একটি বিমান ঘাঁটি নিয়ে কেন এই উত্তেজনা

পরিশেষে এখানে উল্লেখ করতে হয়, ডোনাল্ড ট্রাম্প দ্বিতীয়বার মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর প্রথমে পানামা খাল, পরে গ্রিনল্যান্ড দখলে নেয়ার অভিপ্রায় ব্যক্ত করেছিলেন। পরে তা নিয়ে খুব একটা হইচই করেননি। সর্বশেষ তিনি বাগরাম বিমান ঘাঁটি নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নেয়ার কথা বললেন।

সামরিক কৌশলগত দিক দিয়ে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি বিমান ঘাঁটি নিয়ে বিশ্ব মোড়লদের মধ্যে বেশ উত্তেজনা দেখা দিয়েছে। সম্প্রতি মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এ বিমান ঘাঁটির উপর পুনরায় দখলদারিত্ব প্রতিষ্ঠার ইচ্ছা প্রকাশ করলে বিশ্ব সম্প্রদায় অবাক বিস্ময়ে পরবর্তী ঘটনাবলি দেখার অপেক্ষায় রয়েছে। এটি হচ্ছে আফগানিস্তানের সেই বাগরাম বিমান ঘাঁটি, যেটি ২০২১ সালে পরাজয়ের গ্লানি নিয়ে মার্কিন সেনারা পরিত্যাগ করে চলে গিয়েছিল। আজ তিন বছর পর ডোনাল্ড ট্রাম্প সেই বিমান ঘাঁটি ফেরত চেয়েছেন। না দিলে ভয়ঙ্কর পরিণতির কথাও সে দেশের তালেবান শাসকদের স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন।

তিনি সম্প্রতি সোশ্যাল মিডিয়ার ‘ট্রুথ সোশ্যালে’ লিখেছেন, বাগরাম ঘাঁটিটি যারা নির্মাণ করেছে অর্থাৎ- ওয়াশিংটনের কাছে যদি তুলে দিতে আফগানিস্তান রাজি না হয়, তাহলে দেশটির জন্য খারাপ কিছু ঘটতে যাচ্ছে। এর আগে লন্ডন সফরকালে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, চীনকে মোকাবেলা করতে ঘাঁটিটি ফিরে পেতে চায় ওয়াশিংটন। কারণ চীন যেখানে তার পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি করে, সেখান থেকে বাগরামের দূরত্ব মাত্র এক ঘণ্টার পথ।

কিন্তু কিভাবে ওয়াশিংটনের এ প্রস্তাব বাস্তবায়িত হবে তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। কারণ, ইতোমধ্যে আফগান সরকার এই প্রস্তাব দৃঢ়ভাবে প্রত্যাখ্যান করেছে। তাছাড়া ২০২০ সালে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের প্রথম মেয়াদে কাতারের রাজধানী দোহাতে তালেবানের সাথে যে চুক্তি হয়েছিল সেটি বড় বাধা হয়ে দাঁড়াবে। সেই চুক্তিতে বাগরামসহ আফগানিস্তানের সব স্থান থেকে মার্কিন সেনা প্রত্যাহার করাসহ দেশটির সার্বভৌমত্ব ও অখণ্ডতায় হস্তক্ষেপ না করার অঙ্গীকার করা হয়েছে। রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞদের অভিমত, আফগানিস্তান রাজি না হলে সে ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রকে সেনা পাঠিয়ে দখল নিতে হবে; কিন্তু দোহা চুক্তি বাধা হয়ে দাঁড়ালে যুক্তরাষ্ট্র কী করবে তাও দেখার বিষয়।

তবে যুক্তরাষ্ট্র যদি নিজের ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থে ২০০১-এর মতো সেনা পাঠিয়ে বাগরাম বিমান ঘাঁটি দখলের চেষ্টা করে তাহলে অবধারিতভাবে রাশিয়া আফগানিস্তানের সাথে প্রতিরোধে যুক্ত হবে। কারণ মার্কিন সেনা প্রত্যাহারের পর রাশিয়া প্রথম আফগানিস্তানের তালেবান সরকারকে স্বীকৃতি দিয়েছিল। এ ছাড়া সেখানে চীনের বিপুল বিনিয়োগ রয়েছে যা রক্ষায় বেইজিংও এগিয়ে আসবে। ফলে আফগানিস্তান বিশ্ব মোড়লদের ভয়াবহ সঙ্ঘাতের স্থানে পরিণত হবে। আর যুদ্ধক্ষেত্রের পাশের দেশ হিসেবে সবচেয়ে বেশি বিপদে পড়বে পাকিস্তান। অতীতের দু’টি দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধে সবচেয়ে বেশি ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছিল ওই দেশটি। যদিও টিটিপি উগ্রবাদী গোষ্ঠী নিয়ে আফগানিস্তানের সাথে পাকিস্তানের বিরোধ চরম পর্যায়ে রয়েছে। কারণ, পাকিস্তানের প্রতিবাদ সত্তে¡ও আফগানিস্তান এ উগ্রবাদী গোষ্ঠীকে আশ্রয়-প্রশ্রয় দিয়ে আসছে যারা প্রতিনিয়ত পাকিস্তানের অভ্যন্তরে সন্ত্রাসী হামলা চালিয়ে যাচ্ছে। তবু আফগানিস্তানে আরেকটি মার্কিন আগ্রাসন পাকিস্তানের জন্য বড় বিপদ ডেকে আনবে।

এ পটভূমিতে পাকিস্তানের প্রতি ট্রাম্প প্রশাসনের সাম্প্রতিক অতি আগ্রহকে সন্দেহের চোখে দেখছেন, সেখানে অনেক রাজনৈতিক বিশ্লেষক। বিশেষ করে গত মে মাসে ভারত-পাকিস্তান সংক্ষিপ্ত যুদ্ধের পর মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প পাকিস্তানকে কেবল গুরুত্ব দেয়াই শুরু করেননি; বরং সেখানে খনিজসম্পদ উত্তোলন ও নিরাপত্তা প্রদানের ব্যাপারেও আগ্রহ প্রকাশ করেছেন। পাক সেনাপ্রধান জেনারেল আসিফ মুনিরকে একটি ডিনারে দাওয়াত দিয়ে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প সেই গুরুত্ব আরো জোরালো করেছেন। সুতরাং পাকিস্তানের অনেক রাজনৈতিক বিশ্লেষক মনে করছেন, এ গুরুত্ব দেয়ার পেছনে নিশ্চয় যুক্তরাষ্ট্রের কোনো বড় পরিকল্পনা থাকতে পারে। যেমনটি পারভেজ মোশারফের সময় যুক্তরাষ্ট্রের সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধে পাকিস্তান জড়িয়ে পড়েছিল। ভবিষ্যতে তেমনটি ঘটলে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না।

নিশ্চয় ২০০১ সালের ৭ অক্টোবর আফগানিস্তানের তালেবান সরকারের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের ‘সন্ত্রাসবিরোধী’ যুদ্ধ শুরু করে, যে ঘটনা অনেকের স্মরণ আছে। সেই যুদ্ধের নাম ছিল ‘অপারেশন ইনডুরিং ফ্রিডম’। তখন পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ছিলেন জেনারেল পারভেজ মোশারফ। আফগানিস্তানে প্রবেশে মার্কিন সেনাদের পাকিস্তানের মাটি ব্যবহারের অনুমতি দেন তিনি। সেই সাথে সব ধরনের সামরিক সহায়তা দেন। সুতরাং আগামীতে এরকম একটি পরিস্থিতি ঘটলে সে ক্ষেত্রে পাকিস্তানের ভূমি ব্যবহারের লক্ষ্যে যুক্তরাষ্ট্রের এই পাকিস্তানপ্রীতি হয়ে থাকতে পারে বলে অনেক রাজনৈতিক বিশ্লেষক মনে করছেন।

