‘আমি অনেক মানুষ দেখেছি যাদের শরীরে কোনো পোশাক নেই, আমি অনেক পোশাক দেখেছি যেগুলোর ভেতরে কোনো মানুষ নেই।’ মাওলানা জালাল উদ্দীন রুমির তীক্ষè পর্যবেক্ষণে মানুষের মধ্যে আত্মবিকাশের শক্তি তথা মনুষ্যত্বের অনুসন্ধানের ফল যেভাবে উৎকলিত হয়েছে তাতে তার মানবতার দর্শন ফুটে ওঠে। এই মানুষের মধ্যে সেই মানুষের খোঁজে যখন হয়রান হতে হয়, অন্তর্ভেদি বেদনার অবয়বে তখন বেজে ওঠে রবীন্দ্রনাথের নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গের বাণী ও সুর। জাতীয় কবি কাজী নজরুলের আত্মিক সাধনায় নিমগ্ন (খোদার প্রেমের শরাব পিয়ে বেহুঁশ হয়ে রই পড়ে) না হলে যেমন নিজেকে চেনা যায় না- আকুতি জাগে না আত্মিক উন্নয়নের, তেমনি মানুষের মধ্যে ‘মানুষ’ না থাকলে পোশাকি মানুষের স্বরূপ উন্মোচিত হয় না- স্বরূপের মাঝে অপরূপের সন্ধান মেলে না। টি এস এলিয়টের ‘রাইম অব দ্য এনশিয়েন্ট মেরিনার’-এর মধ্যেও আত্মসমালোচনা ও শাস্তি ভোগের (কুলক্ষণ মনে করে নিরপরাধ আলবাট্রস পাখিকে হত্যার পর অথৈ সাগরের লক্ষ কোটি বারি বিন্দুর মধ্যে পান করার মতো এক ফোঁটা পানি না পাওয়া) মধ্যে, নিরস্ত্র রাজা ডানকানকে ঘুমের মধ্যে তার নিরাপত্তা বিধায়ক স্বয়ং সেনাপ্রধান ম্যাকবেথ তার স্ত্রীর প্ররোচনায় হত্যার পর ম্যাকবেথ দম্পতি যেমন আজীবন আর ঘুমাতে পারেনি (ম্যাকবেথ হ্যাজ কিলড দ্য স্লিপ সো হি উইল নট স্লিপ এনি মোর) এ মর্ম যাতনার অনুভবের আয়নায় মনুষ্যত্বের জয়-পরাজয়ের প্রতিচ্ছবি প্রতিফলিত হয়। সহস্রজনকে কাঁদিয়ে গঙ্গা কেন বইয়ে চলছে, লক্ষ কোটি ভারতবাসীকে সে কেন জাগিয়ে তোলে না এ প্রশ্ন তো আত্মবিকাশের আকিঞ্চন আকাক্সক্ষার প্রতিধ্বনি।
‘সবার উপর মানুষ সত্য তাহার উপরে নাই’ সেই মানুষ তার সত্য প্রতিষ্ঠার প্রয়াসে পেছাচ্ছে বা এগোচ্ছে- তা তার কর্মযজ্ঞ যোজনার মধ্যে প্রকাশ পায়। ‘মোমবাতি হওয়া সহজ কাজ নয়, আলো দেয়ার জন্য প্রথমে নিজেকেই পুড়তে হয়’ মাওলানা রুমির এ পর্যবেক্ষণে মানুষের মধ্যে মানবতাবোধ জাগানোর জন্য আত্মবিশ্লেষণ ও বিচারের সাধনায় নিবেদিত হওয়ার শিক্ষা রয়েছে। ‘যদি তুমি চাঁদের প্রত্যাশা করো, তবে রাত থেকে লুকিয়ো না, যদি তুমি একটি গোলাপ আশা করো, তবে তার কাঁটা থেকে পালিয়ো না, যদি তুমি প্রেমের প্রত্যাশা করো, তবে আপন সত্তা থেকে হারিও না।’ এ উপদেশ বাণীর মধ্যে নিহিত রয়েছে সাবধান সতর্কতার প্রলেপ, সব কিছু জেনে ফেলাই জ্ঞান নয়, জ্ঞান হলো কী কী এড়িয়ে যেতে হবে বা বর্জন করতে হবে তা জানা।’
