ক্রমবর্ধমান হালাল অর্থনীতির বাজার

হালাল অর্থনীতির বিশ্ববাজারে অংশীদার হওয়ার সম্ভাবনা বিবেচনায় নিয়ে বাংলাদেশ সরকার সম্প্রতি একটি ‘হালাল শিল্পপার্ক’ নির্মাণের জন্য মালয়েশিয়ার সহায়তা চেয়েছে।

জুলকার নায়েন ও মেজবাহ উদ্দিন আহমেদ

হালাল অর্থনীতি বলতে ইসলামী আইন মেনে চলা সব পণ্য ও পরিষেবার বাজারকে বোঝায়। স্টেট অব দ্য গ্লোবাল ইসলামিক ইকোনমি রিপোর্টের সর্বশেষ হিসাব অনুসারে, ২০২৩ সালে বিশ্বব্যাপী হালাল অর্থনীতির আকার ছিল ৭.৩৬ ট্রিলিয়ন ডলার, যা ২০২৮ সালের মধ্যে ১০.৮৯ ট্রিলিয়ন ডলারে পৌঁছাবে বলে আশা করা হচ্ছে। এর মধ্যে, হালাল খাতে ভোক্তা ব্যয়ের পরিমাণ ২.৪৩ থেকে ৩.৩৬ ট্রিলিয়ন ডলারে এবং ইসলামী আর্থিক খাতে সম্পদের পরিমাণ ৪.৯৩ থেকে ৭.৫৩ ট্রিলিয়ন ডলারে পৌঁছবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। রিপোর্টটি হালাল খাতে ভোক্তা ব্যয়কে ছয়টি খাতে ভাগ করেছে : খাদ্য, পোশাক, মিডিয়া ও বিনোদন, ভ্রমণ, ওষুধ ও প্রসাধনী। হালাল খাতে ভোক্তা ব্যয়ের সর্বোচ্চ অংশটুকু হালাল খাদ্যে।

হালাল খাদ্য বলতে সেসব খাদ্য ও পানীয়কে বোঝায় যার উৎস ও প্রক্রিয়াজাতকরণে ইসলাম কর্তৃক নিষিদ্ধ উপাদান থাকে না। ইসলামের দৃষ্টিতে কিছু খাদ্য নিষিদ্ধ কারণ সেগুলো অপবিত্র ও ক্ষতিকর। যেমন- শূকরের মাংস বা এর উপাদান দিয়ে তৈরি কোনো খাবার ও যেকোনো পশুর রক্ত। বিশ্বব্যাপী হালাল খাদ্যে ভোক্তাদের বর্তমান ব্যয়ের পরিমাণ ১.৪৩ ট্রিলিয়ন ডলার, যা ২০২৮-এ ১.৯৪ ট্রিলিয়নে গিয়ে দাঁড়াবে। এই চাহিদা বিবেচনায় রেখে হালাল খাদ্য এবং পানীয়ের উৎপাদন, প্রক্রিয়াকরণ ও বাজারজাতকরণের সাথে যুক্ত হয়েছে বিশ্বখ্যাত বহু প্রতিষ্ঠান। আবার, এই সবের হালাল মান নিশ্চিতে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি হালাল সনদ প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান। বেশির ভাগ মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ খাদ্য আমদানিতে হালাল সনদের বাধ্যবাধকতা আরোপ করে নীতিমালা বা আইন প্রণয়ন করেছে। মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ নয় এমন দেশগুলোতে বিভিন্ন ধরনের খাবার একই সাথে থাকার কারণে এই দেশগুলোতেও হালাল সনদ মুসলিমদের কাছে বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ।

মার্জিত পোশাক বলতে ইসলামের দৃষ্টিতে নারী ও পুরুষের জন্য উপযোগী পোশাককে বুঝায়। অস্বচ্ছ কাপড় ব্যবহার করে যথাযথভাবে শরীর ঢাকা ও ঢিলেঢালা পোশাক পরিধান করা। পোশাক তৈরিতে হারাম উপাদান (যেমন- শূকরের চামড়া) পরিহার করাও গুরুত্বপূর্ণ। ২০২৩ সালে মার্জিত পোশাক খাতে বিশ্বব্যাপী ভোক্তাদের ব্যয় ছিল ৩২৭ বিলিয়ন ডলার, যা ২০২৮ সালের মধ্যে ৪৩৩ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। বিশ্বব্যাপী সুনির্দিষ্ট মার্জিত পোশাকের উপর যেমন ফ্যাশন প্রদর্শনীর আয়োজন হচ্ছে, মূলধারার ফ্যাশন প্রদর্শনীগুলোতেও (যেমন- লন্ডন, প্যারিস ও নিউ ইয়র্কের মতো শহরগুলোতে) এটি ক্রমশ জায়গা করে নিচ্ছে।

হালাল বা ইসলামী বিষয়ভিত্তিক মিডিয়া ও বিনোদন বলতে সাধারণভাবে অশ্লীলতা, সহিংসতা, মিথ্যা ও অনৈতিক বিষয়বস্তু পরিহার করে ইসলামী মূল্যবোধের সাথে সামঞ্জস্য রেখে পরিচালিত মিডিয়া ও বিনোদনকে বুঝায়। বর্তমানে বিভিন্ন বিনোদনমাধ্যম থেকে শুরু করে ইন্টারনেটে সাধারণ অনুসন্ধান বা ব্রাউজ করতে গেলেও নানা ধরনের অশ্লীল ছবি, বিজ্ঞাপন ও ইসলামী মূল্যবোধের সাথে অসামঞ্জস্যপূর্ণ উপাদান চলে আসে, যা যেকোনো সচেতন মুসলিমের জন্য আপত্তিকর। এর থেকে বিরত থাকা ও ইসলামী মূল্যবোধভিত্তিক বিনোদনের প্রয়োজনীয়তায় বর্তমানে বিশ্বজুড়ে হালাল বা ইসলামী বিষয়ভিত্তিক মিডিয়া ও বিনোদন খাতের চাহিদা বৃদ্ধি পাচ্ছে। ২০২৩ সালে এই খাতের আকার ছিল ২৬০ বিলিয়ন ডলার, যা ২০২৮ সালের মধ্যে ৩৩৭ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হবে বলে আশা করা হচ্ছে।

মুসলিমবান্ধব ভ্রমণ বা পর্যটন বলতে সাধারণভাবে এমন দেশ বা স্থানে ভ্রমণ বুঝায় যেখানে হালাল খাবার ও হালাল বিনোদনের ব্যবস্থা আছে, নারী ও পুরুষের নামাজ আদায়ের সুব্যবস্থা আছে, ইসলামী রীতি ও ঐতিহ্যের প্রতি সম্মান দেখানো হয় এবং যেসব ক্ষেত্রে ইসলামিক ঐতিহাসিক স্থান বা স্থাপনা আছে তা পরিদর্শনের সুব্যবস্থা আছে। ২০২৩ সালে মুসলিম পর্যটকরা ভ্রমণ বাবদ ব্যয় করেছে ২১৭ বিলিয়ন ডলার, যা ২০২৮ সালে ৩৮৪ বিলিয়ন ডলার হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

হালাল প্রসাধনী বলতে এমন প্রসাধনী বোঝায় যা অন্যান্য হালাল ভোগ্যপণ্যের মতো ইসলামে নিষিদ্ধ ও স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকারক উপাদান ছাড়া উৎপাদিত হয় এবং যার বিপণনে ইসলামী মূল্যবোধ মেনে চলা হয়। এই খাতে ভোক্তা ব্যয়ের পরিমাণ ২০২৩ সালে ছিল ৮৭ বিলিয়ন ডলার, যা ২০২৮ সালে ১১৮ বিলিয়ন ডলার হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

বিশ্ববাজারে হালাল খাতগুলোর অন্যতম অংশীদার হওয়ার সুযোগ থাকলেও বাংলাদেশ এখন পর্যন্ত অনেক পিছিয়ে আছে। যেমন- স্টেট অব দ্য গ্লোবাল ইসলামিক ইকোনমি রিপোর্টে চারটি মানদণ্ডের ভিত্তিতে হালাল অর্থনীতিতে কোন দেশের অবস্থান কেমন তার একটি মূল্যায়ন করা হয়েছে। মানদণ্ডগুলো হলো- হালাল খাতগুলোর আকার, তাদের হালাল সনদ ও শরিয়াহ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা, সচেতনতা, সামাজিক প্রভাব এবং উদ্ভাবনী প্রচেষ্টা। বাংলাদেশের অবস্থান তাতে ১৫তম, যা সিঙ্গাপুর ও যুক্তরাজ্যেরও পেছনে। সবচেয়ে এগিয়ে থাকা মালয়েশিয়ার স্কোর যেখানে ১৬৫.১, বাংলাদেশের স্কোর সেখানে মাত্র ৪৫.৯।

মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, তুরস্ক, সৌদি আরবসহ অনেক মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশে পণ্য রফতানির জন্য হালাল সনদ বাধ্যতামূলক থাকায় বাংলাদেশ সরকারের এক বিশেষ আদেশ বলে বাংলাদেশ ইসলামিক ফাউন্ডেশন ২০০৭ সাল থেকে হালাল সনদ দিয়ে আসছে। আগে এ বিষয়ে কোনো নীতিমালা না থাকলেও সম্প্রতি বাংলাদেশ ইসলামিক ফাউন্ডেশন ‘হালাল সনদ নীতিমালা-২০২৩’ গেজেট আকারে প্রণয়ন করেছে। নীতিমালাটি বাংলাদেশে হালাল খাদ্য, ভোগ্যপণ্য, ওষুধ ও প্রসাধনী উৎপাদন, আমদানি-রফতানি ও বিপণনের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। নীতিমালায় ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশকে হালাল সনদ প্রদানের একমাত্র কর্তৃপক্ষ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। এ ছাড়া, নীতিমালাটিতে হালাল প্রাণী, মৎস্য ও উদ্ভিদের একটি তালিকা রয়েছে, পশু জবাইকরণের হালাল পদ্ধতি বর্ণনা করা হয়েছে। এই নীতিমালায় আন্তর্জাতিক হালাল সনদ প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর সাথে সহযোগিতা ও স্বীকৃতির কার্যক্রম গ্রহণকে উৎসাহিত করা হয়েছে। তবে বাংলাদেশের ভোক্তাদের মধ্যে সচেতনতার অভাব থাকায় ও পণ্যের হালাল সনদ গ্রহণে সরকারের বাধ্যবাধকতা না থাকায় বাংলাদেশে হালাল সনদ গ্রহণকারী প্রতিষ্ঠান খুব একটা পরিলক্ষিত হয় না। এখন পর্যন্ত ২৫৪টি প্রতিষ্ঠান হালাল সনদ নিয়েছে।

হালাল অর্থনীতির বিশ্ববাজারে অংশীদার হওয়ার সম্ভাবনা বিবেচনায় নিয়ে বাংলাদেশ সরকার সম্প্রতি একটি ‘হালাল শিল্পপার্ক’ নির্মাণের জন্য মালয়েশিয়ার সহায়তা চেয়েছে। সাম্প্রতিক এক অনুষ্ঠানে ২০৩০ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে একটি প্রধান হালাল কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলার প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করা হয়েছে। তবে এটি অর্জনে থাকতে হবে একটি সামগ্রিক পরিকল্পনা, প্রতিষ্ঠা করতে হবে প্রয়োজনীয় আইনি কাঠামো ও অবকাঠামো এবং সৃষ্টি করতে হবে প্রয়োজনীয় মানবসম্পদ। একই সাথে, বাংলাদেশের হালাল মান অন্যান্য দেশের মানের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ কিনা তা নিশ্চিত করা প্রয়োজন যাতে বাংলাদেশের হালাল-প্রত্যায়িত পণ্যগুলো সহজে অন্যান্য বাজারে প্রবেশ করতে পারে। হালাল পণ্যের রফতানি বৃদ্ধির জন্য একদিকে যেমন আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ডগুলোর সাথে বাণিজ্য বৃদ্ধি করা প্রয়োজন, অন্যদিকে, বিভিন্ন ব্র্যান্ড বর্জনের আহ্বানের বিষয়েও সতর্ক থাকা প্রয়োজন যাতে বাংলাদেশের হালাল পণ্যের সুনাম ক্ষুণ্ণ না হয়।

জুলকার নায়েন : বাংলাদেশ ব্যাংকের অবসরপ্রাপ্ত নির্বাহী পরিচালক ও বর্তমানে ন্যাশনাল ব্যাংক পিএলসির স্বতন্ত্র পরিচালক

মেজবাহ উদ্দিন আহমেদ : গবেষক