এ দিকে আগেই উল্লেখ করেছি, এ ধরনের একটি যুদ্ধ এসে পড়লে রাশিয়া ও চীন তাতে জড়িয়ে পড়বে, পরিণামে আরেকটি মহাযুদ্ধ শুরু হয়ে গেলে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। ইতোমধ্যে চীন আফগানিস্তানের সার্বভৌমত্ব ও অখণ্ডতা রক্ষার অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছে। শুধু তাই নয়, তার নিজস্ব ভূ-রাজনৈতিক কৌশল ও আফগানিস্তানে বিপুল বিনিয়োগ নিশ্চিতের লক্ষ্যে সর্বাত্মক চেষ্টা চালাবে। ইতোমধ্যে চীনের কর্মকৌশলবিদরা বাগরাম বিমান ঘাঁটিতে রয়েছে। সুতরাং যুক্তরাষ্ট্র বাগরাম বিমান ঘাঁটি নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে কোনো সামরিক অভিযান চালালে তা ২০০১ সালের মতো অত সহজ হবে না। কারণ রাশিয়া ও চীনের মতো দুই পরাশক্তি বাধা হয়ে দাঁড়াবে।

প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ করতে হয়, বাগরাম বিমান ঘাঁটিটির ইতিহাস ও বেশ মজার। এটি ১৯৫০ সালে নির্মাণ করেছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন। পরবর্তীতে আফগানিস্তানে যুক্তরাষ্ট্রের দখলদারিত্বের কালে এটির ব্যাপক উন্নয়ন ঘটানো হয়। অত্যাধুনিক সব সুযোগ সুবিধা নিয়ে এ বিমান ঘাঁটিতে এক সাথে ১০ হাজার সেনা অবস্থান করতে পারে। ২০২১ সালে তালেবানের হাতে মার্কিন সেনারা পরাজিত হয়ে ওই বাগরাম বিমান ঘাঁটি ছেড়ে চলে গেলে পরবর্তীতে সেখানে চীনাদের উপস্থিতি লক্ষণীয়ভাবে বাড়তে থাকে। এ পটভূমিতে যুক্তরাষ্ট্র এই বিমান ঘাঁটি নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিতে চাচ্ছে।

এ বিমান ঘাঁটির সামরিক কৌশলগত অবস্থান আকৃষ্ট করছে বিশ্বের পরাশক্তিগুলোকে। কারণ, এটি দক্ষিণ এশিয়া, মধ্য এশিয়া, মধ্যপ্রাচ্য ও পারস্যের সন্ধিস্থল। এ ঘাঁটি থেকে ওইসব অঞ্চলে নজর রাখা ও সামরিক সুবিধা পাওয়া খুব সহজ। তাই এটি যুক্তরাষ্ট্রের জন্য যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি গুরুত্বপূর্ণ চীনের জন্যও।

পরিশেষে এখানে উল্লেখ করতে হয়, ডোনাল্ড ট্রাম্প দ্বিতীয়বার মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর প্রথমে পানামা খাল, পরে গ্রিনল্যান্ড দখলে নেয়ার অভিপ্রায় ব্যক্ত করেছিলেন। পরে তা নিয়ে খুব একটা হইচই করেননি। সর্বশেষ তিনি বাগরাম বিমান ঘাঁটি নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নেয়ার কথা বললেন। এ ব্যাপারে ইতোমধ্যে আফগান সরকার কঠোর অবস্থান গ্রহণ করেছে। কোনো অবস্থাতে এ ঘাঁটি যুক্তরাষ্ট্রের কাছে হস্তান্তর করবে না। তা হলে যুক্তরাষ্ট্র সেনা পাঠিয়ে বিমান ঘাঁটিটি দখল করে নেবে, নাকি অন্য কোনো পন্থা অবলম্বন করবে সে ব্যাপারে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প এখনো তেমন কিছু বলেননি। তবে কি এটি শুধু বাকপটুতা কিংবা ভয় দেখানো। নাকি হতে পারে মার্কিন মহাসামরিক পরিকল্পনার অংশ? তবে অনেক বিশেষজ্ঞ বলে থাকেন, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প দর কষাকষির ক্ষেত্রে খুব সফল একজন মানুষ। তাই তিনি ওইসব কথাবার্তা বলে থাকেন শুধু তার দর কষাকষির জন্য, অন্য কোনো অভিসন্ধি থেকে নয়।