এই প্রজন্মের তরুণেরা

বিশ্বের সামনে আজ ড. ইউনূসের এ তত্ত্ব নতুন এক পৃথিবী গড়ার উজ্জ্বল সম্ভাবনা নিয়ে এসেছে।

‘পরিশ্রমে ধন আনে, পুণ্যে আনে সুখ, আলস্যে দরিদ্রতা আনে পাপে আনে দুঃখ’ শৈশব থেকে শুনে আসা এই খনার বচনের ‘পরিশ্রম’-ক্রিয়াটির সাথে ঝুঁকি, মেধা, ধৈর্য আর কৌশল যুক্ত হলে জীবনকে বদলে দেয়া যায়।

সত্তরের দশকের কথা। এক তরুণকে চিনতাম। নিম্নবিত্ত পরিবারে বাস করতেন। পয়সার অভাবে লেখাপড়া করতে পারেননি। স্কুল ছেড়ে সেই শৈশবে কাঠের বাক্সে করে বিড়ি বিক্রি করতেন। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের যেখান দিয়ে মদনগঞ্জ-নরসিংদী রেললাইন ক্রস করেছে সেখানে রেললাইনের পাশে বসে বিড়ি বিক্রি করা ছেলেটি ট্রেন আসতে দেখলে বাক্স মাথায় করে দূরে সরে যেতেন।

ওই সুদর্শন হাস্যোজ্জ্বল তরুণটি বর্তমানে ‘বিখ্যাত গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের’ ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি)। থাকেন রাজধানীর প্যারামাউন্ট কর্নকর্ডে। তার ব্যবসায়িক কার্যালয় মতিঝিলের সেনাকল্যাণ ভবনে। বর্তমানে তিনি স্পিনিং মিলস, প্লাস্টিক ইন্ডাস্ট্রিজ, টাইটানিক অয়েল মিলস, টাইটানিক স্টিল ইন্ডাস্ট্রিজ ও মাস্টার্ড অয়েল মিলসের মালিকানা ছাড়াও তার রয়েছে আকিজ বিড়ি ও আকিজ সিমেন্টের ডিলারশিপ। সেদিনের সে শিশুটি এলাকায় বিশিষ্ট ধনীদের একজন বলে জানা যায়।

শুধু এলাকার নয়, একজন রাস্তার টোকাই বিশ্বের সেরা ধনী হওয়ার কাহিনী লিখেছিলাম ইউরোপের চার দেশ গ্রন্থে। গ্রন্থে, ‘দেয়াশলাই বিক্রেতা থেকে বিশ্বসেরা ধনী’ শিরোনামে লেখায় আছে, ‘৪ মে ২০২২ ভ্যাক্সজো থেকে ট্রেনে মালমো আসার পথে ট্রেন ছাড়ার ঘণ্টাখানেক পর আলবেস্তা স্টেশন। আইকিয়ার প্রতিষ্ঠাতা ইঙ্গভার কামপ্রাডের জন্মস্থান আলবেস্তা। কামপ্রাডের জন্ম ১৮৯৩ সালে। মা সুইডিস। বাবা জার্মান। কামপ্রাডের যখন এক বছর বয়স তখন বাবা-মায়ের সাথে সুইডেন আসেন। তখন আরো ভয়াবহ ছিল মাঠের অবস্থা। বাঁচার জন্য কৃষিকাজ যথেষ্ট ছিল না। মানুষকে সৃজনশীল ও উদ্ভাবনী চিন্তা করতে হতো। কামপ্রাডের মা একটি গেস্টহাউজে চাকরি করতেন। বাবার ছিল কান্ট্রিস্টোর। কামপ্রাড শৈশবে দোকানে বসে থাকতেন খেলা করতেন। কামপ্রাড তার পরিবারের অভাব বুঝতে পারতেন। পরিবারকে সাহায্য করতে চাইতেন। কিভাবে সাহায্য করতে পারেন এ নিয়ে ভাবতেন। মাছ ধরার প্রতি কৌতূহলী হয়ে তার বাবাকে জাল কিনতে রাজি করান। মাছ বিক্রি করে বাবার সাথে লাভ ভাগ করে নেন। তার উপার্জন একটি সিগারেটের বাক্সে জমা রাখেন। সর্বক্ষণ চিন্তা করতেন, কম দামে কিনে কী করে গ্রাহকদের মনোযোগ আকর্ষণ করে বেশি দামে বিক্রি করা যায়; সে পথ খুঁজে বের করতেন। স্টকহোমে তার এক খালা ছিল, তার মাধ্যমে কম দামি কার্টন কিনতেন। কামপ্রাড দেয়াশলাইগুলো ছোট ছোট প্যাকেজে ভাগ করে বিক্রি করতেন। কমপ্রাড মাত্র ছয় বছর বয়সে দেশলাই বিক্রি শুরু করেন। ১০ বছর বয়সে সাইকেল করে আশপাশের এলাকা অতিক্রম করে, ক্রিসমাসের সাজসজ্জা, মাছ এবং পেন্সিল বিক্রি করেন।

