আলিয়া মাদরাসায় কমার্স চালু নিয়ে বিতর্ক

‘ইসলামে জ্ঞানের কোনো বিভাজন নেই। যার যেটি পছন্দ তিনি সেটি গ্রহণ করবেন। কোনো মাদরাসায় কমার্স গ্রুপ খুলতে কর্তৃপক্ষ কাউকে বাধ্য করবে না। আবার কেউ খুলতে চাইলেই খুলতে পারবে না।’

পবিত্র কুরআন ও হাদিস শরিফে মানবজাতিকে জ্ঞানার্জনের জন্য যেসব নির্দেশনা দেয়া হয়েছে তাতে জ্ঞানের কোনো শ্রেণীবিন্যাস করা হয়নি। জ্ঞানের জগতকে জাগতিক ও ইসলামী বলে আলাদা করা হয়নি। জাগতিক জ্ঞানও ইসলামী জ্ঞানেরই অন্তর্ভুক্ত। আল কুরআন ও হাদিসে বর্ণিত জাগতিক জ্ঞান, ইসলামী জ্ঞানের বাইরে হতে পারে না। ইসলামের প্রাথমিক সোনালি যুগে শিক্ষাব্যবস্থাকে ধর্মীয় ও আধুনিক বলে পার্থক্য করা হয়নি। আল কুরআন ও আল হাদিসের জ্ঞানের গুরুত্ব বিবেচনা করে সাহাবি, তাবেয়ি ও তৎপরবর্তী ইমামরা গোটা বিশ্বে জ্ঞানের মশাল জ্বালিয়ে ছিলেন। সাহাবি-পরবর্তী যুগে তাফসির জগতে আগমন করেছিলেন ইবনে কাছির (রহ:), ইমাম কুরতুবী (রহ:), ইমাম জাফর সাদিক (রহ:)-সহ অসংখ্য মুফাসসির। হাদিস শাস্ত্রে জন্ম নিয়েছিলেন ইমাম বুখারি (রহ:), ইমাম মুসলিম (রহ:), ইমাম নাসায়ি (রহ:), ইমাম তিরমিজি (রহ:) ও ইমাম আবু দাউদ (রহ:)-এর মতো জগদ্বিখ্যাত মুহাদ্দিস। ফিকহ শাস্ত্রের জন্ম দিয়েছিলেন ইমাম আবু হানিফা (রহ:), ইমাম শাফেয়ি (রহ:), ইমাম মালেক (রহ:) ও ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বল (রহ:)। চিকিৎসাবিদ্যায় আগমন করেছিলেন ইবনে সিনা (রহ:), আল-বিরুনি (রহ:), হাসান ইবনে হাইসাম (রহ:), আলী ইবনে রাব্বান (রহ:)সহ অনেক মুসলিম চিকিৎসাবিজ্ঞানী।

জন্ম নিয়েছিলেন আল-ফারগানি (রহ:), যিনি ছিলেন ফলিত প্রকৌশলের অগ্রদূত। জাবের ইবনে হাইয়ান (রহ:) ছিলেন রসায়ন শাস্ত্রের জনক। আলকেমিস্ট, জ্যোতির্বিজ্ঞানী, জ্যোতিষী, প্রকৌশলী, দার্শনিক ও পদার্থবিজ্ঞানী হিসেবেও তার খ্যাতি বিশ্বময়। আশ্চর্য ব্যাপার হলো, তাফসির, হাদিস ও ফিকহ চর্চার ধারা আজও অব্যাহত আছে। কিন্তু থমকে গেছে ইবনে সিনা, জাবির ইবনে হাইয়ান ও আল বিরুনিদের রেখে যাওয়া আবিষ্কারের ধারা। অবশ্য এর পেছনে রয়েছে দুঃখজনক কিছু ঐতিহাসিক কারণ।

মক্কা বিজয় থেকে শুরু করে পরবর্তী প্রায় এক হাজার বছরব্যাপী মুসলিমরা রাজ্যজয়, রাজ্যশাসন ও জ্ঞানবিস্তারে বিশ্বময় ইতিহাস সৃষ্টি করেন। দীর্ঘ এ শাসনক্ষমতার সময়কালে মুসলিম শাসকদের মধ্যে পারিবারিক ও রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব জন্ম নেয়। তারা ক্ষমতাকেন্দ্রিক নানা বিভাজনে বিভক্ত হয়ে পড়েন। এ বিভাজন মুসলিমদের বিজ্ঞান চর্চায় নেতিবাচক প্রভাব রাখে। এ সময় কিছু জ্ঞানী মানুষ ঝামেলা এড়াতে নির্জনে অবস্থান গ্রহণ করাকে উত্তম মনে করেন। অন্যদিকে রাজনীতিকরা ক্ষমতার লোভ ও নানা বিলাসিতায় গা ভাসিয়ে দেন। ইসলামের সঠিক প্রচার থেকে তারা দূরে সরে যান। কিন্তু জ্ঞানপিপাসু কিছু মুসলিম তাদের জ্ঞানের চর্চা চালিয়ে যান। তারা জ্ঞানের এ চর্চা থেকে ফিরে আসেননি।

