বাংলাদেশ বর্তমানে এক রূপান্তরকালের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। একইসাথে আমরা জাতি হিসেবে ইতিহাসের এক বাঁকে দাঁড়িয়ে আছি। হয় আমরা একটি শক্তিশালী স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে অগ্রসর হবো, নয়তো নতুন ঔপনিবেশিক শক্তির ইচ্ছার দুর্বল পরনির্ভরশীল রাষ্ট্র হওয়ার ঝুঁকিতে থাকবো। ২০২৪ সালের জুলাই বিপ্লব আমাদের সামনে নতুন অধ্যায় খুলে দিয়েছে, যেখানে জনগণের আকাক্সক্ষা অনুযায়ী সমাজ ও রাষ্ট্র পুনর্গঠনের সুযোগ তৈরি হয়েছে।
কিভাবে একটি নিরাপদ রাষ্ট্র গড়া যায়: এ নিয়ে বহু গবেষণা ও আলোচনা হয়েছে। কিন্তু অতীতে সরকার কিংবা কোনো গবেষণা প্রতিষ্ঠান উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি দেখাতে পারেনি। এখন সা¤প্রতিক রাজনৈতিক পরিবর্তনের পর দেশে কাজ করার এক বিশাল ক্ষেত্র সৃষ্টি হয়েছে। একটি নিরাপদ বাংলাদেশ নির্ভর করবে সুশাসন, আইনের শাসন, চরিত্রবান ও দক্ষ নেতৃত্ব এবং শক্তিশালী প্রতিরক্ষাব্যবস্থার ওপর।
সুশাসন : সুশাসন সবসময় নিরাপদ বাংলাদেশের পূর্বশর্ত ধরা হয়। কিন্তু গত ৫৪ বছরে আমরা সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে পারিনি, ব্যতিক্রম শুধু জিয়াউর রহমানের সময়কাল। শুধু তিনি আন্তরিকভাবে একটি নিরাপদ বাংলাদেশ গড়ার চেষ্টা করেছিলেন। সেই সাথে যথেষ্ট সফলও হয়েছিলেন। কিন্তু ১৯৮১ সালে জাতির স্বার্থে তাকে নিজের জীবন উৎসর্গ করতে হয়েছে।
গণতান্ত্রিক চর্চার ব্যর্থতা : ১৯৮২ সালের মার্চে বিএনপি সরকারের মর্মান্তিক সমাপ্তির পর দেশের গণতান্ত্রিক ধারা ভেঙে পড়ে। যদিও পরবর্তীতে জনগণ স্বল্প সময়ের জন্য আবার গণতান্ত্রিক চর্চা দেখেছেন, নিরাপদ বাংলাদেশ তখনো নাগালের বাইরে ছিল। শেখ হাসিনা গণতন্ত্র ও সমাজের মেরুদণ্ড ধ্বংসে সর্বোচ্চ ভূমিকা রেখেছেন। তার পুরো ফ্যাসিবাদী আমলে জনগণ ভারতীয় প্রভাবের তিক্ত অভিজ্ঞতার স্বাদ পেয়েছেন। বাস্তবে ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার বিগত সাড়ে ১৫ বছরের শাসনামলে নিরাপদ বাংলাদেশ জনগণের কাছে কেবল স্বপ্নলোকে রয়ে যায়।
সুশাসন প্রতিষ্ঠা ও রাষ্ট্রযন্ত্রের ভূমিকা : যদি রাজনৈতিক দলগুলো আন্তরিক হয়; তবে দেশে সুশাসন প্রতিষ্ঠায় কোনো কিছু বাধা নয়। তখন সরকারের অঙ্গগুলো নিজ নিজ পথে স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারে। বিচার বিভাগ জনগণের অধিকার নিশ্চিত করতে পারে এবং সমাজে শান্তি প্রতিষ্ঠায় ভূমিকা রাখতে পারে। নির্বাহী বিভাগ সময়মতো জনগণকে সেবা দিতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হলে সুশাসন প্রতিষ্ঠা সম্ভব।
আইনের শাসন ও ন্যায়বিচার : আইনের শাসনের মাধ্যমে সমাজে ন্যায় প্রতিষ্ঠা করলে খুব সহজে জনগণের আস্থা ও বিশ্বাস অর্জিত হয়। সামাজিক ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা গেলে সমাজে শান্তি প্রতিষ্ঠা সহজতর হবে। বিচার বিভাগ যদি নির্বাহী বিভাগের প্রভাব থেকে মুক্ত হয়ে কাজ করতে পারে, তবে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা খুব সহজ।
