বাগরাম-আরেক নতুন ওয়ার গেম

বাগরাম এখন নীরব। কিন্তু এর চারপাশে ঘূর্ণায়মান রয়েছে পরাশক্তির কৌশল, উদ্বেগ এবং প্রতিযোগিতা। এ ঘাঁটির পতন শুধু একটি সামরিক অধ্যায়ের সমাপ্তি নয়; এটি এক নতুন ভূ-রাজনৈতিক প্রশ্নের সূচনা। আফগানিস্তান কি নিজের সার্বভৌমত্ব রক্ষা করতে পারবে? নাকি আবারো পরাশক্তির দাবা খেলায় একটি ঘুঁটি হয়ে উঠবে?

আফগানিস্তান ফের হঠাৎ বিশ্ব রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হতে যাচ্ছে কি। ট্রাম্পের একটি ঘোষণায় ছয়টি শক্তিধর রাষ্ট্র- যুক্তরাষ্ট্র, ভারত, পাকিস্তান, রাশিয়া, চীন ও ইরানে উদ্বেগ দেখা দিয়েছে, তালেবান তো আছেই। তালেবান সরকারের ক্ষমতা গ্রহণ, যুক্তরাষ্ট্রের সেনা প্রত্যাহার এবং বাগরাম বিমানঘাঁটি নিয়ে সাম্প্রতিক বিতর্ক- সব মিলিয়ে দেশটি যেন এক নতুন গ্রেট গেমের মঞ্চে পরিণত হচ্ছে। এ প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে প্রত্যেকের রয়েছে নিজস্ব কৌশল ও স্বার্থ।

মধ্য এশিয়ার পাঁচটি দেশ- কাজাখস্তান, কিরগিজ প্রজাতন্ত্র, তাজিকিস্তান, তুর্কমেনিস্তান ও উজবেকিস্তানে কূটনৈতিক প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে জড়িত এবং নিরাপত্তা সহযোগিতায় অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র মধ্য এশিয়ার দেশগুলোকে সন্ত্রাসবাদ দমন ও সীমান্ত সুরক্ষায় নিরাপত্তা সহায়তায় অর্থায়ন করে থাকে। সেই সাথে সামরিক সরঞ্জাম সরবরাহ, প্রশিক্ষণ ও যৌথ মহড়া পরিচালনা উল্লেখযোগ্য। যুক্তরাষ্ট্রের কোনো স্থায়ী সামরিক বেস না থাকায় বাগরাম আমেরিকার এক আদর্শ স্থানে পরিণত হয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্র চায় বাগরাম ঘাঁটি পুনরুদ্ধার করে চীন ও সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে। তালেবান সরকার এ পদক্ষেপের তীব্র বিরোধিতা করছে, সার্বভৌমত্বের প্রশ্নে কাবুল আপসহীন। চীন, ভারত, পাকিস্তান ও রাশিয়া- চারটি প্রতিবেশী শক্তি, আফগানিস্তান ঘিরে নিজেদের প্রভাব রক্ষা ও সম্প্রসারণের কৌশলে ব্যস্ত। চীন অর্থনৈতিকভাবে প্রবেশ, যোগাযোগ সমৃদ্ধকরণ ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে চায়, আর ইরান সীমান্ত নিরাপত্তা ও ধর্মীয় রাজনীতির ভারসাম্য রক্ষা করতে চায়। এ নিবন্ধে আমরা বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করব এসব দেশের দৃষ্টিভঙ্গি, কৌশলগত অবস্থান কেমন। আফগানিস্তান কি সত্যি নিজের অবস্থান ধরে রাখতে পারবে? নাকি আবারো পরাশক্তির দাবা খেলার ঘুঁটি হয়ে উঠবে? এর জন্য বহুস্তর বিশ্লেষণ দরকার যেখানে ভূ-রাজনীতি, ধর্ম, অর্থনীতি ও কূটনীতি একে-অপরের সাথে জট পাকিয়ে আছে।

