আরাকান আর্মির সন্ত্রাস : বাংলাদেশের করণীয়

আরাকান আর্মির হঠকারি কর্মকাণ্ড প্রতিরোধে সীমান্তে সামরিক ও আধাসামরিক বাহিনীর যৌথ মোতায়েন বাড়ানো দরকার। শুধু স্থলসীমান্ত নয়, উপকূল এবং নদীপথেও নজরদারি বাড়াতে হবে। বিজিবি, সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী এবং কোস্টগার্ডের মধ্যে সমন্বিত অপারেশন চালু করলে অপহরণ, নৌকা দখল এবং সীমান্তে গুলিবর্ষণের মতো কর্মকাণ্ড ঠেকানো সম্ভব হবে। আধুনিক প্রযুক্তি যেমন- ড্রোন, রেডার এবং উপকূলীয় টহল জাহাজ ব্যবহার করতে হবে। এতে শুধু আরাকান আর্মিই নয়, ভবিষ্যতে যেকোনো শক্তি বাংলাদেশের সীমান্ত লঙ্ঘনের আগে দশবার ভাববে

আরাকান অঞ্চল (আজকের মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য) বহু শতাব্দী ধরে বাংলার সাথে গভীরভাবে সম্পর্কিত। চট্টগ্রাম উপকূল ও আরাকানের মধ্যে ছিল বাণিজ্য, সংস্কৃতি ও অভিবাসনের আদান-প্রদান। মধ্যযুগে বাংলার সুলতানদের সাথে আরাকান রাজ্যের যোগাযোগ ছিল ঘনিষ্ঠ। সূফী সাধক, ব্যবসায়ী ও বসতি স্থাপনকারীরা দুই অঞ্চলকে সাংস্কৃতিকভাবে সংযুক্ত রেখেছিল। কিন্তু ঔপনিবেশিক শাসনকালে কৃত্রিম সীমানা আঁকা হলে আরাকান আলাদা হয়ে যায় এবং সেখানে বসবাসরত রোহিঙ্গা মুসলমানরা নিরাপত্তাহীনতায় পড়ে।

মিয়ানমার স্বাধীন হওয়ার পর থেকেই রাখাইন অঞ্চল অশান্ত। প্রথমে রোহিঙ্গাদের বিদ্রোহ, পরে রাখাইন জাতিগোষ্ঠীর স্বাধীনতা আন্দোলন। এই পরিস্থিতিতে ২০০৯ সালে জন্ম নেয় আরাকান আর্মি (AA)। প্রথমে এটি ছিল ছোট একটি গেরিলা সংগঠন, কিন্তু ধীরে ধীরে উত্তর মিয়ানমারের কাচিন বিদ্রোহীদের সহায়তায় বড় এক সশস্ত্রবাহিনীতে পরিণত হয়। ২০২১ সালের সামরিক অভ্যুত্থানের পর মিয়ানমারজুড়ে সেনা সরকার দুর্বল হয়ে পড়ে। এই সুযোগে আরাকান আর্মি দ্রুত নিজেদের বিস্তার ঘটায়। ২০২৩-২৪ সালের মধ্যে তারা রাখাইনের বেশির ভাগ এলাকা দখল করে ফেলে, মিয়ানমার সেনাদের শিবির ধ্বংস করে এবং বিকল্প প্রশাসন চালু করে। অনেকে ভেবেছিল বিজয়ের পর তারা শান্ত হবে, উন্নয়নে মন দেবে এবং প্রতিবেশী বাংলাদেশের সাথে সুসম্পর্ক গড়ে তুলবে। কিন্তু বাস্তবতা উল্টো। আরাকান আর্মি বাংলাদেশবিরোধী কর্মকাণ্ড শুরু করেছে।