পুলিশ সংস্কার : পুলিশ বিভাগকে সংস্কার করে জনগণবান্ধব করতে হবে, তবে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীনে রাখতে হবে। পুলিশের আলাদা স্বাধীনতার প্রয়োজন নেই, কিন্তু তাদের রাজনৈতিক হস্তক্ষেপমুক্তভাবে কাজ করার সুযোগ দিতে হবে। তখন তারা জনগণের বন্ধু হিসেবে আস্থা অর্জন করতে পারবে এবং নিরাপদ বাংলাদেশ গড়ায় বড় ভূমিকা রাখতে পারবে।
চরিত্রবান নেতৃত্ব ও প্রশিক্ষণ : নিরাপদ বাংলাদেশ তখনই সম্ভব; যখন চরিত্রবান ও যোগ্য ব্যক্তিদের জনগণের সেবায় নিয়োজিত করা হবে। যথাযথ নির্বাচন ও প্রশিক্ষণের মাধ্যমে এমন মানুষ তৈরি করা সম্ভব, যারা জনগণের সেবাকে নৈতিক দায়িত্ব হিসেবে দেখবেন।
পার্বত্য ও রোহিঙ্গা ইস্যু : পার্বত্য অঞ্চলের সমস্যা গুরুত্বের সাথে মোকাবিলা করতে হবে। ভারত সবসময় নিজেদের স্বার্থে পার্বত্য অঞ্চলের অধিবাসীদের ব্যবহার করার অপচেষ্টা করবে এটি মনে রেখে আমাদের তা পরিপক্বতার সাথে সামলাতে হবে। এক্ষেত্রে সামাজিক বন্ধনসহ প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ শান্তি প্রতিষ্ঠায় সহায়ক হতে পারে।
রোহিঙ্গা সঙ্কটও পরিপক্ব ও পেশাদারিত্বের সাথে মোকাবেলা করতে হবে। এখানে কোনো ভুলের সুযোগ নেই। আমরা ইতিহাসের এক সড়কবাঁকে দাঁড়িয়ে আছি, এ সমস্যা সমাধানে কোন পথ নেবো তা নির্ধারণ করতে হবে। যুক্তরাষ্ট্র ও চীন দুই দেশ এখানে সক্রিয় এবং প্রভাব বিস্তারে প্রতিযোগিতায় আছে। আমাদের কূটনৈতিক ভারসাম্য রক্ষা করতে হবে, যদিও এটি আমাদের কূটনীতিকদের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ।
সশস্ত্রবাহিনী : দেশের সশস্ত্রবাহিনীকে একটি শক্তিশালী যুদ্ধযন্ত্র হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। পেশাদারিত্বের সঙ্গে তাদের উন্নয়ন করতে হবে, যাতে জনগণ অনুভব করেন তারা নিরাপদ এবং আমাদের সশস্ত্রবাহিনী যথেষ্ট শক্তিশালী। যে কোনো বিদেশী আগ্রাসন মোকাবিলায় সক্ষম। সশস্ত্রবাহিনীকে অবশ্যই রাজনীতিমুক্ত রাখতে হবে। সেই সাথে স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষায় পেশাদার বাহিনী হিসেবে গড়ে তুলতে হবে।
আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক সমর্থন : আমাদের একটি শক্তিশালী প্রতিরক্ষাব্যবস্থা গড়তে হলে ন্যূনতম সমর্থন দরকার একটি আঞ্চলিক শক্তির এবং একটি আন্তর্জাতিক শক্তির, যারা আমাদের নিরাপদ বাংলাদেশ গড়তে সহায়তা করতে পারবে। তাদের সাথে দৃঢ় কূটনৈতিক সম্পর্ক ও সমর্থন অত্যন্ত জরুরি। কিন্তু এ ক্ষেত্রে আমাদের খুব ভেবেচিন্তে এবং সতর্ক পদক্ষেপ নিতে হবে।
বর্তমান সরকারের সুযোগ ও করণীয় : ড. ইউনূসের নেতৃত্বাধীন বর্তমান সরকার তার ব্যক্তিগত ভাবমর্যাদা ও সুনাম ব্যবহার করে নিরাপদ বাংলাদেশের ভিত্তি স্থাপন করতে পারে। আগামী ফেব্রুয়ারির নির্বাচনের মাধ্যমে যে রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় আসবে, তাদের এ বিষয়ে প্রস্তুতি নিতে হবে। অন্য রাজনৈতিক দলগুলোকে ভবিষ্যৎ সরকারের সাথে সহযোগিতা করতে হবে।
সিভিল সোসাইটি ও মিডিয়ার দায়িত্ব : অবশেষে, যাদের অভিজ্ঞতা ও প্রজ্ঞা আছে তাদের এগিয়ে আসতে হবে নিরাপদ বাংলাদেশ গড়ার কাজে। সিভিল সোসাইটি তাদের দায়িত্ব এড়াতে পারে না। গণমাধ্যমকেও সরকারের উদ্যোগকে সঠিক পথে পরিচালিত করার দিকনির্দেশনা দিতে হবে। আমাদের এটি করতে হবে, নিরাপদ বাংলাদেশ গড়তে হবে।