্তরিত হয়। ছাত্র-জনতার ওপর নির্বিচারে গুলিবর্ষণ হাসিনার জন্য বুমেরাং হয়ে দাঁড়ায়। ছাত্র-জনতা বন্দুকের নলের মুখে বুক পেতে দেন। রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তাবাহিনীর হত্যা, দমন-পীড়ন উপেক্ষা করে এক হাজার ৪০০ ছাত্র-জনতার জীবন বিলিয়ে দেয়ার মধ্য দিয়ে ঐতিহাসিক গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে শেখ হাসিনা ভারতে পালিয়ে যেতে বাধ্য হন। এতে করে বাংলাদেশ দীর্ঘ ১৭ বছর পর স্বৈরশাসনের কবল থেকে মুক্ত হয়। এ অভূতপূর্ব রক্তস্নাত বিপ্লবের পর বাংলাদেশে নোবেলবিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার নতুন বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয় নিয়ে পথচলা শুরু করে।

সামাজিক মাধ্যম বন্ধ করা ঘিরে নেপালে ‘জেন-জি’ আন্দোলন শুরু হয়েছিল। এটিকে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা রোধ করার অপচেষ্টা হিসেবে দেখা হয়। আর অসন্তেষের আরো গভীর কারণ ছিল জনগণের সাথে শাসকগোষ্ঠীর যোগাযোগের বাইরে থাকা, সামাজিক বৈষম্য, দুর্নীতি, ভিন্নমত দমন ও অর্থনৈতিক অবস্থার অবনতি। তরুণ-বিক্ষোভকারীদের ওপর দমন-পীড়নের ফলে বহু মানুষ প্রাণ হারান। এতে বিক্ষোভ আরো তীব্র হয়ে ওঠে। নেপালের অগ্নিশিখা শুধু সে দেশের জন্য নয়- এটি গোটা দক্ষিণ এশিয়ার জন্য একটি সতর্কবার্তা। দুর্নীতি, অভিজাততন্ত্র ও বৈষম্যের অবসান ঘটাতে তরুণদের হঠাৎ বিক্ষোভ প্রধানমন্ত্রী কে পি শর্মা অলিকে ক্ষমতাচ্যুত এবং নেপালের ভঙ্গুর গণতন্ত্রের ভিত কাঁপিয়ে দিয়েছে। নেপালের অস্থিরতা আলাদা কোনো ঘটনা নয়। বাংলাদেশে শেখ হাসিনার পতন এবং ২০২২ সালে শ্রীলঙ্কার অর্থনৈতিক ধস- সেটির কারণে রাজাপাকসে পরিবারকে সরিয়ে দেয়া হয় ক্ষমতা থেকে, সেটিও তাদের অনুপ্রাণিত করে।

মাদাগাস্কারে পানির অভাব এবং বিদ্যুৎ বিভ্রাট ছিল অস্থিরতা ও বিক্ষোভের কারণ। কিন্তু এর পটভূমি ছিল দেশের দারিদ্র্য। স্বজনপ্রীতির বিরুদ্ধে জনগণের ঘৃণা এবং দীর্ঘ দিনের খারাপ শাসনের অভিযোগ। বিক্ষোভে সেখানে সরকারের পতন ও সামরিক অভ্যুত্থান সংঘটিত হয়। মরক্কোতেও উন্নত স্বাস্থ্যসেবা ও শিক্ষার দাবিতে বিক্ষোভ হয়। দুর্নীতি ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে মানুষ সোচ্চার হয়। ফলে সরকার সামাজিক সংস্কার ঘোষণা করতে বাধ্য হয়।

দেশে দেশে তরুণদের বিক্ষোভ ফলপ্রসূ হচ্ছে। তরুণসমাজের বিক্ষোভে সরকারের পতন, নতুন করে সংস্কারের প্রতিশ্রুতি থেকে শুরু করে কোনো কোনো দেশে সামরিক অভ্যুত্থানও ঘটেছে। তবে সামরিক অভ্যুত্থান কোনো সমাধান দিতে পারবে বলে মনে হয় না। সংস্কার ও জন-আকাক্সক্ষার বাস্তবায়ন এসব অস্থিরতার প্রকৃত সমাধান। জন-আকাক্সক্ষার বিপরীতে গিয়ে দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠার কারণে দেশে দেশে জেন-জির বিদ্রোহ দেখা দিয়েছে। তাই একবিংশ শতাব্দীতে তরুণসমাজের মধ্যে যে নতুন উদ্দীপনা দেখা দিয়েছে তা যদি বিভিন্ন দেশ ধারণ করে জনসম্পৃক্ত কর্মসূচি নিয়ে এগিয়ে যায় তাহলে এ অস্থিরতার অবসান ও দেশে দেশে আবার শান্তি ফিরে আসবে বলে পর্যবেক্ষক মহল আশা করে। তাই শাসকগোষ্ঠীকে দেশ পরিচালনার পুরনো ব্যবস্থা সংস্কার করে জনকল্যাণকামী নতুন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার প্রত্যয় নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে।