লাদাখে ‘বিছিন্নতাবাদী’ আন্দোলন

ভারতের ইতিহাসে দেখা যায়, সরকার নিজের ভুল স্বীকার করে না। সেটি হতে পারে মনমোহন সিংয়ের ভুল, নেহরুর ভুল বা অন্য কারো।

লেহ, লাদাখ। যেখানে মানুষ তুলনামূলকভাবে শান্তিপ্রিয় ও বন্ধুত্বপূর্ণ। এখন সেখানে তারা অগ্নিসংযোগ করছে। তারা কেন্দ্রীয় সরকারের প্রতি অসন্তুষ্ট। এক শান্তিপূর্ণ অঞ্চলে যে ভয়াবহ ঘটনা ঘটেছে, ইতিহাস না জানলে অনেকে মনে করবেন- এসব গাজা ও মধ্যপ্রাচ্যের যুদ্ধের ছবি।

আন্দোলনের নেতৃত্বে ছিলেন সোনম ওয়াংচুক। সরকার সহিংসতার জন্য তাকে দায়ী করছে। ওয়াংচুক গত ছয় বছর ধরে শান্তিপূর্ণভাবে প্রতিবাদ করে আসছিলেন, সে ব্যক্তি এখন একজন ভিলেন। লাদাখের মানুষের দাবি উপেক্ষিত হয়েছে, এটি সত্য। লেহ, লাদাখে কী ঘটেছে শুধু সেটি জানলেই হবে না, কীভাবে সাধারণ মানুষের ন্যায্য অধিকার দাবিয়ে রাখা হচ্ছে এবং কীভাবে এটিকে রাজনৈতিক প্রচারণার হাতিয়ারে পরিণত করা হয়েছে তাও জানা দরকার।

ভারত সরকারের প্রচারযন্ত্র লাদাখের ঘটনায় চীন, সিআইএ ও বর্তমান বিরোধী দল কংগ্রেসকে জড়িয়ে দিয়েছে। কিছু দিন আগে নেপালের ঘটনায় মূলধারার সাংবাদিকদের টার্গেট করা হয়েছিল, একই ঘটনা লাদাখেও ঘটছে।

শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদের যুগ হয়তো শেষ হয়ে এসেছে, কেউই আর গুরুত্ব দেয় না, না মূলধারার মিডিয়া, না সাধারণ মানুষ, না সরকার। গুরুত্ব না দেয়ার কারণে লাদাখের মানুষ ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। এটিও সত্য, সহিংসতা কখনোই কোনো সমস্যার সমাধান হতে পারে না। কেন মানুষ ধৈর্য হারিয়ে ফেলল?

ওয়াংচুকের মতাদর্শ গান্ধীবাদী। সোনম ওয়াংচুক এখন তার অনশন ভেঙেছেন এবং সমর্থকদের বলেছেন, তারা ভুল পথে চলে গিয়েছিল। মারপিট অশুভ কাজ। এ দিকে সরকারের প্রচারযন্ত্র বলেছে, এই সব কিছুই ঘটেছে ওয়াংচুকের উসকানিমূলক বক্তব্যের কারণে।

এখন লাদাখের দিকে নিরপেক্ষভাবে তাকালে দেখা যায়, অগ্নিসংযোগ, সহিংসতা, চীন, আমেরিকা, আর বিরল খনিজ পদার্থের এক জটিল সংযোগ, যা প্রেক্ষাপট ছাড়া বোঝা অসম্ভব। ওয়াংচুকের প্রতিবাদ চলছিল ছয় বছর ধরে। কখনো দিল্লি অভিমুখে পদযাত্রা, কখনো অনশন। মূল দাবিগুলো সামনে রেখে গত ১০ সেপ্টেম্বর ওয়াংচুক আবার অনশনে বসেন। কেন্দ্রীয় সরকার তা আমলে নেয়নি। ২১ সেপ্টেম্বরের দিকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানায়, আলোচনা হবে। কিন্তু সেই আলোচনার শর্ত দেখে আন্দোলনকারীরা আরো ক্ষুব্ধ হয়। কারণ, সরকার নিজের শর্ত চাপিয়ে দিচ্ছে, মূল দাবিগুলো শুনছে না। তাই অনশন চলতেই থাকে। এক পর্যায়ে দুইজন আন্দোলনকারী অসুস্থ হয়ে পড়েন প্রতিবাদকারীরা ধৈর্য হারিয়ে ফেলেন এবং ২৪ সেপ্টেম্বর সহিংসতা ঘটে। ওয়াংচুক টুইট করে শান্তির আহŸান জানান। সরকার প্রতিক্রিয়া জানায় গুলি চালিয়ে।

লাদাখে যে দমন-পীড়ন চলছে, তা কাশ্মিরের দমন-পীড়নের মতোই। প্রচারণা চালানো হচ্ছে, সোনম ওয়াংচুক সন্ত্রাসী, কেউ বলছে তিনি চীনের এজেন্ট এবং এই সব কিছু চীন দ্বারা পরিচালিত। কেননা, এখানে বিরল খনিজ পাওয়া গেছে, চীন নিতে চায়। কেউ বলছেন, সোনম বাংলাদেশে কেন গিয়েছিল? ড. ইউনূসের সাথে কেন ছবি পাওয়া গেল। বাংলাদেশ লাদাখে কী করবে। গোদি মিডিয়া কিছুই খুঁজে পাচ্ছে না।

গত পাঁচ বছর ধরে জানা যাচ্ছে, লাদাখে বিরল খনিজ পাওয়া গেছে। মূল বিষয় হলো- যে খনিজ পাওয়া গেছে তা উত্তোলনযোগ্য নয়, ঘনত্বও ভালো নয়, পরিমাণও কম। তাই সরকার উত্তোলনে যায়নি। তবু বিষয়টি চীনের ঘাড়ে চাপানো হচ্ছে। কারণ, সরকারকে ‘মহান’ করার জন্য বিদেশী হস্তক্ষেপ দেখানোর দরকার। অভ্যন্তরীণ রাজনীতি ও সমস্যা মোকাবেলার ব্যর্থতায় লাদাখের ঘটনা বিস্তৃত হচ্ছে। ছড়িয়ে পড়ছে নানা জায়গায়।

লাদাখ অঞ্চলটি চীনের লাগোয়া, তাই বলা হচ্ছে চীনের প্রভাব। জম্মু-কাশ্মিরে কেউ কথা বললে তাকে বলা হয় পাকিস্তানি। পাঞ্জাবের কৃষকরা কথা বললে বলা হয় খালিস্তানি। কেরালায় কেউ কথা বললে তাদের বলা হয় আইসিস। বাংলায় কথা বললে বলা হয় বাংলাদেশী অনুপ্রবেশকারী। উত্তরাখণ্ডে ছাত্ররা রাস্তায় নেমেছে পরীক্ষায় প্রশ্নপত্র ফাঁসের অভিযোগে। বলা হচ্ছে, এটি জেন-জি নেপালের অর্থায়নে!

ভারতের খুঁটি কি এতই নড়বড়ে যে, কয়েক খালিস্তানি, কয়েক নেপালি, কিছু চীনা, কিছু আইসিস, কিছু বাংলাদেশী এসে ধ্বংস করে দেবে? সরকারের কোনো ভুল নেই? সবই কি আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র? আহা গোদি মিডিয়া!

