আওয়ামী লীগ দেশের একটি প্রাচীন রাজনৈতিক দল। ১৯৪৯ সালে গঠিত দলটি একসময় এদেশের সর্ববৃহৎ রাজনৈতিক দলের মর্যাদাও পেয়েছিল। দলটি মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তি ও গণতান্ত্রিক অধিকার প্রতিষ্ঠার কথা মুখে বললেও কার্যত দুই দুবার ক্ষমতায় আসীন হয়ে গণতন্ত্রকে হত্যা করে। একবার ১৯৭৫ ও আরেকবার ২০১১ সালে। ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টে সংগঠিত ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী সরকারের পতন ঘটার পর ২০২৫ সালের ১২ মে এক সরকারি নির্দেশে আওয়ামী লীগের সব কার্যক্রম স্থগিত করা হয়। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানকালে ফ্যাসিস্ট হাসিনা সরকারের নির্দেশে নিরাপত্তা বাহিনী ও আওয়ামী গুণ্ডাদের গুলিতে দুই হাজারের মতো মানুষ নিহত হওয়ায় আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের দাবি ওঠে। যার ফলে ড. ইউনূস নেতৃত্বাধীন সরকার আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধ ঘোষণা করতে বাধ্য হয়।
একটি নির্বাচিত সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করার লক্ষ্যে আগামী বছরের ফেব্রুয়ারিতে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে বলে সরকারের পক্ষ থেকে ইতোমধ্যেই ঘোষণা দেয়া হয়েছে। সরকারের এ ঘোষণার পর কোনো কোনো মহল থেকে আওয়ামী লীগকে নির্বাচনে অংশ নেয়ার সুযোগ দানের জন্য ইনিয়ে বিনিয়ে দাবি তোলা হচ্ছে। তাদের বক্তব্য হচ্ছে, ১. আওয়ামী লীগ দেশের বৃহৎ দু’টি রাজনৈতিক দলের একটি। তাদের নেতৃত্বে দেশ স্বাধীন হয়েছে। অতএব এরকম একটি বৃহৎ দলকে বাইরে রেখে নির্বাচন করা হলে তা অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচন হবে না এবং আন্তর্জাতিক মহলে গ্রহণযোগ্য হবে না। ২. যেহেতু গণ-অভ্যুত্থানের মূল লক্ষ্য ছিল দেশে বিরাজমান বৈষম্যমূলক ব্যবস্থার অবসান ঘটানো, সে কারণে আওয়ামী লীগকে নির্বাচনে অংশ নিতে না দেয়া হলে তা হবে বৈষম্যমূলক আচরণ। ৩. দেড় দশকের হত্যা-লুণ্ঠন-চৌর্যবৃত্তির সাথে আওয়ামী লীগের সবাই জড়িত ছিল না। অতএব সবাইকে এক পাল্লায় মাপা ঠিক হবে না। তাদেরকে রাজনীতিতে ফিরে আসার সুযোগ দিতে হবে।
মজার ব্যাপার হলো, রাজনৈতিক দলের কার্যক্রম নিষিদ্ধ হওয়ার কারণে তাদের সমর্থকদেরকে ভোটাধিকার প্রয়োগের যে বিষয়টি নিয়ে এখন আলোচনা হচ্ছে সেরকম একটি পরিস্থিতি কিন্তু ১৯৭৩ সালেও সৃষ্টি হয়েছিল। কিন্তু তখন সে বিষয়ে কেউ কোনো কথা বলেনি। অবশ্য তখন বাংলাদেশে এত পত্র-পত্রিকা, টেলিভিশন চ্যানেল, ফেসবুক, ইউটিউব, টেলিগ্রাম ইত্যাদি ছিল না। সেই সাথে ছিল না (টকশো বুদ্ধিজীবী)। বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পর ১৯৭২ সালে সাংবিধানিকভাবে ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধ ঘোষিত হওয়ার পর মুসলিম লীগ, জামায়াতে ইসলামী, পিডিপি, নেজামে ইসলাম পার্টি, জমিয়তে ওলামায়ে ইসলামের মতো দলগুলোর কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়। এরপর ১৯৭৩ সালে যখন বাংলাদেশে প্রথম সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় তখন ওই দলগুলো আর নির্বাচনে অংশ নিতে পারেনি। সে সময় তাদের সমর্থকরা কি করেছিল তা নিয়ে আলোচনা হওয়া দরকার।
