এক.
এক নতুন বাংলাদেশের আকাক্সক্ষা থেকে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার আন্দোলনের চূড়ান্ত পরিণতি জুলাই গণ-অভ্যুত্থান। এ দেশের প্রতিটি মানুষ এখন তাদের প্রত্যাশিত নতুন বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখছে, যে বাংলাদেশ হবে গণতন্ত্র, আইনের শাসন ও ইনসাফের বাংলাদেশ। সেই বাংলাদেশ গড়ার জন্যই এত রক্ত, এত জীবন, এত সংগ্রাম, এতটা বিক্ষোভ, বিদ্রোহ ও গণ-অভ্যুত্থান। কোনোভাবেই জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের মূল স্পিরিটকে আমরা ব্যর্থ হতে দেবো না।
ফ্যাসিস্ট হাসিনার ক্ষমতাকালে বাংলাদেশে নৈতিক মূল্যবোধের মারাত্মক অবক্ষয়, সামাজিক নিরাপত্তা ও শৃঙ্খলাব্যবস্থা ভেঙে পড়ার উপক্রম হয়েছিল। ব্যাঙের ছাতার মতো কিশোর গ্যাংয়ের উত্থান, চাঁদাবাজি, সন্ত্রাস ও দখল, বে-দখলের মচ্ছব চলে। আইনের শাসনের অভাবে কারো জানমালের নিরাপত্তা ছিল না। দুর্নীতি ও মাদক বিশৃঙ্খলা সমাজকে গ্রাস করে ফেলেছিল। মানুষের মৌলিক অধিকার অন্ন, বস্ত্র, শিক্ষা, চিকিৎসা ও বাসস্থানের অধিকার ছিল না, অপ্রতিরোধ্য গতিতে উন্নয়নের মিথ্যা ও গালভরা গল্প শোনানো হতো জাতিকে। হাসপাতালের করিডোরে ও ঘরে ঘরে অগণিত অসুস্থ মানুষের আহাজারি ও আদালতের বারান্দায় বারান্দায় বিচারপ্রার্থীদের আর্তনাদ আর পথে-ঘাটে লাখো বেকার ও কর্মহীনের অসহায়ত্ব আর হাহাকার দেখেও আওয়ামী ফ্যাসিস্টরা পঙ্গপালের মতো ঝাঁপিয়ে পড়ে রাষ্ট্রীয় সম্পদ লুটপাট ও পাচার করা থেকে বিরত হয়নি। বিবেক ও মনুষ্যত্বহীন একদল লুটপাটকারী ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র ও সমাজের অধিপতি বনে বসেছিল। এক দিকে ক্ষমতা দখলকারী ফ্যাসিস্ট অন্য দিকে চরিত্র ও বিবেকহীন লুটেরা মুৎসুদ্দিরা বাড়বাড়ন্ত দেশ ও সমাজকে শয়তানের অট্টহাসিতে প্রকম্পিত করেছিল।
সমাজ ও রাষ্ট্রের প্রতিটি স্তরে লুটপাট, অনাচার, বিশৃঙ্খলা আর অধিকার হরণ মানুষকে আরো বেশি অসহায় করে তোলে। সেই ভয়ঙ্কর পরিস্থিতির মধ্যেও ফ্যাসিস্টদের বুদ্ধিভিত্তিক দোসররা নীরব ও প্রতিবাদহীন থাকার কারণেই জুলাই গণ-অভ্যুত্থান ঘটে। ফ্যাসিস্ট ও তার দোসরদের প্রতি করুণার কোনো সুযোগ নেই। সেই ভয়াবহ বিপজ্জনক ভয়ঙ্কর পরিস্থিতি উপেক্ষা করে যারা রাজপথে জীবন বিপন্ন করে নতুন বাংলাদেশ গঠনের জন্য লড়াই করছেন তাদের প্রতি আমার বিনীত নিবেদন, তারা যেন সর্বদা তাদের সাথে থাকা নেতাকর্মী, নিকটাত্মীয় ও স্বজনদের কর্মকাণ্ড বিষয়ে সদা সতর্ক থাকেন। নিকটতম ব্যক্তিরা যদি বিনয়ী ও সৎ হয় তাহলে নেতার জন্য কল্যাণ বয়ে আনবে।
দুই.