কামপ্রাডের বয়স যখন ১৭ বছর তখন তার বাবা স্কুলে ভালো করায় তাকে কিছু অর্থ দিয়ে পুরস্কৃত করেন। এ অর্থ দিয়ে আইকেইএ নামে একটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান খুলেন। যা তার গ্রামসহ নিজের নামের অদ্যাক্ষর, ইন্গভার কামপ্রাড এলমট আরিড- আইকেইএ শুরুর দুই বছর পর কামপ্রাড তার পণ্য সরবরাহে দুধের ট্রাক ব্যবহার শুরু করেন। তিনি স্থানীয় নির্মাতাদের তৈরি আসবাবপত্র বিক্রি শুরু করেন। এক সময় উৎপাদনকারীরা আইকেইএ বয়কট করতে শুরু করেন- প্রতিবাদ শুরু করেন প্রতিষ্ঠানটির কম দামে মাল বিক্রির বিরুদ্ধে। এসব তাকে ঘরে আরো আইটেম ডিজাইন করতে উদ্বুদ্ধ করে। তিনি তার নিজের গুদাম থেকে ফ্ল্যাটপ্যাক আকারে ইকেয়ার পণ্য বিক্রি শুরু করেন। এভাবে আইকেইএর সাশ্রয়ী মূল্যে ডিজাইন করা ফ্ল্যাটপ্যাক আসবাবপত্রের চাহিদা হু হু করে বাড়তে থাকে। ১৯৫৬ সালে আইকেইএ ইভেন্টরি ফ্ল্যাট-বক্সযুক্ত আসবাবপত্রের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়, যা বাড়িতে একত্র করতে ডিজাইন করা হয়েছিল। ২০০০ সালে ইকেয়া ইন্টারনেট পণ্যদ্রব্য বিক্রি শুরু করে। এতেও কোম্পানিটি দ্রুত প্রসার লাভ করে। ২০০৩ সাল নাগাদ এটি এত জনপ্রিয় ছিল যে, এর ক্যাটালগটি ছিল বিশ্বের বৃহত্তম বার্ষিক মুদ্রণ। ২০০৯ সাল নাগাদ ক্যাটালগটি দুই ডজনেরও বেশি ভাষায় মুদ্রিত হয়েছিল। আইকেইএর অসাধারণ সাফল্য ২১ শতকের গোড়ার দিকে প্রতিষ্ঠানটিকে বিশ্বের অন্যতম সম্পদশালী হিসেবে পরিণত করেছে।’

