ঈদ ছুটি এবং অন্যান্য প্রসঙ্গ

করোনা ও ডেঙ্গুর ক্ষেত্রে প্রচার মিডিয়াগুলোর বাধ্যতামূলকভাবে জনসচেতনতা বৃদ্ধির অনুষ্ঠানমালা প্রচারের ব্যবস্থা করা দরকার। বিভিন্ন স্কুল-কলেজ, মাদরাসায় এ দুটো রোগের সচেতনতার ব্যাপারে ব্যাপক কর্মসূচি নেয়া দরকার।

আলহামদুলিল্লাহ। এবারের ঈদের ছুটির ঈদ আনন্দ নিরাপত্তাবেষ্টিত হওয়ায় সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে অশেষ ধন্যবাদ। প্রথমত, ঈদের দীর্ঘ ছুটিতে জনহীন ঢাকা শহরের উল্লেখযোগ্য তেমন কোনো দুর্ঘটনা অন্যান্যবারের মতো এবার ঘটেনি। প্রতিবারই যারা ছুটিতে গ্রামের বাড়িতে যেতেন তাদের ছুটির অর্ধেক আনন্দই মাটি হয়ে যেত দুশ্চিন্তায় আর ভয়ে। ঢাকার বাড়িতে যা রেখে গেছেন ফিরে গিয়ে আবার তা ঠিকমতো পাবেন কি না এই দুশ্চিন্তা সারাক্ষণ তাড়া করে বেড়াত। এ দিক থেকে এবারের ঈদের ছুটি অনেকটাই ছিল ঘটনাহীন। দ্বিতীয় লক্ষণীয় বিষয় ছিল কোরবানির পশু সরবরাহ। বরাবরই এ পশু প্রতিবেশী দেশ থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে সীমান্ত পেরিয়ে হাজির হতো পশুর হাটে। ঈদ ঘিরে বিশাল অর্থনীতির বেশির ভাগ চলে যেত সীমান্ত পাড়ি দিয়ে। দেশের খামারিরা অসহায়ভাবে তাদের কষ্টে পালন করা কোরবানির পশু লোকসান দিয়ে বিক্রি করে চোখের পানিতে ভিজতে ভিজতে ফিরে যাওয়ার ঘটনা ঘটেনি এবার। আরো একটি বিশেষত্ব এবারের ঈদ বাজারে লক্ষ করা গেছে। তা হচ্ছে ৩০-৪০ লাখ টাকায় কোরবানির পশু কেনার ঘটনা নেই বললেই চলে। ছিল না ছাগলকাণ্ডের মতো কোনো ঘটনা। শুধু তাই নয়- উদ্বৃত্ত থেকেছে প্রায় ২০ লাখেরও বেশি কোরবানির পশু, যা প্রমাণ করেছে বাইরের আমদানি নয়, আমরা নিজেরাই এ ব্যাপারে স্বয়ংসম্পূর্ণ।