সম্প্রতি প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প আফগানিস্তানের বাগরাম বিমানঘাঁটি পুনরুদ্ধারের দাবি জোরালোভাবে তুলে ধরেন। তার বক্তব্য অনুযায়ী, যুক্তরাষ্ট্র ‘বাগরাম ফিরে পেতে চায়, কারণ তারা আমাদের কাছ থেকে কিছু চায়।’ তালেবান নেতৃত্বকে তিনি আহ্বান জানান ঘাঁটির নিয়ন্ত্রণ ফিরিয়ে দিতে, যুক্তি দেন যে- এটি যুক্তরাষ্ট্র নির্মাণ করেছে এবং এটি তাদের অধিকার। তবে ইতিহাস বলে, সোভিয়েত ইউনিয়ন ১৯৫০-এর দশকে আফগানিস্তানে বাগরাম বিমানঘাঁটি নির্মাণকারী প্রথম দেশ। ১৯৭৬ সালে কংক্রিট রানওয়ে যুক্ত করা হয়েছিল। ২০০১-২১ : যুক্তরাষ্ট্র ২০০১ সালে আক্রমণের পরে ঘাঁটির নিয়ন্ত্রণ নেয়। দুই দশকের বেশি সময় ধরে যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটো বাহিনী বাগরামকে আধুনিকীকরণ এবং দেশের বৃহত্তম সামরিক স্থাপনায় প্রসারিত করে, দ্বিতীয় রানওয়ে ও অসংখ্য সুবিধা যুক্ত করে। এ দাবির পেছনে রয়েছে আফগানিস্তানে পুনরায় মার্কিন প্রভাব বিস্তারের কৌশল, যা তালেবান সরকারের সার্বভৌমত্বের সাথে সাংঘর্ষিক। ট্রাম্প প্রশাসন বাগরাম ঘাঁটির অবস্থানকে চীনের পারমাণবিক অস্ত্র উৎপাদন কেন্দ্রের ‘এক ঘণ্টার দূরত্বে’ রয়েছে বলে উল্লেখ করেছে, যদিও তালেবান এ দাবিকে ‘ভুল তথ্য’ বলে প্রত্যাখ্যান করেছে।

যুক্তরাষ্ট্রের দৃষ্টিতে, আফগানিস্তানে সামরিক উপস্থিতি চীনের প্রভাব মোকাবেলায় সহায়ক হতে পারে। এ ছাড়া সন্ত্রাসবিরোধী কার্যক্রমে কৌশলগত সুবিধা দিতে পারে। তবে তালেবান সরকার স্পষ্ট করেছে, আফগান ভূখণ্ডকে কোনো পরাশক্তির প্রতিযোগিতার মঞ্চে পরিণত হতে দেবে না। যুক্তরাষ্ট্র ও তালেবান সরকারের মধ্যে কিছু সংলাপ হয়েছে, বিশেষ করে বন্দী বিনিময় ও অর্থনৈতিক বিনিয়োগ নিয়ে। তবে তালেবান সরকার বাগরাম প্রসঙ্গে কোনো আলোচনা করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে। কাবুল বলেছে, বিষয়টি ‘অত্যন্ত সংবেদনশীল’। যুক্তরাষ্ট্রের পুনরায় সামরিক উপস্থিতির প্রচেষ্টা তালেবানের দৃষ্টিতে ‘দখলদারিত্বের পুনরাবৃত্তি’ যা তারা কোনোভাবে মেনে নেবে না। এ অবস্থা যুক্তরাষ্ট্রের কৌশলগত পরিকল্পনাকে জটিল করে তুলেছে।