‘আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলেও যারা ধনকুবের হিসেবে পরিচিত তাদের শতকরা নব্বইজন খুব সাধারণ অবস্থা থেকে উঠে এসেছেন। মার্কিন ধনকুবের অ্যান্ডু কার্নেগি তার সময়ের ধনীদের একজন। তিনি তার সময়ের সবচেয়ে বড় ধনকুবের ছিলেন। তিনি ছিলেন বস্তির ছেলে। ১২ বছর যখন তার বয়স, তখন তার পোশাক এত মলিন ও নোংরা ছিল যে, দারোয়ান তাকে পাবলিক পার্কে প্রবেশ করতে দেননি। তখন তিনি প্রতিজ্ঞা করেছিলেন যে, ‘একদিন তিনি পার্কটি কিনবে। ৩০ বছর পর তিনি তার প্রতিজ্ঞা পূরণ করেছিলেন। তিনি সে পার্কটি কিনেছিলেন।’

এই সময়ের তরুণেরা

আমার প্রথম বিদেশ ভ্রমণ মালয়েশিয়া, প্যাট্রোনাস টুইন টাওয়ার যখন বিশ্বের সর্বোচ্চ স্থাপনা তখন। ফিরে আসার সময় বিমানবন্দরে কয়েকজন বেকার বাংলাদেশী যুবকের ব্যবসার ধরন দেখে লিখেছিলাম, ‘খোঁজ নিয়ে জানা যায় এরা বাংলাদেশ থেকে এ দেশে আসা বেকার যুবক। বেকার যুবকদের অনেকে নির্দিষ্ট কোনো মালিকের অধীনে না থেকে নিজ দায়িত্বে বিমানবন্দরে কাজের রিসোর্স বের করে নিয়েছেন। আমাদের সামান্য সম্মতিতে টু-পাইস কামাতে পারতেন। বুদ্ধি আছে বাছাদের। ভাবলাম, এসব মানিকেরা দেশের কাজে লাগুন আর না লাগুন আইকিউয়ের দিক থেকে বিশ্বে এখনো টপে আছে।’

অভিন্ন অর্থ রয়েছে আন্তর্জাতিক ব্যক্তিত্ব প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের ভাষায়, ‘এ প্রজন্মের তরুণরা পৃথিবীর যেকোনো সময়ের তুলনায় সবচেয়ে বেশি শক্তিশালী প্রজন্ম। তরুণদের চাকরিপ্রার্থী না হয়ে উদ্যোক্তা হওয়ার আহ্বান জানাই।’ (থাইল্যান্ডের রাজধানী ব্যাংককে বিমসটেক ইয়ং জেনারেশন ফোরামে বক্তব্যের অংশ)। তার ‘সামাজিক ব্যবসা’ একটি বইয়ের নাম। ড. মুহাম্মদ ইউনূস ‘মাইক্রোফিন্যান্স’ বা ক্ষুদ্রঋণ বিতরণের ক্ষেত্রে তার অসামান্য অবদানের জন্য ২০০৬ সালে নোবেল শান্তি পুরস্কার পান। ক্ষুদ্র ঋণ নিয়ে তার লেখা গ্রন্থ ‘সামাজিক ব্যবসা’। বিশ্বে তোলপাড়সহ বিশিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের কারিকুলামে অন্তর্ভুক্ত হচ্ছে তার এই সামাজিক ব্যবসা।

গ্রন্থের ভূমিকার শেষে প্রকাশক বলেন, প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূসের নতুন এ অর্থনৈতিক তত্ত¡ আজ বিশ্বের নানা দেশে ব্যাপক আলোচনার জন্ম দিয়েছে। বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দেশে নানা ধরনের সামাজিক ব্যবসা ইতোমধ্যে শুরুও হয়ে গেছে। বিশ্বের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি ও ব্যবসা বিদ্যার কারিকুলামে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে সামাজিক ব্যবসা। কয়েকটি দেশের সরকার তাদের উদ্যোগে সামাজিক ব্যবসাবিষয়ক গবেষণা ইনস্টিটিউটও প্রতিষ্ঠা করেছেন। বিশ্বের সামনে আজ ড. ইউনূসের এ তত্ত¡ নতুন এক পৃথিবী গড়ার উজ্জ্বল সম্ভাবনা নিয়ে এসেছে।

লেখক : আইনজীবী ও কথাসাহিত্যিক