মাওলানা রুমি মনুষ্যত্ব বোধের উদ্বোধন প্রত্যাশা করে বলেছিলেন, ‘সুন্দর ও উত্তম দিন তোমার কাছে আসবে না; বরং তোমার এমন দিনের দিকে অগ্রসর হওয়া উচিত।’ সদ্য শহীদ শরিফ ওসমান হাদি (১৯৯৩-২০২৫) আত্মিক অনুসন্ধানের মাধ্যমে মানুষকে মনুষ্যত্ব বিকাশের সাধনায় আহ্বান জানাতে গিয়ে আত্মোৎসর্গ করেছেন। তার আত্মবিশ্বাস জাগিয়ে তুলতে যেমন ছিল মাওলানা রুমির সেই উক্তি- ‘তোমার জন্ম হয়েছে পাখা নিয়ে, উড়ার ক্ষমতা তোমার আছে। তারপরও খোঁড়া হয়ে আছো কেন। তোমার হৃদয়ে যদি আলো থাকে, তাহলে ঘরে ফেরার পথ তুমি অবশ্যই খুঁজে পাবে।’ কিংবা ‘গতকাল আমি বুদ্ধিমান ছিলাম, তাই পৃথিবীকে বদলে দিতে চেয়েছিলাম। কিন্তু আজ আমি জ্ঞানী, তাই নিজেকে বদলে ফেলতে চাই।’ রুমি একাধারে বলে চলেছেন, ‘তুমি সাগরে এক বিন্দু পানি নও। তুমি এক বিন্দু পানিতে গোটা এক সাগর।’ নিজের দিকে নিজে তাকানোর, আল্লামা ইকবালের ‘আপকা দুনইয়া আপ পয়দা করো’-এর মধ্যেও খুঁজে পাই ওসমান হাদির প্রেরণা, ‘অন্যের জীবনের গল্প শুনে সন্তুষ্ট হয়ো না, নিজের পথ তৈরি করো, নিজের জীবন সাজাও। আকাশ কেবল হৃদয় দিয়েই ছোঁয়া যায়। নতুন কিছু তৈরি করো, নতুন কিছু বলো, তাহলে পৃথিবীটা হবে নতুন। যে বাতাস গাছ উপড়ে ফেলে, সে বাতাসেই ঘাসেরা দোলে, বড় হওয়ার দম্ভ কখনো করো না।’
একটি মহাশক্তি প্রত্যেক জিনিসকে ঊর্ধ্বে টেনে তুলছে। খনি জগতের পাথর নিজ সত্তা বিলিয়ে দিয়ে মাটিতে পরিণত হচ্ছে। মাটিতে ধানের বীজ বা অন্য যেকোনো উদ্ভিদের বীজ রোপণ করলে তা মাটি ও খনি থেকে রস আহরণ করছে। খনি, পানি, মাটি ও বীজ নিজ আকার পরিবর্তন করে ধান, সবজি বা ফলমূলে পরিণত হচ্ছে। এগুলো মানুষ খাচ্ছে এবং ফলে তার মধ্যে রক্ত ও বীর্য উৎপন্ন হচ্ছে। যতবার ওই জিনিসগুলোর আকার বিবর্তিত হচ্ছে, ততবার তারা উচ্চতর শ্রেণীতে উন্নীত হচ্ছে। মানুষ যখন মরবে সেও অনুরূপভাবে উন্নীত হবে।
ওসমান হাদি আসন্ন ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ঢাকা-৮ আসনের স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছিলেন। ইচ্ছে ছিল, সংসদে গিয়ে ইনসাফের জন্য লড়বেন। সেই স্বপ্ন পূরণ হলো না ওসমান হাদির। তবে তিনি সংসদ ভবনে গেছেন ঠিকই, সেখানে হয়েছে জানাজার নামাজ। যে সংসদ প্রাঙ্গণে যাওয়ার জন্য লড়াই করছিলেন হাদি, তিনি গেলেনও সেখানে। বীরের বেশে, লাখো মানুষের সাথে, কোটি মানুষের দোয়া আর ভালোবাসায় সিক্ত হয়ে। বিদায় বেলায় এত ভালোবাসা সবার কপালে জোটে না। আল্লাহ তাকে সৌভাগ্যবান করে দুনিয়ায় পাঠিয়েছিলেন।
বর্তমান সময় ও সমাজে সর্বত্র জড়বাদের জয়জয়কার। সর্বত্র এর পরিব্যাপ্ত। দেশসেবা, সমাজসেবা, সংসার ও অন্যের সেবার মূলে এখন নানাবিধ স্বার্থ নিহিত। প্রযুক্তি প্রসারের সুবাদে বৈশ্বিক ও মুক্ত অর্থনীতির আঙিনায় পুঁজিবাদের পৃষ্ঠপোষকতায় দৈহিক উপভোগ যেন মানবের চরম ও পরম লক্ষ্যে পরিণত হয়েছে। অথচ বাংলাদেশের মতো একটি উন্নয়নকামী কল্যাণ অর্থনীতিতে সব পক্ষকে নিজ নিজ অবস্থানে থেকে নিজ নিজ দায়িত্ব পালন এবং সব প্রয়াস প্রচেষ্টায় সমন্বয়ের মাধ্যমে সার্বিক উদ্দেশ্য অর্জনের অভিপ্রায়ে অয়োময় প্রত্যয়দীপ্ত হওয়ার পরিবেশ সৃষ্টির আবশ্যকতা অনস্বীকার্য। বিশেষ করে জুলাই অভ্যুত্থানের পর অত্যাসন্ন জাতীয় নির্বাচনের প্রাক্কালে দেশ ও অর্থনীতিকে পরনির্ভরশীলতার পরিবর্তে আত্মনির্ভরশীল হওয়ার অনিবার্যতা দেখা দিচ্ছে।
বাংলাদেশের সরকার ও জনগণ যখন জাতিগত আত্মমর্যাদা রক্ষার প্রশ্নে অসান্ন নির্বাচন নিয়ে গোটা দেশবাসীকে ঐকমত্যের ভাববন্ধনে আবদ্ধ করতে চাইছে, বাংলাদেশের মতো উন্নয়ন সম্ভাবনা সমৃদ্ধ সমাজে অনুরূপ চিন্তাচেতনার বিকাশ ও প্রয়াস প্রচেষ্টার পরিবেশ আজ কোন পর্যায়ে? ওসমান হাদির শহীদ হওয়ার ঘটনায় শোষণ বঞ্চনা ও বণ্টন বৈষম্যের ঔপনিবেশিক শাসনের জাঁতাকল থেকে ‘মুক্তির সংগ্রামে’ বিজয়লাভের এ পর্যায়ে এই প্রশ্ন, এ বিবেচনা অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক প্রতীয়মান হয়।
চিন্তা থেকে কাজের উৎপত্তি। যেমন ভাবনা তেমনি তার বাস্তবায়ন। মনের মধ্যে বাস করে এক কর্মবিধায়ক, তার আবাস অবগাহনের সুতায় গাঁথা আরেক সূত্রে। ভাববাদীরা যাকে বলেন- আদিবাস তার আরশে মহল্লায়, সেখানে সে থাকে প্রভু নিরঞ্জনের নিরন্তর তত্ত¡াবধানে। আর এ দিকে তার ছায়া ‘(মানবদেহের) খাঁচার ভেতর অচিন পাখি’ হয়ে বারবার আসা-যাওয়া করে- তার পায়ে বেড়ি দেয়ার প্রয়াস চললেও তাকে বাঁধা যায় না। কেন না, তার মূল সুখ বাঁধা আছে আরশে মহল্লায়। তার প্রতিফলন ঘটে, আট কুঠুরি নয় দরজার মধ্যে, অচিন পাখিটির পিঞ্জিরায়। মুরলী বাঁশির সুর শুনে সে শুধু লাফায়। নিত্য যোগাযোগ তার সাথে; কিন্তু সে যোগাযোগের অবকাঠামো অনুধাবনে সবার সম্মিত সমান যায় না। আয়নায় মরিচা ধরলে প্রতিফলন পরিস্ফুট হয় না- আয়না পরিষ্কার থাকা চাই- রাখা চাই। ওসমান হাদি তার আয়না পরিষ্কার রাখতে তৎপর ছিলেন। আর দশজনের চেয়ে তার যোগাযোগের জ্যোতি ও গতিমাত্রা অনেক বেশি। শরিফ ওসমান হাদি এখন একজন ব্যক্তির নাম নয়, এটি একটি আদর্শের নাম। এই আদর্শ প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে ছড়িয়ে পড়বে এবং কোনো হত্যাকাণ্ড দিয়ে একে থামিয়ে দেয়া যাবে না। এ হত্যাকাণ্ড কোনো সাধারণ অপরাধ নয়। এটি ন্যায়, স্বাধীনতা ও আত্মমর্যাদার পক্ষে দাঁড়ানো একটি কণ্ঠকে স্তব্ধ করার চেষ্টা। হাদি হত্যার ঘটনায় দেশবাসীর মধ্যে যে ক্ষোভ ও শোক তৈরি হয়েছে, সেটিকে সব ক্ষেত্রে সুশাসন ও ন্যায়বিচার চাওয়া-পাওয়ার সুযোগ তৈরি হয়েছে।
লেখক : সাবেক সচিব, এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান



