না ভোট, ডাকভোট ও প্রতীকের রাজনীতি

এমন এক সঙ্কটময় মুহূর্তে যখন দেশ একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় নির্বাচনের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে, তখন অবশ্যই সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা ছিল। কিন্তু যথাযথ নিরাপত্তা, গণ-আলোচনা এবং প্রাতিষ্ঠানিক ঐকমত্য ছাড়া প্রবর্তিত সংস্কার, সমস্যার চেয়ে জটিলতাই সৃষ্টি করে বেশি।

৩ নভেম্বর ২০২৫ তারিখে রাষ্ট্রপতি সংবিধানের ৯৩নং অনুচ্ছেদের ক্ষমতাবলে গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও) সংশোধন অধ্যাদেশ-২০২৫ জারি করেছেন। এ অধ্যাদেশের মাধ্যমে আগামী বছরের জাতীয় নির্বাচনের প্রক্রিয়ায় বড় ধরনের পরিবর্তন আসছে। তবে লক্ষণীয় যে, এ অধ্যাদেশ প্রণয়নের আগে নাগরিক সমাজ বা রাজনৈতিক দলগুলোকে কোনো প্রকার পরামর্শ বা মতামত প্রদানের সুযোগ দেয়া হয়নি। অর্থাৎ- সংশোধনীটি সম্পূর্ণভাবে নির্বাহী বিভাগের উদ্যোগে গৃহীত হয়েছে, যেখানে প্রচলিত গণতান্ত্রিক মতবিনিময় ও গণ-পর্যালোচনার প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হয়নি। এ প্রবন্ধে গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশে গৃহীত পরিবর্তনগুলোর সাংবিধানিক তাৎপর্য এবং বাংলাদেশের নির্বাচনী কাঠামোর ওপর এর সম্ভাব্য প্রভাব সম্পর্কে বিশ্লেষণ করা হবে।

এ কথা অস্বীকার করার উপাই নেই, গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে জনগণের সংবিধান প্রণয়ন ক্ষমতা প্রয়োগের ফলস্বরূপ বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয়েছে, তথাপি এটিও ভুলে গেলে চলবে না যে, এটি একটি অনির্বাচিত প্রশাসন। এ সরকার বা তার প্রশাসনের বৈধতা কোনো নির্বাচনী ম্যান্ডেট থেকে আসেনি; বরং এসেছে জনগণের বিপ্লবী কর্তৃত্ব থেকে। সে কারণে এ সরকার যেকোনো সিদ্ধান্ত নিক না কেন, তা অবশ্যই সেই সংবিধান প্রণয়ন ক্ষমতা ও যে ম্যান্ডেট নিয়ে এটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, তার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হতে হবে। এ ম্যান্ডেট থেকে বিচ্যুত যেকোনো পদক্ষেপ সরকারের কর্তৃত্বের আওতার বাইরে চলে যাওয়ার ঝুঁকি তৈরি করবে। সে ক্ষেত্রে সরকার ও তার প্রশাসনের সাংবিধানিক বৈধতার সঙ্কট বিষয়ে প্রশ্নের জন্ম দিতে পারে।

যেহেতু গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও) নির্বাচন পরিচালনার পদ্ধতি নিয়ন্ত্রণ করে এবং রাজনৈতিক দল ও নাগরিকদের নির্বাচন প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে, তাই এ আদেশে কোনো প্রকার সংশোধনী আনার আগে রাজনৈতিক দল ও নাগরিকদের সাথে পরামর্শ করা ছিল অপরিহার্য। এ পরামর্শ না নেয়ায় আদেশটিতে গৃহীত সংশোধনীগুলোর সাংবিধানিক বৈধতা নিয়ে গুরুতর প্রশ্ন উত্থাপিত হচ্ছে।

