ইসলামে রাজনীতি কেবল ক্ষমতা দখল, প্রশাসনিক কৌশল বা পার্থিব সুবিধা-বিন্যাসের পদ্ধতি নয়। এতে আছে নৈতিক-জ্ঞানতাত্তি¡ক প্রকল্প, যার লক্ষ্য শরিয়তের উদ্দেশ্য (মাকাসিদ) অনুযায়ী মানবজীবনের সর্বাঙ্গীণ কল্যাণ নিশ্চিত করা। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ভাষায়, সিয়াসাত হলো সেই প্রক্রিয়া, যা সামষ্টিক সিদ্ধান্তকে নৈতিক যুক্তি, প্রজ্ঞা এবং বাস্তবভিত্তিক বিবেচনার সমন্বয় ঘটিয়ে রাষ্ট্রের আদর্শিক দিকনির্দেশনা নির্ধারণ করে।
গ্রিক রাজনৈতিক চিন্তার কেন্দ্রে ছিল paideia- অর্থাৎ নাগরিককে এমনভাবে গঠন করা, যাতে সে রাষ্ট্রের কল্যাণে নৈতিকভাবে অংশ নিতে পারে। অ্যারিস্টটল দেখান, নাগরিককে সৎ করবে রাষ্ট্র। নাগরিকের চরিত্রগঠন, তাকে কর্তব্যপরায়ণ ও যুক্তিবান বানানোই রাজনীতির মূল লক্ষ্য। প্লেটো রাষ্ট্রকে দেখেছেন একটি নৈতিক আত্মা হিসেবে। শাসকের কাজ হলো মানুষের নৈতিক শক্তি জাগিয়ে তোলা।
নৈতিক রাষ্ট্রের ধারণা ভালো। কিন্তু শাসক-আরোপিত নৈতিকতা বাস্তবে কতটুকু নৈতিকতা? গ্রিক তত্ত¡ নৈতিকতার নামে রাষ্ট্রশক্তির অধিকারকে সীমাহীন বৈধতা দেয়। যা ক্ষমতার অপব্যবহারের ঝুঁকি তৈরি করে।
ইসলাম রাষ্ট্রতত্ত¡কে আরো উন্নত, উচ্চতর নৈতিক ও দায়িত্বশীল স্তরে নিয়ে যায়। এখানে রাজনীতি হলো দায়িত্ব, ক্ষমতা নয়। এটি মাসলাহ (কল্যাণ), আদল (ন্যায়) এবং রাহমাহ (করুণা) ভিত্তিক রাজনীতি।
গ্রিক রাজনৈতিক দর্শনের নৈতিক ও আদর্শিক উৎস নিহিত ছিল মানব-যুক্তির বুনিয়াদে। গ্রিকদের মতে- লগোস হচ্ছে মানুষের যুক্তিবান প্রকৃতি, আর পলিস সেই যুক্তির নৈতিক বাস্তবায়ন। লগোস আর পলিসকে নৈতিক ঔৎকর্ষের সামগ্রিক নকশা হিসেবে ভাবার ঐতিহ্য গ্রিক রাজনীতির নীতিনির্মাণ করে। সেখানে রাজনীতি ছিল নাগরিক তৈরির শিল্প। রাজনীতি এক শিক্ষাগত ক্রিয়া- যেখানে শাসক শিক্ষক, আর রাষ্ট্র বিদ্যালয়।
কিন্তু ইসলামী রাজনৈতিক দর্শনের উৎস হলো ওহির আলো, তাকওয়ার স্বজ্ঞা এবং ইহসানের সংবেদ। ফলে রাজনীতি কেবল নৈতিকতা-চর্চার শিল্প নয়; বরং নৈতিকতার প্রতি জবাবদিহির আমানত। এর উদ্দেশ্য নাগরিক গঠন তো বটেই, তার চেয়েও গভীর উদ্দেশ্য এমন আদল প্রতিষ্ঠা যা হবে ঐশী মানদণ্ডে উত্তীর্ণ।
সুতরাং গ্রিসের কাছে রাজনীতি ছিল নৈতিক শিল্প, আর ইসলামের কাছে রাজনীতি হলো নৈতিক দায়িত্ব, আমানত। যার রক্ষণাবেক্ষণে শাসক শুধু শিক্ষক নন, বরং একই সাথে শিক্ষক, রাখাল ও আমির, যার প্রতিটি পদক্ষেপ থাকবে হিসাবের আওতায়।
গ্রিকরা নাগরিক তৈরির মাধ্যমে তাদের নৈতিক পলিস রক্ষা করতে চেয়েছিল। ইসলাম নাগরিক ও রাষ্ট্র উভয়কেই গড়ে তোলে ন্যায়-আদল এবং ইহসানের সমন্বিত মানদণ্ডে। ফলে গ্রিকদের রাজনীতি যুক্তিকেই মনে করে নৈতিকতার শেষ কথা। কিন্তু ইসলামী রাষ্ট্রচিন্তা দাঁড়ায় এক পরম নৈতিক-অনুশাসনে। যা ওহিভিত্তিক ন্যায়ের উৎসকে অবলম্বন করে প্রথম মানদণ্ড হিসেবে। তারপর মানুষের মেধা ও যুক্তি প্রয়োগের পরিসর।
ইমাম মাওয়ার্দী বিশ্বখ্যাত আল-আহকামুস সুলতানিয়্যাহ গ্রন্থে দেখান, ইসলামী রাজনৈতিক নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য হলো শরিয়াহ রক্ষা, দুনিয়া পরিচালনা এবং মানুষের কল্যাণ নিশ্চিত করা।
ইসলামী রাজনীতি একই সাথে ডিওন্টোলজিক্যাল (কর্তব্যভিত্তিক) ও টেলিওলজিক্যাল (উদ্দেশ্যভিত্তিক)। এখানে রাজনীতি একদিকে নৈতিক কর্তব্য, অন্যদিকে কল্যাণকর ফলাফলের অনুসন্ধান। গ্রিক দর্শন চাইত রাষ্ট্রের নাগরিকরা হবে নিখুঁত যুক্তিবাদী। কিন্তু ইসলাম চায় নাগরিকদের মধ্যে থাকবে তাকওয়া, আমানতদারি, ন্যায়, দয়া, ইহসান এবং আল্লাহর সামনে জবাবদিহির প্রবল বোধ। এই যোগফল রাজনীতিকে নিছক ক্ষমতার বিষয় হিসেবে দেখে না, বরং তাকে নৈতিক দায়িত্বের ইবাদতে রূপান্তর করে।
রাষ্ট্রবিজ্ঞান বলে-রাষ্ট্রের উদ্দেশ্য তিনটি স্তরে গঠিত :
১. নিয়ম-ব্যবস্থা স্থাপন (institutional order)
২. সম্পদবণ্টন ও সিদ্ধান্ত (public policy)
৩. ন্যায় ও বৈধতার ভিত্তি তৈরি (legitimacy)
ইসলামে এই তিনটিই শরিয়ার মাকাসিদ বা উদ্দেশ্যের সাথে সমন্বিত। সেখানে আছে জনকল্যাণের কেন্দ্রিকতা। ইসলামী রাজনৈতিক দর্শন দাবি করে :
রাষ্ট্রপ্রধানের প্রতিটি সিদ্ধান্ত মাসলাহা বা জনকল্যাণমুখী হতেই হবে। ইসলামী সিয়াসাতের আছে নিজস্ব অস্তিত্ব, নীতি ও শৃঙ্খলার তত্ত¡। অস্তিত্বগত বিচারে রাজনীতি হচ্ছে মানুষের খিলাফাহ-পরিচয়ের সম্প্রসারিত রূপ।
মানুষ পৃথিবীতে আল্লাহর প্রতিনিধি; তাই রাষ্ট্রও এক ধরনের নৈতিক ক্ষেত্র। যা- ক. বিশৃঙ্খলা থেকে শৃঙ্খলায়, খ. অত্যাচার থেকে ন্যায় প্রতিষ্ঠায় এবং গ. স্বার্থবিভাজন থেকে ইনসাফব্যবস্থায় অস্তিত্বগত রূপান্তর ঘটায়।
জ্ঞানতত্ত¡ীয় বিচারে রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত কেবল অভিজ্ঞতা (বসঢ়রৎরপরংস) নির্ভর নয়। বরং তা- ক. ওহি, খ. ‘আক্ল, গ. ইবার বা ঐতিহাসিক অভিজ্ঞতা ও শিক্ষা এবং ঘ. সামাজিক বাস্তবতার চারস্তরী জ্ঞানের সমন্বয়। সুতরাং, সিয়াসাত হলো শরিয়াহ-নির্দেশিত একটি প্র্যাকটিক্যাল এপিস্টেমোলজি।
নীতিতত্ত¡ (ঊঃযরপং) এর বিচারে ইসলামী রাজনীতি ফাজিলাহ-কেন্দ্রিক (ারৎঃঁব-নধংবফ) কর্মধারা। যেখানে প্রজ্ঞা, ন্যায়, সংযম-সমঝোতা, সাহস-দৃঢ়তা ইত্যাদি গুণাবলির ওপর রাষ্ট্রকর্ম চলবে।
ইমাম ইবনুল কাইয়্যিম রহ: দেখিয়েছেন, যা মানুষের জীবনকে অধিক ন্যায়পরায়ণ করে এবং তাদের কল্যাণ নিশ্চিত করে- সেটাই সত্য সিয়াসাত। এখানে রাজনীতি একদিকে একটি ফিকহি শিল্প, অন্যদিকে সামাজিক প্রকৌশল। এখানে কৌশল আছে, নীতি আছে, বাস্তবসম্মত নমনীয়তা আছে। কিন্তু সবই নৈতিক তত্তে¡র সীমার মধ্যে।
ইসলামী রাজনীতি দৃষ্টিভঙ্গির সংহতিকে গুরুত্ব দেয়। সিয়াসাতে তাই দু’টি স্তর। প্রথমত, নীতিগত স্তর। যার চাহিদা হলো, ন্যায় প্রতিষ্ঠা, অত্যাচার উৎখাত, ইসলামের লক্ষ্য অর্জন এবং কল্যাণ নিশ্চিতকরণ। এগুলো রাষ্ট্রের নৈতিক দায়।
দ্বিতীয়ত প্রায়োগিক স্তর। এখানে আছে জননীতির নকশা, অর্থনৈতিক বিতরণ, নিরাপত্তাব্যবস্থা ও সামাজিক শৃঙ্খলা। এগুলো রাষ্ট্রব্যবস্থার বাস্তব ভূমি।
রাষ্ট্র শুধু একটি রাজনৈতিক সংগঠন বা ক্ষমতার কেন্দ্র নয়। সে একটি সমন্বিত নৈতিক-সামাজিক ব্যবস্থা। যেখানে মানবসমাজের বাহ্যিক শৃঙ্খলা এবং অভ্যন্তরীণ নৈতিকতা একই ধারায় প্রবাহিত হয়। রাষ্ট্র, সরকার, সমাজ ও ব্যক্তি- এই চার স্তরের উদ্দেশ্য একত্রে যুক্ত হয় ইসলামে। গড়ে ওঠে কল্যাণমুখী সভ্যতার কাঠামো। এ দৃষ্টিকোণ থেকে ইসলামী রাষ্ট্রধারণা আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানের তুলনায় অধিক বহুমাত্রিক। কারণ এটি ক্ষমতার কৌশল নয়; বরং নৈতিক দায়িত্বের প্রকল্প।
প্রথাগত পশ্চিমা রাষ্ট্রতত্তে¡ রাষ্ট্রকে দেখা হয়- ক. ক্ষমতার বিতরণ কাঠামো হিসেবে। খ. প্রশাসনিক কর্তৃত্ব। গ. আইন প্রয়োগকারী প্রতিষ্ঠান। ঘ. রাজনৈতিক প্রতিযোগিতার ক্ষেত্র হিসেবে। কিন্তু ইসলামী রাষ্ট্রদর্শনে রাষ্ট্রের পরিচয় আরো গভীর। এখানে রাষ্ট্র হলো নৈতিকতা, সামাজিক শৃঙ্খলা, ধর্মীয় দায়িত্ব ও ন্যায়ের একটি সমন্বিত প্রতিষ্ঠান।
এ রাষ্ট্র মানবজীবনের চারটি স্তম্ভকে রক্ষা করে।