১৯৭০ সালে অনুষ্ঠিত পাকিস্তানের প্রথম সাধারণ নির্বাচনে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ বিপুল ভোটে জয়লাভ করে। পূর্ব পাকিস্তানের জন্য নির্ধারিত ১৬২টি আসনের মধ্যে তারা ১৬০টি আসনে বিজয়ী হয়। তাদের প্রাপ্ত ভোটের হার ছিল ৭৫.১১ শতাংশ। ওই নির্বাচনে অন্যান্য দলের মধ্যে জামায়াতে ইসলামী ৬.০৭, পাকিস্তান মুসলিম লীগ (কাইউম) ১.০৭, পাকিস্তান মুসলিম লীগ (কনভেনশন) ২.৮১, পাকিস্তান কাউন্সিল মুসলিম লীগ ১.০৬, পিডিপি ২.৮১, জমিয়তে ওলামায়ে ইসলাম ০.৯২, নেজামে ইসলাম পার্টি ২.৮৩ এবং আরো কিছু ছোট ছোট দল ১.২৫ শতাংশ পায়। অর্থাৎ আওয়ামী লীগ-বিরোধী এবং ধর্মীয় মনোভাবাপন্ন দলগুলোর প্রাপ্ত ভোটের হার ছিল ১৮.৮২ শতাংশ।
মনে রাখতে হবে, ওই সময় আওয়ামী লীগের পক্ষে একটি জনজোয়ার সৃষ্টি হয়েছিল এবং আওয়ামী লীগও নির্বাচনের মাঠে অন্য কোনো দলের উপস্থিতি সহ্য করতে রাজি ছিল না। তারা আওয়ামীবিরোধী কোনো দলকে মাঠে-ময়দানে প্রচারণা চালাতে দেয়নি। পেশিশক্তি প্রয়োগ করে অন্য দলের মিছিল, মিটিং পণ্ড করে দিত। ওই বছরের ১৮ জানুয়ারি পল্টন ময়দানে আয়োজিত জামায়াতের জনসভায় আওয়ামী গুণ্ডারা হামলা চালিয়ে দু’জনকে হত্যা করে এবং আরো হাজারখানেক কর্মী ও সমর্থককে আহত করে। পরবর্তীতে তারা পিডিপি ও মুসলিম লীগ আয়োজিত জনসভাগুলোও একই স্টাইলে পণ্ড করে দেয়। এ বিষয়ে স্বাধীন বাংলা নিউক্লিয়াসের অন্যতম নেতা কাজী আরেফ আহমদের লেখা, ‘বাঙালির জাতীয় রাষ্ট্র’ বইয়ে স্বীকারোক্তিমূলক তথ্য রয়েছে।
ওই বইয়ে তিনি লিখেছেন, ‘‘এ ছাড়া দুই অংশের ঐক্যের উপর জোর সৃষ্টিকারী যেকোনো অনুভূতিশীল পদক্ষেপের উপর আওয়ামী লীগ আঘাত হানতে শুরু করল। জামায়াতে ইসলামীর ১৮ জানুয়ারির জনসভা পণ্ড করা হয়েছিল। কেননা, ওই সভাতে দুই অংশের বন্ধনের প্রশ্নে ইসলামী ঐক্যের উপর জোর দেয়া হয়েছিল। নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার বাকি সময়টুকুতেও আওয়ামী লীগ তার এই কৌশলের পুনরাবৃত্তি ঘটাল। দলটি একইভাবে ১ ফেব্রুয়ারিতে পিডিপির ঢাকার জনসভা, ২৮ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রামের জনসভা ও সৈয়দপুরে ৭ মার্চের জনসভা পণ্ড করে দিলো। কুমিল্লায় ১০ মার্চের কনভেনশন মুসলিম লীগের সভা, বরিশালের ১৫ মার্চ এবং ঢাকার ১২ মার্চের জনসভা নষ্ট করে দেয়া হলো। বিভিন্ন রাজনৈতিক গ্রুপ আয়োজিত আরো কয়েকটি জনসভা পণ্ড করে দেয়া হলো। এ কাজগুলো ‘নিউক্লিয়াস’ ও ‘বিএলএফ’-এর সদস্যরাই ঘটাল।” (পৃষ্ঠা-৮৩)
এখন দেখা যাক, ১৯৭৩ সালের প্রথম সাধারণ নির্বাচনের ফলাফল কি ছিল। ওই নির্বাচনে প্রদত্ত ভোটের হার ছিল ৫৪.৯ শতাংশ। ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনের প্রদত্ত ভোটের হার ছিল ৫৭ শতাংশ (অর্থাৎ- ’৭৩-এর নির্বাচনে ২.১ শতাংশ ভোট কম পড়েছে)। তার মধ্যে আওয়ামী লীগ পেয়েছে ৭৩.২০, ন্যাপ ৮.৩২, জাসদ ৬.৫২, ন্যাপ ভাসানী ৫.৩২ ও জাতীয় লীগ ০.৩৩ শতাংশ। অর্থাৎ আওয়ামীবিরোধী দলগুলো পেয়েছে ২০.৪৯ শতাংশ। এ থেকে দেখা যায়, সত্তরের নির্বাচনের তুলনায় আওয়ামী লীগের ভোট কমেছে ১.৯১ শতাংশ। এসব কিছু বিশ্লেষণ করলে বোঝা যায়, ধর্মীয় মনোভাবাপন্ন দলগুলোর ভোটাররা ব্যাপকভাবে ভোট দানে বিরত ছিল তা নয়। তারা ঠিকই ভোট দিয়েছে এবং আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধেই ভোট দিয়েছে।
যেহেতু এটি নিশ্চিত, আসন্ন ফেব্রুয়ারি নির্বাচনে আওয়ামী লীগ অংশ নিতে পারবে না, তাহলে আওয়ামী ভোটাররা কী করবে? প্রথম অপশন, তারা ভোট দিতে যাবে না, যাতে করে ভোটারের অংশগ্রহণ কমে যায়। প্রদত্ত ভোটের হার যদি অনেক কম হয় তাহলে আওয়ামী লীগ, ভারত ও তাদের অনুগত সুশীল বুদ্ধিজীবীরা নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলতে পারবে। তবে এর সম্ভাবনা কম, কারণ গ্রামেগঞ্জে যদি আওয়ামী ভোটাররা ভোট দিতে না যায় তাহলে তারা পতিত স্বৈরাচারের দোসর হিসেবে চিহ্নিত হয়ে যাবে। সেই ঝুঁকি তারা নিতে চাইবে না। দ্বিতীয় অপশন, কমিউনিস্ট পার্টি, জাসদ বা জাতীয় পার্টিতে তারা ভোট দিতে পারে যাতে করে আওয়ামী লীগ তাদের ওইসব পুরনো সহযোগীদের কাঁধে ভর করে আবার রাজনীতিতে ফিরে আসতে পারে। সে ক্ষেত্রে সমস্যা হলো আওয়ামী লীগ নেতারা ওইসব দলের টিকিটে নির্বাচন করতে চাইলেও ওইসব দলের নেতারা মেনে নিতে চাইবে বলে মনে হয় না। তৃতীয় অপশন, বিএনপিকে ভোট দেয়া। বিএনপির সাথে আওয়ামী নেতাদের চেনাজানা বহু দিনের। দুই দলের নেতাদের অনেকেরই মধ্যে পারিবারিক, বৈবাহিক, সামাজিক ও ব্যবসায়িক সম্পর্ক রয়েছে। আর বিএনপি নেতাদের অনেকের মধ্যে আওয়ামী লীগের ব্যাপারে সফট কর্নার রয়েছে। কারণ তারাও একসময় আওয়ামী লীগের রাজনীতি করত। এ ছাড়া বিএনপি কখনোই রাজনীতি থেকে আওয়ামী লীগকে উচ্ছেদ করতে চায়নি। পঁচাত্তরের পর আওয়ামী লীগের যখন দুঃসময় চলছিল তখন জিয়াউর রহমান অজ্ঞাত কারণে শেখ হাসিনাকে দেশে ফিরিয়ে আনার সুযোগ করে দেন। চতুর্থ অপশন, জামায়াতকে ভোট দেয়া। তৃণমূলে আওয়ামী লীগের কর্মী-সমর্থকদের মধ্যে জামায়াতের ব্যাপারে একটি ইতিবাচক মনোভাব তৈরি হয়েছে নিরাপত্তাজনিত কারণে। বিশেষ করে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের লোকজনের মধ্যে। কারণ জামায়াতের নেতাকর্মীরা অনেক ক্ষেত্রে তাদের ঘরবাড়ি ও মন্দির রক্ষায় সহায়তা করেছে। তবে ভারত যেহেতু জামায়াতকে পছন্দ করে না, সে কারণে শেখ হাসিনার নির্দেশ বা ভারতের ইঙ্গিত ছাড়া তারা জামায়াতকে ভোট দেবে বলে মনে হয় না। আর নবগঠিত এনসিপির ব্যাপারে আওয়ামী লীগ খুবই নাখোশ। তারা মনে করে, এনসিপির কারণে তাদের ক্ষমতা ছেড়ে পালিয়ে যেতে হয়েছে।