জুলাই সনদ বাস্তবায়ন বিতর্ক ও ভবিষ্যৎ পরিক্রমা

রাজনৈতিক দল, আমলাতন্ত্র, গণমাধ্যম ও সুশীলসমাজের এই ভূমিকা আমাদের শঙ্কিত করে জুলাই বিপ্লবের ভবিষ্যৎ নিয়ে। ভয় হয় এই ভেবে যে, সেই পুরনো সঙ্কটের কোলেই কি না ফিরে যায় শহীদের স্বপ্নের সোনার বাংলাদেশ।

ন্যাশনাল চার্টার বা জাতীয় সনদ রাষ্ট্র বিনির্মাণের মূল কাঠামো ও ক্ষমতার ভারসাম্য নির্ধারণে যুগান্তকারী ভূমিকা রেখেছে। ইতিহাসের পাতা থেকে উদাহরণ দেয়া যায়; যেমন ইংল্যান্ডের ম্যাগনাকার্টা (১৫ জুন ১২১৫), যার মাধ্যমে রাজার ক্ষমতার সীমা নির্ধারণ করে রাজাকে আইনের কাছে জবাবদিহির সম্মুখীন করা হয়। এটি জনগণের অধিকার ও ন্যায়বিচারের ধারণার ভিত্তি স্থাপন করে। যার কারণে এই চার্টার আধুনিক সাংবিধানিক রাজতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার ভিত্তি হিসেবে ইতিহাসে চিরস্থায়ী স্থান করে নেয়। তেমনইভাবে, ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসন থেকে স্বাধীনতা অর্জনের পর যুক্তরাষ্ট্রে নতুন রাষ্ট্রকাঠামো গঠনের প্রয়োজন দেখা দেয়। তখন জনগণের ইচ্ছার প্রতিফলনে গঠন করা হয় একটি ফেডারেল প্রজাতন্ত্রের কাঠামো, যেখানে নির্বাহী, আইনসভা ও বিচার বিভাগকে পৃথক ক্ষমতা দিয়ে তৈরি করা হয় চেকস অ্যান্ড ব্যালেন্স মডেল। আগের দুর্বল আর্টিকেলস অব কনফেডারেশনের পরিবর্তে প্রতিষ্ঠিত করা হয় শক্তিশালী কেন্দ্রীয় সরকার। যার মাধ্যমে আমেরিকান সংবিধান (১৭৮৭ সাল) পৃথিবীজুড়ে সংবিধানভিত্তিক গণতন্ত্রের মডেল হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়।

রাসূল মোহাম্মদ সা: মদিনা মুনাওরায় আসার আগে আউস ও খাজরাজ এবং ইহুদিদের তিনটি গোত্র, বনু কাইনুকা, বনু নাজির এবং বনু কুরাইজা, নিজেদের মধ্যে প্রায়ই মারামারি ও যুদ্ধে লিপ্ত থাকত। আধিপত্য প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে বছরের পর বছর লেগে থাকত সেই সঙ্ঘাত। হিজরতের পর খুব কম সময়ের মধ্যে রাসূলুল্লাহ সা: মদিনায় মুসলিম, ইহুদি ও অন্যান্য গোত্রকে নিয়ে তৈরি করেন মদিনা সনদ (৬২২)। এর মাধ্যমে তিনি একটি নাগরিক রাষ্ট্র ও জনগণকে একটি রাজনৈতিক সম্প্রদায় (উম্মাহ) হিসেবে পরিচয় নির্ধারণ করে ঐক্যবদ্ধ করেন। এই সনদের ভিত্তি ছিল ন্যায়, সাম্য, পারস্পরিক প্রতিরক্ষা ও ধর্মীয় স্বাধীনতা। এই সনদের মাধ্যমে রাষ্ট্রের কাঠামো বদলে গিয়ে মাত্র ৮-৯ বর্গকিলোমিটারের গোত্রভিত্তিক শাসিত জনপদ কয়েক বছরের মধ্যে গোটা পৃথিবীর দৃষ্টি আকর্ষণ করে। ইতিহাস মদিনা সনদকে সংবিধান হিসেবে বিশেষ স্বীকৃতি দিয়েছে।

জুলাই সনদ ২০২৫ ও রাজনৈতিক বাস্তবতা

চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থানের পর বাংলাদেশ এমন এক সন্ধিক্ষণে এসে দাঁড়িয়েছিল, যেখানে রাষ্ট্র পুনর্গঠন কেবল রাজনৈতিক পরিবর্তন নয়, বরং এক নৈতিক ও প্রাতিষ্ঠানিক পুনর্জন্মের আহ্বান হয়ে উঠেছিল। সচেতন মহল আশা করেছিল, পৃথিবীর ঐতিহাসিক চার্টারগুলোর মতো, বাংলাদেশের জুলাই সনদ বিশ্ববাসীর জন্য এক অনন্য উদাহরণ হবে, বিশেষ করে তৃতীয় বিশ্বের ঔপনিবেশিক ও বৈষম্যমূলক রাষ্ট্রকাঠামো থেকে বের হয়ে জনগণের কল্যাণরাষ্ট্র নির্মাণে বাংলাদেশের জুলাই সনদ একটি অনন্য উদাহরণ হবে, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে গবেষণা হবে, বাংলাদেশের তরুণসমাজ, রাষ্ট্রকাঠামো আলোচিত হবে। এটি হবে তৃতীয় বিশ্বের নতুন সামাজিক চুক্তির একটি অসাধারণ নমুনা, যা জনগণের মুক্তি ও শাসনের ন্যায্যতাকে একই কাঠামোয় একীভূত করবে। যার ভিত্তি হবে : নৈতিক শাসন (মোরাল গভারনেন্স), প্রাতিষ্ঠানিক জবাবদিহি (ইনস্টিটিউশনাল অ্যাকাউন্টেবিলিটি), সামাজিক ন্যায়বিচার (সোশ্যাল জাস্টিস) এবং নাগরিক মর্যাদা (সিভিক ডিগনিটি)। এতে সংবিধান, নির্বাচন ও বিচারব্যবস্থার স্বাধীনতা পুনঃপ্রতিষ্ঠার পাশাপাশি রাষ্ট্রীয় প্রশাসনিক কাঠামোকে দলীয় নিয়ন্ত্রণমুক্ত রাখার অঙ্গীকার থাকবে। একই সাথে শিক্ষা, অর্থনীতি ও জনসেবা ব্যবস্থায় দীর্ঘমেয়াদি কাঠামোগত সংস্কারের মাধ্যমে ‘রাষ্ট্র মূলত জনগণের জন্য’ এই নীতিকে কার্যকর করার রূপরেখা নির্ধারিত হবে।

শত বাধা বিপত্তির পর এনসিপি এবং অন্যান্য আর কিছু দল বাদে প্রতিনিধিত্বশীল প্রায় সব দলের স্বাক্ষরের মাধ্যমে জুলাই সনদ বাস্তবায়নের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু এ ক্ষেত্রে অনেক বিতর্ক ও বাধা লক্ষ করা গেছে। এর চেয়েও বড় ব্যাপার হলো, এই জুলাই সনদ প্রণয়ন ও ঐকমত্যের প্রক্রিয়ায় দেশের রাজনৈতিক দলগুলো, আমলাতন্ত্র ও সরকার যে আচরণ করেছে, সেই আচরণের নির্মোহ বিশ্লেষণ থেকে আগামী রাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ কী হতে পারে তার একটি চিত্র পাওয়া যেতে পারে এবং একই সাথে সেখান থেকে উত্তরণের রাস্তাও হয়তো খুঁজে পাওয়া যেতে পারে।

জুলাই সনদ ও সরকারের আচরণ

অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের আন্তরিকতা নিয়ে সন্দেহ না থাকলেও সরকার তার দক্ষতা, কর্তব্যের মাত্রা ও গণ-আকাক্সক্ষা অনুযায়ী কতটুকু দৃঢ়তার পরিচয় দিয়েছে তা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়। এই সরকারের মেয়াদ শুরুর দিকে ১৮ মাসের একটি টাইম-ফ্রেম নিয়েছিল ঠিক কিসের ভিত্তিতে তা কখনোই স্পষ্ট করেনি। এই আঠারো মাসে তার নিজস্ব প্ল্যানই বা কী ছিল, তা কারো কাছে কোনো সময়ই পরিষ্কার হয়নি। সরকারের উচিত ছিল আঠারো মাসের সুনির্দিষ্ট কৌশল ও পরিকল্পনা তৈরি করে টার্গেটভিত্তিক কাজ এগিয়ে নেয়া। এ ক্ষেত্রে হতে পারত ১৮ মাসের সময়কে ছয় মাসের তিনটি ভাগে ভাগ করে টার্গেট নির্ধারণ করা। প্রথম ছয় মাস সংস্কার কমিশনগুলোর রিপোর্ট ও জুলাই সনদ চূড়ান্তকরণ, দ্বিতীয় ছয় মাস বাস্তবায়ন রোডম্যাপ, সাংবিধানিক ও আইনি ভিত্তি দেয়াসহ সে অনুযায়ী বিচার, প্রশাসন, শিক্ষাসহ রাষ্ট্রের প্রতিটি অংশে পরিবর্তনগুলো দৃশ্যমান করা এবং শেষ ছয় মাস দেশে একটি গ্রহণযোগ্য ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন নিশ্চিতে কাজ করা।

রাজনৈতিক দলগুলোর কালক্ষেপণ ও অপ্রত্যাশিত আচরণ

গণ-অভ্যুত্থানের পর রাজনৈতিক দলগুলোর সামনে ছিল এক ঐতিহাসিক সুযোগ। দলীয় স্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠে রাষ্ট্র পুনর্গঠনে পূর্ণ ঐকমত্য গড়ে তোলা। কিন্তু দলগুলো ঐকমত্য কমিশনে নিয়মিত আলোচনায় বসলেও আবারো পুরনো পথেই ফিরে যায়। জুলাই সনদের যে মূলনীতি হওয়া উচিত ছিল, ‘দল-মত এক দিকে, রাষ্ট্র গঠন সবার আগে’ তা সম্ভবত রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে গ্রহণযোগ্য হয়ে ওঠেনি। তারা বুঝেছিল, নৈতিক রাষ্ট্রকাঠামো প্রতিষ্ঠিত হলে ক্ষমতার বণ্টন স্বচ্ছ ও জবাবদিহিমূলক হবে, যা তাদের দলীয় প্রভাব কমিয়ে দেবে। তাই তারা পুরোপুরি রাষ্ট্রসংস্কারের বদলে স্ট্যাবিলিটি রক্ষার নামে পুরনো এস্টাবলিশমেন্ট রক্ষায় মনোযোগ দেয়, যাতে ভবিষ্যতে ক্ষমতায় এলে এসব পথ বন্ধ না হয়ে যায়।

বিএনপিসহ রাজনৈতিক দলগুলো বিভিন্ন বিষয়ে নোট অব ডিসেন্ট দিয়ে জাতীয় সংলাপ, সংস্কার কমিশন বা প্রশাসনিক পুনর্গঠন বা সনদের আইনি ভিত্তির মতো আলোচনাগুলোকে প্রলম্বিত ও বিলম্বিত করে, জটিল করে বা দলীয় স্বার্থে আংশিকভাবে ব্যবহার করে এবং শেষমেশ অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেয়া ছাত্রদের একটি অংশ দ্বারা নবগঠিত দলটির (এনসিপি) স্বাক্ষর ছাড়াই জুলাই সনদ স্বাক্ষরিত হয়, যা অত্যন্ত দুঃখজনক। এসবের মধ্য দিয়ে গণ-আকাক্সক্ষার জুলাই সনদ ধীরে ধীরে যেন হতাশাই ছড়াল। জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের হাজারো শহীদ ও গাজীর দ্বারা বাংলাদেশ রাষ্ট্রের পুনর্জন্মের আহ্বান এভাবেই রাজনৈতিক স্বার্থের খেলায় অনেকটা হারিয়ে যাওয়ার শঙ্কা তৈরি হয়েছে।

আমলাদের বাধা ও প্রশাসনে বিশৃঙ্খলা

রাষ্ট্রযন্ত্রের কেন্দ্রবিন্দুতে থাকা আমলাতন্ত্র জুলাই সনদের নৈতিক সংস্কারের সম্ভাবনাকে প্রাথমিক পর্যায়েই প্রতিহত করে। তারা ‘প্রশাসনিক ধারাবাহিকতা’ ও ‘স্থিতিশীলতা’র যুক্তি দেখিয়ে বাস্তবে পুরনো ক্ষমতার কাঠামো পুনর্গঠনে নেমে পড়ে। তরুণ প্রশাসক, নৈতিক নেতৃত্ব বা নাগরিক অংশগ্রহণমূলক সংস্কারের জায়গায় তারা নিজেদের প্রতিষ্ঠিত নেটওয়ার্ক শক্তিশালী করে। তথ্যপ্রযুক্তি, স্বচ্ছতা বা সেবার আধুনিকীকরণের নামে তারা কাগুজে সংস্কারের অভিনয় করলেও বাস্তবে প্রশাসন আরো বেশি গোপন, জবাবদিহিহীন ও রাজনীতির বিভিন্ন গ্রুপের সাথে জোটবদ্ধ হয়ে পড়ে। জনগণের যে ‘সেবানির্ভর ও নাগরিকবান্ধব প্রশাসন’ পাওয়ার কথা ছিল, অথবা নয়া রাষ্ট্রকল্পের যে আকাক্সক্ষা তা পরিণত করার চেষ্টা হয় সেই পুরনো ‘নিয়ন্ত্রণ ও ভাগাভাগিনির্ভর আমলাতন্ত্রে’। এভাবেই রাষ্ট্রের নতুন রূপান্তর আটকে ফেলার চেষ্টা হয় প্রাতিষ্ঠানিক আত্মরক্ষার প্রাচীরে।

গণমাধ্যম ও সুশীলসমাজ

সিভিল সোসাইটি, গণমাধ্যম ও তথাকথিত বুদ্ধিজীবী সমাজ জুলাই সনদের মাধ্যমে রাষ্ট্রের আমূল সংস্কার নেয়ার পক্ষে অবস্থান নেয়ার পরিবর্তে এক ধরনের প্রতীকীমূলক নিরপেক্ষতা অবলম্বন করে। আন্তর্জাতিক অনুদান, মিডিয়া প্ল্যাটফর্ম ও ব্যক্তিগত মর্যাদার ভারসাম্য রক্ষার প্রয়োজনে তারা রাষ্ট্র পুনর্গঠনের অসংখ্য মৌলিক নীতির বিষয়ে প্রকাশ্য অবস্থান নেয়নি। বরং তারা কখনো সংবিধান রক্ষার নামে, কখনো বাক-স্বাধীনতার নামে আবার কখনো ইনক্লুসিভ নির্বাচনের নামে আওয়ামী লীগকে ফিরিয়ে আনার তাড়না প্রকাশ ও বিভিন্ন পলিসি প্রস্তাবনায় সংস্কারবান্ধব শব্দাবলিতে ভাসিয়ে রেখে রাষ্ট্রের আমূল সংস্কারের গভীরে যাওয়া এড়িয়ে চলে। তাদের অনেকেই ‘অরাজনৈতিক বিশেষজ্ঞতার’ নামে নৈতিক ও নাগরিক নেতৃত্ব থেকে নিজেদের দূরে রাখে, ফলে গণ-অভ্যুত্থানের জনগণের সাথে সম্পর্কের বুদ্ধিবৃত্তিক ধারাবাহিকতা ভেঙে যায়। নাগরিকসমাজ বিবর্তিত হয় সেই পুরনো ‘প্রকল্পভিত্তিক সমাজ’ যেখানে পরিবর্তনের ভাষা ও ফান্ডিং আছে, কিন্তু অভ্যুত্থানের আত্মত্যাগ ও আদর্শের শক্তি নেই। এই মেকি নিরপেক্ষতা ও স্থবিরতার অক্ষটির পুরনো কার্যক্রমের ধারাবাহিকতা রাজনৈতিক দল ও আমলাতন্ত্র উভয়কেই আরো বেপরোয়া করে তোলে।

রাজনৈতিক দল, আমলাতন্ত্র, গণমাধ্যম ও সুশীলসমাজের এই ভূমিকা আমাদের শঙ্কিত করে জুলাই বিপ্লবের ভবিষ্যৎ নিয়ে। ভয় হয় এই ভেবে যে, সেই পুরনো সঙ্কটের কোলেই কি না ফিরে যায় শহীদের স্বপ্নের সোনার বাংলাদেশ। তবুও আশা দেখতে চাই, স্বপ্ন দেখতে চাই জুলাইয়ের একতা ও ত্যাগের স্মরণ করে। গত এক বছরের হাজারো সঙ্কটেও রাজনৈতিক একতার দিকে তাকিয়ে আছি। আশা রাখি বোধোদয় হবে সবার, বাংলাদেশ ২.০ নতুন স্বপ্নে এগিয়ে যাবে।

লেখক : অ্যাকাডেমিক ডিরেক্টর, সেন্টার ফর গভর্ন্যান্স অ্যান্ড সিভিলাইজেশনাল স্টাডিজ (সিজিসিএস)