বাংলাদেশের জেলেরা সাগরে মাছ ধরতে গিয়ে আরাকান আর্মির হাতে বন্দী হচ্ছে। বিগত কয়েক মাসে ২০০-রও বেশি জেলে অপহৃত হওয়া শুধু মানবিক সঙ্কটই নয়, এটি অর্থনৈতিক আঘাতও বটে। জেলেরা দেশের খাদ্য নিরাপত্তা ও উপকূলীয় অর্থনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। তাদের অপহরণের ফলে পরিবারগুলো নিঃস্ব হচ্ছে, গ্রামীণ অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। তা ছাড়া জেলেদের মুক্তিপণের দাবিতে আরাকান আর্মি অর্থ সংগ্রহ করছে, যা ভবিষ্যৎ সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে ব্যবহৃত হতে পারে। এটি আসলে বাংলাদেশের নাগরিকদের বিরুদ্ধে সংঘটিত সন্ত্রাসবাদ।

আরাকান আর্মি শুধু সাধারণ মানুষকে টার্গেট করছে না, বরং সরাসরি বাংলাদেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর (বিজিবি) ওপর গুলি চালিয়েছে। এটি স্পষ্টতই উসকানির অপচেষ্টা। সীমান্তরক্ষী বাহিনীর ওপর গুলি চালানো মানে বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার প্রতি চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেয়া। এর মাধ্যমে তারা পরীক্ষা করতে চায়- বাংলাদেশ কতটা ধৈর্যশীল এবং কতটা প্রতিক্রিয়া জানাতে প্রস্তুত। এ ধরনের কর্মকাণ্ড চালিয়ে গেলে তা পূর্ণাঙ্গ সংঘর্ষে রূপ নিতে পারে, যা শুধু সীমান্তেই নয়, বরং আঞ্চলিক নিরাপত্তার জন্য হুমকি হতে পারে।

রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশের কাঁধে বোঝা হয়ে আছে। ১০ লাখের বেশি রোহিঙ্গা প্রায় এক দশক ধরে কক্সবাজারে আশ্রিত। এরই মধ্যে আরাকান আর্মিও নতুন করে রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশ সীমান্তে ঠেলে পাঠাচ্ছে। অর্থাৎ মানবিক বিপর্যয়কে তারা ব্যবসায়িক অস্ত্র বানাচ্ছে। এতে বাংলাদেশের জনসংখ্যার ওপর চাপ, সামাজিক অস্থিরতা এবং নিরাপত্তাজনিত হুমকি আরো বাড়ছে। স্পষ্টতই এটি এক ধরনের মানবপাচার ও কৌশলগত চাপ প্রয়োগ।

ভারতের সম্ভাব্য ভূমিকা
আরাকান আর্মির কর্মকাণ্ডের পেছনে ভারতের ভূমিকা নিয়ে সন্দেহ অমূলক নয়। দক্ষিণ এশিয়ার ভূরাজনীতিতে ভারত সবসময়ই বাংলাদেশকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে চেয়েছে এবং মিয়ানমারে চীনের প্রভাব ঠেকাতে বিভিন্ন কৌশল নিয়েছে। রাখাইন ও আরাকান অঞ্চল ভারতের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এখানেই রয়েছে তাদের কালাদান মাল্টি-মোডাল ট্রানজিট প্রকল্প এবং সমুদ্রপথে উত্তর-পূর্বাঞ্চলে প্রবেশাধিকার। ভারত এ কারণেই মিয়ানমারে আরাকান আর্মিকে কাজে লাগানোর কৌশল নিয়েছে।

