শেখ হাসিনাকে কি ফেরত দেবে ভারত

ভারতকে ঘনিষ্ঠভাবে পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে। দেশটি যা বেছে নেয় সেটি নির্ধারণ করবে ন্যায়বিচারের জন্য তার সমর্থন সর্বজনীন নাকি সুবিধাজনক সময়ে ব্যবহৃত একটি রাজনৈতিক হাতিয়ার।

দক্ষিণ এশিয়ায় শেখ হাসিনাকে ঘিরে এই অঞ্চলের কূটনৈতিক দ্ব›দ্ব নাটকীয় মোড় নিয়েছে। নিরস্ত্র শিক্ষার্থীদের ওপর প্রাণঘাতী অস্ত্র দিয়ে হত্যাকাণ্ড চালানোয় দীর্ঘ এক বছর ধরে বিচারিক প্রক্রিয়ার পর দোষী সাব্যস্ত ভারতে পালিয়ে যাওয়া সাবেক এই প্রধানমন্ত্রী ভারতীয় সুরক্ষায় দেশটিতে এখনো স্বাচ্ছন্দ্যে আছেন। অন্য দিকে বন্দিবনিময়ে প্রত্যর্পণ চুক্তিটি একসময় উভয় দেশ লালন করত তার অধীনে বাংলাদেশ উত্তরের অপেক্ষায় রয়েছে।

ভারত আন্তর্জাতিকভাবে নিজেকে আইনের রক্ষক হিসেবে উপস্থাপন করে যে নাটক মঞ্চস্থ করে, মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে দণ্ডিত একজন নেত্রীকে রাজনৈতিক আশ্রয় দিয়ে তার সম্পূর্ণ বিপরীত আচরণ করছে। এই মামলা শুধু একজন ব্যক্তি সম্পর্কে নয়; এটি ভারতের বিশ্বাসযোগ্যতা, প্রত্যর্পণ আইনের সাথে তার সম্পর্ক এবং সুবিধাভোগী যখন তার দীর্ঘকালীন রাজনৈতিক প্রক্সি হয়; তখন তার ক্ষেত্রে নিজস্ব আইন প্রয়োগের ব্যাপারে দিল্লির ইচ্ছা-অনিচ্ছার একটি লিটমাস পরীক্ষা।

ভারত সর্বদা নিজেকে এমন একটি রাষ্ট্র হিসেবে তুলে ধরেছে, যারা বিশ্বব্যাপী আইনি কাঠামোর প্রতি শ্রদ্ধাশীল, বিশেষ করে প্রত্যর্পণে। বছরের পর বছর ধরে নয়াদিল্লি অপরাধী হিসেবে বিবেচিত ব্যক্তিদের ফিরিয়ে আনতে আগ্রাসীভাবে চেষ্টা চালিয়ে আসছে। ১৯৯৩ সালে মুম্বাই বোমা হামলার সাথে জড়িত আবু সালেমকে পর্তুগাল থেকে ফিরিয়ে আনার দাবি জানিয়েছিল দিল্লি। দীর্ঘ আইনি লড়াইয়ের পর ভারত তাকে দেশে ফিরিয়ে এনেছিল। দিল্লি দাউদ ইব্রাহীমের নেটওয়ার্কের সাথে যুক্ত ব্যক্তিদেরসহ সন্ত্রাসী এবং আর্থিক পলাতকদের হস্তান্তর করতে সংযুক্ত আরব আমিরাতের ওপর চাপ সৃষ্টি করেছিল। বারবার বিজয় মালিয়াও নীরব মোদিকে প্রত্যর্পণে যুক্তরাজ্যের প্রতি আবেদন জানিয়েছে। এ ছাড়া জোর দিয়ে বলেছে, রাজনৈতিক আশ্রয়ের ছদ্মাবরণে আর্থিক অপরাধ ক্ষমা করা যাবে না। যুক্তরাষ্ট্রের সাথে চুক্তির অধীনে ভারত মুম্বাই হামলায় কথিত ভূমিকায় তাহাব্বুর রানাকে ফিরিয়ে দেয়ার বিষয়টিও নিশ্চিত করেছে। এ মামলাগুলো সম্মিলিতভাবে বিবেচনা করলে উপলব্ধি করা যায় যে, কূটনীতি এবং আইনি সহযোগিতা অবশ্যই ক্ষতিগ্রস্তদের সেবা দেবে। একই সাথে ন্যায়বিচার পুনরুদ্ধার করবে- এটা ভারতের দীর্ঘস্থায়ী ও গুরুত্বপূর্ণ অবস্থান। যখনই অভিযুক্ত ব্যক্তি ভারতীয় স্বার্থে হুমকিস্বরূপ হয়, তখনই নয়াদিল্লি মানবাধিকার যথাযথ প্রক্রিয়া এবং আন্তর্জাতিক দায়দায়িত্বের আহ্বান জানায়; কিন্তু পরিস্থিতি যখন ভিন্ন হয়, তখন ভারতের নীতিগুলো লোপ পেতে শুরু করে।

