যুবশক্তির জন্য জাতীয় ডকট্রিন : ভবিষ্যৎ নেতৃত্ব নির্মাণে ছয় স্তম্ভ

রাষ্ট্রীয়ভাবে সমর্থিত কিন্তু যুব পরিচালিত থিঙ্কট্যাঙ্ক; যা বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ পথরেখা নির্ধারণে চিন্তা, গবেষণা ও কৌশলগত সুপারিশ দেবে। এর কাজের মধ্যে থাকবে- রাষ্ট্র ও নিরাপত্তা, প্রতিরক্ষা ও অন্যান্য সক্ষমতা, ডিজিটাল রূপান্তর, শিক্ষা, ভৌগোলিক কৌশল বিষয়ে নীতিপত্র তৈরি; সরকার, বেসরকারি খাত ও আন্তর্জাতিক অংশীদারদের জন্য গবেষণাকর্ম; Policy Simulation Lab I Youth Strategic Dialogues ইত্যাদির আয়োজন। Think Bangladesh ২০৫০ তরুণদের পলিসি ফলোওয়ারের জায়গা থেকে পলিসি মেকার হবার দিশা দেবে। কারণ রাষ্ট্রকে যে তরুণরা বোঝে, তারাই একে গড়ে তুলতে পারে। নেতৃত্ব মানে ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তা, দৃষ্টি ও দায় নেয়া। উদ্ভাবন মানে চিন্তার কাঠামো, নীতির ভাষা ও বাস্তবতা-নির্মাণের ক্ষমতা। আমরা চাই দক্ষ যুব নেতৃত্ব। এই দক্ষতাকে দূরদৃষ্টি ও চিন্তাশক্তিসম্পন্ন কৌশলগত নেতৃত্বে রূপান্তরিত করার দায়ও রাষ্ট্রের। এ জন্য প্রয়োজন এমন যুবরূপরেখা, যা ২১শ শতকের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় যথার্থ ও অগ্রসর

নয়া দিগন্ত গ্রাফিক্স

যুবশক্তির বিকাশে বাংলাদেশের জাতীয় কর্মনীতি জরুরি। প্রয়োজন এমন এক ডকট্রিন যা রাজনৈতিক-বিনিয়োগ বা কর্মসংস্থানভিত্তিক নীতিতে সীমাবদ্ধ নয়, বরং সেটি হবে নৈতিক, জ্ঞানতাত্ত্বিক, ভূরাজনৈতিক ও সভ্যতাগত ভবিষ্যৎ নির্মাণে যুবকদের কেন্দ্রীয় শক্তিতে পরিণত করার মূলমন্ত্র।

যুবশক্তিকে একটি সংগঠিত ও নীতিনিষ্ঠ ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে নিতে হবে। এ জন্য চেতনার উদ্দীপনার পাশাপাশি প্রয়োজন একটি নৈতিক, জ্ঞানভিত্তিক ও সাংগঠনিক রূপকল্প।

যুবশক্তির বিকাশে আমরা যদি ডকট্রিন নিয়ে চিন্তা করি, তাহলে তার মুখ্য স্তম্ভগুলো মাথায় রাখতে হবে, যা বাস্তবায়নযোগ্য কর্মধারা প্রস্তাব করবে।

১. চেতনার বিপ্লব : এ হচ্ছে মৌলিক রূপান্তরমূলক দৃষ্টিভঙ্গি, যা কেবল বাহ্যিক উন্নয়ন নয়, বরং অন্তরচক্ষুর জাগরণকে কেন্দ্র করে গঠিত। এই স্তম্ভ জাতিকে এক বৈপ্লবিক বুদ্ধিবৃত্তিক, নৈতিক এবং সাংস্কৃতিক জাগরণে নেতৃত্ব দিতে পারে, যেখানে যুবসমাজ হবে আত্মজাগরিত, ঐতিহাসিকভাবে সংবেদনশীল ও ন্যায়ের প্রতি দায়বদ্ধ।

এ স্তম্ভের তিনটি প্রধান উপাদানের দিকে বিশেষভাবে খেয়াল রাখতে হবে।

ক. শিক্ষার মুখ্য উদ্দেশ্য হবে চিন্তার শক্তি ও নৈতিক স্পষ্টতা।

বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থা ডিগ্রিকেন্দ্রিক ও পরীক্ষানির্ভর। এতে জীবনের উদ্দেশ্য, আত্মবিকাশ ও নৈতিক জিজ্ঞাসা প্রায় অনুপস্থিত।

