ড. মো: তৌহিদুল আলম খান
টেকসই উন্নয়নের এই যুগে বাঁশ একটি অসাধারণ সম্পদ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে, যাকে ‘সবুজ সোনা’ বলা হয়। এই দ্রুত বর্ধনশীল উদ্ভিদটি পরিবেশবান্ধব হওয়ার পাশাপাশি অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য একটি বিশাল সুযোগও তৈরি করেছে। বিশ্বব্যাপী টেকসই পদ্ধতির দিকে ঝোঁক বাড়ার সাথে সাথে বাঁশ তার দ্রুত বৃদ্ধি, বহুমুখী ব্যবহার ও পরিবেশগত সুবিধার কারণে বিশেষভাবে আলোচিত হচ্ছে। বাংলাদেশ তার অনুকূল জলবায়ু, জীববৈচিত্র্য ও অর্থনৈতিক সম্ভাবনার কারণে বিশ্বব্যাপী বাঁশশিল্প উন্নয়নে নেতৃত্ব দেয়ার ক্ষেত্রে আদর্শ অবস্থানে রয়েছে। বাংলাদেশের বাঁশ খাতে বিনিয়োগ করা শুধু লাভজনকই নয়; বরং এটি পরিবেশবাদী হিসেবে আমাদের দায়িত্ববোধেরও একটি প্রকাশ।
বাঁশ প্রকৃতির একটি বিস্ময়
বাঁশ অন্য যেকোনো গাছের চেয়ে আলাদা। এটি মাত্র তিন থেকে পাঁচ বছরে পরিপক্ব হয়, যা একে ঐতিহ্যবাহী কাঠের চেয়ে দ্রুত বর্ধনশীল বিকল্প করে তোলে। কিছু প্রজাতির বাঁশ দিনে ৯১ সেন্টিমিটার পর্যন্ত বৃদ্ধি পেতে পারে, যা বিনিয়োগকারীদের জন্য দ্রুত রিটার্ন নিশ্চিত করে। তবে বাঁশের আকর্ষণ শুধু এর বৃদ্ধির হারেই সীমাবদ্ধ নয়। এই উদ্ভিদটি অত্যন্ত বহুমুখী, যার ব্যবহার নির্মাণশিল্প, আসবাবপত্র, টেক্সটাইল, কাগজ, বায়োফুয়েল এবং এমনকি বাঁশের চাল ও বাঁশের পাতার চায়ের মতো খাদ্যপণ্যেও দেখা যায়। এর শক্তি ও স্থায়িত্ব কাঠের একটি টেকসই বিকল্প হিসেবে কাজ করে, যা বন উজাড় হওয়ার হার কমাতে সাহায্য করে।
বাংলাদেশের বাঁশের সম্ভাবনা ও প্রাকৃতিক সুবিধা
বাংলাদেশ প্রাকৃতিক সম্পদে সমৃদ্ধ এবং বাঁশও এর ব্যতিক্রম নয়। দেশে ৩০টিরও বেশি স্থানীয় বাঁশের প্রজাতি রয়েছে, যা এখানকার গ্রীষ্মমণ্ডলীয় জলবায়ুতে ভালোভাবে বৃদ্ধি পায়। বর্তমানে বাঁশ খাত প্রতি বছর প্রায় ২০০ মিলিয়ন ডলার অর্থনীতিতে অবদান রাখে এবং গ্রামীণ এলাকায় ১৫ লাখেরও বেশি মানুষকে কর্মসংস্থান প্রদান করে। এই কর্মসংস্থান শুধু পরিবারগুলোর জীবিকা নির্বাহেই সাহায্য করে না; বরং গ্রামীণ উন্নয়নেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। আরো বিনিয়োগের মাধ্যমে ২০৩০ সালের মধ্যে অতিরিক্ত পাঁচ লাখ কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা সম্ভব, যা অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও দারিদ্র্যবিমোচনে সাহায্য করবে। বাংলাদেশ সরকার এই সম্ভাবনা উপলব্ধি করে অষ্টম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় (২০২১-২৫) বাঁশ খাতের উন্নয়নে ১০ মিলিয়ন ডলার বরাদ্দ করেছে, পাশাপাশি সবুজ শিল্পের জন্য বিভিন্ন কর প্রণোদনা প্রদান করছে।
বিশ্বব্যাপী চাহিদা ও লাভজনক সুযোগ
বিশ্বব্যাপী বাঁশের বাজার দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে। ২০৩০ সাল নাগাদ এই বাজার ৯৮.৩ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছানোর পূর্বাভাস দেয়া হয়েছে, যা টেকসই পণ্যের ক্রমবর্ধমান চাহিদার দ্বারা চালিত হচ্ছে। ২০২২ সালে বাংলাদেশ বিশেষ করে ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে প্রায় ১৫ মিলিয়ন ডলার মূল্যের বাঁশজাত পণ্য রফতানি করেছে। আসবাবপত্র, হস্তশিল্প ও ফ্লোরিংয়ের মতো উচ্চ চাহিদাসম্পন্ন পণ্যগুলো বাংলাদেশকে টেকসই পণ্যের ক্রমবর্ধমান প্রবণতার সুযোগ নেয়ার ক্ষেত্রে ভালো অবস্থানে রয়েছে।
