বাংলা একাডেমিতে একটি প্রোগ্রাম শেষে ফিরছি। হাঁটতে হাঁটতে সঙ্গী একজন তরুণ চিন্তক প্রশ্ন তুলল, ইকবাল কি নীটশের অনুসারী ছিলেন? তার খুদিদর্শন কি নীটশের উবারম্যানকে অনুকরণ করেছে? প্রশ্নটি গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, ইকবালের খুদিদর্শনকে অনেকেই ভুল করে নীটশের অনুসারী বানিয়ে ফেলেন।
জার্মান দার্শনিক ফ্রিডরিখ নীটশে (Friedrich Nietzsche, 1844-1900) উনিশ শতকের ইউরোপে ধর্ম, নৈতিকতা ও সংস্কৃতির প্রচলিত ভিত্তিকে প্রশ্নবিদ্ধ করেন। তার দর্শনের মূল কেন্দ্রবিন্দু হলো- মানুষকে নিজের সীমা অতিক্রম করতে উদ্বুদ্ধ করা, যেন সে ‘উবারম্যান’ (Übermensch), অর্থাৎ-অধিমানব বা অতিমানবরূপে আত্মপ্রকাশ করতে পারে।
‘জরথুস্ত্র বললেন’ (Thus Spoke Zarathustra) গ্রন্থে তার নির্বাচিত চরিত্র ‘জরথুস্ত্র’র মুখ দিয়ে নীটশে উবারম্যান দর্শন প্রকাশ করেন। Beyond Good and Evil গ্রন্থে তিনি প্রচলিত নৈতিকতার সীমা অতিক্রম করে ‘নতুন মূল্যবোধ’ সৃষ্টির আহ্বান জানান। The Will to Power--এ (মৃত্যুর পর প্রকাশিত নোটসমূহ) উবারম্যানের নেপথ্যের মনস্তত্ত¡ ও অস্তিত্ববাদী শক্তির তত্ত¡ বিশ্লেষিত হয়।
আল্লামা মুহাম্মদ ইকবাল (১৮৭৭-১৯৩৮) আধুনিক ইসলামী চিন্তার অন্যতম নবজাগরণ পুরুষ। তার দর্শন ইসলামের আত্মিক ভিত্তি থেকে মানুষকে নতুনভাবে গড়ে তোলার আহ্বান জানায়। যার তিনি নাম দেন খুদি, অর্থাৎ আত্মসচেতনতা বা আত্ম-সত্তার সমুন্নতি। খুদি দর্শন উপস্থাপিত হয়েছে তার আসরারে খুদি, রুমুজে বেখুদি ইত্যাদি গ্রন্থে।
‘আসরারে খুদি’ ইকবালের মূল দার্শনিক কবিতা যেখানে খুদির ধারণা প্রথম ব্যাখ্যা করেন। ‘রুমুজে বেখুদি’ গ্রন্থে তিনি খুদির সামাজিক রূপ প্রকাশ করেন; যা ব্যক্তি থেকে সমাজে আত্মপ্রসার।
তার ইংরেজি বয়ানগুলোর সঙ্কলন Reconstruction of Religious Thought in Islam (1930-34)-এ তিনি ইসলামী দর্শন, আত্মা ও খুদির বুদ্ধিবৃত্তিক বিশ্লেষণ হাজির করেন।
উভয় দার্শনিক পরস্পরের প্রায় সমসাময়িক। ইকবাল নীটশের প্রতি ছিলেন শ্রদ্ধাশীল। কিন্তু তার খুদি দর্শন কি উবারম্যান দ্বারা দিশাপ্রাপ্ত? আসলেই কি ইকবাল খুদিতত্ত¡ ধার করেছেন নীটশে থেকে? আমরা যদি উভয় দর্শনে দৃষ্টি দিই, তাহলে দেখব, উভয়ের মধ্যে আছে গভীর ও অনতিক্রম্য ব্যবধান।
