ব্যবসায়-বাণিজ্য, বিনিয়োগ প্রসঙ্গে ইসলামের বিধান অত্যন্ত স্পষ্ট। ইসলাম এবং পারস্পরিক কল্যাণ ও সমঝোতার ভিত্তিতে পরিচালিত নির্ভেজাল ব্যবসায়-বাণিজ্যকে গুরুত্বসহকারে শুধু অনুমোদনই করে না; বরং সে ব্যবসায়-বাণিজ্য পরিচালনা কল্যাণকর বলেছে। এতদসংক্রান্ত আল কুরআনের ভাষ্য- ‘আল্লাহ বেচাকেনা বৈধ ও সুদ অবৈধ করেছেন।’ (সূরা বাকারা-৭৫) ‘নগদ আদান-প্রদান ব্যতীত যেকোনো লেনদেন, তা ছোট হোক আর বড়, মেয়াদসহ লিখতে কোনো বিরক্ত না হওয়া।’ (সূরা বাকারা-২৮২) ‘পরস্পর রাজি হয়ে ব্যবসায় করা বৈধ।’ (সূরা নিসা-২৯) ‘সেসব লোক, যাদেরকে ব্যবসায়-বাণিজ্য এবং ক্রয়-বিক্রয় আল্লাহর স্মরণ থেকে এবং সালাত কায়েম ও জাকাত প্রদান করা থেকে বিরত রাখে না, তারা ভয় করে সেদিনকে যেদিন তাদের অন্তর ও দৃষ্টি বিপর্যস্ত হয়ে পড়বে।’ (সূরা আন নূর-৩৭) ‘সালাত সমাপ্ত হলে তোমরা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়বে এবং আল্লাহর অনুগ্রহ সন্ধান করবে ও আল্লাহকে বেশি স্মরণ করবে যাতে তোমরা সফলকাম হও।’ (সূরা জুমুআ-১০) ‘আল্লাহ হিসাব গ্রহণে তৎপর।’ (সূরা আন নূর-৩৯, সূরা আনআম-৬২, সূরা নিসা-৬, সূরা আলে ইমরান-১৯৯)
হজরত মুয়াজ ইবনে জাবাল রা: বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন, ‘সর্বাপেক্ষা পবিত্র রোজগার হচ্ছে ব্যবসায়ীদের। তবে শর্ত হচ্ছে, তারা যখন কথা বলবে তখন মিথ্যা বলবে না। কোনো আমানতের খেয়ানত করবে না। কোনো পণ্য ক্রয় করার সময় সেটিকে মন্দ সাব্যস্ত করে মূল্য কম দেয়ার চেষ্টা করবে না। নিজের মাল বিক্রয় করার সময় সে মালের অযথা তারিফ করে ক্রেতাকে বিভ্রান্ত করবে না। তার নিজের কাছে অন্যের ধার থাকলে পাওনাদারকে অযথা ঘুরাবে না। অপর পক্ষে সে কারো কাছে কিছু পাওনা হলে তাকে উত্ত্যক্ত করবে না।’ অন্য এক হাদিসে বলা হয়েছে, ‘যারা আল্লাহকে ভয় করে, সৎভাবে লেনদেন করে এবং সত্য বলে- সেসব লোক ছাড়া কিয়ামতের দিন ব্যবসায়ীরা গোনাহগারদের কাতারে উত্থিত হবে।’ বস্তুত যেসব ক্ষেত্রে ব্যবসার নামে সুদ, জুয়া, ধোঁকা-প্রতারণা ইত্যাদির আশ্রয় নিয়ে অন্যের সম্পদ হস্তগত করা হয়, সেসব পন্থায় সম্পদ অর্জন করা বৈধ ব্যবসার অন্তর্ভুক্ত নয়; বরং হারাম ও বাতিলপন্থা। তেমনি যদি স্বাভাবিক ব্যবসায়ের ক্ষেত্রেও লেনদেনের মধ্যে উভয়পক্ষের আন্তরিক সন্তুষ্টি না থাকে, তবে সেরূপ ক্রয় বিক্রয়ও বাতিল ও হারাম।