চিন্তার শক্তি মানে আত্মবিশ্লেষণের ক্ষমতা, জিজ্ঞাসাকে ধারণ করার সাহস এবং তত্ত্ব থেকে কর্মে রূপায়ণের বুদ্ধি।

নৈতিক স্পষ্টতা মানে নিছক বাইনারি নয়, বরং ন্যায়ের সূক্ষ্মতাকে বুঝে কাজ করার সাহস। এটি যুক্তিবাদ গঠনের জন্য নয়, বরং মূল্যবোধভিত্তিক চিন্তার ভিত্তিকে অবলম্বন ও চর্চার জন্য।

অতএব শিক্ষার প্রতিটি স্তরে নাগরিক দর্শন, আত্মপরিচয় ও মূল্যবোধ এবং তর্ক ও সহনশীলতার মতো বিষয়কে পাঠ্যকাঠামোতে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।

খ. জাতীয় পর্যায়ে Youth Philosophy Movement-এর মুভমেন্টের কথা বলছি, কারণÑ

জীবনের উদ্দেশ্য, আত্মপরিচয় ও রাষ্ট্রতত্ত্ব নিয়ে যুবকদের চিন্তাভাবনা সক্রিয় করা জরুরি।

বাংলাদেশে এক চিন্তাগত নবজাগরণ সংগঠিত করতে হবে, যার কেন্দ্রে থাকবে যুবকদের চিন্তা।

এ জন্য বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ ও মাদরাসা পর্যায়ে প্রাতিষ্ঠানিক-অপ্রাতিষ্ঠানিক চিন্তাসঙ্ঘ গঠন করে সমাজতাত্ত্বিক, দার্শনিক, ঐতিহাসিক, ধর্মীয় ও অর্থনৈতিক ভাবনার অনুশীলন করা। কিন্তু তা কেবল বিদ্যালয়কেন্দ্রিক হলে চলবে না। সমাজের আরো তৃণমূলে একটা সবল-সক্রিয় সম্ভাবনার মধ্যেও এর বাণী ও বার্তাকে তাদের মতো করে চালিয়ে দিতে হবে। স্বতন্ত্র চিন্তার স্বীকৃতি দিতে শিখতে হবে। যেখানে তরুণরা শুধু কর্মসংস্থানের জন্য নয়, সমাজের নৈতিক অবকাঠামো গঠন-পুনর্গঠনে যুক্ত হবে।

গ. যুবকদের মধ্যে চেতনার বীজ রোপণ

তাদের অন্তর ও চিন্তার গভীরে এমন ধারণা, মূল্যবোধ ও বোধসম্পন্ন বুদ্ধি স্থাপন করা, যা ধীরে ধীরে বেড়ে উঠবে এবং ভবিষ্যতের সিদ্ধান্ত, আচরণ ও রাষ্ট্রদর্শনের ভিত্তি গড়ে দেবে। যেমন-

আত্মবোধ (Selfhood) : আত্মবোধ মানে হলো, আমি কে, আমি কেন বেঁচে আছি, আমার দায় কী? এমনতরো প্রশ্নের উত্তর খোঁজা; আত্মপরিচয় গড়ে না উঠলে মানুষ নিজেকে বাজারের পণ্য, ভোটব্যাংকের সংখ্যা বা কেবল শ্রেণী পরিচয়ে আবদ্ধ রাখে।

কালের বোধ (Historicity): যুবকদের বোঝাতে হবে, তারা ইতিহাসের ধারা থেকে বিচ্ছিন্ন নয়। তারা এক উত্তরাধিকার বহন করছে এবং ভবিষ্যতের উত্তরাধিকার নির্মাণ করছে।

ইতিহাস-বিমুখতা মানেই আত্মপরিচয়হীনতা, যা রাষ্ট্রবিনাশের পূর্বশর্ত হয়ে দাঁড়ায়।

ন্যায়বোধ (Justice Conscience) : এ চেতনাবোধ মানুষকে চিন্তার দিক থেকে এগিয়ে নেয়। শুধু নিজে ভালো থাকার বৃত্ত থেকে মুক্ত হয়ে সবাইকে ভালো রাখার দিকে ধাবিত করে।