২০১৩ সালের ভারত-বাংলাদেশ প্রত্যর্পণ চুক্তির অধীনে, উভয় দেশ মৃত্যুদণ্ডের শাস্তিযোগ্য অপরাধে অভিযুক্ত বা দোষী সাব্যস্ত ব্যক্তিদের ফিরিয়ে দেয়ার ক্ষেত্রে সহযোগিতা করতে বাধ্য। উলফা নেতা অনুপ চেটিয়াকে ফিরিয়ে দিয়ে বাংলাদেশ এ চুক্তির প্রতি সম্মান দেখিয়েছে। অর্থাৎ- এ চুক্তির প্রতি সম্মান দেখিয়েছে। উল্লেখ্য, ভারত প্রায় দুই দশক ধরে অনুপ চেটিয়াকে ফিরিয়ে দিতে অনুরোধ জানিয়ে আসছিল। বাংলাদেশ ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে সক্রিয় বেশ কয়েকজন বিদ্রোহী তথা স্বাধীনতাকামীকে দেশের অভ্যন্তরে সমালোচনা সত্তে¡ও ভারতের কাছে হস্তান্তর করে চুক্তির বাধ্যবাধকতা পূরণ করেছে। এখন বাংলাদেশ আশা করে যে, ভারত শেখ হাসিনার জন্য একই কাঠামো মেনে চলবে, যার সাজা আন্তর্জাতিকমান অনুসরণ করে হয়েছে। যার মধ্যে রয়েছে সাক্ষীর সাক্ষ্য, আইনি যাচাই-বাছাই এবং ২০২৪ সালের দমন অভিযানের সময় এক হাজার ৪০০ মানুষ নিহত হওয়ার ব্যাপারে মানবাধিকার সংগঠনগুলো এবং জাতিসঙ্ঘের পর্যবেক্ষকদের কাছ থেকে প্রাপ্ত প্রামাণ্য দলিল বা নথিপত্র। ভারত বাস্তবসম্মতভাবে দ্বৈত অপরাধের যুক্তি দিতে পারে না, যখন তার নিজস্ব আদালত রাষ্ট্রীয় আদেশে নিরস্ত্র ছাত্রদের হত্যা সহ্য করবে না। এখানে দ্বৈত অপরাধ বলতে রাজনৈতিক নিপীড়ন অথবা অন্যায্য বিচারের কথা বোঝানো হয়েছে।

নয়াদিল্লির দ্বিধা রাজনৈতিক, আইনি নয়। হাসিনা কেবল প্রতিবেশী একজন নেত্রী ছিলেন না, তিনি এ অঞ্চলে ভারতের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য রাজনৈতিক মিত্র ছিলেন। শেখ হাসিনা নিজের শাসনামলে ভারতকে ট্রানজিট দিয়ে অবাধ প্রবেশাধিকার, দেশটির উত্তর-পূর্বাঞ্চলের নিরাপত্তা সুরক্ষা এবং বাংলাদেশের উপকূল বরাবর ভূ-রাজনৈতিক অনন্য সংযোগ নিশ্চিত করেছিলেন। তাকে সুরক্ষা দেয়া মানবিক উদ্বেগে নয়; বরং একটি ন্যারেটিভ রক্ষা করতে। এ বয়ান হলো : ভারতের পছন্দনীয় অংশীদারদের পতন হতে পারে না। আর যদি পতন ঘটানো হয়- তাহলে অবশ্যই ভারতকে তার প্রভাব কমাতে হবে। কিন্তু এ দৃষ্টিভঙ্গি ভারতের নিজস্ব প্রত্যর্পণ ইতিহাসকে দুর্বল ও হেয় করে।

যদি আর্থিক অপরাধী, সন্দেহভাজন সন্ত্রাসী, বিদ্রোহী এবং এমনকি সাবেক সামরিক ব্যক্তিত্বদেরও চুক্তির মাধ্যমে ফেরত পাঠানো সম্ভব হয়, তাহলে একজন দোষী সাব্যস্ত দণ্ডিত সাবেক প্রধানমন্ত্রী কেন ব্যতিক্রম?