বিজ্ঞানী টাইসন বলেন, ‘আমরা আকাশে যে তারকাগুলো দেখছি, সেগুলোর মধ্যে অসংখ্য তারকার নাম আরবিতে। মুসলিমরাই এগুলো আবিষ্কার করেছিলেন। তারাই এগুলোর নাম দিয়েছিলেন।’ তিনি আরো বলেন, ‘বীজগণিতের ইংরেজি নাম হলো আল-জেবরা, এটি মূলত আরবি শব্দ, যা মুসলিমরা আবিষ্কার করেছেন। আমরা কম্পিউটারের জন্য যে অ্যালগরিদম ব্যবহার করি, এটিও আরবি শব্দ। এগুলো মুসলিমদেরই আবিষ্কার।’

কিন্তু মুসলিমদের আদর্শিক পতনের পাশাপাশি উনিশ শতকে যখন ভৌগোলিক পতন শুরু হয় তখন তাদের বিজ্ঞান চর্চায়ও পতন শুরু হয়। এ সময় ইউরোপ থেকে মুসলমানরা বিতাড়িত হয়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে তুরস্ক পরাজিত হলে, অটোমান সাম্রাজ্যকে ইউরোপ ভাগ-বাঁটোয়ারা করে নেয়। তারা প্রতিটি মুসলিম ভ‚মিকে কলোনিতে রূপান্তর করে। এর ফলে চূড়ান্তভাবে মুসলমানদের কোমর ভেঙে যায়। তাদের নিজ ভ‚মিতে তৃতীয় কিংবা চতুর্থ শ্রেণীর নাগরিকের মর্যাদা দেয়া হয়। এক শতকের মাথায় পুরো মুসলিম জাতিকে তারা মূর্খ জাতিতে পরিণত করে। ভৌগোলিক আর জ্ঞানের রাজত্ব তখন ইউরোপীয়দের হাতে চলে যায়।

বলা হয়, শিক্ষাই জাতির মেরুদণ্ড। ইউরোপীয় খ্রিষ্টানরা মুসলিমদের এই মেরুদণ্ড সম্পূর্ণরূপে ভেঙে দেয়। মুসলিমরা আর সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারেনি। মুসলিম রাষ্ট্রগুলোকে তারা যে দাসত্বের শিকলে বন্দী করে তা থেকে তারা আজও মুক্ত হতে পারেনি। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে, এখন মুসলিমরাও তাদের নিজ ধর্ম ইসলামের বিরুদ্ধে ইউরোপ-আমেরিকার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। এটি হলো মুসলিম সমাজে আধুনিক শিক্ষা ও ইসলামী শিক্ষা নামে জ্ঞানের দু’টি আলাদা বিভাগ তৈরির কুফল।

সম্প্রতি বাংলাদেশের আলিয়া মাদরাসা ব্যবস্থায় বাণিজ্যিক শিক্ষা বা কমার্স গ্রুপ চালুর নীতিগত সিদ্ধান্ত হয়েছে। বিষয়টি নিয়ে আলেমদের মধ্যে বিতর্ক ও রীতিমতো ঝগড়া-বিবাদ শুরু হয়ে গেছে। তারা পরস্পরকে গালাগালি পর্যন্ত করছেন। মাদরাসায় যখন বিজ্ঞান বিভাগ চালু করার সিদ্ধান্ত হয় তখনো দেশবাসী এ ধরনের ঝগড়া দেখেছে। আইসিটি বিভাগ খোলার সময়ও একটি পক্ষ বিরোধিতা করে। কিন্তু আইসিটি এখন মাদরাসা শিক্ষার অনিবার্য বাস্তবতা।

প্রথমেই উল্লেখ করেছি, ইসলামে জ্ঞানের কোনো বিভাজন নেই। যার যেটি পছন্দ তিনি সেটি গ্রহণ করবেন। কোনো মাদরাসায় কমার্স গ্রুপ খুলতে কর্তৃপক্ষ কাউকে বাধ্য করবে না। আবার কেউ খুলতে চাইলেই খুলতে পারবে না। চাহিদা মোতাবেক সংশ্লিষ্ট মাদরাসাটি কমার্স খোলার উপযোগী হলেই কেবল শর্তসাপেক্ষে খোলা যাবে।

ইসলাম একটি পরিপূর্ণ জীবনব্যবস্থা যা যুগের চাহিদা পূরণ করে গতিশীল থাকে। তারই অংশ হিসেবে পৃথিবীতে বর্তমানে সর্বাধিক প্রচলিত অ্যাকাডেমিক বিষয় হিসেবে ব্যবসায় শিক্ষা শাখা অবশ্যই যুক্তিযুক্ত। কেউ যদি কুরআন, হাদিস ও ফিকহ বিষয়ে বিশেষজ্ঞ হতে চান তার জন্য দেশে বিকল্প ব্যবস্থা রয়েছে। এ বিষয়ে ব্যাপক ব্যুৎপত্তি অর্জন করতে চাইলে তিনি দেশের যেকোনো ধারার বড় মাদরাসা থেকে সে সুযোগ নিতে পারেন। অনেকে কমার্স শাখার কারিকুলামকে ইসলামাইজেশনের কথা বলছেন অথচ তারা বিজ্ঞান শাখার কারিকুলামের ক্ষেত্রে এ কথা বলছেন না। মনে রাখা দরকার, যুগ সন্ধিক্ষণের দাবি মোতাবেক মানবতার জন্য উপকারী কোনো জ্ঞানই ইসলামবিরোধী নয়। সুতরাং বিজ্ঞান ও ব্যবসায় শাখা ইসলামী জ্ঞানেরই অংশ। প্রচলিত কমার্স শাখার সবকিছুই ইসলামবিরোধী নয়। ব্যবহারিক কিছু বিষয় আছে যা পরিবর্তনযোগ্য। সুতরাং এ বিষয়ে তর্ক উত্থাপন করে ঝগড়া-বিবাদ কাম্য নয়। যারা কমার্স শাখার বিরোধিতা করছেন খোঁজ নিলে দেখা যাবে, তাদের অনেকেই ব্যাংকার অথবা বড় ব্যবসায়ীর সাথে মেয়ে বিয়ে দিয়েছেন। তাদের ছেলেমেয়েদের অনেকেই বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কমার্স পড়ছে।

আলিয়া মাদরাসা শিক্ষা ধ্বংসের পেছনে বিগত সরকারের ইনটেনশন ছিল- এটি সত্য। সরকারের সেই চক্রান্ত বাস্তবায়নে ইন্ধন দিয়েছে আলিয়া মাদরাসারই একটি আলেম গ্রুপ। দেশীয় ও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের ফলে মাদরাসা শিক্ষা কোণঠাসা হয়ে পড়েছিল। দেশীয় আলেমদের একটি গ্রুপ মাদরাসার নেতৃত্ব ধরে রাখেন অনেক দিন। তাদের কারণেই আলিয়া মাদরাসা সরকারি হয়নি। কারণ সরকারি হয়ে গেলে মাদরাসাকেন্দ্রিক তাদের ব্যবসায়-বাণিজ্য ও প্রভাব খর্ব হতো।

বর্তমান সরকারের বড় একটি অংশ মাদরাসা শিক্ষাকে ব্র্যান্ডিং শিক্ষাব্যবস্থায় উন্নীত করতে চায়। এ শিক্ষাব্যবস্থার ব্র্যান্ডিং ক্রাইসিস দূর করতে সরকার ইতোমধ্যে আলেমদের নিয়ে সেমিনার, সিম্পোজিয়াম ও কর্মশালা করেছে। বিগত সরকারের তৈরি করা শিরক এবং বিদাত দূরীকরণে পদক্ষেপ নিয়েছে বোর্ড কর্তৃপক্ষ। ইতোমধ্যে ৩৬টি বই পরিমার্জন প্রক্রিয়া সম্পন্ন করেছেন তারা। বইগুলো ২০২৬ সালে সিলেবাসের অন্তর্ভুক্ত হবে। এ ছাড়া মাদরাসা শিক্ষার স্বকীয়তা ফিরিয়ে আনতে প্রাণান্তকর প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন বোর্ড কর্মকর্তারা। পাশাপাশি আধুনিক যুগের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায়ও তারা বদ্ধপরিকর। ২০২৭ সাল থেকে সিলেবাসের সাথে তাই যুক্ত হবে সামগ্রিকভাবে প্রস্তুতকৃত একটি নতুন সিলেবাস। কারিগরি ও মাদরাসা শিক্ষা বোর্ডের সচিব ড. খ ম কবিরুল ইসলাম একজন মাদরাসাবান্ধব ব্যক্তিত্ব। জানা মতে, বাংলাদেশের ইতিহাসে তিনিই একমাত্র ব্যক্তি যিনি আলিয়া এবং কওমি মাদরাসার শিক্ষার উন্নয়নে নিরলস প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। অথচ তার বিরুদ্ধেও বিষোদগার করে যাচ্ছেন এক ধরনের স্বার্থান্বেষী আলেম। এটি বিবেকবান মুসলিমের জন্য যেমন বিস্ময়কর তেমনি হতাশাজনক!

লেখক : অধ্যাপক, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া।