‘না ভোট’-এর বিধান

গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশের এ সংশোধনীগুলোর মধ্যে সবচেয়ে কৌতূহলোদ্দীপক এবং একই সাথে বিতর্ক জন্ম দেয়া একটি বৈশিষ্ট্য হলো ‘না ভোট’ বিকল্পটির প্রবর্তন। বাংলাদেশের নির্বাচনী ইতিহাসে এই প্রথমবার ভোটারদের ব্যালট বাক্সে কোনো প্রার্থীর প্রতি অসম্মতি বা অসন্তোষ নথিভুক্ত করার সুযোগ তৈরি করা হয়েছে। আপাতদৃষ্টিতে বিকল্পটি অগ্রহণযোগ্য প্রার্থীদের প্রতি ভোটারদের হতাশা প্রকাশের একটি গণতান্ত্রিক পথ হিসেবে মনে হলেও গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যায়, এই ‘না ভোট’ বিকল্পটি আসলে কেবল প্রতীকী, এর বেশি কিছু নয়।

এই সংশোধনী অনুযায়ী, ‘না ভোট’ বিকল্পটি কেবল তখন কার্যকর হবে যখন কোনো আসনে একজন মাত্র প্রতিদ্ব›দ্বী প্রার্থী থাকবেন। এমন পরিস্থিতিতে ভোটারদের সামনে দু’টি বিকল্প থাকবে- হয় সেই একক প্রার্থীকে ভোট দেয়া, অথবা ‘না ভোট’ প্রদান করা। যদি একক প্রার্থীর প্রাপ্ত ভোটের চেয়ে ‘না ভোট’ বেশি হয়, তখন সেই আসনে নির্বাচনটি বাতিল করে পুনরায় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। তবে, এখানেই এর প্রতীকী প্রকৃতি স্পষ্ট হয়ে ওঠে- যদি সেই নতুন নির্বাচনেও ওই আসনটিতে আবারো একজন মাত্র প্রার্থী থাকেন, তবে কোনো প্রতিদ্ব›িদ্বতা ছাড়াই সেই একক প্রার্থীকে নির্বাচিত ঘোষণা করা হবে। এ ক্ষেত্রে দু’টি সমস্যা স্পষ্ট হয়ে দেখা দিয়েছে। প্রথমত, ‘না ভোট’ রাখার মূল উদ্দেশ্য হলো ভোটারদের এমন একটি সুযোগ দেয়া, যাতে তারা জানাতে পারেন, কোনো প্রার্থীই তাদের কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। কিন্তু সংশোধিত বিধানটি ধরে নিচ্ছে, অসন্তোষ কেবল তখনই জন্মায়, যখন নির্বাচনে একজন প্রার্থী থাকেন। এ ধারণা বেশ অস্বাভাবিক। কারণ এমনটি হওয়া খুব সম্ভব যে, নির্বাচকমণ্ডলীর কাছে অংশগ্রহণকারী সব প্রার্থীকে অগ্রহণযোগ্য বলে মনে হচ্ছে। যদি দু’জন প্রার্থী সমানভাবে অযোগ্য, দুর্নীতিগ্রস্ত অথবা দলীয় উচ্চপর্যায় থেকে চাপিয়ে দেয়া হয়ে থাকে, তবে কি ভোটারদের উভয়কে প্রত্যাখ্যান করার অধিকার থাকা উচিত নয়? কেন ‘না ভোট’ অপ্রাসঙ্গিক হয়ে যাবে শুধু এ কারণে যে, ব্যালটে একাধিক নাম রয়েছে?

দ্বিতীয়ত, যদি কোনো একক প্রার্থী ‘না ভোট’-এর চেয়ে কম ভোট পান, তবে আইনে পুনরায় নির্বাচন অনুষ্ঠানের প্রয়োজন হয়। কিন্তু সেই নতুন নির্বাচনেও যদি একই প্রার্থী আবার একমাত্র প্রতিদ্ব›দ্বী হন, তবে আইন স্বয়ংক্রিয়ভাবে তাকে নির্বাচিত ঘোষণা করে দেয়। প্রশ্ন হলো- আইন কেন একই অজনপ্রিয় প্রার্থীকে পুনরায় প্রতিদ্ব›িদ্বতা করার সুযোগ দেবে? যেখানে ভোটাররা ইতোমধ্যে সংখ্যাগরিষ্ঠ ‘না ভোট’-এর মাধ্যমে স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিয়েছেন, তারা এ প্রার্থীকে চান না, সেখানে দ্বিতীয় নির্বাচনে সেই প্রার্থীকে বা তাকে মনোনয়ন দেয়া দলকে পুনরায় মাঠে নামানো থেকে বিরত রাখাই অধিকতর যৌক্তিক হতো এবং গণরায়কে যথাযথ সম্মান জানানো হতো। এ ক্ষেত্রে যেটি হয়েছে তা হলো- জনগণের অপছন্দনীয় প্রার্থীকে স্পষ্টভাবে তাদের প্রতিনিধি হিসেবে চাপিয়ে দেয়া হয়েছে, যা গণতান্ত্রিক রীতির সরাসরি লঙ্ঘন।

