শরিফ ওসমান হাদির ওপর বর্বরোচিত হামলা দেশবাসী কেবল একজন ব্যক্তির ওপর আক্রমণ হিসেবে দেখছে না; বরং এটিকে বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষা এবং ভারতীয় আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে সোচ্চার কণ্ঠ স্তব্ধ করে দেয়ার সুপরিকল্পিত প্রচেষ্টা হিসেবে দেখছে।
১. হাদি কেন লক্ষ্যবস্তু
ওসমান হাদি ‘ইনকিলাব মঞ্চ’-এর মাধ্যমে জাতীয় স্বার্থ রক্ষায় সোচ্চার ছিলেন। বিশেষ করে ভারতীয় আগ্রাসন, সীমান্তে বিএসএফের হাতে বাংলাদেশীদের হত্যা এবং পানি আগ্রাসনের বিরুদ্ধে জোরালো ভূমিকা রাখছিলেন। সংবাদমাধ্যমে বলা হয়েছে, হামলাকারীরা ভারতে পালিয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
২০০৯ সালের বিডিআর হত্যাকাণ্ডের নেপথ্য নায়কদের মুখোশ উন্মোচনে হাদি ছিলেন আপসহীন। তিনি রাজনীতি ও সংস্কৃতিতে বিজাতীয় প্রভাবের বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তোলেন। এটাই তাকে শত্রুর লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করে।
২. দেশপ্রেমিক জনমতের প্রতিফলন
এই হামলার পর অভূতপূর্ব প্রতিক্রিয়া হয়েছে। দলমত নির্বিশেষে জনগণ একে বাংলাদেশের ওপর ‘বিদেশী শক্তির প্র ি হামলা’ হিসেবে দেখছে। সারা দেশে মানুষ রাজপথে নেমে এই হস্তক্ষেপমূলক রাজনীতির প্রতিবাদ জানাচ্ছে। ওসমান হাদির রক্তক্ষরণ আজ তরুণ প্রজন্মের কাছে দেশপ্রেমের নতুন প্রতীকে পরিণত হয়েছে।
৩. তদন্তে প্রাপ্ত চাঞ্চল্যকর তথ্য
তদন্তসংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, হামলাকারীরা কেবল হাদিকে হত্যা করতে চায়নি; দেশে ভীতি ও অস্থিতিশীলতা তৈরি করতে চেয়েছে। পলাতক নেতা জাহাঙ্গীর কবির নানকের ক্যাডার বাহিনীর এই কিলিং মিশন মূলত রাষ্ট্রবিরোধী ষড়যন্ত্রের অংশ।
বর্তমান পরিস্থিতি ও আমাদের করণীয়
হাদির ওপর আক্রমণ এবং এর সাথে প্রতিবেশী দেশের কথিত সংশ্লিষ্টতা বাংলাদেশের রাজনীতি ও জাতীয় নিরাপত্তার ক্ষেত্রে অত্যন্ত স্পর্শকাতর ও গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে পরিণত হয়েছে। ঘটনার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ কিছু তথ্য ও ঘটনা :
১. হামলার প্রেক্ষাপট ও ভারতের সংশ্লিষ্টতা : ১২ ডিসেম্বর ওসমান হাদিকে গুলি করার পরের বেশকিছু চাঞ্চল্যকর তথ্য সামনে এসেছে :
হামলাকারীদের পলায়ন : সরকারের আশঙ্কা, হামলাকারীরা সীমান্ত দিয়ে ভারতে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে। এ বিষয়ে ভারত সরকারকে সহযোগিতা করার এবং আসামিদের বাংলাদেশের হাতে তুলে দেয়ার আনুষ্ঠানিক অনুরোধ জানানো হয়েছে।
