আব্দুর রহমান
ডাকসুর নির্বাচনে ২৮টি পদের মধ্যে ভিপি-জিএসসহ ২৩টিতে এবং জাকসু নির্বাচনে ২৫টি পদের মধ্যে জিএসসহ ২০ টিতে ছাত্রশিবিরের নেতৃত্বে গঠিত প্যানেলের প্রার্থীরা বিপুল ভোটে জয়লাভ করে চমক সৃষ্টি করেছেন। জাকসুতে ভিপি পদে স্বতন্ত্র শিক্ষার্থী সম্মিলিত প্যানেলের প্রার্থী আব্দুর রশিদ জিতু তিন হাজার ৩৩৪ ভোট পেয়ে জয়ী হয়েছেন, যিনি সাবেক ছাত্রলীগের নেতা এবং জুলাই-৩৬ আন্দোলন চলাকালীন পদত্যাগ করে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে যোগদানের সুফল ঘরে তুলতে পেরেছেন। অথচ তার প্যানেলের জিএস প্রার্থী পেয়েছেন মাত্র ৯৬৯ ভোট। ছাত্রশিবিরের জিএস প্রার্থী তিন হাজার ৯৩০ ভোট পেয়ে নির্বাচিত হয়েছেন।
বিজয়ীদের অভিনন্দন জানিয়ে ১৯৬৮ সালে ডাকসু নির্বাচনে জীবনের প্রথমবার ভোট প্রদানকারী ও দলনিরপেক্ষ একজন প্রবীণের দৃষ্টিতে ডাকসু ও জাকসু নির্বাচনের ফল পর্যালোচনার চেষ্টা করবো। ডাকসুতে ভিপি পদে শিবিরের আবু সাদিক কায়েম পেয়েছেন ১৪ হাজার ৪২ ভোট, তার নিকটতম প্রতিদ্ব›দ্বী ছাত্রদলের আবিদুল ইসলাম পেয়েছেন পাঁচ হাজার ৭০৮ ভোট। জিএস পদে শিবিরের এস এম ফরহাদ পেয়েছেন ১০ হাজার ৭৯৪ ভোট, তার নিকটতম প্রতিদ্ব›দ্বী ছাত্রদলের তানভীর পেয়েছেন পাঁচ হাজার ২৮৩ ভোট ও ছাত্র ইউনিয়নের মেঘমল্লার বসু পেয়েছেন চার হাজার ৯৯৪ ভোট।
অনুমান, ছাত্রলীগ সমর্থকরা জিএস পদে ছাত্র ইউনিয়নের প্রার্থীকে ভোট দেয়ায় শিবিরের ভিপি ও সাধারণ সম্পাদকের প্রাপ্ত ভোটের পার্থক্য দাঁড়িয়েছে তিন হাজার ২৪৭ ভোট। গবেষণা ও প্রকাশনা সম্পাদক পদে বৈষম্যবিরোধী প্যানেলের প্রার্থী সানজিদা তন্বীকে শিবির বাদে সব প্যানেল থেকে সমর্থন দেয়ায় তিনি ১১ হাজার ৭৭৮ ভোট পেয়ে জয়ী হয়েছেন। তার প্রতিদ্ব›দ্বী শিবিরের প্রার্থী সাজ্জাত হোসেন পেয়েছেন সাত হাজার ১৮৯ ভোট, যা শিবিরের একক ভোট বলে প্রতীয়মান হচ্ছে। জগন্নাথ হলে ছাত্রদলের ভিপি প্রার্থী পেয়েছেন এক হাজার ২৭০ ভোট, তার প্রতিদ্ব›দ্বী শিবিরের প্রার্থী পেয়েছেন মাত্র ১০ ভোট ও উমামা ফাতেমা পেয়েছেন ২৭৮ ভোট। জিএস পদে ছাত্র ইউনিয়নের প্রার্থী মেঘমল্লার বসু পেয়েছেন এক হাজার ১৭০ ভোট। ছাত্রদলের প্রার্থী পেয়েছেন ৩৯৬ ভোট ও শিবিরের প্রার্থী পেয়েছেন মাত্র পাঁচটি ভোট। জগন্নাথ হলে ছাত্রদল ও ছাত্র ইউনিয়নের প্রার্থীকে ছাত্রলীগের সমর্থকরা ভোট দিলেও অন্যান্য হলে তাদের ভোট দেয়নি বলে প্রতীয়মান হচ্ছে। বেগম রোকেয়া, শামসুন্নাহার, কবি সুফিয়া কামাল, বিজয় ’৭১ ও ড. শহীদুল্লাহ হলে শিবিরের ভিপি প্রার্থী মোট ভোট পেয়েছেন পাঁচ হাজার ৮১৩টি। তার প্রতিদ্ব›দ্বী ছাত্রদলের ভিপি প্রার্থী পেয়েছেন এক হাজার ৮৮৯ ভোট। জগন্নাথ হলে ছাত্রলীগের সমর্থকরা যে হারে ছাত্রদল ও ছাত্র ইউনিয়নের প্রার্থীকে ভোট দিয়েছেন, অন্যান্য হলে ছাত্রলীগের সমর্থকরা সেই হারে তাদের ভোট দেননি বলে প্রতীয়মান হয়।