বহুমুখী পণ্য ও নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন
বাঁশ খাতের বৈচিত্র্যময় সম্ভাবনা অত্যন্ত আকর্ষণীয়। এর ঐতিহ্যবাহী ব্যবহারের বাইরেও বাঁশ থেকে উদ্ভাবনী পণ্য তৈরি করা হচ্ছে, যেমন বাঁশের চাল, যা পুষ্টিগুণে ভরপুর এবং যা সুষম খাদ্য হিসেবে খুবই উপযুক্ত। বাঁশের লবণ যা অতি উপকারী ও গুণাবলি সমৃদ্ধ হিসেবে পরিচিত এবং বাঁশের কাঠের বোর্ড, যা ঐতিহ্যবাহী কাঠের টেকসই বিকল্প হিসেবে বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয়তা পাচ্ছে।
জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় বাঁশের ভূমিকা
বাঁশের পরিবেশগত অবদান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এটি একটি শক্তিশালী কার্বন সিঙ্ক হিসেবে কাজ করে, প্রতি হেক্টরে বছরে ১২ টন পর্যন্ত কার্বন ডাই-অক্সাইড শোষণ করতে পারে, যা সাধারণ গাছের তুলনায় অনেক বেশি। বাংলাদেশে ৬০ হাজার হেক্টর বাঁশের বাগান থাকলে প্রতি বছর প্রায় সাত লাখ ২০ হাজার টন কার্বন ডাই-অক্সাইড শোষণ করা সম্ভব, যা জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখে। এ ছাড়াও বাঁশের ব্যাপক শিকড় ব্যবস্থা মাটির ক্ষয় রোধ করে এবং ভূমি পুনরুদ্ধারে সাহায্য করে।
কার্বন ট্রেডিং ও নতুন আয়ের উৎস
বাঁশের বাগান কার্বন ট্রেডিংয়ের সুযোগও তৈরি করে। বাঁশে বিনিয়োগ করে এর বিনিয়োগকারীরা শুধু পরিবেশ সংরক্ষণেই অবদান রাখে না, বরং কার্বন ক্রেডিটের মাধ্যমে আর্থিক সুযোগও কাজে লাগাতে পারে। এটি বিশেষভাবে উল্লেখ্য যে, ২০৩০ সালের মধ্যে কার্বন ট্রেডিং থেকে বাংলাদেশের বছরে ৫০ মিলিয়ন ডলার আয়ের সম্ভাবনা রয়েছে।
সরকারি সমর্থন ও অনুকূল বিনিয়োগ পরিবেশ
বাংলাদেশ সরকার বাঁশ খাতের সম্ভাবনা উপলব্ধি করে এর উন্নয়নে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। গবেষণা, উন্নত চাষাবাদ পদ্ধতি ও মূল্য সংযোজিত পণ্য উন্নয়নে বিনিয়োগ করা হচ্ছে, যা একটি বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ তৈরি করছে।
কেন বাঁশে বিনিয়োগ করবেন
বাঁশ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, পরিবেশগত স্বাস্থ্য ও সামাজিক উন্নয়নের মধ্যে একটি ব্যাপক সামঞ্জস্যপূর্ণ সম্পর্ক তৈরি করে। এটি লোহার রড, প্লাস্টিক ও অন্যান্য উপকরণের টেকসই বিকল্প হিসেবে কাজ করে। এ ছাড়াও বাঁশ খাতে উদ্যোক্তারা স্বল্প সুদে ঋণ পেতে পারেন এবং ব্যাংকগুলো ক্রেডিট গ্যারান্টি সুবিধার মাধ্যমে ছোট ব্যবসাগুলোর জন্য অর্থায়ন সহজতর করছে।
সম্মিলিত প্রচেষ্টা : টেকসই ভবিষ্যৎ
বাঁশ টেকসই ও লাভজনক বিনিয়োগের একটি অনন্য সুযোগ সৃষ্টি করে। এটি অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, পরিবেশগত স্থিতিশীলতা ও সামাজিক উন্নয়নের মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখে। বিশ্বব্যাপী টেকসই পণ্যের চাহিদা বৃদ্ধির সাথে সাথে এখনই সময় বাংলাদেশের বাঁশ খাতে বিনিয়োগ করার। একসাথে আমরা এই অসাধারণ সম্পদের সম্ভাবনা কাজে লাগাতে পারি এবং বাংলাদেশ ও বিশ্বের জন্য একটি টেকসই ভবিষ্যৎ গড়ে তুলতে পারি। বাঁশ শুধু একটি পরিবেশবান্ধব বিকল্পই নয়, এটি একটি সমৃদ্ধ ব্যবসায়িক সুযোগও বটে। বিনিয়োগকারী ও উদ্যোক্তাদের এখনই সময় এই ‘সবুজ সোনা’র সম্ভাবনাকে কাজে লাগানোর!
লেখক : ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা, এনআরবিসি ব্যাংক পিএলসি।