অঘোষিত যুদ্ধের অভিযোগ : জাতীয় বিপ্লবী পরিষদসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও গোষ্ঠী দাবি করেছে, ওসমান হাদির ওপর হামলা ভারতের ইন্ধনে হয়েছে। তারা একে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ভারতের ‘অঘোষিত যুদ্ধ’ হিসেবে দেখছেন এবং প্রতিবাদে ভারতীয় পণ্য বয়কট ও কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করার দাবি তুলেছেন।
২. জাহাঙ্গীর কবির নানক ও ক্যাডার-সংশ্লিষ্টতা : ২০০৯ সালের পিলখানা হত্যাকাণ্ডের সময় তার বিতর্কিত ভূমিকা নিয়ে ‘জাতীয় স্বাধীন তদন্ত কমিশন’ সুনির্দিষ্ট প্রতিবেদন দিয়েছে। অভিযোগ আছে, নানকের ক্যাডার বাহিনী বর্তমানে ভারতের আশ্রয়ে থেকে বা সীমান্ত এলাকা ব্যবহার করে দেশে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির চেষ্টা করছে।
টার্গেট কিলিং : ওসমান হাদির ওপর হামলা অত্যন্ত সুপরিকল্পিত। জনাকীর্ণ স্থানে হামলা করে নির্বিঘ্নে পালিয়ে যাওয়া কোনো সাধারণ অপরাধীর কাজ নয়; বরং প্রশিক্ষিত বাহিনীর কাজ বলেই ধারণা করা হচ্ছে। তদন্তসংশ্লিষ্টরা বলছেন, নানকের মতো পলাতক আওয়ামী লীগ নেতাদের নির্দেশে এবং ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’-এর সম্ভাব্য সহযোগিতায় এই ‘টার্গেট কিলিং’ মিশন পরিচালনা করা হয়েছে। তদন্তকারী সংস্থা ও বিভিন্ন রাজনৈতিক বিশ্লেষকের মতে, পলাতক আওয়ামী লীগ নেতাদের নির্দেশে দেশে খুনে বাহিনী কাজ করছে।
৩. পিলখানা হত্যার সাথে যোগসূত্র : ‘জাতীয় স্বাধীন তদন্ত কমিশন’ গত নভেম্বরে প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে :
২০০৯ সালের বিডিআর হত্যাকাণ্ডের সময় ৯২১ জন ভারতীয় নাগরিক বাংলাদেশে অবৈধভাবে প্রবেশ করে; এদের উদ্দেশ্য ছিল হত্যাকাণ্ড ঘটানো ও পরবর্তী পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ।
ওসমান হাদির ওপর হামলা পিলখানা হত্যাকাণ্ডের ধারাবাহিকতা হিসেবে দেখছেন বিশ্লেষকরা। তাদের মতে, যারা বাংলাদেশের স্বার্থ রক্ষা করতে বা ভারতের আধিপত্যবাদের বিরোধিতা করে, তাদের ওপর আক্রমণ বাংলাদেশের নিরাপত্তা দুর্বল করার দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার অংশ।
হাদিকে গুলি করার পর ভারতীয় গণমাধ্যম ও সামাজিক মাধ্যমে যে ধরনের প্রতিক্রিয়া ও উল্লাস দেখা গেছে, তার একটি বিস্তারিত বিশ্লেষণ তুলে ধরা হয়েছে শুটারকে নিজেদের ‘এজেন্ট’ দাবি করা একটি ভিডিওতে। এটি আমাদের সন্দেহ জোরালো করে।
(Osman Hadi, India Media-YouTube Global TV News)
হামলাকারী হিসেবে যাদের শনাক্ত করা হয়েছে, তাদের সাবেক মন্ত্রী জাহাঙ্গীর কবির নানকের প্রশিক্ষিত ক্যাডার বলে সন্দেহ করা হচ্ছে।
ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা এবং ‘অঘোষিত যুদ্ধ’ : বাংলাদেশের সাম্প্রতিক অস্থিতিশীলতার পেছনে ভারতের গোয়েন্দা সংস্থার সংশ্লিষ্টতা নিয়ে সরকার ও সাধারণ মানুষের মধ্যে গভীর উদ্বেগ তৈরি হয়েছে :