ভারত ঐতিহাসিকভাবে উত্তর-পূর্ব ভারতের বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোর সাথে সরাসরি কিংবা গোপনে সম্পর্ক রেখেছে এবং প্রয়োজনে তাদের ব্যবহার করেছে। মিজো, নাগা কিংবা কুকি বিদ্রোহীদের ক্ষেত্রেও এ ধরনের উদাহরণ রয়েছে। চীনের সাথে মিয়ানমার সেনা সরকারের ঘনিষ্ঠতা বাড়ার ফলে ভারত বিকল্প হিসেবে আরাকান আর্মিকে ব্যবহার করতে পারে। এতে ভারতের দু’টি লক্ষ্য পূরণ হয়, বাংলাদেশকে দক্ষিণ সীমান্তে অস্থিরতায় ফেলা এবং মিয়ানমারে চীনা প্রভাব দুর্বল করা। বাংলাদেশকে চাপের মধ্যে রাখতে ভারত সীমান্তে অস্থিতিশীলতা তৈরি করতে আগ্রহী হতে পারে। আরাকান আর্মিকে পরোক্ষ সমর্থন দিলে তারা বাংলাদেশের জেলেদের অপহরণ, সীমান্তে গুলি এবং রোহিঙ্গাদের ঠেলে পাঠানোর মতো কাজ চালিয়ে যেতে পারবে। এতে বাংলাদেশের নিরাপত্তা ও মানবিক সঙ্কট আরো গভীর হবে। বাংলাদেশকে ব্যস্ত ও বিভ্রান্ত রাখবে এবং ভারতের জন্য রাজনৈতিক চাপ সৃষ্টি এবং চীনের বিরুদ্ধে কৌশলগত সুবিধা এনে দেবে।

এই বাস্তবতা বাংলাদেশের জন্য স্পষ্ট সতর্কবার্তা। ভারত সবসময় সরাসরি নয়, বরং গোপন ও প্রক্সি কৌশল ব্যবহার করে। আরাকান আর্মির মতো একটি শক্তিশালী বিদ্রোহী সংগঠনকে প্রশ্রয় দিয়ে বাংলাদেশকে সঙ্কটে ফেলা ভারতের জন্য সহজ একটি পন্থা হতে পারে। তাই বাংলাদেশের কৌশল নির্ধারণে এই দিকটি অবশ্যই বিবেচনায় রাখতে হবে। বাংলাদেশের উচিত কূটনৈতিকভাবে ভারতের সম্ভাব্য ভূমিকা চিহ্নিত করা, চীনের সাথে কৌশলগত সম্পর্ক জোরদার করা, মিয়ানমারের কেন্দ্রীয় সরকারের সাথে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রাখা এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণভাবে সামরিক শক্তি প্রদর্শনের মাধ্যমে স্পষ্ট বার্তা দেয়া যে, বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব নিয়ে কোনো দেশই খেলা করতে পারবে না।

বাংলাদেশের করণীয়
বাংলাদেশ প্রথমেই কূটনৈতিক পথে আরাকান আর্মিকে সতর্কবার্তা জানাতে পারে। সীমান্ত লঙ্ঘনের ঘটনাগুলো চিহ্নিত করে সরাসরি আনুষ্ঠানিকভাবে বার্তা দিতে হবে যে, এ ধরনের কর্মকাণ্ড মেনে নেয়া হবে না। একই সাথে আন্তর্জাতিক মহলকে সচেতন করা জরুরি। চীন এ অঞ্চলে প্রভাবশালী শক্তি; তাদের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক স্বার্থ আরাকান অঞ্চলে গভীরভাবে জড়িত। আসিয়ান (ASEAN) মিয়ানমারের রাজনৈতিক সঙ্কটে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বাংলাদেশ যদি আন্তর্জাতিক পরিসরে বিষয়টি জোরালোভাবে তুলে ধরে, তবে আরাকান আর্মি কূটনৈতিকভাবে বিচ্ছিন্ন হবে এবং তাদের ওপর চাপ বাড়বে। এতে একদিকে বাংলাদেশের অবস্থান দৃঢ় হবে, অন্য দিকে আন্তর্জাতিক সমাজের সহানুভূতি অর্জিত হবে।

আরাকান আর্মির হঠকারী কর্মকাণ্ড প্রতিরোধে সীমান্তে সামরিক ও আধাসামরিক বাহিনীর যৌথ মোতায়েন বাড়ানো দরকার। শুধু স্থলসীমান্ত নয়, উপকূল এবং নদীপথেও নজরদারি বাড়াতে হবে। বিজিবি, সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী এবং কোস্টগার্ডের মধ্যে সমন্বিত অপারেশন চালু করলে অপহরণ, নৌকা দখল এবং সীমান্তে গুলিবর্ষণের মতো কর্মকাণ্ড ঠেকানো সম্ভব হবে। আধুনিক প্রযুক্তি যেমন- ড্রোন, রেডার এবং উপকূলীয় টহল জাহাজ ব্যবহার করতে হবে। এতে শুধু আরাকান আর্মিই নয়, ভবিষ্যতে যেকোনো শক্তি বাংলাদেশের সীমান্ত লঙ্ঘনের আগে দশবার ভাববে।

