ফ্যাসিবাদ-উত্তর বাংলাদেশে এক নতুন রাজনৈতিক বাস্তবতা হাজির। শেখ হাসিনার অপশাসন থেকে মুক্তি পেতে চব্বিশের ছাত্র-আন্দোলনে শরিক হওয়া সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের মনোজগতে অভূতপূর্ব এক পরিবর্তন ঘটেছে। ডাকসু-জাকসু নির্বাচনের ফল আমাদের সেই বার্তা দিচ্ছে কি?
এ কথা সত্যি, একটি ঘটনা সময় বা চরিত্রকে আমরা কে কিভাবে বিশ্লেষণ করব তা নির্ভর করে মন-মানসিকতা, লেখাপড়া, শিক্ষা-দীক্ষা ও উদ্দেশ্য বিবেচনায়। এখানে দেখার দৃষ্টিভঙ্গি আসল। আমরা অর্ধেক পানি ভরা গ্লাসের একটি উদাহরণ সচরাচর দিয়ে থাকি। কেউ বলেন, গ্লাসটি অর্ধেক খালি। সেই একই গ্লাসকে দৃষ্টিভঙ্গিগত পার্থক্যে আরেকজন বলেন, গ্লাসটি অর্ধেক ভরা। সে জন্য সব ঘটনা বিশ্লেষণে দৃষ্টিভঙ্গিটাই সার কথা। আমাদের বর্তমান নতুন রাজনৈতিক বাস্তবতা বিশ্লেষণেও কথাটি শতভাগ খাটে। দৃষ্টিভঙ্গির এই বিভিন্নতা মনে রেখেই আমরা দেশের রাজনৈতিক বাস্তবতা বিচার-বিশ্লেষণের প্রয়াস চালাব। এর সাথে কারো দ্বিমত থাকা স্বাভাবিক। তবে আমাদের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের সাথে কারো চিন্তা মিলে গেলে তা হবে বাড়তি পাওনা। মানে সোনায় সোহাগা।
শুরুতে বলা হয়েছে, এখন দেশে হাজির আছে নতুন রাজনৈতিক বাস্তবতা। একে আমরা কিভাবে দেখছি তার একটি সারসংক্ষেপ পাঠকের কাছে তুলে ধরতে এ কলামের অবতারণা।
প্রথমে গত এক বছরের জাতীয় জীবনের রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহ একটু পরখ করে নেয়া যাক। শেখ হাসিনার দুঃশাসনের অবসানে জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার সমন্বিত আন্দোলন গড়ে ওঠে যা ছিল আমাদের সাম্প্রতিক ইতিহাসে অনুপস্থিত। এ আন্দোলনে সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের ইচ্ছার প্রকাশ ঘটেছে। চব্বিশের আন্দোলনে উচ্চারিত স্লোগান-দেয়াল লিখন কিংবা গ্রাফিতিতে প্রতিফলিত হয়েছে জনঅভিপ্রায়। যেখানে জনআকাঙ্ক্ষা মূর্ত হয়ে ফুটে উঠেছে।
চব্বিশের ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে অংশ নেয়া সবাই বাংলাদেশ রাষ্ট্রে তাদের ইচ্ছার প্রতিফলন দেখতে চান, যা বাস্তবায়নের দায়িত্ব রাজনৈতিক দলগুলোর। প্রশ্ন হলো- জনগণের চাওয়ায় প্রাধান্য দিয়ে রাজনৈতিক দলগুলো কি নিজস্ব কর্মসূচি বা কর্মকাণ্ড ঢেলে সাজাবে? সোজাসাপটা জবাব হতে পারে এই যে- না হলে ওই রাজনৈতিক দল সমাজে প্রাসঙ্গিকতা হারাবে। যেমন- একসময় তুমুল জনপ্রিয় রাজনৈতিক দল মুসলিম লীগ তদানীন্তন পূর্ব বাংলায়; আজকের বাংলাদেশে সংখ্যাগরিষ্ঠের আকাঙ্ক্ষা বুঝতে না পারার খেসারত দিয়েছে তাদের মানসপট থেকে মুছে গিয়ে।
জুতা যত চকচকে হোক না কেন, তার কোনো উপযোগিতা থাকে না, যদি পায়ের মাপের সাথে খাপ না খায়। অর্থাৎ কোনো মাত্রার ছোট-বড় হলে পরিত্যাজ্য। ঠিক তেমনি, রাজনৈতিক দল জনমানস পাঠে ব্যর্থ হলে জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব করার যোগ্যতা হারায়। এটি এভাবেও বলা যেতে পারে- পলিটিক্যাল এজেন্সি বা রাজনৈতিক কর্তাসত্তার হাতবদল হয়ে নতুন রাজনৈতিক শক্তি বা দলের অভ্যুদয় ঘটে। ফ্যাসিবাদ-উত্তর বাংলাদেশে কি এমন পরিস্থিতি বর্তমানে বিরাজমান? এর তত্ত¡তালাশ করাটা রাজনৈতিক জীব হিসেবে আমাদের কর্তব্য।
ফ্যাসিবাদের অবসানে গত এক বছরে এমন রাজনৈতিক বাস্তবতা হাজির হয়েছে দেশে। তবে এ কথাও ঠিক, বিষয়টি জনসমাজে কী অবস্থায় বা কী মাত্রায় বিরাজিত, তার কোনো তথ্য-প্রমাণ কারো কাছে ছিল না। এটি বুঝতে হলে জনমানসের যে সঠিক চিত্র জানা জরুরি, তা ছিল বিমূর্ত। জনমানস বুঝতে চায় গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে অবাধ সুষ্ঠু নির্বাচন। যেহেতু দেশে সাড়ে ১৫ বছরে ফ্যাসিস্ট হাসিনা ভোটব্যবস্থা ধ্বংস করে ক্ষমতা দীর্ঘায়িত করেছিলেন; তাই গত দেড় দশকে রাজনৈতিক কর্তাসত্তা কোনো দিকে ঝোঁকা তা বোঝার উপায় ছিল না। সেই ধারাবাহিকতায় গত এক বছরেও কোনোপর্যায়ে নির্বাচন না হওয়ায় ফ্যাসিবাদ-উত্তর জনমানস পাঠ করাও ছিল মুশকিল। ছিল দুর্বোধ্য।
গত কয়েক দিন আগে অনুষ্ঠিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ-ডাকসু ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ-জাকসু নির্বাচনের ফল নতুন রাজনৈতিক বাস্তবতা কিরূপে হাজির তার খানিকটা আঁচ করা যায়। এ থেকে দিশা পেতে পারি আমরা। সংখ্যাগরিষ্ঠের মনোজাগতিক অবস্থাটা কিরূপে বিরাজমান তা কিঞ্চিত ঠাহরে আসে।
এ দু’টি নির্বাচনে শিক্ষিত নিম্ন-মধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্ত শ্রেণীর বর্তমান মনোজাগতিক অবস্থা সম্পর্কে ইঙ্গিত পাওয়া যায়। যেমন- হাঁড়ির একটি বা দু’টি চাল পরখ করে রাঁধুনী বুঝতে পারেন ভাত হয়েছে কি না। ঠিক তেমনি ডাকসু-জাকসু নির্বাচনের ফল পরখ করে বোঝা যেতে পারে- আগামী ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে কোন দল কেমন জনসমর্থন পেতে পারে। কারা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় যাওয়ার প্রতিযোগিতায় এগিয়ে।
এ বিচারে যাওয়ার আগে দেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের দিকে নজর দেয়া প্রয়োজন। ইংরেজ আমলে ভারতবর্ষে মুসলমানদের আর্থ-রাজনৈতিক স্বার্থ সংরক্ষণে লড়াই-সংগ্রাম করেছে ১৯০৬ সালে গঠিত নিখিল ভারত মুসলিম লীগ। অন্য দিকে হিন্দুদের স্বার্থ দেখতে সচেষ্ট ছিল ১৮৮৫ সালে গড়ে ওঠা ভারতীয় কংগ্রেস। ভারতের মুসলিম সম্প্রদায় নিজেদের জনপ্রতিনিধিত্ব, মানে- রাজনৈতিক কর্তাসত্তা দ্বিধাহীন চিত্তে অর্পণ বা ন্যস্ত করেছিল মুসলিম লীগের ওপর। মুসলিম লীগও অর্পিত দায়িত্ব মুসলিম জনগোষ্ঠীর রাজনৈতিক কর্তাসত্তার আমানত রক্ষায় ছিল সদা সতর্ক। ফলে ১৯৪৭ সালে ভারত উপমহাদেশ ভাগ হয়ে গঠিত হয় মুসলমানদের স্বপ্নের স্বাধীন ভূমি পাকিস্তান।
পূর্ববাংলার মুসলিম জনগোষ্ঠী নিজেদের ভাগ্য জড়িয়ে নেয় পাকিস্তানে অন্তর্ভুক্তির মাধ্যমে। কিন্তু দুর্ভাগ্য হলো- স্বাধীনতা-উত্তর পাকিস্তানে মুসলিম লীগ দলীয় কোন্দলে জর্জরিত হয়ে নিঃশেষ হয়ে যায়। অথচ পরাধীন ভারতে মুসলিম লীগে অভ্যন্তরীণ দ্ব›দ্ব-সঙ্ঘাতের তেমন কোনো বালাই ছিল না। স্বাধীনতা প্রাপ্তির মাত্র সাত বছরের মাথায় পূর্ববাংলায় ১৯৫৪ সালের প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচনে ভরাডুবি হয় মুসলিম লীগের। এটি ছিল অকল্পনীয়। বলে রাখা ভালো, মুসলিম লীগ নেতৃত্বের একটি অংশ ক্ষুদ্র স্বার্থ সংরক্ষণ করতে গিয়ে ১৯৪৯ সালে দলটি ভেঙে আওয়ামী মুসলিম লীগের জন্ম হয়। সেই আওয়ামী মুসলিম লীগ এবং কৃষক শ্রমিক প্রজা পার্টির নেতৃত্বে গঠিত যুক্তফ্রন্টের কাছে শোচনীয় পরাজয় হয়। পূর্ব পাকিস্তানে সেই যে মুসলিম লীগ জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে, তা আর পুনরুদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। আর সত্তরের নির্বাচন তো পাকিস্তানের ভাঙন ত্বরান্বিত করে মাত্র। অর্থাৎ পূর্ব পাকিস্তানে জনপ্রতিনিধিত্ব হারিয়ে মুসলিম লীগ রাজনৈতিক কাঙালে পরিণত হয়। আর নবগঠিত আওয়ামী লীগ জনতার রাজনৈতিক কর্তাসত্তার নাটাই পেয়ে হয়ে ওঠে অপ্রতিরোধ্য। রাজনৈতিক শক্তিমত্তায় বলীয়ান।
স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে পঁচাত্তর-পরবর্তী এ কর্তাসত্তার পালাবদল ঘটে বিএনপির কাছে। নব্বইয়ের গণ-অভ্যুত্থান-পরবর্তী বিএনপি ও আওয়ামী লীগ পালাক্রমে জনগণের সমর্থন নিয়ে রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়। কিন্তু গত দেড় দশকে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ দেশে ফ্যাসিবাদী শাসনব্যবস্থা কায়েম করে। পরিণামে চব্বিশের ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে সেই অপশাসনের অবসান ঘটে।
চব্বিশের অভ্যুত্থান-উত্তর এক বছর অতিক্রান্ত হওয়ার পর বহুল আলোচিত ডাকসু ও জাকসু নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এতে দেশে দীর্ঘদিন চরম রাষ্ট্রীয় নিপীড়নের শিকার বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির বিপুল বিজয় পেয়েছে। মিডিয়ায় ব্যাপক প্রচার পাওয়া ডাকসু এবং তার চেয়ে একটু কম আলোচিত জাকসুর ফল আমাদের কী বার্তা দিচ্ছে- তা নিয়ে চলছে চুলচেরা বিশ্লেষণ। এ কথা অনস্বীকার্য, এ দু’টি নির্বাচন জনমানসের পালস বা মনোভাব বুঝতে সহায়ক মনে হয়েছে, তাই এর একটি নির্মোহ বিশ্লেষণ দরকার। আমরা আমাদের বোধ-বুদ্ধি খাটিয়ে দু’টি নির্বাচনের ফল থেকে এমন বার্তা উপলব্ধি করেছি, এটি আসলে দেশের রাজনৈতিক কর্তাসত্তা বদলেরই ইঙ্গিত।
আওয়ামী লীগের পতনের পর বিএনপিকে যেমনটি অপ্রতিরোধ্য মনে করা হচ্ছিল, তাতে খানিকটা ছেদ পড়েছে। মনে করা হচ্ছিল, আওয়ামী লীগের অনুপস্থিতিতে বিএনপির হাতে আপনাআপনি রাজনৈতিক কর্তাসত্তা ধরা দেবে। কিন্তু ডাকসু-জাকসু নির্বাচনের ফল সেই চিন্তার অসারতাকে ইঙ্গিত করছে। এই ফলাফলে এ কথাও মনে হওয়ার কারণ রয়েছে যে, বিএনপির প্রতি শিক্ষিত শ্রেণী আর আস্থা বা ভরসা রাখতে পারছে না। তারা দ্বিধান্বিত। পরিণামে ডাকসু-জাকসুতে ছাত্রদলের ভরাডুবি।
অন্য দিকে চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থান-পরবর্তী ইসলামপন্থীদের গ্রহণযোগ্যতা আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেড়েছে। প্রকৃত বাস্তবতায় সর্বভারতীয় সংস্কৃতি থেকে স্বাতন্ত্র্য বজায় রেখে যারা শক্তিশালী বাংলাদেশের অস্তিত্ব সামনে হাজির করতে চান, মূলত ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এ দেশের মানুষ তাদের হাতে নিজেদের জনপ্রতিনিধিত্ব অর্পণ করতে যাচ্ছেন বলে মনে হয়। ১৯০৫ সালে পূর্ববঙ্গবাসী বঙ্গভঙ্গে নিজেদের যে ভাগ্যবদলের সম্ভাবনা দেখেছিলেন, ঠিক ৪২ বছর পর ১৯৪৭ সালে আবার তারা বাংলা ভাগের মধ্য দিয়ে পাকিস্তানে অন্তর্ভুক্ত হয়েছিলেন। তাদের উত্তরসূরিরা আজো বাংলাদেশে ভারতের আধিপত্য দেখতে নারাজ। তারাই তাদের রাজনৈতিক কর্তাসত্তার আমানত রাখতে চান মুসলিম রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক আদর্শে গঠিত রাজনৈতিক দলের ওপর। বর্তমান বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ তরুণ জনগোষ্ঠীর সেই মনোজাগতিক ভাবনার প্রতিফলন ঘটেছে ঢাকা ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদ নির্বাচনে। এ সমীকরণ আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভোটের বাক্সে প্রতিফলিত হলে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। আসলে সেই রিহার্সেল হয়ে গেল ডাকসু-জাকসু নির্বাচনে।
 