উদ্দেশ্য : ওসমান হাদির মতো যারা আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিচ্ছেন, তাদের সরিয়ে দিয়ে জনমনে আতঙ্ক সৃষ্টি করা এবং বাংলাদেশের বর্তমান শাসনব্যবস্থাকে অকার্যকর প্রমাণ করা।
পিলখানা গণহত্যার আসামি এবং বর্তমান হামলাকারীদের যোগসূত্রটি খুবই তাৎপর্যপূর্ণ।
পিলখানা হত্যা ছিল বাংলাদেশকে সামরিকভাবে পঙ্গু করার চেষ্টা। আর ওসমান হাদি হত্যাচেষ্টা জাতীয়তাবাদী ও স্বাধীনচেতা জনমত স্তব্ধ করার চেষ্টা। উভয় ক্ষেত্রেই ভারতের কৌশলগত স্বার্থ এবং আওয়ামী লীগের শীর্ষনেতাদের যোগসাজশের বিষয়টি তদন্ত প্রতিবেদনে উঠে এসেছে।
কূটনৈতিক চাপ : ভারতের হাইকমিশনারকে তলব করা এবং এই ‘অঘোষিত যুদ্ধের’ তথ্যপ্রমাণ আন্তর্জাতিক মহলে তুলে ধরা বর্তমানে বাংলাদেশের জন্য কেবল একটি কূটনৈতিক পদক্ষেপ নয়; বরং জাতীয় সার্বভৌমত্ব রক্ষার একটি বড় চ্যালেঞ্জ। হাদির ওপর হামলার পর সরকারের ন্যূনতম যে ব্যবস্থাগুলো নেয়া উচিত :
১. তথ্যপ্রমাণ সংগ্রহের পর্যায় : আন্তর্জাতিক মহলে জোরালো অবস্থান নিতে হলে বাংলাদেশের কাছে অকাট্য প্রমাণ থাকতে হবে। তদন্ত-সংশ্লিষ্টরা বর্তমানে যে বিষয়গুলো নিয়ে কাজ করছেন তা হলো বিজয়নগরের হামলার সিসিটিভি ফুটেজ বিশ্লেষণ করে হামলাকারীদের পরিচয় ও তাদের গতিবিধি নিশ্চিত করা।
২. আন্তর্জাতিক ফোরামে উপস্থাপন : বাংলাদেশ সরকার এই ইস্যুটিকে বিশ্বমঞ্চে তুলে ধরতে নিচের প্ল্যাটফর্মগুলো ব্যবহার করতে পারে।
জাতিসঙ্ঘ : জাতিসঙ্ঘের সাধারণ অধিবেশনে এবং ওআইসিতে (OIC) ভারতের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ এবং রাষ্ট্রীয় মদদে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের অভিযোগ আনুষ্ঠানিকভাবে তোলা।
মানবাধিকার সংস্থা : অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল এবং হিউম্যান রাইটস ওয়াচকে ওসমান হাদির ওপর হামলার তথ্য প্রদান করা, যাতে এটি একটি রাজনৈতিক টার্গেট কিলিং হিসেবে বিশ্বজুড়ে স্বীকৃত হয়।
কূটনৈতিক ব্রিফিং : ঢাকায় নিযুক্ত বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূতদের ডেকে তদন্তের তথ্যপ্রমাণ তুলে ধরা এবং ভারতকে আসামিদের হস্তান্তরের জন্য চাপ দিতে দেশগুলোর সহায়তা চাওয়া।
৩. ভারতের ওপর চাপ সৃষ্টির কৌশল : ভারতীয় হাইকমিশনারকে তলব করার পর পরবর্তী সম্ভাব্য কূটনৈতিক পদক্ষেপ হতে পারে :
২০১২ সালের প্রত্যর্পণ চুক্তি অনুযায়ী শেখ হাসিনা এবং জাহাঙ্গীর কবির নানকসহ অন্যান্য আসামিকে ফেরত পাঠানোর জন্য ভারতের ওপর তীব্র চাপ সৃষ্টি করা।
সীমান্তে বিএসএফের আগ্রাসন ও বাংলাদেশের অভ্যন্তরে এজেন্টদের অনুপ্রবেশ বন্ধে আন্তর্জাতিক তদারকির দাবি জানানো।
সরকার যদি এই হামলার পেছনের মাস্টারমাইন্ডদের এবং তাদের বিদেশী মদদদাতাদের মুখোশ বিশ্বদরবারে উন্মোচন করতে পারে, তবে এটি হবে বাংলাদেশের জন্য একটি বড় কূটনৈতিক বিজয়।
সতর্কতা : দেশের ভেতরে লুকিয়ে থাকা বিদেশী এজেন্ট ও তাদের দোসরদের চিহ্নিত করে জাতীয় নিরাপত্তা জোরদার করা।
বাংলাদেশের জাতীয় নিরাপত্তা এখন সর্বোচ্চ ঝুঁকির মুখে। কারণ দেশের ভেতরে ঘাপটি মেরে থাকা এজেন্টরা কেবল ব্যক্তিবিশেষকে টার্গেট করছে না; বরং রাষ্ট্রের মেরুদণ্ড ভেঙে দেয়ার চেষ্টা করছে।
জাতীয় নিরাপত্তা জোরদারে বর্তমানে যেসব পদক্ষেপ জরুরি :
১. ‘স্নাইপার সেল’ ও এজেন্টদের নেটওয়ার্ক ধ্বংস করা : বিডিআর হত্যাকাণ্ডের সাথে জড়িত পলাতক আসামি এবং জাহাঙ্গীর কবির নানকের মতো নেতাদের ব্যক্তিগত ক্যাডার বাহিনীর সদস্যদের পূর্ণাঙ্গ ডাটাবেজ তৈরি করে তাদের খুঁজে বের করা।
আর্থিক উৎস বন্ধ : এই ধরনের ‘টার্গেট কিলিং’-এ ব্যবহৃত বিদেশ থেকে হুন্ডির মাধ্যমে আসা সন্দেহজনক অর্থায়ন কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করা।
২. নিরাপত্তাবাহিনীর ভেতরে বা প্রশাসনের বিভিন্ন স্তরে এখনো যারা বিদেশী এজেন্ডা বাস্তবায়ন করতে সচেষ্ট, তাদের চিহ্নিত করা।
কাউন্টার ইন্টেলিজেন্স : দেশের ভেতরে অন্য কোনো দেশের গোয়েন্দা নেটওয়ার্ক যাতে সক্রিয় না থাকতে পারে, সে জন্য শক্তিশালী কাউন্টার ইন্টেলিজেন্স ব্যবস্থা গড়ে তোলা।
প্রশাসনিক শুদ্ধি : পিলখানা হত্যাকাণ্ডের সুবিধাভোগী বা সেই সময় তদন্তে বাধা সৃষ্টিকারী কর্মকর্তাদের বর্তমান গুরুত্বপূর্ণ পদ থেকে সরিয়ে দেয়া।
৩. সীমান্ত নিরাপত্তা ও অনুপ্রবেশ রোধ : ওসমান হাদির হামলাকারীরা যেভাবে হামলার পর সহজেই পালিয়ে যাওয়ার সুযোগ পায়, তা সীমান্ত নিরাপত্তার দুর্বলতাকে ফুটিয়ে তোলে।
কঠোর সীমান্ত নিয়ন্ত্রণ : সীমান্তে বিজিবির নজরদারি বাড়ানো ও সন্দেহভাজন ব্যক্তিদের দেশত্যাগে কঠোর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা। রাজধানীর গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টগুলোতে এবং সীমান্তে উন্নত সিসিটিভি ও ফেসিয়াল রিকগনিশন প্রযুক্তি ব্যবহার করা।
৪. সাইবার স্পেসে সতর্কতা : সোস্যাল মিডিয়ায় যারা গুজব ছড়িয়ে বা উসকানিমূলক প্রচারণা চালিয়ে এই হামলাগুলোকে জায়েজ করার চেষ্টা করছে, তারা মূলত এই এজেন্টদেরই ডিজিটাল দোসর। এদের আইনের আওতায় আনা জরুরি।
৫. জনসচেতনতা ও প্রতিরোধ : জনগণই হচ্ছে রাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় সুরক্ষা। এলাকাভিত্তিক দেশপ্রেমিক নাগরিকদের সচেতনতা বৃদ্ধি করা প্রয়োজন, যাতে কোনো অপরিচিত বা সন্দেহভাজন ব্যক্তির গতিবিধি লক্ষ করলে তারা দ্রুত নিরাপত্তাবাহিনীকে অবহিত করতে পারে।
হাদির রক্ত আমাদের মনে করিয়ে দেয়, স্বাধীনতা রক্ষার লড়াই শেষ হয়নি। বিডিআর হত্যার বিচার এবং চলমান অঘোষিত যুদ্ধের এজেন্টদের নির্মূল করাই এখন জাতীয় নিরাপত্তার প্রধান অগ্রাধিকার হওয়া উচিত।
লেখক : সিনিয়র ফেলো, এসআইপিজি, নর্থ-সাউথ ইউনিভার্সিটি