আন্দোলনকারীরা চারটি দাবি-দাওয়া দিয়েছে : ১. লাদাখের রাজ্য মর্যাদা : যখন লাদাখকে কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল ঘোষণা করা হলো তারা ভেবেছিল, কেন্দ্রের নজর তাদের দিকে থাকবে। কিন্তু ধীরে ধীরে তারা বুঝতে পারল, কীভাবে তারা প্রতারিত হচ্ছে। কোনো বড় উন্নয়নমূলক কাজ হয়নি, শুধু বিনিয়োগের নামে বড় শিল্পপতিরা এসেছে। জম্মু ও কাশ্মিরের রাজ্য মর্যাদা কবে ফিরিয়ে দেয়া হবে? লাদাখের মানুষও একই দাবি তুলেছেন, রাজ্য মর্যাদা। দ্বিতীয়টি হলো- ২. ষষ্ঠ তফসিলের অধীনে সংরক্ষণ : দ্বিতীয় দাবি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, লাদাখকে ভারতের সংবিধানের ষষ্ঠ তফসিলের আওতায় আনার দাবি। কারণ, সেখানে ৯৭ শতাংশ জনসংখ্যা উপজাতি। ভারতের সংবিধানের ষষ্ঠ তফসিল স্বায়ত্তশাসিত জেলা ও অঞ্চল গঠনের কথা বলা থাকায় স্বায়ত্তশাসিত জেলা পরিষদ এবং আঞ্চলিক পরিষদ চালু করা যায়। এর মূল বৈশিষ্ট্যগুলোর মধ্যে রয়েছে : প্রশাসনিক স্বায়ত্তশাসন- এই কাউন্সিলগুলো ভূমি ব্যবস্থাপনা, বন, খাল এবং পানির ব্যবহার এবং সামাজিক রীতিনীতিসহ কিছু বিষয় পরিচালনা করতে পারে। ক্ষমতা এবং এখতিয়ার- বিভিন্ন বিষয়ে আইন প্রণয়ন এবং প্রবিধান প্রয়োগ করার ক্ষমতা রয়েছে। ৩. পাবলিক সার্ভিস কমিশন গঠন- লেহ একটি শিক্ষিত অঞ্চল কিন্তু স্নাতক বেকারত্বের হার সেখানে ২৬.৫ শতাংশ, যা জাতীয় গড় ১৩.৪ শতাংশের প্রায় দ্বিগুণ। তাই স্থানীয়রা চায়, চাকরির সুযোগ তৈরির নিয়মকানুন তারা নিজেরাই নির্ধারণ করবে, নিজস্ব পাবলিক সার্ভিস কমিশনের মাধ্যমে। সর্বশেষ দাবি হলো সংসদে আসন বাড়ানো। ৪. সংসদীয় প্রতিনিধিত্ব বৃদ্ধি- বর্তমানে লাদাখে মাত্র একজন সংসদ সদস্য রয়েছেন। তাদের দাবি, অন্তত দু’টি সংসদ পদ।

দমন-পীড়ন সত্তে¡ও আরো অনেক প্রতিষ্ঠান অধিকার রক্ষায় আন্দোলন করেছে যেমন- লাদাখ অ্যাপেক্স বডি, কারগিল ডেমোক্র্যাটিক অ্যালায়েন্স, ফুনসুখ ওয়াংডু। যখন তারা শাটডাউনের ডাক দিলো, কিছু অংশ সহিংসতায় জড়িয়ে পড়ল। কোনো বিক্ষোভে সবাইকে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয় না। সহিংসতা ও লুটমারের ঘটনায় আসলে কে জড়িত এখনো প্রমাণ হয়নি। তথাপি রাজনীতি ও কুপ্রচারণা চলছেই। মানুষের কোনো কথা না শুনে নিজের ইচ্ছামতো কাজ করলে সমস্যা বাড়ে এটি চিরন্তন সত্য।