গাজা যুদ্ধ বন্ধে যুক্তরাষ্ট্র বারবার ভেটো দিয়ে যাচ্ছে, সাম্প্রতিক ভেটো নিয়ে ১২ বার হলো। সমালোচকরা বলছেন, গাজা যুদ্ধ বা ফিলিস্তিনিদের নির্মূল করা ইসরাইলের চেয়ে ট্রাম্পের ইচ্ছা বেশি। গাজা যুদ্ধে ইতোমধ্যে এক লাখ ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন, যাদের বেশির ভাগ শিশু ও নারী এবং সাধারণ নাগরিক। গাজা এখন ভুতুড়ে নগরী। বেঁচে থাকার যেসব প্রাথমিক উপকরণ দরকার- খাবার, পানীয়, বিদ্যুৎ, ওষুধপাতি, অর্থকড়ি- এসব উৎস শেষ করে দেয়া হয়েছে। এসব প্রত্যক্ষ করে ইরানের সাথে যুদ্ধে যোগ দিতে চীন, রাশিয়া সহায়তা পাঠাচ্ছে। এটিও প্রকাশিত হয়েছে, আফগানিস্তান থেকে কালেমার পতাকাবাহী সেনাবাহিনী যুদ্ধে যোগ দিতে অনেক আগে জমায়েত শুরু করেছে। সমালোচকরা জানিয়েছেন, কমপক্ষে এক লাখ আফগানি বা তালেবান বাহিনী এ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করবেন। ট্রাম্প হিসাব করেছেন, রাশিয়ার জন্য রয়েছে ইউক্রেন, চীনের জন্য তাইওয়ান। বাগরাম বিমানঘাঁটিতে পা রাখা গেলে তালেবানকে বাগে আনা যাবে, একই সাথে চীন ও রাশিয়ার সাথেও সামরিক বোঝাপড়া করা যাবে। তাই ট্রাম্পের বাগরাম বিমানঘাঁটি চাই।

প্রসঙ্গক্রমে আলোচনায় ভারতের কথাও আসে। ভারতের আফগানিস্তান-সংলগ্ন কৌশলগত পরিকল্পনার কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে চাবাহার বন্দর। পাকিস্তানকে বাইপাস করে আফগানিস্তান ও মধ্য এশিয়ায় প্রবেশে এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ করিডোর। তবে যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা ও তালেবান সরকারের অনিশ্চিত অবস্থান এ প্রবেশপথকে ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলেছে। ভারত চায় আফগানিস্তানের স্থিতিশীলতা, যাতে বাণিজ্যিক ও জ্বালানি কৌশল বাস্তবায়ন সম্ভব হয়। ভারত ২০২১ সালের পর থেকে ব্যাকচ্যানেল কূটনীতি চালিয়ে যাচ্ছে তালেবান সরকারের সাথে, তবে এখনো আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেয়নি।

ভারতের দৃষ্টিতে আফগানিস্তান একটি ভূ-রাজনৈতিক বাফার, যা চীন-পাকিস্তান জোটের প্রভাব রোধে সহায়ক হতে পারে। বাগরামঘাঁটি পুনরুদ্ধার নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের আগ্রহ দিল্লিকে দ্বিধায় ফেলেছে। একদিকে এটি চীনের বিরুদ্ধে কৌশলগত সুবিধা, অন্যদিকে তালেবানের সাথে ভারতের যোগাযোগ জটিলতর হওয়া। ভারত তাই প্রভাবের ভারসাম্য রক্ষা করতে চায়, যাতে আফগানিস্তান নিজের কৌশলগত স্বার্থে সহায়ক থাকে। আফগানিস্তানের সাথে উত্তর সীমান্তের কাছে রয়েছে ভারতের ফারখোর ঘাঁটি। ফারখোর ভারতের প্রথম বিদেশী সামরিক ঘাঁটি। এটি ভারতীয় ও তাজিক বিমানবাহিনী যৌথভাবে পরিচালনা করে। ঘাঁটিটি পাকিস্তান অধিকৃত কাশ্মির থেকে ২০ কিলোমিটার দূরে। তালেবানবিরোধী নর্দার্ন অ্যালায়েন্সকে সমর্থন করতে ভারত নব্বইয়ের দশকের শেষের দিকে ফারখোরে একটি সামরিক হাসপাতাল পরিচালনা করতে সহায়তা করেছিল। দুশানবের কাছে ভারতের আয়নি বিমানঘাঁটি রয়েছে। এটি সংস্কার করতে আনুমানিক ৭০ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করেছে ভারত। সরাসরি প্রবেশাধিকারের অভাব, রাশিয়া ও চীন উভয় মধ্য এশিয়াকে প্রভাব বিস্তারের চারণভূমি বানানোয় ভারত মধ্য এশিয়ায় সীমিত সামরিক বেস করতে পেরেছে। রাশিয়া সক্রিয়ভাবে ভারতীয় সামরিক সম্প্রসারণে বাধা দিয়ে আসছে।