ন্যায়বোধ একটি সামাজিক রেডার। সে এক প্রবল শক্তি। অনৈতিকতা, বৈষম্য, শোষণ ও ক্ষমতার অপব্যবহারের বিপরীতে সে প্রতিরোধ গড়ে তোলে। আত্মবোধ মানুষকে জাগাবে, কালের বোধ মানুষকে দায় বোঝাবে, আর ন্যায়বোধ মানুষকে সততার যোদ্ধা বানাবে।

২. দ্ব্যর্থহীন দক্ষতা (Skill without Subservience)

স্তম্ভটি বাংলাদেশের যুবশক্তিকে এমন দক্ষতা, অন্তর্দৃষ্টি ও প্রযুক্তিগত ক্ষমতায়ন দেয়ার প্রস্তাব করে, যা এক দিকে আত্মনির্ভরতা নিশ্চিত করবে, অন্য দিকে জাতিকে পরাধীনতা-মুক্ত, টেকসই ও নেতৃত্বদানকারী ভবিষ্যতের পথে পরিচালিত করবে। দ্ব্যর্থহীন কথাটা বলছি, কারণ সে বলছে, দক্ষতা হবে স্বচ্ছ, স্বাধীন ও লক্ষ্যনির্ভর, কোন প্রভুভক্ত মানসিকতা থেকে তা হবে না। কিংবা নিছক চাকরিপ্রার্থী সত্তায় আটকে থাকলে দ্ব্যর্থহীন দক্ষতা আসবে না।

এই দক্ষতা গঠনের কাঠামো হবে কয়েক স্তরের। যা যুবশক্তিকে প্রযুক্তিগতভাবে যেমন সক্ষম করবে, তেমনি নৈতিক, কৌশলগত ও বিশ্বদৃষ্টিসম্পন্ন নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলার লক্ষ্যে প্রণীত হবে। স্তরগুলোর মধ্যে আছে-

ক. প্রযুক্তিগত দক্ষতা (Hard Skills)

এই স্থরের উদ্দেশ্য হবে প্রযুক্তির ওপর কর্তৃত্ব ও প্রয়োগক্ষমতা অর্জন। এই দক্ষতাগুলো বিশ্বের চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের কেন্দ্রে অবস্থিত। বাংলাদেশ যদি বৈশ্বিক শ্রমবাজার, খাদ্য নিরাপত্তা, স্বাস্থ্য প্রযুক্তি ও উৎপাদন ব্যবস্থায় অংশ নিতে চায়, তাহলে Hard Skills-এ অগ্রসর হওয়া ছাড়া বিকল্প নেই। অপর দিকে এই দক্ষতা Precision Farming-এর মাধ্যমে কৃষিজ রূপান্তর ঘটবে, যেখানে কম জমিতে, কম পানিতে, অধিক উৎপাদন সম্ভব।

খ. নৈতিক ও আন্তঃসম্পর্ক দক্ষতা (Soft Skills) :

এই দক্ষতার উদ্দেশ্য হবে, মানুষকে মানুষ হিসেবে পরিচালনার সক্ষমতা অর্জন। Hard Skills দক্ষ জনবল তৈরি করে, কিন্তু Soft Skills নেতৃত্ব, নৈতিকতা ও সামাজিক বুদ্ধিমত্তার ভিত্তি গড়ে তোলে। এই স্তরের দক্ষতা ছাড়া প্রযুক্তির বর্বর চর্চা হবে। যেমন অও দিয়ে নজরদারি, রোবট দিয়ে যুদ্ধ। নৈতিকতা ছাড়া দক্ষতা প্রযুক্তি শক্তি হতে পারে, কিন্তু সমৃদ্ধি, শান্তি আনতে পারে না।

গ. কৌশলগত ও ভবিষ্যৎ-সংবেদনশীল দক্ষতা (Strategic Skills) :

এই দক্ষতার উদ্দেশ্য হবে ভবিষ্যতের বিশ্বে নেতৃত্বদানের জন্য দূরদৃষ্টি ও পরিপক্বতা তৈরি করা। এই স্থরে Geo-economics বা Cyber Strategy-এর মতো বিষয়ে দক্ষতা অর্জন করবে; যা তরুণদের গ্লোবাল ভিশনকে ঋদ্ধ করবে, শুধু চাকরি নয়, নীতি, কৌশল ও দিকনির্দেশনায় ভূমিকাযোগ্য বানাবে। Geo-economics শেখা মানে শুধু অর্থনীতি নয়, কূটনীতি ও নিরাপত্তার মধ্যে অর্থনৈতিক বলয়ের প্রভাব বোঝা। Cyber Strategy ছাড়া কোনো জাতিই এখন ডিজিটাল নিরাপত্তা বা সার্বভৌমত্ব রক্ষা করতে পারে না। সে জন্য বিশেষভাবে-