ডাকভোট ব্যবস্থা

এই সংশোধনীতে গভীর উদ্বেগের আরেকটি ক্ষেত্র হলো নতুন পোস্টাল-ব্যালট ব্যবস্থা। সংশোধনীটি বিদেশে বসবাসরত বাংলাদেশী নাগরিকসহ লাখ লাখ ভোটারকে নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় যুক্ত করেছে। তত্ত¡গতভাবে এটি অংশগ্রহণ বাড়ানোর একটি প্রচেষ্টা বলে মনে হলেও বাস্তবে পদক্ষেপটি ব্যবস্থাপনা এবং নিরাপত্তাসংক্রান্ত এক তীব্র সঙ্কট সৃষ্টি করেছে। বাংলাদেশের ডাক পরিষেবা ইতোমধ্যে অতিরিক্ত কাজের ভারে জর্জরিত, তা সত্তে¡ও নির্বাচন কমিশনকে এখন বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে থাকা ভোটারদের কাছে ‘অবিলম্বে ডাকযোগে’ ব্যালট পাঠাতে হবে। আবার, ব্যালট পেপার প্রাপকের প্রাপ্তিস্বীকার বা পরিচয় প্রমাণের বিষয়ে আইনে কোনো স্পষ্টতা দেয়া হয়নি। ভোটারকে ব্যালট প্রাপ্তির বিষয়টি নিশ্চিত করারও কোনো আবশ্যকতা রাখা হয়নি। ফলস্বরূপ, একটি ব্যালট যদি হারিয়ে যায়, মাঝপথে আটকে যায় বা বিলম্বিত হয়- তবে তা নির্বাচনী রেকর্ড থেকে হারিয়ে যাবে। এ সমস্যাগুলোর সমাধান করা না হলে যেসব আসনে বিপুলসংখ্যক ভোটার বিদেশে বসবাস করেন, সেখানে নির্বাচনের ফল ঘিরে নতুন ধরনের আইনি চ্যালেঞ্জ ও বিতর্ক তৈরি হবে- এ ব্যাপারে সন্দেহ নেই।

এ ব্যবস্থায় আরো একটি উদ্বেগজনক বিষয় হলো- প্রতিটি পোস্টাল ব্যালটে একটি ‘স্বতন্ত্র শনাক্তকারী’ রাখার এবং ব্যালটটির ‘পুরো যাত্রাপথ’ ট্র্যাক করার বাধ্যবাধকতা। এ বিধান ভোটের গোপনীয়তাকে মারাত্মকভাবে ক্ষুণœ করবে এবং একটি নির্দিষ্ট ভোটকে একজন একক ভোটারের সাথে যুক্ত করার সুযোগ তৈরি করবে। যেহেতু ট্র্যাকযোগ্য ব্যালট একজন ভোটারকে চিহ্নিত করার সুযোগ দেয়, তাই এটি নির্বাচনী জবরদস্তি বা চাপ সৃষ্টির সম্ভাবনা সৃষ্টি করে।

