ইনকিলাব জিন্দাবাদ

শহীদ ওসমান হাদির বপন করা বীজ ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে সাহস ও ঐক্যের প্রতীক হয়ে পথ দেখাবে। বিপ্লবীকে হত্যা করা যায়; কিন্তু বিপ্লবের চেতনা হত্যা করা যায় না।

ইনকিলাব (বিপ্লব) অনেকসময় হঠাৎ করেই আবির্ভূত হয় এবং তা সমাজে গভীর ও সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলে। কিছু বিপ্লব অল্প সময়ের মধ্যেই তাদের লক্ষ্য পূরণ করে, আবার কিছু বিপ্লব দীর্ঘ সময় ধরে নানা ধাপ অতিক্রম করে তাদের মিশন সম্পন্ন করে। যখন একটি সমাজ দীর্ঘ দিন ধরে অবিচার ও বৈষম্যের শিকার হয় এবং মুক্তির কোনো দিশা খুঁজে পায় না, তখন বিপ্লব অনিবার্য হয়ে ওঠে। ফরাসি বিপ্লব তার উজ্জ্বল উদাহরণ- যা দীর্ঘ সময় ধরে বিভিন্ন পর্যায় অতিক্রম করে পরিপূর্ণতা লাভ করে। রুশ বিপ্লব তুলনামূলকভাবে স্বল্প সময়েই সফল হয়েছিল। অন্য দিকে ইরানি বিপ্লব এখনো সম্পূর্ণভাবে ইরানি সমাজে তার আত্মা স্থিত করতে পারেনি।

১৯৭১ সালের বাংলাদেশের বিপ্লব একটি নতুন রাষ্ট্রের জন্ম দিলেও জনগণের আকাক্সক্ষা পূরণে ব্যর্থ হয়। এরপর ৭ নভেম্বর ১৯৭৫ সালের সিপাহি-জনতার বিপ্লব জাতিকে উপহার দেয় এক অসাধারণ নেতাকে, যিনি নানা সংস্কারমূলক কর্মসূচির মাধ্যমে আধুনিক বাংলাদেশের ভিত্তি স্থাপন করেন এবং সমসাময়িক ইতিহাসের অংশ হয়ে ওঠেন। তিনি শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান। তিনিই সমাজে ইসলামী ও গণতান্ত্রিক চেতনার সূচনা করেন। তিনি চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করেন এবং বাংলাদেশকে ভারতীয় আধিপত্যবাদের কবল থেকে মুক্ত করার সর্বোচ্চ চেষ্টা করেন; কিন্তু ভারতের স্থানীয় সামরিক এজেন্টদের হাতে তিনি নিহত হন। তাকে হত্যা করা হলেও তার রাজনৈতিক আদর্শ ধ্বংস করা যায়নি; বরং তা দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব ও জাতীয় সংহতি আরো মজবুত ও সুদৃঢ় করে।

২০২৪ সালের জুলাই বিপ্লব এখনো সেই কাক্সিক্ষত পরিবর্তনের মুখ দেখেনি, যার জন্য বাংলাদেশের মানুষ দীর্ঘ দিন ধরে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে। জনগণের আকাক্সক্ষা আংশিকভাবে পূরণ হতে পারে কেবল তখনই, যখন পরবর্তী সরকার জুলাই সনদ বাস্তবায়ন করবে; কিন্তু এর বাস্তবায়ন নিয়ে এখনো অনিশ্চয়তা রয়ে গেছে, এমনকি নিকট ভবিষ্যতে এই বিপ্লবের প্রকৃত চেতনা আদৌ বাস্তবায়িত হবে কি না, তা নিয়েও যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে।

রাজনৈতিক দলগুলো যখন ক্ষমতার লড়াইয়ে মেতে উঠে বিপ্লবের চেতনা ও দেশের স্বার্থ ভুলে যায়, তখন সাধারণ মানুষ গভীর বিভ্রান্তিতে পড়ে। বিপ্লব-পরবর্তী বাংলাদেশে এখন এমনই এক অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ দৃশ্যমান, যা জাতির জন্য অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক।

শহীদ শরিফ ওসমান হাদি ইতিহাস ভালোভাবেই জানতেন। শহীদ তিতুমীর থেকে শুরু করে শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান পর্যন্ত যারা অতীতে জাতির জন্য সর্বোচ্চ আত্মত্যাগ করেছেন তাদের কথা তিনি বলতেন। হাদিও ছিলেন ওই সব মহান ত্যাগী পুরুষদেরই প্রকৃত উত্তরসূরি।

শহীদ ওসমান হাদির অকাল এবং অস্বাভাবিক মৃত্যু নতুন বাংলাদেশ গঠনের জন্য নতুন রক্ত ও অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে; একটি বাংলাদেশ, যা হবে ভারতীয় আধিপত্যবাদ থেকে মুক্ত। এটিই ছিল ওসমান হাদির একমাত্র স্বপ্ন। এই স্বপ্ন বাস্তবায়নে প্রয়োজন দৃঢ় ও সাহসী পদক্ষেপ।