এবারের নির্বিঘ্ন ঈদ পরিবেশে একটি বিষয় ছিল যা সহজে সবার চোখে পড়েনি। সরকার পশুর চামড়ার দাম বেঁধে দেয়া মূল্যে চামড়া বিক্রয় হয়নি বলে অভিযোগ রয়েছে। একই সাথে বিভিন্ন এতিমখানাও কোনো এক অজানা কারণে এগিয়ে আসেনি চামড়া সংগ্রহে। লবণযুক্ত ও লবণমুক্ত চামড়া আশানুরূপভাবে বিক্রি না হওয়ার পেছনে সিন্ডিকেট কতটুকু সক্রিয় ছিল তা বের করা দরকার। নইলে চামড়াশিল্পের সামনে অশনি সঙ্কেত রয়েই যাবে। এবারের ঈদ আনন্দকে ছাপিয়ে বিষাদের করুণ আবহও কিন্তু কম ছিল না। কমতি ছিল না ঈদযাত্রার দুর্ঘটনা। ক্ষেত্রবিশেষে আট ঘণ্টার যাত্রা ১৮-২০ ঘণ্টায় গিয়ে ঠেকেছে। বিশেষ করে উত্তরবঙ্গের গাড়িগুলোর। এতে সবচেয়ে বেশি ভোগান্তির শিকার হয়েছে মহিলা, শিশু ও বয়স্ক যাত্রীরা। নিবন্ধন ও নিবন্ধনহীন গাড়ির চাপ ছিল যাত্রাপথে। বহু বছর থেকেই আশার বাণী শোনা যাচ্ছেÑ যাত্রী বিড়ম্বনা থাকবে না, যানজট থাকবে না, থাকবে না নিবন্ধনহীন ও রাস্তায় চলাচলের উপযুক্ত নয় এমন সব গাড়ি। অথচ কোনো এক অদৃশ্য শক্তির জাদুবলে এই গাড়িগুলো রাস্তা দাপিয়ে বেড়িয়েছে। ফলে পথযন্ত্রণার সাথে মৃত্যুযন্ত্রণাও ছিল বেশুমার। সরকারি হিসাবে এবারের ঈদযাত্রায় সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে ৩৭৯টি, মৃত্যু হয়েছে ৩৯৯ জনের, আহত হয়েছেন এক হাজার ১৮২ জন। এ হিসাব কেবল ১৫ জুন পর্যন্ত। রাস্তার কাজের দীর্ঘসূত্রতা, ফিটনেসবিহীন যন্ত্রদানবের দৌরাত্ম্য; সর্বোপরি রাস্তা ও যানবাহন নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে সমন্বয়হীনতার জন্য ঘটেছে দুর্ঘটনাগুলো। লক্ষণীয়, দুর্ঘটনার হার নিয়মিতই বাড়ছে। বিশেষ করে প্রতি বছর ঈদ ছুটিকে কেন্দ্র করে দুর্ঘটনার হার বাড়ছে। সম্প্রতি যাত্রী কল্যাণ সমিতির এক প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে, সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর ৪২ শতাংশই মোটরসাইকেল দুর্ঘটনার শিকার। বিভিন্ন মডেল, বিভিন্ন গতিসম্পন্ন মোটরসাইকেল এ ক্ষেত্রে জড়িত কি না তা-ও দেখা দরকার। ১০০ সিসি এবং ১২০ সিসি শক্তিসম্পন্ন মোটরসাইকেল আমদানি বা তৈরির ব্যবস্থা করলে এ দুর্ঘটনা খানিকটা হলেও কমবে, আশা করা যায়। সে ক্ষেত্রে রাস্তায় গতির প্রতিযোগিতার একটি ভারসাম্য বজায় থাকার সম্ভাবনা আছে । চীন, ভিয়েতনাম ও পাকিস্তানে এ ধরনের ব্যবস্থা রয়েছে। মোটরসাইকেল বিক্রয়ের সময় গাড়ি চালানোর দক্ষতা-বিষয়ক পরিচয়পত্র দেখানো বাধ্যতামূলক করা- হেলমেটবিহীন মোটরসাইকেল আরোহীর ক্ষেত্রে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ এ ক্ষেত্রে সহায়ক ভূমিকা পালন করতে পারে।

ঈদ আনন্দ ও ঈদের ছুটিতে এবার উঁকি মেরেছে করোনা; আরো সংহারি রূপে। এ ব্যাপারে সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগ জোরালোভাবে দেখা যাচ্ছে না। একই ঘটনা ঘটছে ডেঙ্গুর ক্ষেত্রেও। নতুনভাবে দাপট দেখাচ্ছে ডেঙ্গু। করোনা ও ডেঙ্গুর ক্ষেত্রে প্রচার মিডিয়াগুলোর বাধ্যতামূলকভাবে জনসচেতনতা বৃদ্ধির অনুষ্ঠানমালা প্রচারের ব্যবস্থা করা দরকার। বিভিন্ন স্কুল-কলেজ, মাদরাসায় এ দুটো রোগের সচেতনতার ব্যাপারে ব্যাপক কর্মসূচি নেয়া দরকার। নইলে আবারো মারাত্মকভাবে আবির্ভূত হয়ে এ রোগ দুটো জীবনযাত্রাকে স্তব্ধ করে দিতে পারে। আঘাত হানতে পারে জাতীয় অর্থনীতির ধারায়।

লেখক : চক্ষুরোগ বিশেষজ্ঞ
[email protected]