রাজনীতির অলিগলি কত বাঁকা! প্রথমে আন্দোলনকারীদের ‘অবৈধ’ বলা হলো, বলা হলো তারা সহিংসতা করছে, দেশে অরাজকতা ছড়াচ্ছে। লাদাখ থেকে কীভাবে পুরো দেশে অরাজকতা ছড়াতে পারে, আদৌ পারে কি না তা মেপে বলা কঠিন। কিন্তু গোদি মিডিয়া সেটিই করছে। বলা হচ্ছে- এটি কংগ্রেসের কাজ, রাহুল গান্ধী বিজেপি অফিসে আগুন ধরিয়ে দেয়।

নিজের মানুষকে বিশ্বাসঘাতক বললে সেটি গোষ্ঠী বিছিন্ন করে দেয়ার মতো। লাদাখ এখন তাই মনে করে। তারা এককভাবে বাঁচতে চায়। তাই নতুন আওয়াজ আসছে। প্রশ্ন হলো- সরকার কি এই ঘটনা ব্যবহার করে সাধারণ মানুষকে টার্গেট করবে? আন্দোলন থামিয়ে দেবে? কেননা ওয়াংচুক তার অনশন শেষ করেছেন, এখন জনমানুষ এগিয়ে এসেছে। কিছু প্রতিবাদকারী উত্তেজিত হয়ে আগুন লাগিয়েছে। অনেকে বলছেন জিহাদ, জিহাদ, আজাদি, আজাদি। এতে ওয়াংচুকও ভয় পাচ্ছেন! ভারতে অবস্থাটা এমন যে কেউ আওয়াজ করলে, তাকে বলা হয় জিহাদি, বিদেশী, আইএস, সিআইএ এজেন্ট, চীনা গুপ্তচর, তালেবান বা পাকিস্তানের আইএসআই।

লেহতে যা দেখা যাচ্ছে, তাতে মনে হয়, লাদাখ হতে পারে পরবর্তী কাশ্মির। কাশ্মিরিদের সাথে যে আচরণ করা হয়েছে তা এখন লাদাখিরাও বুঝতে পারছে। ঘৃণা কীভাবে ছড়ানো হয়, কীভাবে বিচ্ছিন্নতা তৈরি হয়, কীভাবে ‘টেরর কমপ্লেক্স’ বানানো হয়। কেন মানুষ বিছিন্ন হতে চায়।

সরকার বুঝতে পারছে, মানুষের ধৈর্য ফুরিয়ে আসছে। অমিত শাহ পুলিশ গবেষণা ও উন্নয়ন ব্যুরোকে নির্দেশ দিলেন, প্রতিবাদ কীভাবে ঘটছে, কে করছে, কে অর্থায়ন করছে এবং ফলাফল কী তা বিশ্লেষণ করতে। সরকার কী নিয়ে ভয় পাচ্ছে? প্রতিবাদ তো তখনই হয়, যখন বছরের পর বছর জনগণের অধিকার উপেক্ষা করা হয়, অপমান করা হয়।

সরকার শেষের দু’টি দাবি, পাবলিক সার্ভিস কমিশন এবং অতিরিক্ত সংসদীয় আসনের দাবি মেনে নিতে রাজি হয়েছে। কিন্তু রাজ্য মর্যাদা এবং ষষ্ঠ তফসিলের বিষয়ে এখনো অনঢ়। সামনে কী ঘটতে পারে তার জন্য কি সরকার ভীত? ভারতের ইতিহাসে দেখা যায়, সরকার নিজের ভুল স্বীকার করে না। সেটি হতে পারে মনমোহন সিংয়ের ভুল, নেহরুর ভুল বা অন্য কারো। সুপ্রিম কোর্টের এক বিচারক সম্প্রতি বলেছেন, বাবরি মসজিদ অপবিত্র ছিল। গোদি মিডিয়া আর আইটি সেলের ছড়ানো মিথ্যা আর স্টুপিডিটি দেখেও বোঝা উচিত, আসল কাজটি কে করছে। দেশপ্রেমিকরা এসবের জবাব জানে, অন্যরা নয়।

লেখক : অবসরপ্রাপ্ত যুগ্মসচিব ও গ্রন্থকার