২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টের ঘটনাবলি ‘বিপ্লব’ পদবাচ্য হবে, নাকি গণ-অভ্যুত্থান- তা নিয়ে বিতর্ক আছে। বিপ্লব যদি হয় ‘আমূল রূপান্তর’ তাহলে চব্বিশের বিষয়টিকে রূপান্তর বলা যাবে না এ কারণে যে, সেখানে পুরনো সমাজকাঠামো পরিবর্তন না করে গণ-অভ্যুত্থান বা জনগণের সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এ ধরনের যেকোনো বিপ্লব বা অভ্যুত্থান-পরবর্তীতে সামাজিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া পরিলক্ষিত হয়। মার্কসবাদীরা বিপ্লবের বিপরীতে ‘প্রতিবিপ্লব’ শব্দটি ব্যবহার করে প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির প্রতিক্রিয়া ব্যাখ্যা করেন। সেটি সশস্ত্র হতে পারে অথবা গোষ্ঠীনির্ভর হতে পারে। বিপ্লব না হয়ে যদি গণ-অভ্যুত্থান হয়, তারও ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া রয়েছে।
গণ-অভ্যুত্থানে সমাজের প্রতিটি স্তরে সঞ্চারিত হয় সংগ্রামের চেতনা। সংগ্রাম আন্দোলনের অবশেষে শাসকের স্থান কেড়ে নেয় শাসিতরা। শুধু ক্ষমতার অদল-বদল গণ-অভ্যুত্থানের লক্ষ্য থাকে না। শাসক পরিবর্তনের সাথে সাথে নিজেদের ভাগ্য পরিবর্তনের লক্ষ্যও থাকে। আজকের বাংলাদেশে সংস্কার নিয়ে যে আগ্রহ তার মর্মমূলে পরিবর্তন আকাক্সক্ষা রয়েছে। এটি স্বাভাবিক যে, যারা এই পরিবর্তনের মাধ্যমে পরাজিত হবে তারা ছলে-বলে-কলে কৌশলে ফিরে আসতে চাইবে। প্রতিবিপ্লবের মতো বা এ চেষ্টাকে প্রতি-অভ্যুত্থানও বলতে পারি। অভ্যুত্থান যেমন গণভিত্তিক হয় তেমনি প্রতি-অভ্যুত্থানও গণনির্ভর হওয়ার কথা। কিন্তু পতিত আওয়ামী লীগের গণভিত্তি নিঃশেষিত হয়েছে। তবে গোপালগঞ্জের মতো আচমকা আক্রমণকে কিভাবে ব্যাখ্যা করা যায়! বিশ্লেষকরা বলেন, এটি প্রতিবিপ্লব বা প্রতি-অভ্যুত্থান নয়; বরং পতিত নেতৃত্বের ইশারা-ইঙ্গিতে একদল মানুষের নির্বোধ প্রতিক্রিয়া।
সারা দেশে মানুষ যখন চব্বিশের গণ-বিপ্লবের অনুবর্তী, তখন গোপালগঞ্জের মানুষেরা কি ভিন্ন দ্বীপের বা ভিন্ন দেশের বাসিন্দা যে, তারা কোনো খোঁজ-খবরই রাখেন না? সমাজতাত্তি¡করা এভাবে ব্যাখ্যা করেন, পতিত স্বৈরাচারের ক্যারিশমা কিছু লোককে এ কথা বিশ্বাস করতে উদ্বুদ্ধ করে যে, শেখ হাসিনা অঘটন-ঘটনপটিয়সী। বিগত ১৫ বছরে সিংহাসনে অধিষ্ঠিত থাকতে তিনি ভারতের অবাধ ও অনৈতিক সহযোগিতা পেয়েছেন। এখন যেহেতু তিনি সেখানে রয়েছেন এবং মাঝে মধ্যে সেখান থেকে বাণী বিতরণ করছেন, ‘বর্ডারের কাছেই আছি টুপ করে ঢুকে পড়ব’-এ ধরনের আশ্বাস গোপালগঞ্জের মতো কিছু কিছু মানুষ বিশ্বাস করছে। নীতিকথায় আমরা পড়েছি যে- ‘খলের আশ্বাস বাক্য না করিবে বিশ্বাস’। কিন্তু তারা খল নায়ক-নায়িকা চিনতে ভুল করছেন। একটি অবুঝ, অসত্য ও অন্যায় অহমিকার ঘোরে আচ্ছন্ন হয়ে আছে তারা। সেই আচ্ছন্নতার ঘোরে আওয়ামী স্বৈরাচার গোপালগঞ্জসহ সারা দেশে আবারো অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টিসহ নৈরাজ্যের মাধ্যমে ক্ষমতা দখলের অপতৎপরতায় লিপ্ত রয়েছে।
গত ১৬ জুলাই তারা গোপালগঞ্জে এনসিপির পূর্বঘোষিত কর্মসূচিতে বর্বরোচিত হামলা চালিয়েছে। ককটেল বিস্ফোরণ, গাড়িতে অগ্নিসংযোগ ও পুলিশ সদস্যদের গায়ে হাত তোলার মতো ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ করেছে। এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে সেখানে গুলিবর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। চারটি প্রাণ ঝরেছে। মৃত্যু-তা যেকোনো কারণেই হোক, দুঃখজনক। সংবাদপত্রে প্রকাশিত প্রতিবেদনে দেখা যায়, তাদের হাতেও অস্ত্র ছিল। অভ্যুত্থান-পরবর্তীকালে নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা বলছিলেন, প্রতিবেশী তার ক্ষমতা পুনরুদ্ধারের জন্য যেকোনো অপকৌশল গ্রহণ করবে। এখন দেখা যাচ্ছে, অস্ত্রের মাধ্যমে অস্থিতিশীলতা তৈরির একটি ষড়যন্ত্র হয়তো চলছে। না হলে এই তৃণমূলে কিভাবে অস্ত্রের ঝনঝনানি শোনা যায়। এর কয়েক মাস আগে এরকম হামলা চালিয়ে তারা বিএনপির রক্ত ঝরিয়েছে।
অতি সা¤প্রতিককালে নির্বাচন এবং ক্ষমতায় আরোহণকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বিভেদ, বিভাজন দেখা যায়। গত সপ্তাহে রাজনৈতিক দলগুলো একে অপরের বিরুদ্ধে বিব্রতকর মন্তব্য করে। এটি এখন সন্তুষ্টির বিষয় যে, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ও প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো গোপালগঞ্জের মতো ঘটনাকে কেন্দ্র ঐক্যের তাড়না অনুভব করছে। এ ধরনের দেশদ্রোহী কার্যকলাপের ব্যাপারে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার কঠোর অবস্থান ব্যক্ত করেছে। সরকারের তরফ থেকে এক বিবৃতিতে গোপালগঞ্জের হামলাকে ‘বর্বরতা’ বলে আখ্যা দিয়েছে। এ ঘটনার সাথে জড়িতদের ছাড় দেয়া হবে না এবং হামলাকারীদের দ্রুত শনাক্ত করে কঠোর শাস্তির আওতায় আনার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন সরকার। বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর তার বিবৃতিতে বলেন, ‘ছাত্র-জনতার আন্দোলনে আওয়ামী স্বৈরাচারী শাসকগোষ্ঠীর পতনের পর দুষ্কৃতকারীরা আবারো দেশে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টিসহ নৈরাজ্যের মাধ্যমে ফায়দা হাসিলের অপতৎপরতায় লিপ্ত হয়েছে। জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার তার এক বক্তব্যে গোপালগঞ্জে জুলাই যোদ্ধাদের সমাবেশের মঞ্চ ভাঙচুর করে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে জুলাই যোদ্ধাদের অবরুদ্ধ করার ঘটনায় তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়ে বলেন, জনগণের জানমালের নিরাপত্তার জন্য অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন করা হয়েছে। গোপালগঞ্জের ঘটনায় সরকার ও প্রশাসন দায় এড়াতে পারবে না। প্রশাসনকে এর জবাব দিতে হবে, কিভাবে তাদের উপস্থিতিতে আওয়ামী ফ্যাসিস্টের দোসররা এমন ন্যক্কারজনক ঘটনা ঘটিয়েছে। তিনি আরো বলেন, গোপালগঞ্জ বাংলাদেশের অংশ, এটি মনে রাখতে হবে। গোপালগঞ্জ আধিপত্যবাদী দিল্লির অংশ নয়। হামলার তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছেন গণ-অধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক নূর।
গোপালগঞ্জের ঘটনাটি ছোট করে দেখার অবকাশ নেই। আশার কথা এই যে, এক্ষেত্রে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার, প্রধান দল বিএনপি, জামায়াতে ইসলামীসহ সব মত ও পথের ঐক্য পরিলক্ষিত হয়েছে। গত কয়েক দিন ধরে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বিভেদ-বিতর্ক দেখে যারা হতাশ হচ্ছিলেন, তাদের মনে এই অর্জিত ঐক্য আশার আলো জ্বালাবে। আসলে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব যখনই হুমকির মুখে পড়েছে তখনই এরকম জাতীয় ঐক্যের মাধ্যমে সব ষড়যন্ত্র প্রতিহত করা সম্ভব হয়েছে। জুলাই-আগস্ট বিপ্লব-পরবর্তীকালে ভারত কোনোভাবেই এই পরিবর্তনকে মেনে নিতে পারেনি। ভারতের আমলাতন্ত্র ও কূটনীতিকরা বেশ পরিপক্ব ও দূরদর্শী বলে পরিচিত। এটি বিস্ময়ের ব্যাপার যে, সেই দূরদর্শীরা বাংলাদেশের এক কঠিন বাস্তবতাকে মেনে নিতে পারছেন না। পররাষ্ট্রনীতির লক্ষ্য হলো জাতীয় স্বার্থ নিশ্চিত করা। একটি রাষ্ট্র আরেকটি রাষ্ট্রের সাথে সম্পর্ক বিন্যাস করে জাতীয় স্বার্থের নিরিখে। এটি একটি বিরল ঘটনা যে, ভারত তার সবচেয়ে মূল্যবান ও গুরুত্বপূর্ণ প্রতিবেশীর সাথে তথা জনগণের সাথে সম্পর্ক বিন্যস্ত না করে শুধু একটি দল ও এক বিকারগ্রস্ত ব্যক্তিতন্ত্রকে কেন্দ্র করে তাদের পররাষ্ট্রনীতি পরিচালনা করছে।
ভারতের প্রতি শেখ হাসিনার দায় এবং ভারতের তার প্রতি দায়িত্ব সম্পর্কে সহজেই ধারণা করা যায়। কিন্তু ভারত থেকে বাংলাদেশ রাষ্ট্রবিরোধী যে কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে তা যেকোনো কূটনৈতিক শিষ্টাচারের বিরোধী। তিনি সেখানে রাজনৈতিক আশ্রয় লাভ করেছেন নাকি উদ্বাস্তু হয়ে বসবাস করছেন, তা ভারত আজও পরিষ্কার করেনি। বিস্ময় লাগে যে, গোটা পৃথিবী যখন হাসিনাকে অবাঞ্ছিত বা ‘পার্সোনা নন গ্রাটা’ মনে করছে, তখন ভারত তাকে রাজকীয় হালে রেখেছে। কূটনৈতিক বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা প্রকাশ করেন যে বাংলাদেশকে নিয়ে ভারতের বিশেষ পরিকল্পনা রয়েছে। স্মরণ করা যেতে পারে যে পঁচাত্তরের ১৫ আগস্টের ঘটনাবলির পর ভারত কাদের সিদ্দিকীকে অস্ত্রশস্ত্র দিয়ে সীমান্তে আক্রমণের সুযোগ করে দেয়। পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতিদের অস্ত্রশস্ত্র দিয়ে অশান্তি সৃষ্টির জন্য ‘শান্তি বাহিনী’ তৈরি করে দেয়।
এখন তারা বাংলাদেশকে বিব্রত করার জন্য প্রায় প্রতিদিন বাঙালি মুসলমানদের জড়ো করে বাংলাদেশে ঠেলে দিচ্ছে। আমদানি-রফতানি, ব্যবসায়-বাণিজ্যে নানা ধরনের বিধি-নিষেধ আরোপ করছে। সংখ্যালঘু ইস্যুকে ব্যবহার করে বিপর্যয় তৈরি করার অপচেষ্টা চালাচ্ছে। ভারতীয় সীমান্ত বাহিনীর গুলিতে বাংলাদেশী নাগরিকদের মৃত্যুর মিছিল অব্যাহত রয়েছে। ভবিষ্যতে আরো কী কী করতে পারে সে বিষয়ে বাংলাদেশ সরকারকে সতর্ক থাকতে হবে। বাংলাদেশের সাহসী জনগণ সীমান্তে কিংবা দেশের অভ্যন্তরে যেকোনো ভারতীয় চক্রান্তকে রুখে দেয়ার জন্য প্রস্তুত রয়েছে। অবশেষে কবি কিশোর সুকান্তের উচ্চারণ দিয়ে শেষ করি- ‘বন্ধু, তোমার ছাড়ো উদ্বেগ, সুতীক্ষ্ণ করো চিত্ত, বাংলার মাটি দুর্জয় ঘাঁটি বুঝে নিক দুর্বৃত্ত।’
লেখক : অধ্যাপক (অব:), সরকার ও রাজনীতি বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়