বাগরাম ঘাঁটির বিষয়ে পাকিস্তানের সংযোগ জটিল। তালেবান সরকার সরাসরি হুঁশিয়ারি দিয়েছে- যদি পাকিস্তান যুক্তরাষ্ট্রকে লজিস্টিক, কূটনৈতিক বা সামরিক সহায়তা দেয় বাগরাম ঘাঁটি পুনরুদ্ধারে, তাহলে ইসলামাবাদকে ‘শত্রুরাষ্ট্র’ হিসেবে ঘোষণা করা হবে। এ অবস্থান পাকিস্তানের জন্য কূটনৈতিক সঙ্কট তৈরি করবে। একদিকে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে দীর্ঘমেয়াদি সম্পর্ক, অন্যদিকে তালেবানের সাথে সীমান্ত, ধর্মীয় ও নিরাপত্তা সংযোগ। পাকিস্তান এখন দ্বিধাগ্রস্ত, যেখানে প্রতিটি পদক্ষেপে রয়েছে ঝুঁকি। আফগান-পাকিস্তান সীমান্তে শরণার্থী প্রবাহ, চোরাচালান এবং নিরাপত্তা সঙ্ঘাত পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিকে প্রভাবিত করে আসছে।

তালেবান সরকারের সাথে সম্পর্ক খারাপ হলে টিটিপির (তেহরিক-ই-তালেবান পাকিস্তান) মতো গোষ্ঠীগুলো আরো সক্রিয় হয়ে উঠবে। পাকিস্তান-বিরোধী শক্তিগুলো এদের সামরিক, আর্থিক ও কৌশলগত সহায়তা দিতে ছুটে আসবে। একই সাথে, তালেবান সরকার পাকিস্তানের দ্বৈত ভূমিকার সমালোচনাও করছে, একদিকে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে যোগাযোগ, অন্যদিকে তালেবানকে প্রভাবিত করার চেষ্টা। এ দ্ব›দ্ব পাকিস্তানের সীমান্ত নীতি জটিলতর করে তুলেছে। পাকিস্তান যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সম্পর্ক বজায় রাখতে চায়, বিশেষ করে অর্থনৈতিক-সামরিক সহায়তা ও আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি রক্ষায়। তবে তালেবানের হুঁশিয়ারি ও সীমান্ত বাস্তবতা ইসলামাবাদকে গভীরভাবে ভাবনাচিন্তা করতে বাধ্য করেছে। পাকিস্তানে এখন নীরব কূটনীতি চলছে বাগরাম নিয়ে। উভয় পক্ষে ভারসাম্য রক্ষা করতে চাইছে।

রাশিয়া বাগরামের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। রাশিয়া তালেবান সরকারের সার্বভৌমত্বের পক্ষে অবস্থান নিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের বাগরাম ঘাঁটি পুনরুদ্ধারের প্রচেষ্টার সরাসরি বিরোধিতা করেছে। মস্কোর মতে, আফগানিস্তানে ফের মার্কিন সামরিক উপস্থিতি আঞ্চলিক অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করবে এবং রুশ প্রভাব হুমকির মুখে ফেলবে। রাশিয়া তালেবানকে একটি বাস্তবতা-ভিত্তিক শক্তি হিসেবে মেনে নিয়েছে, যদিও এখনো আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেয়নি। তাজিকিস্তান ও কিরগিজস্তানে রাশিয়ার সামরিকঘাঁটি রয়েছে, যা আফগানিস্তানের উত্তরে নিরাপত্তাবলয় গড়ে তুলেছে। তালেবান সরকার যদি যুক্তরাষ্ট্রের সাথে ঘনিষ্ঠ হয়, তাহলে এ বলয় দুর্বল হয়ে নিরাপত্তা ঝুঁকি তৈরি করবে।

রাশিয়া চায় আফগানিস্তান নিরপেক্ষ ভূখণ্ড হিসেবে থাকুক, যাতে তারা মধ্য এশিয়ায় নিজেদের প্রভাব বজায় রাখতে পারে এবং চীন ও ইরানের সাথে সমন্বয় করে যুক্তরাষ্ট্রবিরোধী অবস্থান জোরদার করতে পারে। রাশিয়া আফগানিস্তানকে একটি ভূ-রাজনৈতিক প্রতিযোগিতার ক্ষেত্র হিসেবে দেখে, যেখানে যুক্তরাষ্ট্রের প্রত্যাবর্তন মানে নতুন ঠাণ্ডা যুদ্ধের আশঙ্কা। তালেবান সরকারের সাথে রাশিয়ার সম্পর্ক প্রতীকী সমর্থন ও কৌশলগত বার্তা বহন করে যে, তারা পশ্চিমা হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধে।

রাশিয়া চায় আফগানিস্তানকে চীন-ইরান-রাশিয়া জোটের ছায়ায় রাখতে, যাতে যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব সীমিত থাকে। বহুপক্ষীয় বিশ্বব্যবস্থার ধারণা জোরদার হয়। যদিও রাশিয়া ঐতিহাসিকভাবে প্রভাবশালী সামরিক শক্তি হয়ে উঠেছে কালেক্টিভ সিকিউরিটি ট্রিটি অর্গানাইজেশন-সিএসটিও নামে রাশিয়ার নেতৃত্বাধীন সামরিক জোটে কাজাখস্তান, কিরগিজস্তান ও তাজিকিস্তান অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। মধ্য এশিয়ায় কিরগিজস্তানে রাশিয়ার একটি প্রকাণ্ড বিমানঘাঁটি এবং কাজাখস্তানে সামরিক পরীক্ষার সাইট রয়েছে।

আফগানিস্তানকে চীন বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের অংশ হিসেবে দেখতে চায়, বিশেষ করে লিথিয়াম, তামা ও অন্যান্য খনিজসম্পদের জন্য। তালেবান সরকার চীনের বিনিয়োগকে স্বাগত জানিয়েছে, কারণ এটি আর্থিক স্থিতিশীলতা ও বৈদেশিক স্বীকৃতি অর্জনে সহায়ক হতে পারে। চীন উদ্বিগ্ন যে, আফগানিস্তান উইঘুর বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠীর আশ্রয়স্থল, যারা চীনের শিনজিয়াং অঞ্চলে হামলা চালাতে সক্ষম। তালেবান সরকার চীনকে আশ্বস্ত করেছে, আফগান ভূখণ্ড চীনের বিরুদ্ধে ব্যবহৃত হবে না। এ নিরাপত্তা উদ্বেগ চীনকে তালেবানের সাথে নিয়ন্ত্রিত সম্পর্ক বজায় রাখতে বাধ্য করছে।

যুক্তরাষ্ট্রের বাগরাম ঘাঁটি পুনরুদ্ধারের প্রচেষ্টার বিরোধিতা করেছে চীন, কারণ এটি আঞ্চলিক ভারসাম্য নষ্ট করবে। চীনের পশ্চিম সীমান্তে সামরিক উত্তেজনা বাড়াবে। তাছাড়া যুক্তরাষ্ট্র মূলত চীনের বিরুদ্ধে সামরিক অভিযান পরিচালনায় বাগরাম ঘাঁটিতে আসতে চায়। চীন চায় আফগানিস্তান নিরপেক্ষ ভূখণ্ড হিসেবে থাকুক, যেখানে তারা সামরিক প্রতিযোগিতা এড়িয়ে অর্থনৈতিক প্রভাব বজায় রেখে সমৃদ্ধি অর্জন করতে পারে। তালেবান সরকারের সাথে চীনের সম্পর্ক তাই যুক্তরাষ্ট্রবিরোধী কৌশলগত ভারসাম্য রক্ষার অংশ।

ইরান ও আফগানিস্তানের মধ্যে দীর্ঘ সীমান্ত রয়েছে, হেলমান্দ নদীর পানিবণ্টন নিয়ে বারবার উত্তেজনা দেখা দেয়। তালেবান সরকার ইরানের পানি চাহিদা মেনে নিতে অনিচ্ছুক, ফলে সীমান্তে সংঘর্ষ ও কূটনৈতিক বিবাদ বেড়েই চলছে। একই সাথে আফগানিস্তান থেকে শরণার্থী প্রবাহ ইরানের অভ্যন্তরীণ অর্থনীতি ও নিরাপত্তায় চাপ সৃষ্টি করছে। ইরান চায় একটি স্থিতিশীল ও সহযোগিতামূলক সীমান্ত সম্পর্ক; কিন্তু তালেবানের অনমনীয়তা এ লক্ষ্য বাধাগ্রস্ত করছে।

তালেবান সরকারের অধীনে শিয়া হাজারা জনগোষ্ঠী বারবার নিপীড়নের শিকার হয় বলে অভিযোগ রয়েছে, যা ইরানের জন্য ধর্মীয় ও মানবাধিকার উদ্বেগ তৈরি করেছে। ইরান নিজেকে শিয়া মুসলিম বিশ্বের রক্ষক মনে করে, ফলে তালেবানের সুন্নি আধিপত্যবাদী নীতির বিরুদ্ধে ইরানের অবস্থান। তবে ইরান সরাসরি সঙ্ঘাতে না গিয়ে কূটনৈতিক চাপ ও নরম বার্তা দিয়ে তালেবানকে প্রভাবিত করার চেষ্টা করছে। ইরান যুক্তরাষ্ট্রের বাগরাম ঘাঁটি পুনরুদ্ধারের প্রচেষ্টার বিরোধিতা করেছে, কারণ এটি আঞ্চলিক হস্তক্ষেপ ও সামরিক উত্তেজনা বাড়াবে। ইরান চায় আফগানিস্তান যুক্তরাষ্ট্রবিরোধী বলয়ের অংশ হিসেবে থাকুক, যেখানে চীন ও রাশিয়ার সাথে সমন্বয় করে তালেবানকে প্রভাবিত করা যায়। ইরান বিভিন্ন চুক্তির মাধ্যমে মধ্যএশিয়ায় প্রভাব বিস্তার করছে। তবে বিস্তৃত প্রতিরক্ষা জোট নেই। তবে মধ্য এশিয়ার তাজিকিস্তান এবং উজবেকিস্তানের সাথে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক রয়েছে। ২০২১ সালে ইরান এবং তাজিকিস্তানের মধ্যে নিরাপত্তা সহযোগিতা চুক্তি হয় ও একটি যৌথ সামরিক প্রতিরক্ষা কমিটি গঠিত হয়। মার্চ ২০২২ সালে ইরান ও উজবেকিস্তান একটি নিরাপত্তা সহযোগিতা চুক্তি স্বাক্ষর করে। আফগানিস্তানের অস্থিতিশীলতা নিয়ে উভয় দেশ নিয়মিত আলোচনা করে থাকে। প্রচুর চাপ সত্তে¡ও তালেবান সরকার ট্রাম্পের সাথে বাগরাম বিষয়ে কোনো বৈঠক করতে নারাজ।

উসংহার

বাগরাম এখন নীরব। কিন্তু এর চারপাশে ঘূর্ণায়মান রয়েছে পরাশক্তির কৌশল, উদ্বেগ এবং প্রতিযোগিতা। এ ঘাঁটির পতন শুধু একটি সামরিক অধ্যায়ের সমাপ্তি নয়; এটি এক নতুন ভূ-রাজনৈতিক প্রশ্নের সূচনা। আফগানিস্তান কি নিজের সার্বভৌমত্ব রক্ষা করতে পারবে? নাকি আবারো পরাশক্তির দাবা খেলায় একটি ঘুঁটি হয়ে উঠবে?

লেখক : অবসরপ্রাপ্ত যুগ্মসচিব ও গ্রন্থকার