ক. প্রতিটি উপজেলা, পৌরসভায় বাধ্যতামূলক Youth Tech-Hub & Green Lab : এই অংশটি হলো এই স্তম্ভের প্রাতিষ্ঠানিক অবকাঠামো- যেখানে এই তিন স্তরের দক্ষতা অর্জন হবে বাস্তব অনুশীলনের মাধ্যমে।

Youth Tech-Hub হবে প্রযুক্তি ও উদ্ভাবনচর্চার কেন্দ্র এবং অও, রোবটিকস, কোডিং, ডিজিটাল উদ্যোক্তা তৈরির প্ল্যাটফর্ম। তরুণদের জন্য সে উন্মুক্ত করে দেবে নিজেদের ঘরেই বিশ্বমানের দক্ষতা অর্জনের সুযোগ।

খ. Green Lab : Green Lab হবে পরিবেশগত সঙ্কট ও সমাধানের স্থানীয় চর্চাকেন্দ্র, ভূমিকা রাখবে Climate-smart agriculture, renewable energy, local ecology রক্ষায়। সে তরুণদের সবুজ সচেতনতা ও বৈজ্ঞানিক মনোভঙ্গি গড়ে তুলতে সক্রিয় থাকবে।

গ. Defense Lab : প্রতিরক্ষা ল্যাব বলতে এমন একটি গবেষণা ও উদ্ভাবন কেন্দ্র বোঝায়, যেখানে রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা, সামরিক কৌশল, প্রযুক্তি ও প্রতিরক্ষা নীতিবিষয়ক চিন্তা, গবেষণা, বিশ্লেষণ ও প্রযুক্তি উন্নয়ন কার্যক্রম পরিচালিত হয়। এটি কেবল অস্ত্র উন্নয়ন বা সামরিক গবেষণার কেন্দ্র নয়, বরং একটি কৌশলগত জ্ঞানভিত্তিক প্রতিষ্ঠান-যেখানে দেশের সার্বভৌমত্ব, ভূরাজনীতি, সাইবার নিরাপত্তা ও ভবিষ্যৎ যুদ্ধপদ্ধতি বিষয়ে কাজ হয়।

এসব প্রতিষ্ঠানের উদ্দেশ্য হবে প্রযুক্তিগত দক্ষতা যেন বিশ্বমানের হয়। এই দক্ষতা যেন মানুষ, মাতৃভূমি, প্রকৃতি, পরিবেশ ও ভবিষ্যতের প্রতি দায়িত্বশীল এক মানবিক বুদ্ধিবৃত্তির প্রকাশ হয়ে ওঠে।

৩. স্বাধীনতা-পরবর্তী আরেক যুদ্ধ- তথ্যের দখল :

একটি নীরব কিন্তু গভীর যুদ্ধ হলো তথ্য, জ্ঞান ও সাংস্কৃতিক আধিপত্যের বিরুদ্ধে আত্মপরিচয় রক্ষার সংগ্রাম। আজকের বিশ্বে যুদ্ধ কেবল মাটি বা অস্ত্রে হয় না, বরং তথ্যপ্রবাহ, মনোজগৎ ও দৃষ্টিভঙ্গির ওপর দখলের মাধ্যমেও যুদ্ধ চলমান। বাংলাদেশের তরুণদের সেই যুদ্ধক্ষেত্রে সবল করতে হলে দরকার সুসংহত নীতিমালা, ডিজিটাল সচেতনতা এবং কৌশলগত সক্ষমতা। এক্ষেত্রে দরকার :

ক. Content Sovereignty Policy : এ হচ্ছে রাষ্ট্রীয় ও কৌশলগত তথ্যনীতির প্রস্তাব, যা হবে বাংলাদেশে বিদেশী তথ্য-আগ্রাসন ও সাংস্কৃতিক উপনিবেশবাদকে প্রতিরোধে সচেতন প্রচেষ্টা।

গ্লোবাল মিডিয়া, স্ট্রিমিং প্ল্যাটফর্ম, সোশ্যাল মিডিয়া এবং অ্যালগরিদমিক ফিডÑ সবখানেই পশ্চিমা বা বহুজাতিক করপোরেট বয়ানের আধিপত্য। এতে তরুণদের ইতিহাস, মূল্যবোধ, ভাষা ও আত্মপরিচয় হুমকির মুখে পড়ে।