ইসলামের দৃষ্টিতে ব্যবসায়-বাণিজ্য ও পারস্পরিক লেনদেনে স্বচ্ছতা, বৈধতা ও সুষ্ঠুতা যেসব মৌলিক নীতিমালার ওপর নির্ভরশীল তার মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখ্য-
১. পারস্পরিক সাহায্য-সহযোগিতার মনোভাব। মুনাফার ক্ষেত্রে একজনের বেশি মুনাফা আর অপরজনের বেশি লোকসানের মনোভাব অবশ্যই পরিত্যাজ্য।
২. পারস্পরিক স্বতঃস্ফূর্ত সম্মতি। জোরপূর্বক সম্মতি আদায় বৈধ বলে গণ্য হবে না।
৩. লেনদেনে উভয়পক্ষকে বিবেক বুদ্ধিসম্পন্ন, প্রাপ্তবয়স্ক ও স্বাধীন হতে হবে। অবুঝ, অপ্রাপ্ত বয়স্ক, পাগল হলে ব্যবসার চুক্তি সম্পাদন বৈধ সাব্যস্ত হবে না।
৪. কোনো প্রকার প্রতারণা, আত্মসাৎ, ক্ষতি ও পাপাচারের উদ্দেশ্য থাকতে পারবে না। যেসব বস্তুর কারবার হারাম, সেসবের ব্যবসায় করা যাবে না।
নামাজ শেষ হলে ‘আল্লাহর অনুগ্রহ সন্ধানে’ বেরিয়ে পড়ার নির্দেশনার মধ্যে ব্যবহারিক জীবনের বাস্তব প্রয়োজনীয়তার প্রতি মনোযোগ দেয়া কর্তব্য হিসেবে সাব্যস্ত করা হয়েছে। বস্তুত ইসলামে বৈরাগ্য সাধনার স্বীকৃতি নেই। ব্যবহারিক সংসার যাত্রার দাবিকে জীবনের জন্য অপরিহার্য বিবেচনা করা হয়। ইবাদত-বন্দেগির পাশাপাশি দৈনন্দিন জীবনের দাবির প্রতিও দায়িত্বশীল হওয়ার আবশ্যকতা রয়েছে।
যে ব্যবসায়-বাণিজ্য ও বিনিয়োগের দ্বারা কল্যাণকর পণ্য বা সামগ্রী উৎপন্ন তথা বিপণন হয়, কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়, দেশজ সম্পদ উৎপাদনে গঠনমূলক অবদান রাখতে সক্ষম হয় সে ব্যবসায়-বাণিজ্য কল্যাণকর অবশ্যই। এ জাতীয় বাণিজ্য, বিনিয়োগ, ব্যবসার দ্বারা মানুষের উপকারের সুফল যত দিন কায়েম থাকবে তত দিন বিশেষ সওয়াব হাসিল হতে থাকবে ওই বিনিয়োগকারীর। রাসূল সা: ইরশাদ করেন, ‘সৎ ও আমানতদার ব্যবসায়ী হাশরের দিন নবীগণ, সিদ্দিকিন ও শহীদদের সাথী হবে।’
অর্থবিত্ত অর্জন ও ব্যয়-ব্যবহার সম্পর্কে আল কুরআনের নির্দেশনা- ‘অন্যের জন্য তোমরা যা কিছু ব্যয় করো বা যা কিছু তোমরা মানত করো, আল্লাহ সবই জানেন। (দান না করে অর্থ কুক্ষিগত করা জুলুম)। আর এই জালেমদের কোনো সাহায্যকারী থাকিবে না।’ (সূরা বাকারা-২৭০)
