মুলতানের পাশের অঞ্চল বুসেন আম ও মাল্টার বাগানের জন্য বিখ্যাত। মুলতান শহর থেকে বুসেনের দিকে গেলে স্পষ্ট নজরে পড়ে, একের পর এক বাগান কেটে কেটে সেখানে হাউজিং স্কিম ও মার্কেট বানানো হচ্ছে। এ রাস্তার ওপর বাহাউদ্দিন জাকারিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ও রয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কিছুটা এগিয়ে একটি রাস্তা বামে মোড় নিয়েছে। এ ভাঙাচোরা রাস্তা আম ও মাল্টার অবশিষ্ট বাগানের মাঝখান দিয়ে চেনাব নদীর কিনার ধরে কিছু দূরে খাজাপুর পর্যন্ত পৌঁছেছে। বহু বছর আগে সায়্যিদ ইউসুফ রাজা গিলানি এ এলাকা থেকে নির্বাচিত হয়ে জাতীয় অ্যাসেম্বলির স্পিকার হলে তিনি এখানে শুধু পাকা রাস্তা বানিয়ে দেননি; বরং এ এলাকায় বিদ্যুৎ ও গ্যাসের লাইনেরও ব্যবস্থা করেন।
এই এলাকার লোকেরা জিয়ো নিউজের কর্মী জাওদাত নাদিমের মাধ্যমে আমার সাথে যোগাযোগ করেন। তিনি বলেন, খাজাপুর বন্যার পানিতে ডুবে গেছে। বুসেনের অন্য এলাকাগুলোতে পানি দ্রুত গতিতে বাড়ছে। আমি ঝাঙ্গের বন্যাকবলিত এলাকা অতিক্রম করে মুলতান পৌঁছলাম। যা শুধু চেনাব নয়; বরং শতলুজ (শতদ্রু) নদী ও রাভীর উত্তাল ঢেউয়েরও মুখোমুখি হয়েছিল। আমাদের ডাবল কেবিন গাড়ি যে রাস্তায় আছাড় খেতে খেতে খাজাপুর স্থানের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল, সে রাস্তাটি খোখার এলাকার কাছে পানিতে ডুবে ছিল। হঠাৎ আমাদের গাড়ি থেমে গেল। গাড়ি পেছনে ঘোরানো বেশ কঠিন ছিল। কেননা ডান দিকে খাজাপুর বন্যার পানিতে ডুবে ছিল এবং বাম দিকে খোখার এলাকার বিধ্বস্ত বাড়িঘর ছিল, যেগুলো পেছনে থাকা একটি বাগানের দিক থেকে আসা পানি ঘিরে নিয়েছিল। এখানকার লোকদের অধিকাংশ বুসেনে স্থাপিত ত্রাণশিবিরে আশ্রয় নিয়েছেন। তবে একটু দূরে একটি বরই বৃক্ষের তলায় কিছু মহিলা ও শিশু বসা অবস্থায় নজরে পড়ল।
আমি কোনো আলেম বা পরিবেশ বিশেষজ্ঞ নই। আমি একাধিকবার বন্যা ও ভূমিকম্পে এটি দেখেছি যে, গাছ মৌসুমি বিপদাপদে প্রতিরক্ষার ভূমিকা নিয়ে থাকে। তাই গাছ কেটে আমরা নিজেরা নিজেদের ধ্বংস ডেকে আনছি। আমি বুনের জেলার বিশনুয়ি গ্রাম থেকে নিয়ে মুলতানের খাজাপুর মৌজা পর্যন্ত এটি দেখলাম, যেখানে গাছ কাটা হয়েছে, সেখানে কখনো না কখনো মানুষের লালসার শাস্তি অবশ্যই আসমানি গজব আকারে নাজিল হয়। যে পেয়ারা নবী সা: যুদ্ধাবস্থাতেও আমাদের গাছ কাটতে নিষেধ করেছেন, সেই নবী সা:-এর অনুসারীরা বন-জঙ্গল কেটে সেখানে ঘরবাড়ি বানালে তাদের ঘরবাড়ির পরিণতি সেটিই হবে, যা খাজাপুরের হয়েছে। খাজাপুরের পরিণতি থেকে বাঁচতে আমাদের গাছ কাটার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে হবে।