নির্বাচনী প্রতীক ব্যবহারের বিধান

গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশের সংশোধনীতে নিয়ে আসা আরো একটি গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন হলো রাজনৈতিক দলগুলো জোট গঠন করার ক্ষেত্রে নির্বাচনী প্রতীক ব্যবহারের নিয়মসংক্রান্ত। নতুন নিয়ম অনুযায়ী, যদি দুই বা ততোধিক দল একটি কেন্দ্রে যৌথ প্রার্থী দিতে সম্মত হয়, তাহলে সেই প্রার্থী কেবল তার নিজের দলের প্রতীক ব্যবহার করতে পারবে। এর ফলে বাংলাদেশের জোটনির্ভর রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে বিরাট প্রভাব পড়বে। অতীতের নির্বাচনে, বিশেষ করে ২০০৮ সালের বৃহৎ জোটের সময়, ছোট দলগুলো প্রায়ই তাদের প্রার্থীদের প্রধান সহযোগী দলের প্রতীক ব্যবহার করত। এতে কম পরিচিত প্রার্থীরা বড় দলের পরিচিতি, জনপ্রিয়তা ও সাংগঠনিক শক্তি ব্যবহার করে নির্বাচনে বিপুল সুবিধা পেত। নতুন বিধান কার্যত প্রথাটিকে শেষ করেছে। রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা হলে এটি নিঃসন্দেহে জোটগুলোর কার্যকারিতা আরো জটিল করে দেবে। বড় দলগুলো হয়তো কম পরিচিত ছোট সহযোগী দলের জন্য আসন ছাড়তে এতটা আগ্রহী হবে না। অন্য দিকে, ছোট দলগুলো আর বড় দলের প্রতীকের জনপ্রিয়তা ও সাংগঠনিক শক্তির ওপর নির্ভর করতে না পারায় তাদের দরকষাকষির ক্ষমতা কমে যাবে।

তবে এই সংশোধনীকে একদিক থেকে একটি সঠিক পদক্ষেপ হিসেবে দেখা যায়। এক দলের প্রার্থীকে অন্য দলের প্রতীক ব্যবহার করার অনুমতি দিলে ভোটারদের মধ্যে একটি মিথ্যা বিভ্রম তৈরি করে। এটি ভোটারদের বিভ্রান্ত করে। সেই সাথে স্বল্প-পরিচিত ব্যক্তিত্বদের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর খ্যাতিকে পুঁজি করার সুযোগ করে দেয়। এ ধরনের চর্চা হয়তো সরাসরি অবৈধ নয়; কিন্তু গণতান্ত্রিকভাবে এর পক্ষে দাঁড়ানো কঠিন। যখন একজন ভোটার একটি প্রতীক নির্বাচন করেন, তখন তারা বহু দশকের রাজনৈতিক ইতিহাস, নেতৃত্ব, আদর্শ ও আস্থার ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নেন। সম্পূর্ণ ভিন্ন একটি দলের সদস্যকে নির্বাচিত করতে সেই প্রতীকটি ব্যবহার করা হলে তা ভোটের মূল অর্থকে বিকৃত করে।

বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে প্রতীকের গুরুত্ব অপরিসীম, অতএব, প্রতীকের অখণ্ডতা রক্ষা করা অপরিহার্য।

সুতরাং এমন এক সঙ্কটময় মুহূর্তে যখন দেশ একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় নির্বাচনের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে, তখন অবশ্যই সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা ছিল। কিন্তু যথাযথ নিরাপত্তা, গণ-আলোচনা এবং প্রাতিষ্ঠানিক ঐকমত্য ছাড়া প্রবর্তিত সংস্কার, সমস্যার চেয়ে জটিলতাই সৃষ্টি করে বেশি। একটি সীমাবদ্ধ ও কিছুটা অযৌক্তিক ‘না ভোট’ প্রক্রিয়া চালু করা, জোটগুলোর ক্ষেত্রে নির্বাচনী প্রতীক ব্যবহারের নিয়ম কঠোর করা এবং দুর্বল কাঠামোর ডাকযোগে ভোটব্যবস্থা- এসব জনগণের পরামর্শ ও অংশগ্রহণের সীমাবদ্ধতাকে নির্দেশ করে। অতএব এসব পরিবর্তন স্বচ্ছ ও অংশগ্রহণমূলক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে পুনর্বিবেচনা না করা হলে আসন্ন নির্বাচনের সাংবিধানিক বৈধতা ও বিশ্বাসযোগ্যতা ক্ষুণ্ণ হওয়ার ঝুঁকি রয়েছে।

লেখক : বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী ও হেগের আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের নিবন্ধিত কৌঁসুলি