নীটশের উবারম্যান নিজেই নিজের মূল্যবোধের স্রষ্টা। সে পুরনো নৈতিকতাকে উপেক্ষা করে- বিশেষ করে খ্রিষ্টান ধর্মের নম্রতা ও আনুগত্যের নীতি অতিক্রম করে নিজেই নতুন মূল্যবোধ তৈরি করে। নীটশে দেখান, উবারম্যান নিজের নৈতিকতাকে ‘ঊর্ধ্বলোকে’ নয়; বরং পৃথিবীতেই স্থাপন করে।
উবারম্যানের প্রধান চালিকাশক্তি হলো Will to Power; জীবনের প্রতি এমন এক অন্তর্নিহিত আকাক্সক্ষা যা আত্মবিস্তার ও সৃষ্টিশীল শক্তির প্রকাশ ঘটায়। সে নিজের দুর্বলতা জয় করে, নিজের শক্তি বিকশিত করে।
উবারম্যানের কাছে ঈশ্বর মৃত। deadÕ- এই ঘোষণাকে রটনা করে উবারম্যান। একে সে মুক্তির ঘোষণা হিসেবে গ্রহণ করে। ঈশ্বরের মৃত্যুর ফলে নৈতিক শূন্যতা তৈরি হয়, আর সেই শূন্যতা পূরণ করে উবারম্যান নিজের সৃষ্ট অর্থ দিয়ে।
উবারম্যান কোনো স্থির আদর্শ নয়; সে নিজেকে ‘শেষ মানুষ’-এর মতো স্থির রাখে না; বরং প্রতিনিয়ত নিজেকে পুনর্নির্মাণ করে। জীবনকে হ্যাঁ বলতে সে সচেষ্ট। উবারম্যান জীবনের বেদনা, কষ্ট ও অনিত্যতাকেও স্বীকার করে ‘হ্যাঁ’ বলে। সে জীবনের বিরুদ্ধে নয়; বরং সে জীবনের সৌন্দর্য ও যন্ত্রণা-দু’টিকেই গ্রহণ করে। সে নিজেকে নৈতিকতার ঊর্ধ্বে স্থাপন করতে চায়। সে প্রচলিত ভালো-মন্দের দ্বৈততায় বিশ্বাস করে না। উবারম্যানের কাছে নৈতিকতা এক ব্যক্তিগত সৃষ্টি- যা তার শক্তি ও সৌন্দর্যের প্রতিফলন। তার নৈতিকতা কোনো সামাজিক বাধ্যবাধকতা নয়। সে নিজেকে সৃজনশীল ও শিল্পসত্তা হিসেবে বিকশিত করতে চায়।
উবারম্যান এক সৃষ্টিকর্তা; সে জীবনের মধ্যে কবির মতো নিমজ্জিত, শিল্পীর মতো সে সৃজনশীল দৃষ্টি বিস্তার করে। তার কাছে জীবনই এক শিল্পকর্ম-ষরভব ধং ধৎঃ।
ভয়হীনতা ও একাকিত্ব তার চরিত্রে নিহিত। উবারম্যান ভিড়ের মানুষ নয়। সে একা চলতে জানে, কারণ সে জানে, সত্যিকার সৃজনশীলতা ও জাগরণ আসে আত্ম-নিবিষ্ট একাকিত্ব থেকে।
উবারম্যান এমনভাবে বাঁচে, যদি এই জীবন অসীমবার ফিরে আসে, তবুও সে একে আবার বেছে নেবে। এই মানসিক দৃঢ়তাই তার সবলতা।
উবারম্যান হলো মানুষের পরবর্তী ধাপ- এক ধরনের বিবর্তন। সে জানে, প্রাইমেট থেকে মানুষ এসেছে, তেমনি মানুষ থেকে উবারম্যান আসবে। সে এক রূপান্তরিত মানব, মানবতার পরবর্তী চূড়ান্ত সৃজন।
নীটশের উবারম্যান হলো এমন এক অস্তিত্ব, যে ধর্মের বদলে জীবনের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করে, কর্তৃত্বের বদলে আত্ম-সৃষ্টিকে বেছে নেয় ও নৈতিকতার বদলে সৃজনশীলতার আলোয় বেঁচে থাকে।
আল্লামা ইকবালের খুদি দর্শনের স্বরূপ কী?
আত্মসচেতনতা খুদির কেন্দ্রে নিহিত। খুদি মানে নিজের সত্তাকে জানা, উচ্চকিত করা, মহিমান্বিত করা। ইকবাল বলেন, ‘খুদি কো কর বুলান্দ ইতনা কে হার তাকদির সে পহলে/খুদা বন্দে সে খুদ পুঁছে, বাতা তেরি রেজা কিয়া হে।’ অর্থাৎ- আত্মসত্তাকে এমন উচ্চে উন্নীত করো, যাতে ভাগ্য নির্ধারণের আগে খোদা স্বয়ং তোমার ইচ্ছা জিজ্ঞাসা করেন।
এই আত্মসচেতনতা হলো সত্তার প্রথম জাগরণ। ইকবালের খুদি কোনো অহঙ্কার নয়; এটি ঈমানমুখী আত্মসত্তা। খুদি এমন এক আত্মা, যে আল্লাহর গুণাবলি আত্মস্থ করে।
সে জানে- ‘আমি’ আছি, কারণ ‘তুমি’ আছো (অর্থাৎ- আল্লাহর অস্তিত্বই আমার সত্তার উৎস)।
খুদি চায় ইচ্ছাশক্তির সৃজনশীলতা (Creative Will)। খুদি মানে কেবল চিন্তা নয়, ইচ্ছার প্রকাশ। যা কর্মে, সৃষ্টিতে, উদ্যোগে প্রতিফলিত হয়।
ইকবালের দৃষ্টিতে খুদি এমন এক সত্তা, যে নিষ্ক্রিয় নয়- সে কাদার ও কাযার (তাকদির ও নিয়তির) দাস নয়; বরং নিজের নিয়তির গতিনিয়ন্ত্রক, পরিণতির স্রষ্টা। খুদি চায় স্বাধীনতা ও আত্মনিয়ন্ত্রণ (Freedom and Self-discipline)। খুদির বিকাশ ঘটে স্বাধীনতা ও নিয়ন্ত্রণের ভারসাম্যে।
ইকবাল বলেন, সত্যিকারের স্বাধীনতা হলো আল্লাহর বিধানের আলোয় আত্মনিয়ন্ত্রণ শেখা। এটি স্বাধীনতা; কিন্তু সীমাহীন নয়- একটি ঐশিক শৃঙ্খলায় নিয়ন্ত্রিত স্বাধীনতা।
ইকবালের মতে খুদি অলস নয়; সে কর্মপ্রবণ। তিনি বলেন, ‘আমল সে জিন্দেগি বনতি হে, জান্নাত ভি, জাহান্নাম ভি।’ অর্থাৎ- কর্ম দিয়েই জীবন গড়ে-জান্নাতও কর্মফল, নরকও কর্মফল।
খুদির মূল শক্তি তার কর্মচেতনা।
খুদির বৈশিষ্ট্য হলো আত্মোন্নতি ও আত্মবিস্তার (Self-elevation and Expansion) খুদি ক্রমাগত বিকশিত হয়; সে স্থির নয়।
ইকবালের মতে খুদির বিকাশ তিন ধাপে হয় :
১. আনুগত্য; ২.আত্ম-নিয়ন্ত্রণ; ৩.আল্লাহর প্রতিনিধিত্ব, সান্নিধ্য।
ইকবালের দর্শনে ইশ্ক বা প্রেম হলো খুদির প্রাণশক্তি। এই প্রেম কেবল রোমান্টিক নয়; এটি সৃষ্টিশীল, আধ্যাত্মিক ও নৈতিক আগুন-যা মানুষকে ভয়হীন, দৃঢ় ও দয়ালু করে। খুদি ভয়কে জয় করে, বিপদকে আলিঙ্গন করে। সে ‘মুমিন’- যে সাহসী, কর্মী ও দৃঢ়চেতা।
খুদির লক্ষ্য ব্যক্তিগত সুখ নয়; বরং মানবতার কল্যাণ ও আল্লাহর খিদমত। সে জীবনের প্রতিটি কর্মে অর্থ ও লক্ষ্য খোঁজে। এভাবে খুদি জীবনের অর্থহীনতা দূর করে।
খিলাফত বা ঐশিক প্রতিনিধিত্ব (Divine Vicegerency)
খুদির চূড়ান্ত পর্যায় হলো খিলাফতে ইলাহি। অর্থাৎ- মানুষ হয়ে আল্লাহর প্রতিনিধি হওয়া। যখন খুদি পরিপূর্ণতা পায়, তখন মানুষ আল্লাহর গুণাবলি ধারণ করে পৃথিবীতে ন্যায় প্রতিষ্ঠা করে।
ইকবালের খুদির সারমর্ম কী? এককথায় বলতে গেলে- খুদি এমন এক আত্মা, যে নিজের ভেতর আল্লাহর আলো আবিষ্কার করে, নতুন নৈতিকতা সৃষ্টি করে এবং ভালোবাসা ও কর্মের মাধ্যমে বিশ্বকে রূপান্তরিত করে। তাহলে দেখা যাচ্ছে, ইকবালের খুদি ও নীটশের উবারম্যান এর মধ্যে ব্যবধান বিস্তর।
ইকবালের কাছে খুদি কোনো জৈব বা মানসিক উদ্ভব নয়; বরং খোদাজাত ওহিভিত্তিক উৎস থেকে নির্গত এক আলো। তিনি বলেন, ‘খুদি কি রুহ হে নিয়াবতে ইলাহি’। খুদির আত্মা হলো আল্লাহর প্রতিনিধিত্ব।
অর্থাৎ- মানুষের আত্মা আল্লাহর নাফাখ বা ফুঁকে দেয়া সত্তা, নিঃশ্বাস। তাই খুদি হলো ঐশীজাত স্ফুলিঙ্গ বা Divine Spark। এ হচ্ছে মানুষের অস্তিত্ব সৃষ্টির ধারাবাহিকতায় আল্লাহর ইচ্ছারই বহিঃপ্রকাশ।
ইকবাল তার দর্শনে বলেন, মানুষ যখন নিজের খুদিকে জাগায়, তখন সে নিজের মধ্যকার ঐশী সম্ভাবনাকে চিনে ফেলে। এই আত্মসচেতনতা খোদা থেকে দূরে নয়; বরং খোদার দিকে ফিরে চলে।
অর্থাৎ- মানবসত্তা মূলত খোদাপ্রদত্ত আমানত। মানুষের ‘আমি’ আসলে ‘তুমি’রই প্রতিফলন। এ কারণেই ইকবালের খুদি ranscendent origin-এ প্রতিষ্ঠিত- এটি সৃষ্টির মধ্যে খোদা তায়ালার প্রতিধ্বনি।
সুতরাং, মানুষ যত বড় হয়, তত বেশি খোদাপাকের নৈকট্য পায়। অন্য দিকে, নীটশের দর্শনে অস্তিত্বের উৎস ঈশ্বর নয়; বরং মানুষের নিজস্ব ইচ্ছাশক্তি (Will to Power)।
তার বিখ্যাত ঘোষণা, ÔGod is dead. We have killed HimÕ-এ ঘোষণা নিছক ধর্মবিরোধী নয়; বরং অস্তিত্বের নতুন দার্শনিক ঘোষণা : মানুষ আর কোনো বাহ্যিক ঈশ্বর বা নৈতিক বিধির ওপর নির্ভর করবে না। সে নিজের জীবনের অর্থ নিজেই সৃষ্টি করবে।
নীটশের দৃষ্টিতে মানুষের আত্মা কোনো ঐশী উপহার নয়; বরং অস্তিত্বের অনিবার্য সংগ্রাম ও শক্তির প্রকাশ। জীবন মানে ‘শক্তির প্রবাহ’ আর উবারম্যান সেই শক্তির পূর্ণ বিকাশ। অর্থাৎ, নীটশের মানবসত্তা স্বনির্মিত ইচ্ছা।
তাই নীটশের উবারম্যান immanent origin-এ প্রতিষ্ঠিত- এটি জগতের ভেতরের শক্তি ও প্রাণশক্তির আত্মনির্মাণ।
মানুষ যত বড় হয়, তত বেশি ঈশ্বরকে অতিক্রম করে।
তাহলে দেখা যাচ্ছে, খুদি দর্শনে অস্তিত্বের উৎস ঈশ্বর (Divine Origin), উবারম্যানে অস্তিত্বের মূলে আছে মানবিক ইচ্ছাশক্তি ((Human Will))। খুদির বিচারে সত্তার প্রকৃতি ঐশ্বরিক প্রতিফলন, উবারম্যানে তা জৈব-দার্শনিক আত্মনির্মাণ, খুদির দিক-নির্দেশনা ঈশ্বরের দিকে আরোহণ, উবারম্যানের আহ্বান, ঈশ্বরের ঊর্ধ্বে উত্তরণ, তাকে উপেক্ষা করা।