‘(হে মানুষ)। যে অর্থবিত্ত তোমরা দান করো, সে দান তো তোমাদের নিজেদের কল্যাণের জন্য। তোমরা তো আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য ব্যয় করো। অতএব দানের পুরোপুরি প্রতিদান তোমাদেরকে অবশ্যই দেয়া হবে। তোমাদের হক কখনো নষ্ট করা হবে না। (হে বিশ্বাসীগণ মরে রেখো) বিশেষভাবে সাহায্য পাওয়ার অধিকারী হচ্ছে সেসব অভাবী, যারা আল্লাহর কাজে এমনভাবে ব্যস্ত যে, নিজের জীবিকা উপার্জনের চেষ্টা করতে পারে না। তারা কিছু চায় না বলে অবিবেচকরা মনে করে, এদের কোনো অভাব নেই। এদের দিকে তাকালেই এদের ভেতরের অবস্থা বুঝতে পারবে। এরা কখনো ভিক্ষা চায় না। এদের সাহায্যে তোমরা যে অর্থবিত্ত ব্যয় করবে তা আল্লাহর কাছে গোপন থাকবে না।’ (সূরা বাকারা : ২৭২-২৭৩)
‘হে বিশ্বাসীগণ! তোমরা একে অপরের অর্থবিত্ত অন্যায়ভাবে গ্রাস করবে না। অবশ্য তোমরা মিলেমিশে পারস্পরিক সম্মতির ভিত্তিতে ব্যবসায় করতে পারো।’(সূরা নিসা-২৯)
আর যারা নিজেরা কৃপণ এবং অন্যকে কৃপণতা করতে উৎসাহিত করে (বা দানে নিরুৎসাহিত করে) এবং আল্লাহর অনুগ্রহ-সম্পদ গোপন করে, আল্লাহ তাদেরও অপছন্দ করেন। আর যারা লোকদেখানোর জন্য অর্থবিত্ত ব্যয় করে এবং আল্লাহ ও আখিরাতে অবিশ্বাস করে, তাদের আল্লাহ অপছন্দ করেন। আসলে শয়তান কারো সঙ্গী হলে এর চেয়ে খারাপ সঙ্গ আর কিছু হতে পারে না। (সূরা নিসা : ৩৭-৩৮)
‘ওরা আল্লাহ ও তার রাসূলকে অমান্য করে, দায়সারাভাবে নামাজে হাজির হয় আর বিরক্তিসহকারে অর্থ সাহায্য করে বলেই ওদের দান গ্রহণ করতে নিষেধ করা হয়েছে। অতএব ওদের পার্থিব ধনসম্পত্তি ও সন্তানসন্ততি (থেকে প্রাপ্ত দৃশ্যমান সুখ) তোমাদের যেন মোহিত না করে। আল্লাহ তো পার্থিব জীবনে এগুলো দিয়েই ওদের শাস্তি দিতে চান। আর সত্য অস্বীকাররত অবস্থাতেই ওদের আত্মা দেহত্যাগ করবে। (সূরা তওবা : ৫৪-৫৫)
‘জাকাত তো শুধু- ১. দরিদ্র, ২. অক্ষম, ৩. জাকাত ব্যবস্থাপনায় নিয়োজিত কর্মচারী, ৪. যাদের মন জয় করা প্রয়োজন, ৫. দাসত্ব থেকে মুক্তির জন্য, ৬. ঋণ জর্জরিত অবস্থা থেকে পরিত্রাণের জন্য, ৭. আল্লাহর পথে (জনকল্যাণমূলক কাজ), ধর্ম প্রচার ও প্রতিষ্ঠার কাজে এবং ৮. মুসাফিরদের জন্য ব্যয় করা যাবে। (জাকাতের অর্থ ব্যয়ে) এটিই আল্লাহর বিধান। নিশ্চয়ই আল্লাহ সর্বজ্ঞ, প্রজ্ঞাময়।’ (সূরা তওবা-৬০)
‘সে কি মনে করে (অন্যায় ও পাপাচার করলেও) তাকে কারো কাছে জবাবদিহি করতে হবে না? সে বলে আমি প্রচুর অর্থ উড়িয়ে দিয়েছি। সে কি মনে করে, কেউ তা দেখেনি।’ (সূরা বালাদ : ৫-৭)