১. উচ্চতর উদ্দেশ্য (আকিদাহ ও নৈতিকতা)
২. সামাজিক শৃঙ্খলা (সাহচর্য, পরিবার, সম্প্রদায়)
৩. রাজনৈতিক শাসন (সিদ্ধান্ত, আইন, ন্যায়বিচার)
৪. অর্থনৈতিক কল্যাণ (বণ্টন, দারিদ্র্যনিবারণ)
এখানে রাষ্ট্র হলো কাঠামো; সরকার হলো সেই কাঠামোর গতিশীল প্রয়োগ।
ইসলামী রাষ্ট্রবিজ্ঞানে সরকার তিনটি মৌলিক দায়িত্ব পালন করে :
ক. নৈতিক অভিভাবকত্ব : সরকার মানুষের ধর্মীয় অধিকার রক্ষা করে। তাদের চরিত্র-উন্নয়নের অনুকূল পরিবেশ তৈরি করে। সমাজের নৈতিক দিশা নিশ্চিত করে।
খ. ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা : এটি রাষ্ট্র ও সরকারের রাজনৈতিক-আইনি মাত্রা। এখানে নিশ্চিত হবে আইনের ন্যায্যতা, অত্যাচার প্রতিরোধ, সম্পদের ন্যায্য বণ্টন ও দুর্নীতি দমন।
ইসলামী রাষ্ট্রের ঘোষিত ও বাধ্যতামূলক প্রতিশ্রুতি হলো, অন্যায়ের অবসান এবং ন্যায়ের প্রতিপালন।
গ. প্রশাসনিক দক্ষতা ও বাস্তবতা : সরকার নীতি, কৌশল ও প্রজ্ঞার সমন্বয়ে সমাজ পরিচালনা করে।
ইসলামী রাষ্ট্রে সরকার শুধুই আইন প্রয়োগকারী নয়। সে বরং ব্যবস্থাপক ও নৈতিক দিশানির্দেশক। ইসলামী রাষ্ট্রতত্ত¡ একটি টেলিওলজিক্যাল থিউরি বা উদ্দেশ্য-কেন্দ্রিক তত্ত¡। ইসলামী রাষ্ট্রও তাই।
দর্শনের ভাষায়, ইসলামী রাষ্ট্রতত্ত¡ প্রধানত তিনটি স্তরে আত্মপ্রকাশ করে। যা অন্তলোজিক্যাল, নর্মেটিভ এবং ফাংশনাল মাত্রার সমন্বয়। এই তিনটি মাত্রা মিলিত হয়ে রাষ্ট্রকে এক নৈতিক-সভ্যতামূলক সত্তায় রূপ দেয়।
১. Existential structure : ইসলামে রাজনীতি হচ্ছে সমাজের আত্মপরিচয় ও নৈতিকতা ধারণকারী কাঠামো। অস্তিত্বগত স্তরে রাষ্ট্র কেবল প্রশাসনিক বিন্যাস নয়। এটি একটি কালেক্টিভ সেলফ; এক সমষ্টিগত আত্মপরিচয়। ইসলামে রাষ্ট্র হলো উম্মাহর নৈতিক আত্মার প্রকাশ। যেখানে সমাজের ঈমান, মূল্যবোধ, আধ্যাত্মিক চেতনা এবং নৈতিক স্বভাব এক সমন্বিত ঐক্য গঠন করে। অর্থাৎ রাষ্ট্র হলো এমন এক অস্তিত্বগত ক্ষেত্র। এখানে মানুষের নৈতিক জীবন ও সামাজিক অর্থবোধ অর্থপূর্ণতা লাভ করে।
২. Normative structure : ইসলামে রাজনীতি হচ্ছে ন্যায়ের নীতি ও শরিয়াহর দিশানির্দেশ। এই স্তরে রাষ্ট্রকর্ম নিছক আইনচর্চা নয়, বরং ন্যায়ের নীতিচর্চা। এখানে শরিয়াহ কেবল বিধান নয়, বরং সে এক মোরাল গ্রামার। যা রাষ্ট্রকে নির্দেশ করে কোনটি ন্যায়, কোনটি অন্যায়; কোনটি বৈধ, কোনটি অবৈধ; কোনটি কল্যাণকর, কোনটি ক্ষতিকর।
এই স্তরে রাষ্ট্র- ক. আদলের নীতি সংরক্ষণ করে। খ. প্রত্যেকের হুকুক (অধিকারসমূহ)কে দিব্য নৈতিকতায় স্থাপন করে। গ. ক্ষমতার ব্যবহারে জবাবদিহি আরোপ করে। ঘ. নীতিকে প্রশাসনের পূর্বশর্ত করে তোলে।
এই স্তর বিশ্লেষণ করে এমন সব প্রশ্নের, যা জানতে চায়, কী হওয়া উচিত? রাষ্ট্রকে সে বলে দেয় কোথায় কখন কিভাবে কী করবে? এখানে রাষ্ট্রের প্রতিটি সিদ্ধান্তের পরীক্ষা দিতে হয়। অর্থনীতি, সমাজনীতি, দণ্ডবিধি, পররাষ্ট্রনীতিসহ যেকোনো বিষয়েরই নৈতিক মাপকাঠিতে উত্তীর্ণ হওয়া আবশ্যক।
৩. Operational structure : ইসলামী রাষ্ট্রতত্তে¡ আছে কার্যকর কাঠামো। প্রশাসন, আইন, নীতি ও শাসনপ্রক্রিয়া। এই স্তর হচ্ছে রাষ্ট্রের মানবিক ও প্রাতিষ্ঠানিক কার্যকরী দেহ। এখানে রয়েছে- ক. প্রশাসনিক শৃঙ্খলা, খ. আইন প্রণয়ন ও প্রয়োগ, গ. নীতি-নির্ধারণ, ঘ. শাসনের প্রাত্যহিক প্রক্রিয়া ঙ. সামাজিক সেবা ও কল্যাণব্যবস্থা।
অপারেশনাল স্তরটি দৃশ্যমান। কিন্তু এটি নরম্যাটিভ ও এক্সিসটেন্সিয়াল স্তরের উপর নির্ভরশীল। যদি রাজনীতির নৈতিক ভিত্তি দুর্বল হয়, তবে শাসনপ্রক্রিয়া যান্ত্রিক ও প্রাণহীন হয়ে পড়ে। আর যদি অস্তিত্বগত ভিত্তি না থাকে, তবে রাষ্ট্র জনগণের নৈতিক আত্মপরিচয় রক্ষা করতে ব্যর্থ হয়। ইসলামে অপারেশনাল স্তর মেকানিক্স নয়- বরং এটি হচ্ছে নৈতিক কার্যকারিতা।
এই যে তিন স্তর; এক্সিসটেন্সিয়াল, নরম্যাটিভ ও অপারেশনাল স্তরগুলো যখন একে অপরের সাথে সামঞ্জস্য বজায় রাখবে, তখন রাষ্ট্র তার আপন শক্তি প্রত্যক্ষ করবে। সে শুধু ক্ষমতাবণ্টনের প্রতিষ্ঠান বা আইনি কাঠামোতেই সীমিত থাকবে না, হয়ে উঠবে নৈতিক-সভ্যতামূলক সত্তা।
এটি এমন সত্তা-যার মধ্যে সমাজের আত্মপরিচয় বাস করে। যার নীতি ন্যায়ের উৎস থেকে জন্ম নেয়। যার কর্ম মানবকল্যাণে নিবেদিত। যার শাসন মানুষের নৈতিক ও বস্তুগত উন্নতির ক্ষেত্র হয়ে ওঠে। এই বহুস্তরীয় কাঠামোই ইসলামী রাষ্ট্রচিন্তাকে পাশ্চাত্যের রাজনৈতিক দর্শন থেকে আলাদা করে। ইসলাম রাষ্ট্রকে তথাকথিত সামাজিক চুক্তি বা সোশ্যাল কন্ট্রাক্ট হিসেবে দেখে না। ইসলাম রাষ্ট্রকে দেখে সামাজিক আমানত ও সোস্যাল ট্রাস্ট হিসেবে। ইসলামী রাষ্ট্রব্যবস্থায় সমাজ, রাষ্ট্র, সরকার ও ব্যক্তিকে পরস্পর প্রতিদ্ব›দ্বী নয়। এখানে সম্পর্কের স্তরগুলো পারস্পরিক নির্ভরতামূলক। প্রত্যেকে অন্যকে সম্পূর্ণ করে। কারও ভূমিকা কারও বিরুদ্ধে নয়।