কূটনৈতিক সতর্কবার্তা অমান্য করা হলে বাংলাদেশকে দ্রুত সীমিত সামরিক পদক্ষেপ নিতে হবে। এর মধ্যে রয়েছে অপহৃত জেলেদের উদ্ধারে বিশেষ কমান্ডো অভিযান এবং সীমান্তবর্তী আরাকান আর্মির ঘাঁটি ধ্বংস করা। এ ধরনের অভিযান লক্ষ্যভিত্তিক হবে অর্থাৎ সরাসরি আঘাত হেনে শত্রুপক্ষকে ক্ষতিগ্রস্ত করা, কিন্তু দীর্ঘমেয়াদি যুদ্ধে না জড়ানো। এতে এক দিকে বাংলাদেশের নাগরিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত হবে, অন্য দিকে সীমান্ত লঙ্ঘনকারীকে স্পষ্ট বার্তা দেবে।

যদি আরাকান আর্মি সীমিত সামরিক ব্যবস্থার পরও উসকানিমূলক কর্মকাণ্ড চালিয়ে যায়, তখন বাংলাদেশকে বড় আকারে কৌশলগত আক্রমণ চালানোর কথা বিবেচনা করতে হবে। এতে আরাকান অঞ্চলের ভেতরে প্রবেশ করে নিরাপত্তা বলয় (buffer zone) তৈরি করা যেতে পারে, যাতে ভবিষ্যতে তারা সীমান্তে উসকানি দেয়ার সুযোগ না পায়। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর পক্ষে এমন অভিযান চালানো কঠিন নয়। বরং এতে ভবিষ্যতের জন্য এক দৃঢ় প্রতিরোধমূলক দৃষ্টান্ত তৈরি হবে।

চীন আরাকান অঞ্চলে বাণিজ্যিক করিডোর ও বন্দর প্রকল্পে জড়িত। তাই তারা চায় না, কোনো অস্থিতিশীলতায় তাদের বিনিয়োগ বিপন্ন হোক। অন্য দিকে মিয়ানমারের কেন্দ্রীয় সরকারও চায় না আরাকান আর্মি অতিরিক্ত শক্তিশালী হয়ে উঠুক। বাংলাদেশ এই দুই পক্ষকে পাশে রাখলে আরাকান আর্মি আন্তর্জাতিক মঞ্চে একঘরে হয়ে পড়বে। এতে তাদের ভারতের হাতিয়ার হওয়ার সুযোগ সীমিত হবে।

সার্বভৌমত্ব রক্ষার ডাক
ইতিহাস বলে, দুর্বলতা আগ্রাসন ডেকে আনে। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ অস্ত্রের শক্তিতে স্বাধীনতা ছিনিয়ে নিয়েছিল, কারণ তখন জাতি ও সেনাবাহিনী দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিল। আজ আরাকান আর্মির উসকানি আমাদের সামনে নতুন চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে। বাংলাদেশকে তাই দৃঢ়ভাবে পদক্ষেপ নিতে হবে। সতর্কবার্তা দেয়া জরুরি। কিন্তু তা উপেক্ষিত হলে প্রয়োজনে শক্তি প্রয়োগ করতেই হবে।

এশিয়ার ভূরাজনীতির দাবার ছকে দ্বিধা মানেই ক্ষতি। সময়মতো কঠোর পদক্ষেপই পারে দক্ষিণ সীমান্ত নিরাপদ রাখতে এবং স্বাধীন বাংলাদেশের মর্যাদা অটুট রাখতে।

লেখক : নিরাপত্তা বিশ্লেষক