‘(দুর্ভোগ এমন প্রত্যেক ব্যক্তির জন্য, যে কৃপণের মতো) অর্থ জমায় আর বারবার তা গণনা করে এবং একে নিজের রক্ষাকবচ মনে করে।’ (সূরা হুমাজাহ-২)
কোভিড-১৯ মহামারীর পর বাংলাদেশসহ প্রায় প্রতিটি অর্থনীতিতে ব্যাপক দুর্যোগ, দুরবস্থা ও দুর্ভোগ নেমে আসে। দ্রব্যমূল্য, জ্বালানি ও খাদ্যসঙ্কটের সমস্যার আভাস দিয়েই চলছে ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ, মধ্যপ্রাচ্যে সমর সঙ্ঘাত আর অতি সম্প্রতি পাকিস্তানের পায়ে পাড়া দিয়ে ভারতের বাধানো যুদ্ধ। বাংলাদেশের অর্থনীতিতে, বিশেষ করে জীবন ও জীবিকার ক্ষেত্রে চব্বিশের জুলাই-আগস্ট অভ্যুত্থান এবং দূরের ও কাছের যুদ্ধের অভিঘাত ব্যাপক, কেননা এ দেশের বেশির ভাগ মানুষ নিম্ন ও মধ্যবিত্তের বলয়ে, এখানে উচ্চবিত্তের সাথে মধ্য ও নিম্নবিত্তের আনুভূমিক ও উলম্ব সম্পর্কের দূরত্ব সাধারণ সমীকরণ ও সূচকের ধারে কাছে নয়। পতিত সরকারের রেখে যাওয়া দুর্বল ও ফোকলা অর্থনীতিতে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি ও মাতামাতিতে আয় উপার্জনের জন্য মুখিয়ে থাকা দেশের অধিকাংশ মানুষকে ব্যর্থ মনোরথের পথে নিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশের অর্থনীতি ঈদুল আজহার সাথে সংশ্লিষ্ট হজব্রত পালন ও কোরবানি উপলক্ষে জেগে ওঠার হাতছানি দিচ্ছে। কেননা, এই উৎসব উপলক্ষেই আয়-ব্যয় বণ্টনপ্রক্রিয়ার মাধ্যমে বৈষম্য দূরীকরণের, সম্পদ ভাগাভাগির এবং মধ্য ও নিম্নবিত্তের জীবিকা নির্বাহের একটি সুযোগ বা উপায় উপস্থিত হতে পারে। সে নিরিখে করোনার সাথে সংগ্রামে এবং পতিত সরকার সৃষ্ট দুরবস্থায় বৈষম্যের বিবরে বাংলাদেশের অর্থনীতি জেগে ওঠার মতো আগের ডজনখানিক উৎসব আয়োজন পালন হাতছাড়া হয়েছে, অর্থাৎ গত বছর এই একই সময়ে আগের রাউন্ডে হাতছাড়া হওয়ার পর সবাই পরের বার সব ঠিক হওয়ার যে আশায় বুক বেঁধেছিল এবং এবারের এই উৎসব আয়োজনের জন্য বেশ কিছু বাড়তি বিনিয়োগেও নেমেছে সবাই। এবার যেন সেগুলো মন্দ বিনিয়োগে পরিণত না হয় সেদিকে লক্ষ রাখতে হলে আল কুরআনের আলোকে ব্যবসায়-বাণিজ্য, বিনিয়োগের ক্ষেত্রে যে নির্দেশনা তা অনুসরণ আবশ্যক।
লেখক : সাবেক সচিব, এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান