বাংলাদেশের আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে রাজনৈতিক দলগুলো নির্বাচনী ইশতেহার, জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষা এবং অংশগ্রহণমূলক প্রতিশ্রুতি নিয়ে এগোচ্ছে। গণমানুষের মূল দাবি স্বচ্ছ, অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন, আইনশৃঙ্খলা ও সামাজিক উন্নয়ন- এগুলো সব রাজনৈতিক দলের ইশতেহারের অংশ হিসেবে উঠে আসছে। নির্বাচনের আগে রাজনৈতিক দলগুলোর ভিতরে ইশতেহার নিয়ে যতটা উৎসাহ-উদ্দীপনা দেখা যায়, নির্বাচন-উত্তর এই বিষয়ে ততটা উদাসীন হয়ে পড়তে দেখা যায়। বাংলাদেশের নাগরিকরা আশাবাদী হয়ে ভোটকেন্দ্রে যান এবং ভোট দেন।
ভোটের পর বিজয়ী দল সরকার গঠন করলেও ইশতেহারের প্রতিশ্রুতির কথা বেমালুম ভুলে যান। অতীতে যারা ক্ষমতায় এসেছিলেন প্রায় সব সরকারের মধ্যে এই উদাসীনতা লক্ষ করা গেছে। তাই এবারের তরুণ ও যুবশ্রেণী রাজনৈতিক দলগুলোর ইশতেহার, তাদের মুখের ভাষা, বাচনভঙ্গি, চরিত্র ও আদর্শিক বিষয়গুলো বিবেচনায় নিয়ে নিজেদের পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দেয়ার প্রত্যাশা করে। এটি নির্ভর করবে নির্বাচন কতটা অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য হবে তার ওপর। সরকার আগামী ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তারিখ ২০২৬ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি নির্ধারণ করে প্রস্তুতি গ্রহণ করছে। নির্বাচন কমিশন (ইসি) এ লক্ষ্যে কাজ করছে।
রাজনৈতিক পরিস্থিতি বহুল আলোচিত ও উত্তেজনাপূর্ণ; সব দল অন্তর্ভুক্তিমূলক ও স্বচ্ছ নির্বাচনের দাবি তুলছে। এদিকে ভোটারদের মধ্যে বেশির ভাগ মানুষ চান নির্বাচনে অংশগ্রহণমূলক, অবাধ ও সুষ্ঠু পরিবেশ তৈরি হোক। বড় ছোট সব রাজনৈতিক দল ইতোমধ্যে পুরোদমে নির্বাচনী প্রস্তুতি নিচ্ছে। ভোটারদের দ্বারে দ্বারে যাওয়া শুরু করেছে। দলগুলোর দলীয় নির্বাচনী ইশতেহারও সাজাচ্ছে। দীর্ঘদিন জনগণ ভোট দিতে পারেননি, সুযোগ পাননি। এবার যেহেতু স্বৈরাচার হাসিনা দেশ ছেড়ে পালিয়েছে ও অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় রয়েছে; সেহেতু জনগণের প্রত্যাশা তারা স্বাধীনভাবে মতপ্রকাশ করার সুযোগ পাবেন। আমাদের স্পষ্ট ভিশন দরকার, আমরা কোথায় পৌঁছাতে চাই। আমাদের ভিশন হওয়া উচিত বাংলাদেশকে দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে সুখী দেশ হিসেবে গড়ে তোলা। অথচ পরিসংখ্যান বলে, সুখী দেশের সূচকে আমাদের অবস্থান দ্রুত পিছিয়েছে। আমরা উন্নয়ন নিয়ে কথা বলি, জিডিপি নিয়ে গর্ব করি, কিন্তু অর্থনীতির মৌলিক সংস্কার, সামাজিক সহায়তা, সাম্য ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা এবং মানুষের প্রতি সহানুভূতির মতো বিষয়গুলো জনপরিসরে আলোচনায় গুরুত্ব পায় না। উল্টো বৈষম্য ও দুর্নীতি যেন সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঢুকে পড়েছে। যার প্রমাণ বিগত স্বৈরাচারী আওয়ামী লীগের শাসনামল। তাই আগামী সংসদ নির্বাচনে রাজনৈতিক দলগুলোর ইশতেহারে নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণে দুর্নীতিমুক্ত দেশগঠন, স্থিতিশীলতা, সহানুভূতি ও ইতিবাচক রাজনৈতিক সংস্কৃতির কথা উল্লেখ থাকা চাই। বর্তমানে বাংলাদেশের যেসব রাজনৈতিক দল রয়েছে বিশেষ করে বিএনপি, বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী, জাতীয় নাগরিক পার্টি- এনসিপি, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ, এবি পার্টি, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসসহ সব দল নিজেদের নির্বাচনী ইশতেহার তৈরি করছে। সবার প্রত্যাশা এবারের ইশতেহার গতানুগতিক হবে না।
বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল- বিএনপি
বিএনপি ৩১ দফা কেন্দ্র করে ও জন-আকাঙ্ক্ষাকে গুরুত্ব দিয়ে প্রস্তুত করছে দলীয় নির্বাচনী ইশতেহার। বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক শামা ওবায়েদ এক গোলটেবিল বৈঠকে বলেন, পাহাড় থেকে সমতলে বৈষম্য দূরীকরণের বিষয়ে বিএনপি আরো চার বছর আগে থেকে সংস্কারের কথা বলে আসছে। সবার জন্য শিক্ষা এবং স্বাস্থ্য কিভাবে নিশ্চিত করা যাবে, তা-ও বিএনপির ৩১ দফায় রয়েছে। তিনি বলেন, বিভিন্ন ধর্মের, দলের, মতের মানুষের মধ্যে ঐক্য নিশ্চিত করা গেলে দেশের উন্নয়ন সম্ভব। এর জন্য বিএনপির ৩১ দফায় ‘রেইনবো ন্যাশনে’র কথা বলা হয়েছে। প্রান্তিক, পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীকে যদি জাতিগঠনে, রাষ্ট্র সংস্কারে যুক্ত করা যায়, তাহলে আদতে একটি ‘পজিটিভ ন্যাশন’ গড়ে উঠবে। সেই জায়গাতে বিএনপি কাজ করছে। বিএনপি তাদের নির্বাচনী ইশতেহার ও পরিকল্পনা প্রস্তুত করছে, যার মধ্যে শিক্ষা, কর্মসংস্থান, স্বাস্থ্য, দুর্নীতি প্রতিরোধ, মানবাধিকার এবং শাসনব্যবস্থার সংস্কারের প্রতিশ্রুতি অন্তর্ভুক্ত থাকবে। এ ছাড়া দলটির উচ্চ পর্যায়ের নেতারা বলছেন যে, ভবিষ্যৎ সরকারকে আইনের শাসন, স্বাধীন বিচারব্যবস্থা ও গণতান্ত্রিক সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিত করতে হবে।
বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী
বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর ইশতেহারে দুর্নীতিকে লাল কার্ড দেখানোর বিষয়টি গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। জানা গেছে, জামায়াত নারীদের কর্মসংস্থান, শিক্ষা, নিরাপত্তার বিষয়গুলোকেও ইশতেহারে গুরুত্বের সাথে তুলে ধরবে। জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার বলেন, তারা ‘জনতার ইশতেহার’ নামে একটি জনমুখী ও বাস্তবসম্মত ইশতেহার প্রস্তুত করছেন, যেখানে জনগণের মতামত ও সহযোগিতা প্রতিফলিত হবে।
এই ইশতেহার প্রচলিত দলীয় ইশতেহার থেকে আলাদা করে জনমতের ভিত্তিতে গঠিত হচ্ছে বলে দাবি করেন তিনি।
জাতীয় নাগরিক পার্টি-এনসিপি
দল হিসেবে এনসিপি নির্বাচনী ইশতেহারে তরুণ জনগোষ্ঠীর জন্য কর্মসংস্থান নিশ্চিত করার বিষয়টি অগ্রাধিকার দেবে বলে দলটির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম আহ্বায়ক আরিফুল ইসলাম আদীবের এক ভাষ্য থেকে জানা যায়। তিনি বলেন, নারীদের জন্য গৃহস্থালির কাজসহ সব পরিশ্রমের স্বীকৃতি, নিরাপদ কর্মক্ষেত্র, উত্তরাধিকার নিশ্চিত, মাতৃত্বকালীন ছয় মাসের ছুটির প্রতিশ্রুতি থাকবে এনসিপির ইশতেহারে। পাশাপাশি নির্বাচনে ১৫ শতাংশ নারী প্রার্থীকে মনোনয়ন দেবে এনসিপি। এ ছাড়া বৈষম্য দূর করে সব জাতি গোষ্ঠীকে আলাদা জাতিসত্তার সাংবিধানিক স্বীকৃতি ও মাতৃভাষায় শিক্ষার ব্যবস্থা করার কথাও ইশতেহারে উল্লেখ থাকার কথা বলেছেন তিনি।
তবে বিশ্লেষকরা বলছেন, জুলাইয়ের আকাঙ্ক্ষা অর্থাৎ জন-অভিপ্রায়, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ও মানবাধিকারের প্রসঙ্গ কিভাবে থাকবে, দেশের অর্থনীতি কিভাবে সাজানো হবে, আর্থিক খাতের অনিয়ম ও দুর্নীতি নির্মূলসহ তা নিয়ে আলাপ করা জরুরি।
কেমন বাংলাদেশ চাই
গত ৫৪ বছরের ব্যবস্থার একটি মৌলিক পরিবর্তনের আকাঙ্ক্ষা অর্থাৎ নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণের জন-অভিপ্রায় তীব্রতর হয়েছে। এত বছর পরও নাগরিকের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়নি। সামাজিক অবস্থান, ধর্মীয় পরিচয়, পেশা, শিক্ষাগত যোগ্যতা ও ভৌগোলিক অবস্থানে মানুষ প্রতিনিয়ত বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন।
শিক্ষাক্ষেত্রে এ বৈষম্য সবচেয়ে স্পষ্ট। পেশাগত ক্ষেত্রেও একই চিত্র বিদ্যমান রয়েছে। রাষ্ট্রীয় প্রশাসনে থাকা ব্যক্তিরা যে সেবা পান, একজন গার্মেন্টস শ্রমিক বা নিম্ন আয়ের মানুষ তা পান না। জুলাই-আগস্টের গণ-অভ্যুত্থানের কেন্দ্রে ছিল জীবিকার নিরাপত্তা। জীবিকার প্রশ্ন সামনে আসাতে তরুণেরা রাজপথে নেমেছেন। এতে বোঝা যায়, আমাদের সমাজ-রাষ্ট্রে বৈষম্য কত গভীরে প্রোথিত রয়েছে।
নতুন বাংলাদেশের প্রথম শর্ত কর্মসংস্থানের নিশ্চয়তা। একজনের চাকরি মানে একটি পরিবারের নিরাপত্তা। একই সঙ্গে রাষ্ট্রীয় সেবায় নাগরিক পরিচয়ের বাইরে কোনো বৈষম্য চলতে পারে না; জবাবদিহি নিশ্চিত করতে হবে। বাংলাদেশে শিক্ষা এবং স্বাস্থ্য এ দু’টি খাতে বাজেট বরাদ্দ কম। এটা বাড়াতে হবে। এ দেশের সবাই নাগরিক অর্থাৎ হিন্দু, মুসলমান, পাহাড়ি বা সমতলের মানুষ কাউকে আলাদা করে দেখার সুযোগ নেই। পাহাড়ি অঞ্চলের শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও যোগাযোগব্যবস্থা সমতলের মতো করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব।
ইশতেহারে কী থাকা চাই
রাজনৈতিক দলগুলোর এবারের ইশতেহারে যেসব বিষয়ের গুরুত্ব দেয়া উচিত বিশেষ করে মুক্ত গণমাধ্যম, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, ডিজিটাল ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাসংক্রান্ত নীতি, সংস্কৃতির অধিকার, মানবাধিকার, ধর্মীয় ও জাতিগত বৈচিত্র্য, নারীদের অধিকার সুরক্ষা ইত্যাদি। সেই সাথে খেয়াল রাখতে হবে- তরুণেরা শুধু অর্থনৈতিক সম্পদ নয়, সাংস্কৃতিক ও নৈতিক সম্পদ হিসেবেও মূল্যায়িত করতে হবে তাদের।
জুলাই গ্রাফিতির বার্তা অনুযায়ী, তরুণদের আকাঙ্ক্ষা, সমাজে ন্যায়বিচার, বৈষম্যবিরোধী সংস্কৃতি ও অন্তর্ভুক্তিমূলক নীতি ইশতেহারে প্রতিফলিত হতে হবে। শিক্ষার ন্যায্যতা, কর্মসংস্থান ও সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে। নির্বাচনের প্রেক্ষাপটে ইশতেহার শুধু প্রতিশ্রুতি নয়, বাস্তবায়নযোগ্য নীতি হিসেবে তৈরি হওয়া প্রয়োজন। শুধু ক্ষমতা বা অর্থের ভিত্তিতে নয়, সংস্কৃতি, মতপ্রকাশ ও মানুষের নৈতিক শক্তি অনুযায়ী যেন তরুণেরাও স্থান পায়। জুলাই আন্দোলনে দেশের সব স্তরের জনগণ একসঙ্গে নিজেদের দাবি উত্থাপন করেছিলেন। সেই স্পিরিট এখন নীতিতে রূপান্তর করতে হবে।
ইশতেহারে যেন জুলাই আন্দোলনের চেতনা ফুটিয়ে তোলা হয়। যেখানে প্রত্যেক মানুষ সমান মর্যাদা, সুযোগ ও সুরক্ষা পাবে। ইশতেহারে থাকা উচিত দুর্নীতি, নৈতিক ও প্রশাসনিক অসঙ্গতি দূর করে স্বচ্ছতা, জবাবদিহি এবং মানবিক রাজনীতি প্রতিষ্ঠা করার কথা। থাকা উচিত সাংস্কৃতিক চর্চার অধিকার নিশ্চিত করা এবং তরুণদের সাংস্কৃতিক, নৈতিক ও মানবিক সম্পদ হিসেবে গড়ে তুলতে প্রয়োজনীয় নীতিমালা প্রণয়ন করা। নির্বাচনের আগে রাজনৈতিক দলগুলোর যেমন জনগণের সামনে সুন্দর সুন্দর ইশতেহার প্রকাশ ও প্রচার করে, ঠিক তেমনিভাবে নির্বাচনে পরে বিজয়ী হয়ে এসব পরিকল্পনা, প্রতিশ্রুতি ভুলে যাওয়াটা যেন স্বাভাবিক হয়ে গেছে। তবে এবারের নির্বাচনী ইশতেহার হতে হবে তারুণ্যনির্ভর, অন্তর্ভুক্তিমূলক।
লেখক : ব্যাংকার


