সামুদ ফ্লোটিলা, গাজার পথে অভিযাত্রা

মুসলিম বিশ্বের সরকারদের এই নীরবতা ভাঙা যাবে কিভাবে? এর জন্য দরকার কিছু জরুরি মৌলিক পদক্ষেপ। যেমন- ইসলামী সম্মেলন সংস্থার (ওআইসি) পুনর্গঠন যাতে এটি বাস্তব পদক্ষেপ নিতে পারে; ইসলামী অর্থনৈতিক ব্লক তৈরি করে ফিলিস্তিন পুনর্গঠনের জন্য একটি স্থায়ী তহবিল গঠন করা যা রাজনীতি নিরপেক্ষভাবে পরিচালিত হবে; মুসলিম দেশগুলোকে জাতিসঙ্ঘে গাজার অবরোধ অবৈধ ঘোষণা করার প্রস্তাব নিয়ে একযোগে উদ্যোগ নেয়া। সামুদ ফ্লোটিলা শুধু সমুদ্রযাত্রা নয়, এটি মুসলিম বিশ্বের আয়না অথচ আমরা দেখি উদাসীনতা, বিভাজন, ভয়, নীরবতা। কিন্তু যদি আমরা একত্র হই, গাজার অবরোধ নয়, পৃথিবীর কোনো অবরোধই টিকবে না। গাজার মুক্তি কেবল ফিলিস্তিনের নয়, এটি মুসলমানের আত্মার মুক্তি। মুসলিম বিশ্ব যদি এক হতে পারে তবেই সামুদ ফ্লোটিলার মতো অভিযান সফল হবে।

ড. মো: মিজানুর রহমান
ড. মো: মিজানুর রহমান |নয়া দিগন্ত গ্রাফিক্স

গাজা আজ পৃথিবীর অন্যতম মানবিক বিপর্যয়ের প্রতীক। সব পথ বন্ধ থাকায় সেখানে খাদ্য, ওষুধ, জ্বালানিসহ সব ধরনের সরবরাহ বন্ধ হয়ে গেছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মে ২০২৫-এর রিপোর্ট অনুযায়ী, গাজার প্রায় দুই মিলিয়ন অধিবাসীর মধ্যে প্রায় ৬৮ হাজার নিহত হন যাদের মধ্যে প্রায় ২১ হাজার শিশু। এখনো বেঁচে থাকা ৮০ শতাংশ মানুষ মানবিক সহায়তার ওপর নির্ভরশীল। কিন্তু কোনো সরবরাহ নেই। তারা অনাহারে মারা যাচ্ছে। এই প্রেক্ষাপটে ‘সামুদ ফ্লোটিলা’ আন্দোলন বিশ্বজুড়ে এক মানবিক প্রতিরোধের প্রতীক হয়ে উঠেছে।

এর লক্ষ্য কেবল সাহায্য পৌঁছে দেয়া নয়, বরং বিশ্বের দৃষ্টি আকর্ষণ করা গাজার মানবিক সঙ্কট ও অবরোধের অবৈধতার দিকে। ২০১০ সালে তুরস্কের নেতৃত্বে প্রথম যে ফ্লোটিলা অভিযান শুরু হয়, তা বিশ্বজনমতে গভীর আলোড়ন তোলে। সেই থেকেই এই আন্দোলন প্রতি বছরই নতুনভাবে সংগঠিত হচ্ছে।

এবারের অভিযানে বিশ্বের ৪৪টি দেশের প্রতিনিধিরা অংশ নেন। ছিলেন বিভিন্ন দেশের চিকিৎসক, সাংবাদিক, মানবাধিকারকর্মী, সমাজকর্মী, অধ্যাপক ও প্রাক্তন কূটনীতিক। দক্ষিণ এশিয়া, মধ্যপ্রাচ্য, ইউরোপের বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধি এমনকি কানাডা ও লাতিন আমেরিকার কিছু মানবিক সংগঠনও এই মিশনে যোগ দেয়। মিশনের উদ্দেশ্য ছিল গাজার অবরোধ ভাঙা এবং সেখানে জরুরি চিকিৎসা ও খাদ্যসামগ্রী পৌঁছে দেয়া।

অভিযানের প্রস্তুতি শুধু মানবিক নয়, আইনগত ও রাজনৈতিক দিক থেকেও সুসংগঠিত ছিল। আন্তর্জাতিক সমুদ্র আইন, মানবাধিকার আইন ও যুদ্ধবিধির আওতায় এর কর্মকাণ্ড ছিল বৈধ। আন্তর্জাতিক নৌ সীমায় সাহায্যবাহী জাহাজ আটক করা এবং তাতে হামলা চালানো আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন। তবু ইসরাইলি নৌবাহিনী একাধিকবার ফ্লোটিলাকে বাধা দেয়, জাহাজগুলোকে ইসরাইলি বন্দরে নিয়ে যায় এবং অংশগ্রহণকারীদের আটক করে। অনেককে ঘণ্টার পর ঘণ্টা জিজ্ঞাসাবাদ ও নির্যাতনের অভিযোগও ওঠে, যদিও ইসরাইল তা অস্বীকার করেছে।

অন্য দিকে আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া ছিল যথেষ্ট জোরালো। পাকিস্তান, মালয়েশিয়া, মালদ্বীপ, দক্ষিণ আফ্রিকা ও তুরস্কসহ অন্তত ষোলোটি দেশ এক যৌথ বিবৃতিতে ফ্লোটিলা আটকানোর ঘটনাকে ‘মানবিক অধিকারের সরাসরি লঙ্ঘন’ বলে নিন্দা এবং বন্দীদের মুক্তি ও গাজার অবরোধ অবিলম্বে প্রত্যাহারের আহ্বান জানায়। দক্ষিণ আফ্রিকা, স্পেন ও আয়ারল্যান্ডের সংসদ সদস্যরাও মানবিক সংবিধান অনুসারে এই অভিযানের প্রতি সমর্থন জানান। ইউরোপীয় কিছু দেশের নাগরিক সমাজ ও মানবাধিকার সংগঠনগুলো স্পষ্টভাবে ফ্লোটিলার পক্ষে অবস্থান নেয়।

তবে বিশ্বের পরাশক্তিগুলোর ভূমিকা ছিল মিশ্র। ইসরাইলি সরকার, বিরোধী দল, সাধারণ জনগণ এবং আন্তর্জাতিক ইহুদি সম্প্রদায়ের মধ্যে সামুদ ফ্লোটিলার প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি ও প্রতিক্রিয়া ভিন্ন মাত্রায় প্রতিফলিত হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রে মাত্র ৩২ শতাংশ আমেরিকান ইসরাইলি গাজা অভিযানে সমর্থন জানিয়েছেন, যা আগের বছরের তুলনায় অনেকটা কম। বিশেষ করে ডেমোক্র্যাটিক পার্টির সমর্থন মাত্র ৮ শতাংশ এবং রিপাবলিকান ভোটারদের ৭১ শতাংশ পর্যন্ত পৌঁছেছে। ফ্রান্স ও ইতালি সরকার গাজার মানবিক পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে। ইতালি ও স্পেন প্রথমে সামুদ ফ্লোটিলার নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সামরিক নৌযান পাঠালেও পরে সরিয়ে নেয়।

ইসরাইলের অভ্যন্তরীণ প্রতিক্রিয়ায়, প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু গ্লোবাল সামুদ ফ্লোটিলাকে ‘জিহাদি ফ্লোটিলা’ হিসেবে অভিহিত করেন এবং এটিকে হামাসের সাথে সম্পর্কিত বলে দাবি করেন। ন্যাশনাল সিকিউরিটি মিনিস্টার ইতার মার বেন-গভি বলেন, যেসব দেশ আটককৃতদের সমর্থন করে তারা ‘সন্ত্রাসের সমর্থক’। তবে বিরোধী নেতা ইয়ায়ির ল্যাপিড যুদ্ধের অবসান এবং শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য আন্তর্জাতিক উদ্যোগ সমর্থন করেন, যদিও সরকারের রাজনৈতিক চাপে এই সমর্থন সীমিত। আন্তর্জাতিক ইহুদি সম্প্রদায়ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে এবং শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে।

বিশ্ব গণমাধ্যম এই ঘটনার ব্যাপক প্রচার করেছে। রোম, এথেন্স, ইস্তাম্বুল, লন্ডন ও কুয়ালালামপুরে হাজারো মানুষ বিক্ষোভ মিছিল করেছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে মিলিয়ন মিলিয়ন পোস্ট ছড়িয়েছে। মিডিয়ার বিশ্লেষণ অনুযায়ী, ফ্লোটিলার প্রচার মানবিক চেতনা জাগাতে ব্যাপক প্রভাব ফেলেছে। এই অভিযানে দ্রুত আন্তর্জাতিক ও সামরিক উত্তেজনায় পরিণত হয়। ইসরাইলি নৌবাহিনী ফ্লোটিলার সব নৌযানই আটক করেছে, ফলে ফ্লোটিলার পক্ষে গাজায় পৌঁছা সম্ভব হয়নি।

সামুদ ফ্লোটিলার অর্জন

এই অভিযানের ফলাফল দু’টি মাত্রায় মূল্যায়ন করা যায়। বেশির ভাগ জাহাজ আটক হওয়ায় তারা গাজার ভূখণ্ডে প্রবেশ করাতে ব্যর্থ হয়েছে। খাদ্য, ওষুধ বা অন্যান্য পণ্য পৌঁছানো যায়নি। অভিযানে অংশ নেয়া শতাধিক বিদেশীকে ইসরাইল আটক করে। পরে তাদের গ্রিস ও জর্দানে পাঠিয়ে দেয়।

অনেক বিশ্লেষকদের মতে, ফ্লোটিলা অবরোধ ভাঙতে না পারলেও এটি একটি নৈতিক বিজয় অর্জন করেছে। কারণ বিশ্বব্যাপী গাজার মানুষের দুর্দশা নিয়ে নতুন করে আলোচনা সৃষ্টি হয়েছে। বিশ্বের সাধারণ মানুষ, সাংবাদিক ও চিকিৎসকরা এখনো ন্যায়ের পক্ষে দাঁড়াতে প্রস্তুত। গাজার অবরোধের বৈধতা নিয়ে আন্তর্জাতিক আদালতে আলোচনা ইতোমধ্যেই শুরু হয়েছে। আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত ও মানবাধিকার কমিশন এই ঘটনাগুলো পর্যবেক্ষণ করছে।

ফ্লোটিলার আরেকটি বড় প্রভাব হলো আন্তর্জাতিক জনমতের পরিবর্তন। বহু দেশ ও সংস্থায় এখন ‘গাজা ব্লকেড’ শব্দটি মানবাধিকার লঙ্ঘনের প্রতীক হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। সংবাদমাধ্যম ও অ্যাকাডেমিক জগতে গবেষণা ও প্রতিবেদন তৈরি হচ্ছে, যেখানে বলা হচ্ছে, অবরোধ কোনোভাবেই বৈধ নয়, কারণ এটি সামরিক নয়, বরং সাধারণ জনগণের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা। এই জনমতের চাপ একদিন কূটনৈতিক অবস্থান পরিবর্তনে প্রভাব ফেলতে পারে।

ভবিষ্যতে আন্দোলন সফল করতে হলে কিছু কৌশলগত পরিবর্তন জরুরি। যেমন- আন্তর্জাতিক আদালত ও জাতিসঙ্ঘে অবরোধের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করা; জাতিসঙ্ঘ বা বহু দেশের সমন্বয়ে ‘নিরপেক্ষ মানবিক কনভয়’ গঠন করা, যা ইসরাইলি সেনাবাহিনীর আক্রমণের শঙ্কা ছাড়াই গাজায় সহায়তা পৌঁছাতে পারবে। গাজার সঙ্কট শুধু রাজনৈতিক বা সামরিক ইস্যু নয়; এটি মানবতার প্রশ্ন। সামুদ ফ্লোটিলা সেই কান্নার জবাব দিয়েছে। এই নৌযাত্রা গাজার উপকূলে পৌঁছায়নি, কিন্তু এটি পৌঁছে গেছে বিশ্বের বিবেকের গভীরে।

মুসলিম বিশ্বের বিবেকের পরীক্ষা

সামুদ ফ্লোটিলা অভিযানের পক্ষে কিছু মুসলিম দেশ জোরালো অবস্থান নিলেও অনেক আরব দেশ নীরব থাকে। সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, বাহরাইন ও মরক্কো ইসরাইলের সাথে সম্পর্ক জোরদার করেছে। মধ্যপ্রাচ্যের অধিকাংশ দেশ পশ্চিমা সামরিক ও অর্থনৈতিক নির্ভরতার কারণে সরাসরি অবস্থান নিতে ভয় পায়। রাষ্ট্রীয় নীতি হয়ে দাঁড়ায় ‘মৌন কূটনীতি’ যেখানে মানবিক দায়বোধ প্রান্তিক হয়। ফলে ফ্লোটিলা রাজনৈতিকভাবে একাকী হয়ে যায়।

কিন্তু প্রশ্ন থেকে যায়, মুসলিম বিশ্বের সরকারদের এই নীরবতা ভাঙা যাবে কিভাবে? এর জন্য দরকার কিছু জরুরি মৌলিক পদক্ষেপ। যেমন- ইসলামী সম্মেলন সংস্থার (ওআইসি) পুনর্গঠন যাতে এটি বাস্তব পদক্ষেপ নিতে পারে; ইসলামী অর্থনৈতিক ব্লক তৈরি করে ফিলিস্তিন পুনর্গঠনের জন্য একটি স্থায়ী তহবিল গঠন করা যা রাজনীতি নিরপেক্ষভাবে পরিচালিত হবে; মুসলিম দেশগুলোকে জাতিসঙ্ঘে গাজার অবরোধ অবৈধ ঘোষণা করার প্রস্তাব নিয়ে একযোগে উদ্যোগ নেয়া। সামুদ ফ্লোটিলা শুধু সমুদ্রযাত্রা নয়, এটি মুসলিম বিশ্বের আয়না অথচ আমরা দেখি উদাসীনতা, বিভাজন, ভয়, নীরবতা। কিন্তু যদি আমরা একত্র হই, গাজার অবরোধ নয়, পৃথিবীর কোনো অবরোধই টিকবে না। গাজার মুক্তি কেবল ফিলিস্তিনের নয়, এটি মুসলমানের আত্মার মুক্তি। মুসলিম বিশ্ব যদি এক হতে পারে তবেই সামুদ ফ্লোটিলার মতো অভিযান সফল হবে।

লেখক : অর্থনীতিবিদ, গবেষক ও কলামিস্ট
[email protected]