খুদির চূড়ান্ত লক্ষ্য খিলাফত : ঈশ্বরের প্রতিনিধি হওয়া। উবারম্যানের লক্ষ্য আত্মদেবত্ব, নিজে ঈশ্বর হওয়া।
ঈশ্বরের সাথে সম্পর্কের প্রশ্নেও উভয় দর্শনের ব্যবধান বিস্তর। ইকবালের কাছে ঈশ্বর ও মানুষের সম্পর্ক কেবলই সৃষ্টিকর্তা ও সৃজনের সম্পর্ক নয়; বরং প্রেম, সংলাপ ও প্রতিনিয়তের বন্ধনের সম্পর্কও। ইকবাল মানুষকে বলেন, ‘সিফাতে ইলাহি কা মাজহার বন যা’। অর্থাৎ- খোদার গুণাবলির দৃশ্যরূপ হয়ে যাও।
উভয় দর্শনে নৈতিকতার ভিত্তি আলাদা। ইকবালের মতে-নৈতিকতা হলো মানুষের আত্মার খুদামুখী রূপ। তিনি মনে করেন, নৈতিকতার উৎস কোনো সামাজিক চুক্তি নয়; বরং খোদাপ্রদত্ত ফিতরাহ, মানুষের অন্তর্নিহিত ন্যায়ের বোধ।
নীটশে পশ্চিমা নৈতিকতাকে ‘দাস নৈতিকতা’ (slave morality) বলেছেন। তিনি বলেন, ÔMorality is the herd-instinct in the individualÕ অর্থাৎ- নৈতিকতা হলো দুর্বলদের গোষ্ঠীবদ্ধ প্রতিরক্ষা-প্রবৃত্তি।
উবারম্যান সেই ‘দাস নৈতিকতা’ ভেঙে নতুন মূল্যবোধ সৃষ্টি করে।
তার কাছে ভালো-মন্দ কোনো ঈশ্বরীয় আদেশ নয়; বরং মানুষের শক্তি ও সৃজনশীলতার মাপকাঠি। উবারম্যান নিজেই হয়ে ওঠে নৈতিকতার মাপকাঠি।
খুদির দার্শনিক স্বর নৈতিক মরমিবাদ, উবারম্যানের দার্শনিক লক্ষ্য নৈতিক বিপ্লববাদ। জীবনের লক্ষ্যের প্রশ্নেও উভয় দর্শন আলাদা।
ইকবালের দৃষ্টিতে জীবন একটি খোদাপ্রদত্ত দায়িত্ব; খেলাফত। অর্থাৎ-আল্লাহর প্রতিনিধি হয়ে পৃথিবীতে ন্যায় প্রতিষ্ঠা করা। এই যাত্রার ফলাফল হলো ‘ইনসানে কামিল’ বা পূর্ণ মানুষ। যে মানুষ আল্লাহর পরম অভিব্যক্তির বাস্তবায়ন করে নিজের মধ্যে ও জগতে। অন্যদিকে নীটশের উবারম্যান জীবনের লক্ষ্যকে ভিন্নভাবে ব্যাখ্যা করে। এই ব্যাখ্যার মূলে আছে আত্মনির্মাণ ও অর্থসৃষ্টি।
নীটশের মতে, জীবনের কোনো ঈশ্বরপ্রদত্ত লক্ষ্য নেই। অর্থের অভাবই মানুষের সবচেয়ে বড় সঙ্কট। তাই উবারম্যানের কাজ হলো অর্থ সৃষ্টি করা।
ÔMan is a rope between beast and ÜbermenschÕ
অর্থাৎ- মানুষ হলো পশু ও অতিমানবের মধ্যবর্তী এক সেতু। তার জীবন হলো এক অবিরাম আত্মনির্মাণের যাত্রা। নিজের সীমা অতিক্রম করে নতুন মূল্যবোধ সৃষ্টি করা তার লক্ষ্য।
এ কারণেই নীটশে বলেন, ÔBecome who you areÕ তুমি যা, তা-ই হও- পূর্ণভাবে, নির্ভয়ে, স্বাধীনভাবে।
অন্যদিকে খুদিদর্শনে জীবন হলো ঈশ্বরের অভিপ্রায়ের সাধে সহযাত্রা।
নীটশের দর্শনের অন্যতম কেন্দ্রীয় ঘোষণা- ঈশ্বর মারা গেছেন মূলত;
একটি সভ্যতার রূপান্তরের দার্শনিক চিৎকার। তার কাছে ‘ঈশ্বরের মৃত্যু’ মানে হলো ঐতিহ্যগত ঈশ্বরকেন্দ্রিক মূল্যবোধের পতন। এর পরিণতিতে মানুষকে নিজের অর্থ নিজেই সৃষ্টি করতে হবে। উবারম্যান তাই ঈশ্বরের বিকল্প হিসেবে দেখে মানুষকে। সে বলে, ঈশ্বরকে ছাড়াই মানুষ নিজেকে ঈশ্বরতুল্য মর্যাদা দেবে।
ইকবালের কাছে ঈশ্বর কোনো ‘হারানো কেন্দ্র’ নয়; বরং জীবনের প্রতিটি তন্ত্রীতে উপস্থিত এক জীবন্ত বাস্তবতা। তার মতে, খুদি মানে হলো- সেই ঐশী আত্মার প্রতিবিম্ব। খুদি যত পরিণত হয়, ততই তা ঈশ্বরীয় গুণাবলির প্রতিফলন ঘটায়।
তাহলে দেখা যাচ্ছে, নীটশের দর্শনে ঈশ্বর থেকে স্বাধীন হয়ে মানুষ ঈশ্বরের জায়গা নেয়।
ইকবালের দর্শনে খুদার মাধ্যমে মানুষ নিজের প্রকৃত মর্যাদা খুঁজে পায়।
একজন বলেন, ‘ঈশ্বর নেই, তাই আমি সৃষ্টি করি’।
অন্যজন বলেন, ‘খুদা আছেন, তাই আমি পূর্ণ হই’।
সমাজ ও নেতৃত্বে উভয় দর্শনের ভূমিকা আলাদা।
উবারম্যান কোনো সমাজসংস্কারক নয়। সে একাকী, শীর্ষে, আত্মনির্বাচিত।
ইকবালের খুদি মূলত সমাজসচেতন ও নৈতিকভাবে দায়িত্বশীল আত্মা। খুদি যত পরিণত হয়, ততই সে উম্মাহ ও মানবতার জন্য নেতৃত্বের উৎসে পরিণত হয়। খুদি সমাজের শৃঙ্খল ভাঙে না; বরং তাকে ন্যায় ও চেতনার আলোয় পুনর্গঠন করে।
উবারম্যানের ভালোবাসা সৃজনশীল ও শক্তিবর্ধক। প্রেম বা সম্পর্ক তাকে কোনো ঈশ্বরীয় কর্তব্যের দিকে প্রাণিত করতে পারে না।
ইকবালের খুদিতে শক্তি ও ভালোবাসা অখণ্ড। খুদি হলো খুদার ইচ্ছার প্রতিফলন। এখানে শক্তি ও আত্মনির্ভরতা উচ্চকিত; কিন্তু তার প্রকাশ ঈশ্বরীয় নির্দেশে ন্যায়ের প্রয়োগে।
জ্ঞান ও দর্শনের প্রশ্নে উভয়ের ভিন্নতা আরো স্পষ্ট। উবারম্যানের জ্ঞান হচ্ছে স্বনির্ভর, অভিজ্ঞতাবদ্ধ ও কার্যকরী। সত্য শুধু এক ধ্রুবক নয়; তা পরিবর্তনশীল, জীবন-উদ্দীপক।
জ্ঞান- জীবনের শক্তি বৃদ্ধি ও মূল্যবোধ সৃষ্টির হাতিয়ার।
দর্শন মানুষকে ‘যবৎফ’-এর সীমা অতিক্রমে সাহায্য করে, তাই জ্ঞান ও দর্শন উবারম্যানের ক্ষমতার প্রসারণের অংশ।
অতএব ÔThere are no facts, only interpretationsÕ (Beyond Good and Evil)
অর্থাৎ-জ্ঞান কোনো ঈশ্বরপ্রদত্ত সত্য নয়; বরং মানব সৃষ্টিশীলতার ফল।
ইকবালের খুদিতে জ্ঞান হলো ঐশী ও আত্মমুখী। এখানে জ্ঞান- আত্মচেতনতা+ঈশ্বরচেতনা পরস্পরলগ্ন। এখানে জ্ঞান শুধু চেতনায় সীমাবদ্ধ নয়; এটি খুদির বিকাশ ও সমাজের কল্যাণে প্রয়োগ করতে হয়।
নীটশের উবারম্যান স্বনির্ভর জ্ঞানের কথা বলে। ইকবালের খুদি চায় ওহিকেন্দ্রিক জ্ঞান, নৈতিকভাবে শক্তিশালী, সমাজ ও উম্মাহর কল্যাণে নিবেদিত আধ্যাত্মিক সত্তা।
এর মানে পরিষ্কার। ইকবাল তার খুদি দর্শন নীটশের উবারম্যান থেকে ধার করেছেন, এমন রটনার কোনো ভিত্তি নেই।
লেখক : কবি, গবেষক