এই নীতির মাধ্যমে স্থানীয় কনটেন্ট নির্মাতাদের প্রশিক্ষিত করা, পাঠ্যক্রমে তথ্যনির্ভর সাংস্কৃতিক প্রতিরোধ শিক্ষা, গ্লোবাল প্ল্যাটফর্মে বাংলাদেশের নিজস্ব ন্যারেটিভ তুলে ধরা যায়।

ডিজিটাল সেন্সরশিপ নয়, বরং তথ্য-জ্ঞানভিত্তিক সচেতন প্রতিরোধ জরুরি।

খ. Digital Youth Citizenship Card : এটি হবে ডিজিটাল পরিচয়পত্র ও কৃতিত্ব স্বীকৃতির প্ল্যাটফর্ম, যেখানে তরুণদের গবেষণাকর্ম, জ্ঞান-নির্মাণে অংশগ্রহণ, স্বেচ্ছাসেবী কার্যক্রম, প্রযুক্তি ও সামাজিক উদ্ভাবনে অবদান ইত্যাদিতে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে স্বীকৃতি দেয়া হবে।

এই কার্ডের মাধ্যমে তৈরি হবে জ্ঞানভিত্তিক নাগরিকত্ব। এই নাগরিকতা কেবল জন্মগত নয়, বরং তথ্যচর্চা ও সামাজিক দায়বদ্ধতায় অর্জিত হয়। এটি ভবিষ্যতের ডিজিটাল সিভিক পার্টিসিপেশন মডেল হতে পারে।

গ. Youth Simulation Council : প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এটি গঠন হবে, যা হবে একটি চিন্তানির্ভর রাষ্ট্রচর্চার ল্যাব। এখানে তরুণরা নানা অধিবেশনে অংশ নেবে। যেমন তথ্যযুদ্ধের কৌশল (information warfare), সাইবার কূটনীতি (cyber diplomacy), ভূরাজনৈতিক চিন্তাভাবনা (geo-strategy), জাতিসঙ্ঘ, OIC, SAARC ইত্যাদির অনুকরণমূলক সংলাপ ইত্যাদিতে।

এটি তরুণদের পরিণত করবে যুক্তি, তথ্য, নৈতিকতা ও কৌশলের মাধ্যমে নেতৃত্বদানকারী ভবিষ্যৎ নাগরিক হিসেবে। ক্লাসরুম আর সিলেবাসের গণ্ডি পেরিয়ে জ্ঞানকে রাজনৈতিক ও কৌশলগত হাতিয়ার হিসেবে গড়ে তোলাই এর লক্ষ্য।

৪. ভূরাজনৈতিক সচেতনতা : স্তম্ভটি বাংলাদেশের তরুণ সমাজকে আন্তর্জাতিক বাস্তবতা, কূটনৈতিক চ্যালেঞ্জ ও ভূরাজনৈতিক চিত্র সম্পর্কে সচেতন করবে। ২১শ শতকের বাংলাদেশ একটি ভূরাজনৈতিক সংঘর্ষ ও কৌশলগত প্রতিযোগিতার কেন্দ্রস্থলে দাঁড়িয়ে। তাই একটি জ্ঞানসমৃদ্ধ, কৌশলনির্ভর ও দৃষ্টিশক্তিসম্পন্ন যুবসমাজ ছাড়া রাষ্ট্রের সার্বভৌম সিদ্ধান্ত নেয়া ও গ্লোবাল পটভূমিতে সম্মানজনক অবস্থান অর্জন সম্ভব নয়।

এই ধারায় যা করা যেতে পারে

ক. মাধ্যমিক স্তর থেকেই Geostrategy & Diplomacyi অন্তর্ভুক্তি : শিক্ষাব্যবস্থায় ভূগোল বা রাষ্ট্রবিজ্ঞান থাকলেও বর্তমান বিশ্বদৃষ্টির জন্য তা যথেষ্ট নয়। তরুণদের জানাতে হবে আন্তর্জাতিক শক্তির মানচিত্র (Great Powers, Multipolarity, Indo-Pacific dznamics), কূটনীতির নীতি ও কৌশল (soft power, track II diplomacy) বাংলাদেশকে ঘিরে আন্তর্জাতিক স্বার্থ (Bay of Bengal, Teesta, Rohingya crisis, BRI vs. Indo-Pacific strategy)

এটি হবে পাঠ্যসূচিতে কৌশলগত চেতনার প্রথম অনুপ্রবেশ, যাতে শিক্ষার্থীরা রাষ্ট্র বুঝতে শেখে।

খ. দক্ষিণ এশিয়া, মুসলিম বিশ্ব ও জাতিসঙ্ঘে বাংলাদেশের ভূমিকায় তরুণদের সরাসরি যুক্ত করার রূপরেখা :

তরুণদের আন্তর্জাতিক বিষয় নিয়ে কেবল পড়ানো নয়, ব্যবহারিকভাবে সম্পৃক্ত করা হবে। যেমন- দক্ষিণ এশীয় রাষ্ট্রগুলোর সাথে সীমান্ত, পানি বণ্টন, অর্থনৈতিক সম্পর্কের মতো বিষয়ে যুব সংলাপ বা মডেল কনফারেন্স। মুসলিম বিশ্বের সাথে কূটনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক-উম্মাহ-চিন্তায় তরুণদের প্রস্তুতি। জাতিসঙ্ঘের বিভিন্ন এজেন্সিতে তরুণ প্রতিনিধি ও ফেলোশিপ কর্মসূচি।

যেন তরুণরা রাষ্ট্রনীতি ও বৈদেশিক নীতিতে ‘অবজারভার’ নয়, অংশগ্রহণকারী হয়।

গ. Bangladesh Youth Geopolitical Forum (BYGF) প্রতিষ্ঠা : এটি হবে একটি জাতীয় কৌশলচর্চার প্ল্যাটফর্ম, যেখানে- ছাত্র, গবেষক, তরুণ কূটনীতিক ও উদ্যোক্তারা দেশের ভূরাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে তুলবে, আঞ্চলিক সঙ্কট, যুদ্ধ, বাণিজ্য ও নিরাপত্তা বিষয়ে গবেষণা ও সংলাপ হবে এবং বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও থিঙ্কট্যাঙ্কের সাথে যৌথ কার্যক্রম চলবে। এই ফোরাম হবে রাষ্ট্রনির্ভর যুবক নয়, রাষ্ট্রনির্মাতা যুবক গড়ার কারখানা।

৫. ন্যায্যতা ও ভবিষ্যৎ সুরক্ষা : এই স্তম্ভের লক্ষ্য হলো বাংলাদেশে যুবশক্তিকে কেবল ভবিষ্যতের নাগরিক হিসেবে নয়, বরং ভবিষ্যতের রক্ষক ও ন্যায্যতার কর্মী হিসেবে গড়ে তোলা। জলবায়ু পরিবর্তন, ভূমি দখল, পানি সঙ্কট ও পরিবেশ বিপর্যয়ের বিরুদ্ধে সংগ্রাম এখন আর কেবল পরিবেশবাদীদের কাজ নয়- এটি ন্যায়বোধসম্পন্ন যুবশক্তির যুদ্ধক্ষেত্র। এই স্তম্ভ দাবি করে-

ক. রাষ্ট্রীয় পরিকল্পনায় যুব ন্যায্যতার সংরক্ষণ :

একে বুঝাবার জন্য Youth Equity Quota পরিভাষার চল রয়েছে। এটি এমন এক ন্যায্যতামূলক কাঠামো, যার মাধ্যমে বাংলাদেশে যেকোনো পরিবেশ, জলবায়ু ও ভূমি-সম্পর্কিত নীতিতে যুবসমাজের সক্রিয়, অর্থবহ ও দায়িত্বশীল অংশগ্রহণ আইনগত ও প্রাতিষ্ঠানিকভাবে বাধ্যতামূলক করা হবে।

খ. Climate Youth Corps গঠনের প্রস্তাব: এটি হবে একটি প্রশিক্ষিত, সংগঠিত ও অভিযানে সক্ষম যুববাহিনী, যাদের কাজ হবে-

নদীর গতিপ্রকৃতি, বনাঞ্চল, জলাভূমি, উপকূলীয় অঞ্চল ও জীববৈচিত্র্য নিয়ে তথ্য সংগ্রহ, পর্যবেক্ষণ ও প্রতিবেদন তৈরি।