দেখতে পাচ্ছিলাম, যেখানে যেখানে বড় ও শক্ত গাছ বিদ্যমান ছিল, সেখানে ভূমি বন্যার পানির বিরুদ্ধে বিক্ষোভ করছিল। যেখানে গাছ ছিল না, সেখানে ভূমি ভেঙে ভেঙে টুকরো হয়ে পানিতে পড়ছিল। চেনাব নদীর পানি তীরের বাইরে এসে ভূমি গ্রাস করছিল। আমি যে রাস্তায় দাঁড়িয়ে ছিলাম, সে রাস্তা দ্রুত গতিতে পানির নিচে চলে যাচ্ছিল এবং আমাকে বারবার সরে যেতে হচ্ছিল। কিছু স্থানীয় ব্যক্তি তাদের ঘরে পড়ে থাকা আসবাবপত্র পাহারা দিতে সেখানে উপস্থিত ছিলেন। তারা বললেন, খাজাপুর মৌজার বিশাল অংশ মসজিদসহ পানিতে ডুবে গেছে। একটি ডুবে থাকা এলাকার অবশিষ্ট অংশে দাঁড়িয়ে কারো কাছে তার বিধ্বস্ত হওয়ার কাহিনী শোনা বড় কষ্টদায়ক অভিজ্ঞতা।
আমি একজন স্থানীয় ব্যক্তি গাজানফারের কাছে জানতে চাইলাম, খাজাপুর ও চেনাব নদীর মাঝখানে বাগান ছিল কি? জবাবে তিনি বললেন, জী অবশ্যই বাগান ছিল। কিন্তু সেটি নদীভাঙনের শিকার হয়েছে। পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা একজন প্রবীণ ব্যক্তি বললেন, এ এলাকা তো পাকিস্তান হওয়ার আগেও ছিল। কিন্তু নদীর তীরে যখন জঙ্গল কাটা শুরু হলো, তখন আমাদের বাগান পর্যন্ত বন্যার পানির আসা শুরু হয়ে গেল। এ পানি কিছু দিন পর চলে যেতে শুরু করত। যখন আমরা বাগান কাটা শুরু করলাম, তখন নদীর পানি মাটি ভাঙা শুরু করে দিলো। অন্য কয়েকজন ওই প্রবীণ ব্যক্তিকে চুপ করিয়ে দিলেন। এখানে একটি নৌকা দেখতে পেলাম, যা স্থানীয় কোনো এক মাল্লার। নৌকাটিতে বসে ওই নারী-শিশুদের কাছে গেলাম, যারা একটি বরই বৃক্ষের তলে বসে ছিলেন। আমাকে দেখে মেয়েরা তাদের ঘরে চলে গেলেন। দু’জন পুরুষ ওখানে বসে ছিলেন। তাদের জিজ্ঞাসা করলাম, ‘পানি আপনাদের দিকে এগিয়ে আসছে। আপনারা এ এলাকা ত্যাগ করছেন না কেন? তারা একটি গাছের সাথে বাঁধা নৌকার দিকে ইশারা করে বললেন, আমরা কিছুক্ষণের মধ্যে এ নৌকায় চড়ে চলে যাবো। কাছেই কিছু গবাদিপশু বাঁধা ছিল। আমি বুঝলাম, এ লোকগুলো তাদের গবাদিপশু ছাড়া যেতে চাচ্ছেন না। তাদের ঘরবাড়ি ছিল যথেষ্ট উঁচু স্থানে। ঘরবাড়িগুলোর আশপাশে বেশ বড় বড় গাছ চোখে পড়ল। গাছগুলোর শিকড় ভাঙনের হাত থেকে ভূমি আটকে রেখেছিল। তবে উচ্চতা বৃদ্ধি পাওয়া পানির পৃষ্ঠ শঙ্কা বাড়াচ্ছে।
আমার সাথে এখানে আসা ক্যামেরাম্যান ইমরান আলেকজান্ডার সতর্ক করে দিয়ে বললেন, পানি অতি দ্রুত মাটি গ্রাস করছে। আমাদের নৌকায় ফিরে যাওয়া উচিত। আমি নৌকায় চড়ে খাজাপুর মৌজার সেই ভাঙাচোরা রাস্তায় গিয়ে পৌঁছলাম, যা এখন চেনাব নদীর একটি তীরে পরিণত হয়েছে। এখন আমরা বন্যার কভারেজ করা ভুলে গেলাম; বরং জীবন বাঁচাতে অকুস্থল থেকে রীতিমতো পালিয়ে এলাম। যে রাস্তা দিয়ে আমাদের গাড়ি পালাচ্ছিল, জায়গায় জায়গায় সেটি পানিতে ডুবে ছিল। বিভিন্ন পথ দিয়ে বুসেন বাঁধের দিকে পানি বেড়ে চলছিল। এটি বলা ভুল হবে না যে, বন্যার পানি ও আমাদের গাড়ির মধ্যে একটি প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে গেল।
বুসেন বাঁধে পৌঁছে আমি গাড়ি থেকে বের হলাম। পেছনে ঘুরে তাকাতে দেখলাম, আমের মনোরম বাগান, ভুট্টা ও কার্পাস তুলার আন্দোলিত ক্ষেতগুলো সব নদীতে বিলীন হয়ে যাচ্ছে। এখন আমার ওই পরিবারের কথা মনে পড়ল, যারা খোখার এলাকা থেকে কিছু দূরে বরইয়ের একটি গাছের তলায় বসে ছিল এবং পরিবারের পুরুষদের নিজেদের নৌকার ওপর বড় ভরসা ছিল। আমার হজরত নূহ আ:-এর নৌকার কথা মনে পড়ল। বন্যাকবলিত এলাকায় নৌকা একটি বেশ বড় নেয়ামত। আমি বড় গুনাহগার বান্দা। তবে আজ হাত জোড় করে বেশ বিনয়ের সাথে এ কলামের পাঠকের কাছে আবেদন করছি, যদি আপনি এখন পর্যন্ত আপনার ঘরে নিরাপদে থাকেন এবং বন্যার করালগ্রাসের নিশানা না হন, তবে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করুন। তবে আপনি যদি আপনার আমল ঠিক না করে থাকেন, তাহলে আল্লাহ না করুন, আপনারও আগামী বছর এ মৌসুমে নৌকার প্রয়োজন পড়তে পারে। বহু মানুষ এ বন্যাকে আল্লাহর আজাব বলে অভিহিত করছেন। কুরআন মাজিদের সূরা আর-রাদে বলা হয়েছে- ‘নিঃসন্দেহে আল্লাহ কোনো জাতির অবস্থা ততক্ষণ পরিবর্তন করেন না, যতক্ষণ সে জাতি নিজেরা নিজেদের অবস্থা পরিবর্তন না করে।’
আফসোস, যখনই জাতির অবস্থা পরিবর্তনের কথা হয়, তখনই যে কারো প্রেসিডেন্ট ব্যবস্থার কথা মনে পড়ে যায়। কেউ ১৮তম সংশোধনীর ত্রুটি অন্বেষণ করতে শুরু করে দেন, কেউ তার চেয়ার বাঁচাতে হঠাৎ কোনো বিতর্কিত ড্যামের সমর্থন শুরু করে দেন, কেউ বা চেয়ার রক্ষায় ওই ড্যামের বিরোধিতা শুরু করে দেন। আজ আপনাদের নিজেদের অবস্থা পরিবর্তন করতে হলে পুরো জাতি এক হয়ে শুধু একটি কাজ করতে হবে। কাজটি হচ্ছে, চতুর্দিকে গাছ লাগানো এবং ক্ষেতখামারে হাউজিং স্কিম বানানোর ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করুন। আল্লাহ তায়ালা সূরা আল-বাকারাতে ক্ষেতখামার ধ্বংসকারীদের নিন্দা করেছেন।
আমি কোনো আলেম বা পরিবেশ বিশেষজ্ঞ নই। আমি একাধিকবার বন্যা ও ভূমিকম্পে এটি দেখেছি যে, গাছ মৌসুমি বিপদাপদে প্রতিরক্ষার ভূমিকা নিয়ে থাকে। তাই গাছ কেটে আমরা নিজেরা নিজেদের ধ্বংস ডেকে আনছি। আমি বুনের জেলার বিশনুয়ি গ্রাম থেকে নিয়ে মুলতানের খাজাপুর মৌজা পর্যন্ত এটি দেখলাম, যেখানে গাছ কাটা হয়েছে, সেখানে কখনো না কখনো মানুষের লালসার শাস্তি অবশ্যই আসমানি গজব আকারে নাজিল হয়। যে পেয়ারা নবী সা: যুদ্ধাবস্থাতেও আমাদের গাছ কাটতে নিষেধ করেছেন, সেই নবী সা:-এর অনুসারীরা বন-জঙ্গল কেটে সেখানে ঘরবাড়ি বানালে তাদের ঘরবাড়ির পরিণতি সেটিই হবে, যা খাজাপুরের হয়েছে। খাজাপুরের পরিণতি থেকে বাঁচতে আমাদের গাছ কাটার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে হবে।
লেখক : পাকিস্তানের প্রখ্যাত সাংবাদিক ও কলামিস্ট
পাকিস্তানের জাতীয় পত্রিকা দৈনিক জং, ৪ সেপ্টেম্বর, ২০২৫-এর উর্দু থেকে ভাষান্তর
ইমতিয়াজ বিন মাহতাব
[email protected]