গণ-অভ্যুত্থানের পর বাংলাদেশে ইসলামপন্থীদের উত্থান ঘটেছে- এটি প্রমাণ করতে ছাত্রলীগের ৪৪ বছরের অভিভাবক পলাতক পতিত ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার ইচ্ছেপূরণে ছাত্র সংসদ নির্বাচনে ছাত্রলীগের সমর্থকরা অনন্য ভূমিকা রেখেছে। প্রতিটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ৬০ শতাংশের বেশি শিক্ষক যেমন শেখ হাসিনার কট্টর সমর্থক, তেমনি তাদের ও ছাত্রলীগ নেতাদের সহায়তায় বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ ও আবাসিক হলে আশ্রয় পাওয়া সুবিধাভোগী ছাত্রলীগ সমর্থকের সংখ্যা ন্যূনতম ২০ শতাংশ হতে পারে।
সুবিধাভোগী আওয়ামীপন্থী শিক্ষক ও ছাত্রলীগের সমর্থক ভোটাররা এখনো বিশ্বাস করেন, তাদের অভিভাবক শেখ হাসিনা খুব শিগগির ক্ষমতায় ফিরে আসবেন। ছাত্রলীগের সমর্থকরা স্বতন্ত্র শিক্ষার্থীদের ঐক্য, বৈষম্যবিরোধী ও স্বতন্ত্র প্যানেলকে ভোট দেবেন না, কারণ তারা আন্দোলন করে তাদের অভিভাবককে ক্ষমতাচ্যুত করেছেন, যা বিএনপি ও জামায়াত ১৫ বছরেও করতে পারেনি। ডাকসুর নির্বাচনে প্যানেলের আধিক্য শিবিরকে বাড়তি সুবিধা এনে দিয়েছিল। ছাত্র সংসদ নির্বাচনের মাধ্যমে শেখ হাসিনা জাতীয় নির্বাচনের স্টেজ রিহার্সেল করার সুযোগ পেয়েছিলেন বিএনপির ভুলের কারণে।
জুলাই-৩৬ গণ-অভ্যুত্থানের ফসল ড. মুহাম্মদ ইউনূসের অন্তর্বর্তী সরকার শপথ নেয়ার পর প্রধান উপদেষ্টার মাসপূর্তি ভাষণে নির্বাচনের কোনো আভাস না থাকায় বিএনপির জপের মালা হয়ে দাঁড়িয়েছিল- নির্বাচন, নির্বাচন এবং নির্বাচন। নগরবাসীর নাগরিক সেবা নিশ্চিতে জাতীয় নির্বাচনের আগে সিটি করপোরেশন নির্বাচনের দাবি না করে মাত্র এক মাসের জন্য ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়রের চেয়ার পেতে বিএনপির তরুণ নেতা ইশরাক হোসেনের নেতৃত্বে তার সমর্থকদের মাসব্যাপী নগরভবন অবরুদ্ধ করে রাখা ছিল রাজনৈতিক ভুল।
পবিত্র ঈদুল ফিতর উপলক্ষে জাতির উদ্দেশে দেয়া ভাষণ প্রধান উপদেষ্টা নির্বাচন জুন থেকে দুই মাস এগিয়ে এপ্রিলে করার ঘোষণা দিয়েও বিএনপিকে সন্তুষ্ট করতে না পারায় সরকারি সফরসূচি না থাকা সত্তে¡ও তাকে লন্ডন সফরে যেতে হয়েছিল। সেখানে যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রীর সাথে সাক্ষাৎ না হলেও বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সাথে সাক্ষাৎ করে নির্বাচন দুই মাস এগিয়ে ফেব্রুয়ারিতে আনার ঘোষণা দিতে হয়েছে। যা বিএনপি নেতারা তাদের নেতার কৃতিত্ব বলে জাহির করে অলক্ষে জামায়াতের হাতে একটি অস্ত্র তুলে দিয়েছিল। যেমন ২০০৪ সালে সংবিধান সংশোধন করে বিচারপতিদের চাকরিকাল দুই বছর বাড়িয়ে শেখ হাসিনার হাতে একটি অস্ত্র তুলে দেয়ার খেসারত শুধু বিএনপি-জামায়াতকে দিতে হয়নি, জনগণকেও দিতে হয়েছে দীর্ঘ সাড়ে ১৫ বছর।
তারেক রহমানের জনপ্রিয়তা তুঙ্গে পৌঁছত, যদি তিনি আমার দেশ পত্রিকার সম্পাদক মাহমুদুর রহমানের মতো ৫ আগস্টের পরে দেশে ফিরে এসে আদালতে আত্মসমর্পণ করে তার আপিল মঞ্জুর হওয়ার পর জামিনে মুক্ত হতেন এবং প্রধান উপদেষ্টার সাথে সাক্ষাৎ করে জাতীয় নির্বাচনের ছয় মাস আগে সিটি করপোরেশনের নির্বাচন দিতে প্রধান উপদেষ্টাকে রাজি করাতে পারতেন। গত আগস্ট-সেপ্টেম্বরে সিটি করপোরেশনের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে ১০টি সিটি করপোরেশনের মধ্যে অন্তত আটটিতে জয়ী হয়ে বিএনপি রাজনীতির চালকের আসনে বসতে পারত। যেমন- ডাকসু ও জাকসু নির্বাচনে জয়ী হয়ে জামায়াত এখন রাজনীতির চালকের আসনে বসেছে।
ছাত্র সংসদ নির্বাচনে নির্বাচন কমিশন, প্রশাসন ও পুলিশের পক্ষে জাতীয় নির্বাচন পরিচালনার মতো কোনো ভূমিকা রাখার সুযোগ ছিল না। জাতীয় নির্বাচন পরিচালনায় গত এক বছরে নির্বাচন কমিশন, প্রশাসন ও পুলিশের দক্ষতা এবং সক্ষমতা বৃদ্ধির একটি পরীক্ষা হতে পারত সিটি করপোরেশন নির্বাচনের মাধ্যমে। আর শেখ হাসিনার রাজনৈতিক পরিণতি থেকে শিক্ষাগ্রহণ করে রাজনৈতিক দলগুলো প্রার্থী বাছাই, নির্বাচনী প্রচার ও ভোট গ্রহণকালীন বুথ দখলের মতো অতীতের রাজনীতির ঘেরাটোপ থেকে বের হয়ে আসতে পেরেছে কিনা তা-ও প্রমাণিত হতো। অন্তর্বর্তী সরকারও গত এক বছরে এত বেশি পরিমাণ ভাত দুধ দিয়ে মেখেছে, যা স্বাচ্ছন্দ্যে গলাধঃকরণ দূরের কথা, ঠিকমতো চিবুতেও পারছে না। ঢাকার দু’টি, গাজীপুর ও নারায়ণগঞ্জ চারটি সিটি করপোরেশনের অবস্থান পাশাপাশি হওয়ায় এবং রাজধানী ও শিল্পাঞ্চল হিসেবে কর্মসূত্রে পুরো দেশের অনেক ভোটার এখানে বাস করেন। সঙ্গত কারণে এই চার সিটি করপোরেশন নির্বাচনের ফল আগামী জাতীয় নির্বাচনের ফলকে প্রভাবিত করত, যা বিএনপির পক্ষে যাওয়ার সম্ভাবনা বেশি ছিল।
ছাত্রলীগ সমর্থকরা ছাত্রদের বিভিন্ন মিছিলে যোগদান করে নানা প্রকার অঘটন ঘটিয়ে চলেছে। বুয়েটের শিক্ষার্থীরা শাহবাগ মোড়ে সংঘর্ষে জড়ালেও উল্টো পুলিশকে ক্ষমা চাইতে বাধ্য হওয়ায় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সাথে জোবরাবাসীর রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ থামাতে পুলিশ এগিয়ে আসেনি।