অন্য দিকে সাথে থাকা নেতাকর্মী ও নিকটাত্মীয়রা যদি অসৎ ও দুর্বৃত্তপরায়ণ হয়ে পড়ে তবে তার বিপদ সরাসরি নেতার ওপর বর্তাবে। নেতাকে হতে হবে মানবিক, কর্মঠ, সৎ, পরোপকারী ও বিনয়ী। একই সাথে নেতাকে সর্বক্ষণ সতর্ক থাকতে হবে। নেতাকে নজর রাখতে হবে সারাক্ষণ তাকে ঘিরে থাকা নেতাকর্মী সমর্থক ও নিকটাত্মীয় ও স্বজনরা তার অগোচরে নেতার নাম ভাঙিয়ে বিশেষ সুবিধা নিচ্ছে কি না। নেতার অগোচরে নেতার নাম ভাঙানো কঠোর হাতে দমন করতে হবে। ৫ আগস্টের পর নাম ভাঙানোর এই আত্মঘাতী প্রবণতা ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। এমন কিছু ঘটনা এরই মধ্যে জাতির সামনে এসেছে। কিছু কিছু ব্যবস্থাও নেয়া হয়েছে যা ইতিবাচকভাবে দেখছেন দেশবাসী। কিন্তু ক্ষমতাবানদের নাম ভাঙানো ও ক্ষমতার অপব্যবহার এখন বানের পানির মতো সমাজকে তলিয়ে দেয়ার উপক্রম করেছে। সর্বত্র নৈতিক অবক্ষয় ও বিশৃঙ্খলার বিস্তার ঘটছে যা খুবই উদ্বেগজনক আলামত। ক্ষমতার অপব্যবহার, দুর্নীতি, লুটপাট আর নাম ভাঙিয়ে চলার মতো রুচিহীন কুকর্ম কঠোরভাবে দমন করতে হবে। এই কাজে যারা জড়িত তাদের বিবেক ও মনুষ্যত্ব বলে আর কিছু থাকে না। তাদের সাথে আওয়ামী দুর্বৃত্তদের কোনো পার্থক্য খুঁজে পাওয়া যায় না। নেতার পাশে থেকে নেতার নাম ভাঙিয়ে চলার চেষ্টা করলে তাদের বিরুদ্ধে সম্মিলিতভাবে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। এমন স্বভাবের লোকদের এড়িয়ে চলতে হবে।
তিন.
‘জুলাই গণ-অভ্যুত্থান’ ফ্যাসিবাদী শাসনব্যবস্থার বিরুদ্ধে বাংলাদেশের সর্বস্তরের জনগণের একটি সম্মিলিত প্রচেষ্টার নাম। এ দেশের ২০ কোটি মানুষের রাগ, ক্ষোভ, হতাশা, প্রত্যাশার নাম জুলাই। এই জুলাইয়ের চেতনায় দেশ গড়তে এ দেশের রাজনীতিবিদদের দায় ও দায়িত্ব অনেক বেশি। এই যে সমাজের সব স্তরে অব্যবস্থাপনা, অস্থিরতা, গণতন্ত্র নিয়ে মানুষের এখন ভয়, আশঙ্কা তা দূর করতে ও নতুন রাজনৈতিক ব্যবস্থা এবং চিন্তা বিনির্মাণের যে স্বপ্ন তা রাজনৈতিক দল ও নেতৃত্বকেই পূরণ করতে হবে।
দীর্ঘ দিন সমাজ ও রাষ্ট্র ফ্যাসিবাদী কর্তৃপক্ষের নিয়ন্ত্রণে থাকায় সব সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান ধ্বংস হয়ে গেছে। সব রাজনৈতিক সিস্টেম কলাপ্স করছে। এর প্রভাব পড়েছে সমাজের প্রতিটি স্তরে। উত্তরণের পথ বিনির্মাণ করবে এখন নতুন দিনের রাজনীতি। আমরা যদি সেই পথে চলতে ভুল করে ফেলি কিংবা জন-আকাক্সক্ষা ভুলে যাই, আমাদেরকেও জবাব দিতে হবে।
চার.
জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের পরে এই সরকারের কাছে মানুষের যে প্রত্যাশা সেটি পূরণ হচ্ছে না। পিএস, এপিএসদের দুর্নীতি, নানা নামে নানা সংবাদ, অনেকের বিলাসী জীবন নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত নিয়ে আশাবাদী মানুষকে হতাশ করেছে।
অন্য দিকে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যেও ঘাপটি মেরে থাকা সুবিধাভোগী শ্রেণী অত্যন্ত তৎপর। তারা দলের এবং নেতার নাম ভাঙিয়ে সম্পদ লুটপাটে বেপরোয়া হয়ে উঠেছে, যা এ দেশের প্রতিটি মানুষের আকাক্সক্ষার সম্পূর্ণ বিপরীত।
নতুন বাংলাদেশ গড়তে রাজনীতিতে নীতিনৈতিকতা ও মূল্যবোধের খুব বেশি প্রয়োজন। মানুষের সত্যিকারের সমস্যা সমাধানের জন্য ‘নতুন দিনের রাজনীতি’ সবার এজেন্ডা হতে হবে। আমরা অতীতের ‘চোরতন্ত্রে’ ফিরে যেতে চাই না। আমাদের সব ঐতিহাসিক লড়াইয়ের চেতনা ধারণ করে আমরা আগামী দিনে একটি নতুন বাংলাদেশ গড়তে চাই, যার মূল ভিত্তি হবে জাস্টিস, ন্যায়বিচার। আমাদের সবার উচিত নতুন বাংলাদেশ গড়তে রাজনীতিতে, দলে, রাষ্ট্রে, সমাজে সবখানে একটি ইতিবাচক চিন্তার লালন এবং বাস্তবায়ন করা।
লেখক : বিএনপি চেয়ারপারসনের বিশেষ সহকারী