এসব স্তরকে ধরে রেখেছে তিনটি সমন্বিত ভিত্তি। প্রথমত, নৈতিক সমন্বয়। ব্যক্তির জীবনে চরিত্রের বিকাশ, সমাজে পারস্পরিক সহযোগিতা, আর রাষ্ট্রে ন্যায় প্রতিষ্ঠার নীতি। এই তিনটি একসাথে মিলে একটি নৈতিক পরিবেশ তৈরি করে। মানুষের ব্যক্তিগত সততা থেকে শুরু করে রাষ্ট্রের ন্যায়ের মানদণ্ড-সবই একই নৈতিক ধারার অংশ। দ্বিতীয়ত, সামাজিক সমন্বয়। পরিবারের ভিত্তি, প্রতিবেশী সম্পর্ক, পরস্পরের দায়িত্ব ভাগ করে নেয়া এবং উম্মাহর প্রতি সচেতনতা। এসব বিষয় সমাজকে একটি সমন্বিত সামাজিক কাঠামোতে একত্রিত করে। তৃতীয়ত, রাজনৈতিক সমন্বয়। রাষ্ট্রীয় আইন, প্রশাসনিক শৃঙ্খলা এবং জনকল্যাণমূলক নীতি-এসব কার্যক্রম সমাজ ও নৈতিকতার সাথে সমন্বিতভাবে কাজ করে। রাজনীতি মুখ্যত মানুষের কল্যাণ নিশ্চিত করার জন্য রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব পালন।
রাষ্ট্রদর্শন বলে, রাষ্ট্র একটি প্রতিষ্ঠান। সে ক. আইন সৃষ্টি করে, খ. আইনের শাসন নিশ্চিত করে, গ. জনগণের নিরাপত্তা রক্ষা করে এবং ঘ. অর্থনৈতিক ও সামাজিক কাঠামো পরিচালনা করে।
কিন্তু ইসলাম রাষ্ট্রের লক্ষ্যকে আরো গভীর স্তরে নিয়ে যায়। ইসলামে রাষ্ট্র হচ্ছে একটি ন্যায়নিষ্ঠ, শূরা-ভিত্তিক ও শরিয়াহ-নির্দেশিত রাজনৈতিক সত্তা। যেখানে নির্দিষ্ট ভূখণ্ডে বসবাসকারী মানুষ বৈধ কর্তৃত্বের অধীনে থাকে এবং শাসনের সব স্তর আল্লাহর বিধানের আওতায় পরিচালিত হয়।
ইসলামী তত্তে¡ ব্যক্তি-রাষ্ট্র সম্পর্ক নৈতিক দায়িত্বের সম্প্রসারণ ঘটায়। এখানে ব্যক্তির নৈতিকতা রাষ্ট্রের নৈতিকতার ভিত্তি। রাষ্ট্রনৈতিক দায়িত্ব হচ্ছে ব্যক্তির নৈতিক দায়ের সম্প্রসারিত রূপ। এখানে ব্যক্তির চাই তাকওয়া, রাষ্ট্রের চাই আদল বা ন্যায়পরায়ণতা। ব্যক্তির চাই দায়িত্বশীলতা, রাষ্ট্রের চাই কল্যাণনীতি। ব্যক্তির চাই শুদ্ধতা, রাষ্ট্রের চাই স্বচ্ছতা।
এ সম্পর্ককে নৈতিক প্রতিফলন তত্ত¡ দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায়। মানে, যেমন ব্যক্তি, তেমন সমাজ; যেমন সমাজ, তেমন রাষ্ট্র। ব্যক্তিকে অন্ধকারে রেখে সমাজ আলোকিত হতে পারে, সমাজকে অন্ধকারে রেখে রাষ্ট্র ন্যায্য হতে পারে- ইসলাম তা স্বীকার করে না।
লেখক : কবি, গবেষক