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলেনের নেতাদের আহ্বানে সাড়া দিয়ে শেখ হাসিনার ওপর বিক্ষুব্ধ জনগণ ব্যাপক হারে জুলাই-৩৬ আন্দোলনে যোগ দেয়ায় তা সফল হয়। পরিণামে প্রাণ বাঁচাতে শেখ হাসিনা তার সেকেন্ড হোম ভারতে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছেন। দেশে রাজনৈতিক দলের সংখ্যা অর্ধশতাধিক হওয়ায় শেখ হাসিনার রাজনৈতিক অপমৃত্যু ঘটানোর কৃতিত্বের অধিকারীরা এখন হালে পানি পাচ্ছেন না। রাজনীতির খালি মাঠ দখলে রাজনৈতিক দলগুলো পরস্পরের বিরুদ্ধে বিষোদগারে ব্যস্ত থেকে ১৩টি মাস পার করে দেয়ায় পলাতক শেখ হাসিনা ও দেশে অবস্থানরত তার সমর্থকরা উজ্জীবিত হয়ে উঠেছেন।
সংসদীয় আসনের সীমানা পুনর্নির্ধারণের নামে নির্বাচন কমিশন ভিমরুলের চাকে আঘাত করায় এখন বাগেরহাট, ভাঙ্গা ও পাবনা নিয়ে তাদের ভাবনার শেষ নেই, যার চাপ সরকারও সামলাতে হিমশিম খায়। চব্বিশের ৫ আগস্টের গণ-অভ্যুত্থান-পরবর্তী আওয়ামী লীগের ১৯৯১ সালের নির্বাচন-পূর্ব ভূমিকা বিএনপি হুবহু অনুসরণ করায় জামায়াতের কৌশলের কাছে বেকায়দায় পড়ে।
জামায়াত এখন উচ্ছ¡সিত আর বিএনপি হতাশ। আগামী নির্বাচন যদি যথাসময়ে অনুষ্ঠিত হয়ও, তাতে রাজনৈতিক সমস্যার সমাধান না হয়ে নতুন করে জটিলতা সৃষ্টি হতে পারে। ছাত্র সংসদ নির্বাচনের মাধ্যমে শেখ হাসিনা আগামী নির্বাচনের যে স্টেজ রিহার্সেল করার সুযোগ পেয়েছেন তাতে নির্বাচন সনাতন পদ্ধতিতে হোক আর পিআর পদ্ধতিতে হোক- শেখ হাসিনার ছকের কারণে বিএনপি ও জামায়াতের জন্য বিরাট চমক অপেক্ষা করছে।
আওয়ামী লীগের কট্টর সমর্থক ভোটার রয়েছেন ১৫ শতাংশ ও দলনিরপেক্ষ ভোটার রয়েছে ৪০ শতাংশ, যাদের অধিকাংশ বয়সে তরুণ হওয়ায় জীবনে প্রথমবারের মতো ভোটাধিকার প্রয়োগ করবেন। এই ৫৫ শতাংশ ভোটার আগামী নির্বাচনের ফল নিয়ন্ত্রণ করবে। আওয়ামী লীগ নির্বাচনের মাঠে না থাকায় শেখ হাসিনার কথায় তার সমর্থকদের ভোট জাপা বা কমিউনিস্ট পার্টি অথবা এলাকাভিত্তিক অন্য দলের প্রার্থীর পক্ষে যেতে পারে। কিন্তু দলনিরপেক্ষ ভোটারদেরও অতীতের মতো মার্কা দেখে নয়, এলাকাভিত্তিক প্রার্থী দেখে ভোট দেয়ার সম্ভাবনা বেশি। সামরিক শাসকদের মন্ত্রিসভায় যোগদানে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি নেতাদের যেমন লাইন পড়ে যেত, তেমনি শেখ হাসিনার আশীর্বাদপুষ্ট দলের প্রার্থীর অভাব হবে বলে মনে হয় না।
তাহলে তাদের দরকষাকষির সুযোগ সঙ্কুচিত হয়ে পড়বে। সিবিএ নেতাদের আচরণের সাথে রাজনৈতিক দলের আচরণের কোনো পার্থক্য দেখা যাচ্ছে না। তবু জাতীয় নির্বাচনের পর দলীয় সরকারের অধীনে সিটি করপোরেশন নির্বাচন হলে নির্বাচনের পর রাজনৈতিক আন্দোলন ১৯৯৪-৯৬ সালের মতো হতে পারে। চলমান রাজনৈতিক সমস্যা নিরসনে অন্তর্বর্তী সরকার সফল হোক- এটিই আমজনতার প্রত্যাশা।