দুর্যোগকালীন সময়ে স্বেচ্ছাসেবী সহায়তা ও পুনর্বাসন কার্যক্রম।

স্থানীয় জনগোষ্ঠীর সাথে পরিবেশ-সচেতনতা ও প্রতিবাদ সংগঠনে নেতৃত্বদান।

নদী-পাহাড় বন-সমুদ্র- এই চার জাতীয় ঐতিহ্যের ভিত্তিকে পরবর্তী প্রজন্মের জন্য সংরক্ষণ করা।

এ হচ্ছে একধরনের Green Territorial Citizenship- যেখানে তরুণরা শুধু বসবাসকারী নয়, জল-জমি-জীবনের দায়িত্বশীল রক্ষক হতে শিখবে।

৬. উদ্ভাবনী নেতৃত্ব ও কৌশলচর্চা : এই স্তম্ভ বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ নির্মাণে তরুণদের নেতৃত্ব ও বুদ্ধিবৃত্তিক অংশগ্রহণকে নীতি ও কাঠামোর স্তরে বৈধতা দিতে চায়। রাষ্ট্র কেবল নেতৃত্ব তৈরি করবে না, বরং উদ্ভাবক ও কৌশলজ্ঞ তরুণদের স্বাধীন চিন্তা, গবেষণা ও দিকনির্দেশনা প্রদানের পরিবেশ নিশ্চিত করবে। এ স্তম্ভের দাবি-

ক. জাতীয় বাজেটে Youth Sovereignty Fund : এটি হবে সরকারি বাজেটের একটি পৃথক ও সংরক্ষিত অংশ, যার মাধ্যমে তরুণ উদ্ভাবক, গবেষক, চিন্তক ও সংগঠকদের উদ্যোগকে আর্থিক, প্রযুক্তিগত ও নীতিগত সহায়তা দেওয়া হবে।

এর লক্ষ্য হবে : প্রযুক্তি, সাহিত্য, জলবায়ু, ইতিহাস বা কৌশল বিষয়ক স্বাধীন গবেষণা; গ্রাম ও শহরভিত্তিক উদ্ভাবনী সমাজ-উন্নয়ন প্রকল্প; বিশ্ববিদ্যালয়, মাদরাসা, কারিগরি প্রতিষ্ঠানসহ সবক্ষেত্রের চিন্তাশীল তরুণদের সমান সুযোগ।

এই তহবিল দাতাভিত্তিক হবে না, হবে অধিকারভিত্তিক। এর উদ্দেশ্য হচ্ছে Youth as Strategic Stakeholders.

খ. যুব পরিচালিত গবেষণাকেন্দ্র- Think Bangladesh 2050 :

এটি হবে একটি স্বাধীন, রাষ্ট্রীয়ভাবে সমর্থিত কিন্তু যুব পরিচালিত থিঙ্কট্যাঙ্ক; যা বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ পথরেখা নির্ধারণে চিন্তা, গবেষণা ও কৌশলগত সুপারিশ দেবে।

এর কাজের মধ্যে থাকবে- রাষ্ট্র ও নিরাপত্তা, প্রতিরক্ষা ও অন্যান্য সক্ষমতা, ডিজিটাল রূপান্তর, শিক্ষা, ভৌগোলিক কৌশল বিষয়ে নীতিপত্র তৈরি; সরকার, বেসরকারি খাত ও আন্তর্জাতিক অংশীদারদের জন্য গবেষণাকর্ম; Policy Simulation Lab I Youth Strategic Dialogues ইত্যাদির আয়োজন।

Think Bangladesh ২০৫০ তরুণদের পলিসি ফলোওয়ারের জায়গা থেকে পলিসি মেকার হওয়ার দিশা দেবে। কারণ রাষ্ট্রকে যে তরুণেরা বোঝে, তারাই একে গড়ে তুলতে পারে।

নেতৃত্ব মানে ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তা, দৃষ্টি ও দায় নেয়া। উদ্ভাবন মানে চিন্তার কাঠামো, নীতির ভাষা ও বাস্তবতা-নির্মাণের ক্ষমতা। আমরা চাই দক্ষ যুব নেতৃত্ব। এই দক্ষতাকে দূরদৃষ্টি ও চিন্তাশক্তিসম্পন্ন কৌশলগত নেতৃত্বে রূপান্তরিত করার দায়ও রাষ্ট্রের। এ জন্য প্রয়োজন এমন যুবরূপরেখা, যা ২১শ শতকের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় যথার্থ ও অগ্রসর।

লেখক : কবি, সাহিত্যিক
[email protected]