চুক্তির পছন্দনীয় ব্যাখ্যা এমন একটি দ্বৈত মানদণ্ড প্রকাশ করে যা ভারতের নৈতিকতা দুর্বল করে দেয়। সেই সাথে বড় ধরনের রাজনৈতিক সঙ্কটের মুহূর্তে ঢাকার সাথে দিল্লির সম্পর্ক ক্ষতিগ্রস্ত করার হুমকি তৈরি করে। বাংলাদেশের জনগণ এটাকে হস্তক্ষেপ হিসেবে দেখছে- সেখানে ভারতের কৌশলগত স্বাচ্ছন্দ্যকে বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বের চেয়ে প্রাধান্য দেয়া হয়েছে- এটা দিল্লির আগের ধারাবাহিকতার বহিঃপ্রকাশ।

এখন বড় প্রশ্ন হলো : ভারত কি শেখ হাসিনাকে তার সাজা ভোগ করতে বাংলাদেশের কাছে ফেরত দেবে? আইনগতভাবে প্রত্যাখ্যান করার পক্ষে দিল্লির খুব কম যুক্তিসঙ্গত কারণ রয়েছে। রাজনৈতিকভাবে যদি ভারত প্রতিরোধ করে তবে অনেকাংশে সদিচ্ছা হারাতে পারে। তরুণদের নেতৃত্বে একটি স্বৈরাচারী সরকারের শাসনের পতনকারী বিদ্রোহ থেকে জন্ম নেয়া বাংলাদেশের নতুন নেতৃত্ব, একটি আঞ্চলিক কূটনীতির প্রতিনিধিত্ব করে যা বহিরাগত আধিপত্যের প্রতি কম সহনশীল। বৈদেশিক সম্পর্কে মর্যাদা দাবি করে এমন বাংলাদেশীদের উদীয়মান প্রজন্মকে বিচ্ছিন্ন করার ঝুঁকিতে পড়বে ভারত।

দিল্লি যদি অনির্দিষ্টকালের জন্য হাসিনাকে আশ্রয় দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়, তাহলে চুক্তির ব্যাপারে প্রতিশ্রুতি লঙ্ঘন, ব্যাপক বা গণসহিংসতায় জবাবদিহিকে অবমূল্যায়ন এবং বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিচারপ্রক্রিয়ায় নিজেকে অন্তর্ভুক্ত করার অভিযোগের মুখোমুখি হবে।

তবে যদি ভারত চুক্তিকে সম্মান করে, বাংলাদেশের বিচারিক সার্বভৌমত্ব স্বীকার করে এবং ঐতিহাসিকভাবে অন্যদের ওপর আরোপিত নিয়মনীতিগুলো পুনর্ব্যক্ত করে; তাহলে তা হবে একটি ইতিবাচক দিক। যেভাবে হোক, ভারতের পছন্দ নিজেকে একটি আঞ্চলিক শক্তি হিসেবে সংজ্ঞায়িত করবে; যা হয় আন্তর্জাতিক আইন সম্মান করে। শেখ হাসিনার মামলা দক্ষিণ এশিয়াকে একটি অস্বস্তিকর বাস্তবতার মুখোমুখি হতে বাধ্য করেছে। আইন নিজের ইচ্ছা অনুসারে বেছে নেয়া যায় না এবং ন্যায়বিচারকে আঞ্চলিকীকরণ করা যায় না। বাংলাদেশ প্রাতিষ্ঠানিক স্বাধীনতা পুনরুদ্ধারে একটি কঠিন; কিন্তু সিদ্ধান্তমূলক পদক্ষেপ নিয়েছে, এর বিচার বিভাগ ভূ-রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ ছাড়া কাজ করার যোগ্য। অন্য দিকে ভারতকে অবশ্যই সিদ্ধান্ত নিতে হবে আন্তর্জাতিক সহযোগিতার ওপর বিশ্বাসযোগ্য কণ্ঠস্বর থাকতে চায় নাকি কৌশলগত পক্ষপাতিত্বের ছায়ায় ফিরে যেতে চায়। ভারতকে ঘনিষ্ঠভাবে পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে। দেশটি যা বেছে নেয় সেটি নির্ধারণ করবে ন্যায়বিচারের জন্য তার সমর্থন সর্বজনীন নাকি সুবিধাজনক সময়ে ব্যবহৃত একটি রাজনৈতিক হাতিয়ার।

লেখক : যুগ্ম বার্তা সম্পাদক, দৈনিক নয়া দিগন্ত