গত বছরের ১৬ জুলাই নিজের জীবন উৎসর্গকারী শহীদ আবু সাঈদের মতোই শহীদ ওসমান হাদিও ভারতীয় আধিপত্যবাদী রাজনীতির বিরুদ্ধে লড়াইয়ে জাতিকে আবারো জাগিয়ে তুলেছেন। নিজে লড়াই করেছেন সার্বক্ষণিক। ফলে ২০২৪ সালের জুলাই বিপ্লব খুব শিগগিরই তার দ্বিতীয় ধাপের যাত্রা শুরু করতে পারে- এটি অত্যন্ত সম্ভাব্য।

শহীদ ওসমান হাদি আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন; কিন্তু রেখে গেছেন জাতীয় ঐক্যের এক অনন্য ইতিহাস। ভবিষ্যতে যেকোনো চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় বাংলাদেশীরা ঐক্যবদ্ধ থাকবে। আশা করা যায়, এই ঐতিহাসিক সন্ধিক্ষণে বিএনপি, জামায়াত ও এনসিপিসহ দেশের রাজনৈতিক দলগুলো জাতীয় স্বার্থে একসাথে কাজ করবে।

তিনি ছিলেন মানুষের জন্য এক সতর্ক ঘণ্টা, ঘুম থেকে জাগিয়ে তোলার আহ্বান। তার কণ্ঠ ছিল স্পষ্ট ও দৃঢ়। শত্রুরা তার মধ্যে এক ভবিষ্যৎ ক্যারিশম্যাটিক নেতার উত্থান দেখতে পেয়েছিল। তিনি জানতেন, তার জীবন হুমকির মুখে, তবুও মিশন ত্যাগ করেননি। বহুবার সতর্ক করা হলেও তিনি অবিচল ছিলেন।

বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে তিনি এক উজ্জ্বল নক্ষত্রের মতো আবির্ভূত হয়ে এক যোদ্ধার গৌরবময় জীবন রেখে গেছেন। নিজের জীবন উপেক্ষা করে তিনি কেবল একটি নিরাপদ বাংলাদেশ দেখতে চেয়েছিলেন। অল্প সময়েই তিনি নিজেকে জাতীয় নেতৃত্বের শিখরে তুলে আনতে সক্ষম হন; কিন্তু শত্রুর বুলেট তার জীবন কেড়ে নেয় এবং জাতিকে এক সম্ভাবনাময় নেতার সেবা থেকে বঞ্চিত করে।

জাতি দীর্ঘ দিন ধরে এমনই একজন নেতার অপেক্ষায় ছিল; কিন্তু শত্রুরা তাকে সম্ভাব্য হুমকি হিসেবে দেখে পেইড এজেন্টদের মাধ্যমে তাকে হত্যা করে। যদিও তারা মনে করে সফল হয়েছে, বাস্তবে তারা বাংলাদেশে অসংখ্য ‘হাদি’র জন্ম দিয়েছে।

এটি নিঃসন্দেহে জাতির জন্য এক অপূরণীয় ক্ষতি, তবে তার আত্মত্যাগ বৃথা যাবে না। অনেকেই মনে করেন, শহীদ ওসমান হাদির হত্যা ফেব্রুয়ারির নির্বাচনে প্রভাব ফেলবে। তার সাহসিকতা ইতিহাসে চিরদিন উদাহরণ হয়ে থাকবে। তিনি বাংলাদেশের এক আইকনিক নায়ক হিসেবে স্মরণীয় থাকবেন।

গত ২০ ডিসেম্বর ২০২৫ অনুষ্ঠিত তার নামাজে জানাজায় লাখ লাখ মানুষ অংশগ্রহণ করে ইতিহাসের সব রেকর্ড ভেঙে দেয়। জাতি তার জন্য আন্তরিকভাবে দোয়া করেছে। আল্লাহ যেন তাকে শহীদের মর্যাদা দান করেন এবং জান্নাতুল ফেরদৌস নসিব করেন। এর আগে কেবল শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানই এমন সম্মান পেয়েছিলেন, বাংলাদেশের ইতিহাসে এ এক অতি বিরল ঘটনা।

তার বীরত্ব ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে জুলাই বিপ্লবের পথ অনুসরণে অনুপ্রাণিত করবে। মাত্র ৩২ বছরের সংক্ষিপ্ত জীবন হলেও তার আদর্শ অমর। তিনি বিশ্বাস করতেন, নৈতিকতা অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির চেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ। নৈতিকভাবে দুর্বল জাতি অবশেষে নিশ্চিত ধ্বংসের পথে এগিয়ে যায়। তিনি ভারতীয় সাংস্কৃতিক আধিপত্যের আগ্রাসনের বিরুদ্ধে এক সাংস্কৃতিক বিপ্লবে বিশ্বাস করতেন। সেই লক্ষ্যেই তিনি ‘ইনকিলাব মঞ্চ’ প্রতিষ্ঠা করেন।

শহীদ ওসমান হাদির বপন করা বীজ ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে সাহস ও ঐক্যের প্রতীক হয়ে পথ দেখাবে। বিপ্লবীকে হত্যা করা যায়; কিন্তু বিপ্লবের চেতনা হত্যা করা যায় না। এক বিদ্রোহীর রক্ত বহু বিদ্রোহীর জন্ম দেয়। স্বল্পজীবন; কিন্তু চিরন্তন নেতা। হাদি চলে গেছেন; কিন্তু জুলাই রয়ে গেছে। জয় হোক জুলাই বিপ্লবের। ইনকিলাব জিন্দাবাদ।

লেখক : সম্পাদক, মিলিটারি হিস্ট্রি জার্নাল