ইসলামী ও আধুনিক রাষ্ট্রতত্ত্ব : দায়িত্ব বনাম ক্ষমতা

ইসলামী রাষ্ট্র নিছক ক্ষমতার নয়, দায়িত্বের রাষ্ট্র। নিছক আইনের নয়, ন্যায়ের রাষ্ট্র।

আধুনিক রাষ্ট্রতত্ত্ব যেখানে রাষ্ট্রকে দেখে ক্ষমতার যন্ত্র হিসেবে, ইসলামী রাষ্ট্রতত্ত্ব দেখে দায়িত্বের কাঠামো হিসেবে। এই মৌলিক পার্থক্য থেকেই রাষ্ট্র সম্পর্কে প্রশ্নের ধরন পাল্টে যায়। আধুনিক রাষ্ট্রতত্ত্বের মুখ্য প্রশ্ন, কে ক্ষমতার ধারক? ইসলামী রাষ্ট্রতত্ত্বের মুখ্য সওয়াল, কে কী দায়িত্ব বহন করে?

থমাস হবস (১৫৮৮-১৬৭৯), ম্যাক্স ভেবার (১৮৬৪-১৯২০), কার্ল স্মিথ (১৮৮৮-১৯৮৫) প্রমুখের তত্ত্ব রাষ্ট্রকে একটি নির্দিষ্ট মানবধারণার ওপর দাঁড় করায়। এই দর্শনের প্রথম ভিত্তি হলো নৃতাত্তি¡ক সন্দেহ। মানুষকে এখানে মূলত স্বার্থপর, সহিংস ও বিশৃঙ্খল সত্তা হিসেবে কল্পনা করা হয়। ফলে তাকে নিয়ন্ত্রণ করাই রাষ্ট্রের প্রধান দায়িত্ব হয়ে ওঠে। এই নিয়ন্ত্রণের যুক্তি থেকেই জন্ম নেয় ক্ষমতাকেন্দ্রিক রাষ্ট্র।

এই ধারার দ্বিতীয় বৈশিষ্ট্য হলো নৈতিকতা থেকে ক্ষমতার বিচ্ছেদ। নৈতিকতা ব্যক্তিগত পরিসরের বিষয়; রাষ্ট্র নিরপেক্ষ, যান্ত্রিক, মূল্যহীন। রাষ্ট্রের কাজ ন্যায় প্রতিষ্ঠার চেয়ে বরং শৃঙ্খলা বজায় রাখা। আইন এখানে কোনো নৈতিক সত্যের ভাষা নয়; এটি কার্যকারিতার হাতিয়ার।

তৃতীয় এবং সবচেয়ে গভীর স্তরে আসে সার্বভৌম সিদ্ধান্তবাদ। কার্ল স্মিথ-এর বিখ্যাত সংজ্ঞা অনুযায়ী- যে আইন স্থগিত করতে পারে, সেই-ই সার্বভৌম (ঝড়াবৎবরমহ রং যব যিড় ফবপরফবং ড়হ ঃযব বীপবঢ়ঃরড়হ)। এখানে রাষ্ট্রের চূড়ান্ত পরিচয় দাঁড়ায়- আইনের ঊর্ধ্বে দাঁড়িয়ে সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষমতা। ফলে রাষ্ট্র হয়ে ওঠে এক ধরনের অর্গানাইজড ফোর্স, যেখানে ন্যায়-অন্যায় পরে আসে, আগে আসে কার্যকারিতা।

ইসলামী রাষ্ট্রতত্ত্ব এই পথ থেকে সচেতনভাবে সরে আসে। এর দার্শনিক প্রস্থানবিন্দুই আলাদা। প্রথমত, ইসলাম মানুষকে কেবল ভীত প্রাণী হিসেবে দেখে না। মানুষ এখানে নৈতিক সত্তা-মোরাল এজেন্ট। সে মুকাল্লাফ-দায়িত্বপ্রাপ্ত। এতে মানুষকে নিয়ন্ত্রণযোগ্য বস্তু নয়, বরং জবাবদিহির অধিকারী সত্তা হিসেবে ধরা হয়।

দ্বিতীয়ত, ইসলামী রাষ্ট্রতত্ত্ব নৈতিক বাস্তবতা স্বীকার করে। ন্যায় ও অন্যায় রাষ্ট্রের সৃষ্টি নয়; এগুলো সত্তাগতভাবে বাস্তব। রাষ্ট্র এগুলোর উৎপাদক নয়, রক্ষক। ফলে রাষ্ট্রের অস্তিত্ব ন্যায়ের পূর্বশর্ত নয়; বরং ন্যায়ই রাষ্ট্রের অস্তিত্বের শর্ত।

তৃতীয়ত, এখানে ক্ষমতা কোনো অধিকার নয়; ক্ষমতা একটি আমানত। শাসক ক্ষমতার মালিক নন, বরং বাহক। ক্ষমতা এখানে অধিকার নয়, বরং বোঝা; সুবিধা নয়, বরং দায়িত্ব।

এই দার্শনিক ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে ইসলামী রাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় ধারণাটি স্পষ্ট হয়। ইসলামী রাষ্ট্র ব্যক্তিগত নৈতিক দায়িত্বকে সামাজিক ও প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেয়। কিছু দায়িত্ব এমন, ব্যক্তি একা যা বহন করতে পারে না। যেমন- ন্যায়ের কাঠামো নির্মাণ, দুর্বলের সুরক্ষা, অর্থনৈতিক ভারসাম্য রক্ষা, জ্ঞানের সংরক্ষণ, মূল্যবোধের উত্তরাধিকার। রাষ্ট্র এমন দায়িত্বগুলোকে সমষ্টিগতভাবে বহন করে।

এই অর্থে রাষ্ট্র ব্যক্তিগত তাকওয়ার সম্প্রসারণ। রাষ্ট্র সামাজিক ইখলাসের অবকাঠামো। রাষ্ট্র নৈতিক বিবেকের প্রাতিষ্ঠানিক স্থিতি। রাষ্ট্র এখানে নৈতিকতার বিকল্প নয়; রাষ্ট্র নৈতিকতার বাহন।

এই কারণেই আধুনিক রাষ্ট্র ও ইসলামী রাষ্ট্রের আইনের পথ আলাদা। আধুনিক রাষ্ট্রে আইন আসে আগে। তারপর প্রয়োগ, তারপর শাস্তি। ইসলামী রাষ্ট্রে পথটি উল্টো। সেটা হলো মূল্যবোধম দায়িত্বম অভ্যাসম আইন। আইন এখানে শেষ ধাপ, প্রথম নয়। রাষ্ট্রের কাজ মানুষকে ভালো হতে মূলত বাধ্য করা নয়; বরং মূলত ভালো হওয়ার পরিবেশ তৈরি করা।

এই কাঠামোর ভেতরেই হুদুদ আছে, কিন্তু তা সমাজের কেন্দ্র নয়। শাস্তি আছে, কিন্তু তা নৈতিক শিক্ষার বিকল্প নয়। ক্ষমতা আছে, কিন্তু তা আত্মঘোষিত নয়। সবকিছুই দায়িত্বের অধীন।

এ কারণেই সার্বভৌমত্বের ধারণাও রূপান্তরিত হয়। আধুনিক রাষ্ট্রে সার্বভৌমত্ব মানে চূড়ান্ত ক্ষমতা। ইসলামী রাষ্ট্রে সার্বভৌমত্ব মানে চূড়ান্ত জবাবদিহি। রাষ্ট্র নিজেই আইনের অধীন, কারণ আইন কোনো শাসকের ইচ্ছা নয়; আইন নৈতিক সত্যের ভাষ্য।

এটি এমন এক রাষ্ট্র, যেখানে ন্যায় রাষ্ট্রকে বৈধ করে; রাষ্ট্র ন্যায়কে নয়।

এখানে মানবকল্যাণের মূল ভিত্তি মাকাসিদুশ শরিয়া (শরিয়ার লক্ষ্য-উদ্দেশ্য) ।

ইমাম আবু হামিদ গাযালী (১০৫৮-১১১১) শরীয়তের উদ্দেশ্যকে মানবকল্যাণ ও ‘মাকাসিদ’ বাস্তবায়ন হিসেবে চিহ্নিত করেছেন, যাকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে মানবনিরাপত্তার (যঁসধহ ংবপঁৎরঃু) পাঁচ ভিত্তির সাথে দেখা যেতে পারে।

ক. ধর্মের নিরাপত্তা (হেফাজতে দ্বীন)

খ. জীবনের নিরাপত্তা (হেফাজতে নাফস)

গ. আকলের নিরাপত্তা (হেফাজতে আকল)

ঘ. বংশের নিরাপত্তা (হেফাজতে নাসল)

ঙ. সম্পদের নিরাপত্তা (হেফাজতে মাল)

ইমাম গাযালীর মাকাসিদ-চিন্তা কেবল আইনতাত্তি¡ক নয়, বরং মানব-তত্ত্ব (ধহঃযৎড়ঢ়ড়ষড়মু) নির্ভর।

গাযালীর কাছে মানুষ কেবল আইন-অনুগত সত্তা নয়। বরং মানুষ হচ্ছে নৈতিক, বুদ্ধিবৃত্তিক ও আধ্যাত্মিক সত্তা।

ইসলামী মাকাসিদ তত্ত্বে পাঁচটি মৌলিক জরুরত ঘোষিত কোনো বিচ্ছিন্ন আইনগত তালিকা নয়। এগুলো হলো মানব অস্তিত্বের অন্তঃস্থ কাঠামো। যার মাধ্যমে ইসলাম মানুষকে বোঝে, গড়ে তোলে এবং রক্ষা করতে চায়। এগুলোকে যদি শুধু ‘আইন সংরক্ষণের লক্ষ্য’ হিসেবে পড়া হয়, তবে তাদের গভীর দার্শনিক শক্তি ধরা পড়ে না। আসলে এগুলো মানুষের পাঁচটি মৌলিক স্তম্ভ। স্তম্ভগুলো হচ্ছে থাকা, জানা, বাঁচা, চলা ও অর্থবহ হওয়া।

মাকাসিদের প্রথম স্তম্ভ দ্বীন। দ্বীন অবশ্যই শরিয়ত। কিন্তু এখানে কেবল ধর্মীয় আচার নয়; বরং সে একই সাথে অর্থের উৎস, মূল্যবোধের কেন্দ্র এবং অস্তিত্বের নৈতিক দিকনির্দেশ। মানুষ কেবল জীবিত থাকলেই মানুষ হয় না। কেন বাঁচছে এই প্রশ্নের উত্তর ছাড়া সে এক ধরনের জৈবযন্ত্রে পরিণত হয়। দ্বীন মানুষের জীবনে সেই ধর্মতাত্তি¡ক অক্ষ তৈরি করে, যা না থাকলে নফস, আকল, মাল- সবই লক্ষ্যহীন শক্তিতে পরিণত হয়।

দ্বিতীয় স্তম্ভ নফস। অস্তিত্ব ও নিরাপত্তা। কিন্তু এখানে নিরাপত্তা কেবল শারীরিক টিকে থাকা নয়; এটি মানুষের রহারড়ষধনরষরঃু। মানুষের জীবন এমন কিছু, যা রাষ্ট্র, সমাজ বা সংখ্যাগরিষ্ঠ মতের কাছে বলিদানযোগ্য নয়। এই ধারণা আধুনিক রাষ্ট্রে শর্তসাপেক্ষ। কিন্তু ইসলামে এটি সত্তাগত পবিত্রতা। নাফসের হেফাজত মানে-মানুষকে কেবল উপযোগের বিচারে না দেখা। বরং তাকে এমন এক সত্তা হিসেবে দেখা, যার জীবন নিজেই একটি মূল্য।

তৃতীয় স্তম্ভ আকল। আকলের হেফাজত মানে জ্ঞানচর্চা নয় কেবল, বরং বিবেচনার সক্ষমতা রক্ষাও। ইসলাম জানে-মানুষ যদি বেঁচে থাকে, কিন্তু বিচার করতে না পারে, সত্য-মিথ্যা আলাদা করতে না পারে, তবে সে সহজেই নিপীড়নের যন্ত্রে পরিণত হয়। তাই মদ, মাদক, বিভ্রম, জ্ঞানদমন- সবই আকলের ওপর আঘাত। এখানে ইসলাম আধুনিক ব্যবস্থার চেয়ে গভীরতর। আধুনিকতা তথ্য দেয়, কিন্তু প্রজ্ঞা নিশ্চিত করে না। ইসলাম আকলকে নৈতিক দায়িত্বসহ রক্ষা করে।

চতুর্থ স্তম্ভ নাসল। বংশ ও সামাজিক ধারাবাহিকতা। মানুষ কোনো বিচ্ছিন্ন পরমাণু নয়। সে প্রজন্মের সেতু। নাসলের হেফাজত মানে পরিবার, পরিচয়, উত্তরাধিকার, দায়িত্ববোধ- সবকিছুর সংরক্ষণ। আধুনিক সমাজে ব্যক্তি সর্বোচ্চ। ফলে পরিবার ভঙ্গুর। সমাজ বিধ্বস্ত। ইসলামে ব্যক্তি গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু সে উত্তরাধিকারবাহী সত্তা। নাসল ভেঙে গেলে নৈতিক স্মৃতি নষ্ট হয়। এতে সমাজ হয় স্মৃতিহীন। আর স্মৃতিহীন সমাজ সহজেই নিয়ন্ত্রিত হয়।

পঞ্চম স্তম্ভ মাল। বস্তুগত সক্ষমতা। ইসলাম বস্তুজগতকে অস্বীকার করে না, বরং তাকে নৈতিক কাঠামোর ভেতরে স্থাপন করে। মাল মানে কেবল সম্পদ নয়; এটি মানুষের কর্মক্ষমতা, স্বনির্ভরতা ও মর্যাদার ভিত্তি। দারিদ্র্য মানুষকে শুধু দুর্বল করে না- সে তাকে নৈতিকভাবে বø্যাকমেইলযোগ্য করে তোলে। তাই মালের হেফাজত মানে শোষণমুক্ত অর্থনীতি, ন্যায্য বণ্টন এবং মানব-মর্যাদা সংরক্ষণ।

এখানে আধুনিক ও ইসলামী রাষ্ট্রতত্ত্বের মূল দার্শনিক পার্থক্যটি স্পষ্ট। ইসলাম মানবনিরাপত্তাকে বোঝে চার স্তরে। ক. মেটাফিজিক্যাল (দ্বীন)। খ. সামাজিক-নৈতিক (নাসল ও আকল), গ. অস্তিত্বগত-জীবনগত স্তর (নাফস) এবং ঘ. বস্তুগত স্তর (মাল)

অন্যদিকে আধুনিক হিউম্যান সিকিউরিটি প্রধানত প্রশাসনিক ও বস্তুগত। এর মুখ্য দিক হলো খাদ্য, স্বাস্থ্য, আয়, নিরাপত্তা বাহিনী। ফলে সেখানে মানুষ নিরাপদ হতে পারে, কিন্তু থাকে অর্থহীন; বাঁচে, কিন্তু থাকে দিকহীন।

ইসলামী মাকাসিদে মানুষ কেবল রক্ষিত জীব নয়; সে উদ্দেশ্যসম্পন্ন সত্তা। এই পাঁচটি হেফাজত আসলে পাঁচটি প্রশ্নের উত্তর :

আমি কেন আছি? (দ্বীন)

আমি কি নিরাপদ? (নাফস)

আমি কি বুঝতে পারি? (আকল)

আমি কি ধারাবাহিক? (নাসল)

আমি কি সক্ষম? (মাল)

এই সমন্বয়ই ইসলামী রাষ্ট্র ও সমাজতত্ত্বের গভীরতা।

গাযালির পরে ফকিহ ও রাষ্ট্রচিন্তকেরা মাকাসিদের পরিধিকে বিস্তৃত করেছেন। ইমাম ইবনু তাইমিয়্যা (১২৬৩-১৩২৮), ইবনুল কাইয়্যিম আল-জাওযিয়্যাহ (১২৯২-১৩৫০), আবু মুহাম্মদ আল-কাসিম ইবন্ ফিররুহ আশ শাতিবী (১১৪৪-১১৯৪), মুহাম্মদ আত-তাহির ইবনু আশুর (১৮৭৯-১৯৭৩), সমকালীন গবেষক মুহাম্মদ সাদিক কাওয়াসিমি, আহমদ আর-রাইসুনি প্রমুখের হাতে বর্ধিত হয়েছে মাকাসিদের পরিসর।

ইবনু তাইমিয়্যা ও ইবনুল কাইয়্যিম দেখান, যেখানে ন্যায় আছে, সেখানেই আল্লাহর শরিয়াহ আছে। অর্থাৎ- শরিয়াহের আত্মা হচ্ছে ন্যায়। আইন হচ্ছে ন্যায়ের মাধ্যম, লক্ষ্য নয়।

ইমাম শাতিবী মাকাসিদকে দেন-ক. সামষ্টিক যুক্তি, খ. সমাজকেন্দ্রিক ব্যাখ্যা এবং গ. রাষ্ট্রীয় নীতির ভিত্তি। এখানে মাকাসিদ হয়ে ওঠে ঢ়ঁনষরপ ৎবধংড়হ।

ইবনু আশুর মাকাসিদকে যুক্ত করেন- ক. মানবিক মর্যাদা, খ. সভ্যতা বিকাশ এবং গ. স্বাধীনতা ও সৃজনশীলতা। ফলে ইসলামী রাষ্ট্রের লক্ষ্যভাষ্য আরো স্পষ্ট হয়। এই রাষ্ট্রের লক্ষ্য কেবল পাপ দমন নয়, বরং মানব সম্ভাবনার বিকাশ। তাহলে ইসলামী মাকাসিদ কি আধুনিক নাগরিক অধিকারের বিকল্প? আমরা তা মনে করি না। কারণ মাকাসিদে আছে আধুনিক নাগরিক অধিকারের চেয়ে গভীর দায়বদ্ধতা।

আধুনিক মানবাধিকার দর্শন মূলত ব্যক্তিকেন্দ্রিক। সে দাবিভিত্তিক (পষধরস-নধংবফ) এবং সে রাষ্ট্রকে সন্দেহের চোখে দেখে।

অপর দিকে ইসলামী মাকাসিদ দর্শন মূলত দায়িত্বকেন্দ্রিক। সে সম্পর্কভিত্তিক এবং রাষ্ট্রকে নৈতিক এজেন্ট হিসেবে দেখে। এখানে অধিকার আসে-নৈতিক দায়িত্ব পালনের ফল হিসেবে। স্বয়ংসম্পূর্ণ দাবি হিসেবে নয়।

কীভাবে মাকাসিদ হিউম্যান সিকিউরিটির সীমা অতিক্রম করে?

হিউম্যান সিকিউরিটির ধারণা বলে খাদ্যের কথা, স্বাস্থ্য, নিরাপত্তা ও পরিবেশের কথা। দার্শনিকভাবে এটি একটি নেগেটিভ অন্তলোজি। মানে, মানুষকে কী থেকে বাঁচাতে হবে- সেই প্রশ্নের উত্তর। এখানে মানুষকে দেখা হয়- ঝুঁকিপূর্ণ জৈব সত্তা হিসেবে। আর রাষ্ট্রকে দেখা হয়- ঝুঁঁকি ব্যবস্থাপক (ৎরংশ সধহধমবৎ) হিসেবে। এই কাঠামোতে মানুষ অর্থবাহী সত্তা নয়, বরং সে একটি ঢ়ৎড়ঃবপঃবফ ষরভব-ঁহরঃ।

ইসলামী মাকাসিদ এই সীমা ভেঙে দেয়। এটি কেবল সারভাইভাল নয়, বরং সে সিগনিফিকেন্স নিয়ে কথা বলে।

মাকাসিদের মৌলিক প্রশ্ন- মানুষ কেবল বাঁচবে কেন? সে কিসের লক্ষ্যে বাঁচবে? সে বলে, মানুষ শুধু নিরাপদ থাকতে চায় না, মানুষ উদ্দেশ্যসহ বাঁচতে চায়।

মাকাসিদ একটি পজিটিভ অন্তলোজি; মানুষ কী হয়ে উঠবে- সেই প্রশ্নের উত্তর।

ইসলামী মাকাসিদ বলে- মানুষ শুধু নিরাপদ থাকতে চায় না, মানুষ অর্থপূর্ণভাবে বাঁচতে চায়। এখান থেকে নির্মিত হয় ইসলামী রাষ্ট্রের দায়। প্রথমত, রাষ্ট্রের দায়িত্ব হলো আধ্যাত্মিক শূন্যতা পূরণ করা। মানুষকে এক অর্থপূর্ণ জীবনের পরিসরে স্থাপন করা। যেখানে জীবন কেবল বেঁচে থাকার সংগ্রাম নয়। বরং তা উদ্দেশ্য ও নৈতিক দিকনির্দেশনা বহন করে।

দ্বিতীয়ত, নৈতিক বিচ্ছিন্নতা রোধ করা। মানুষ যেন নৈতিকভাবে একা না হয়ে পড়ে। ভালো-মন্দের মানদণ্ড হারিয়ে না ফেলে। যেন মানুষকে সমাজের মধ্যে একটি নৈতিক ও সামাজিক সমন্বয় বজায় রেখে চলার সুযোগ দেওয়া হয়।

তৃতীয়ত, মানব নিরাপত্তা। মাকাসিদ চায় সামাজিক সংহতি। যেখানে মানুষ পাশাপাশি থাকে, সংযুক্ত থাকে। একই সাথে ন্যায়ের বোধ, দায়িত্ববোধ, পারস্পরিক হক এবং আমানতের সংস্কৃতি রক্ষা করে। রাষ্ট্রের ভূমিকা এখানে সেই নৈতিক ও সামাজিক বন্ধন গড়ে তোলা এবং সংহতি বজায় রাখা।

চতুর্থত, হিউম্যান সিকিউরিটি সময়কে বর্তমানকেন্দ্রিকভাবে দেখে। তার দৃষ্টি মূলত আজকের নিরাপত্তার ওপর। কিন্তু মাকাসিদ সভ্যতাগতভাবে চিন্তা করে। সভ্যতা অতীত থেকে ভবিষ্যতের দিকে প্রবহমান। তাই নাসল, জ্ঞান, নৈতিক ঐতিহ্য ও সাংস্কৃতিক স্মৃতির সংরক্ষণ করতে হবে। তা না হলে মানুষ নিরাপদ থেকেও সভ্যতাগতভাবে উদ্বাস্তু হয়ে পড়ে।

অতএব দেখা যাচ্ছে ইসলামী রাষ্ট্র কেবল একটি ওয়েলফেয়ার স্টেট নয়। সে শুধুমাত্র নিরাপত্তার যন্ত্রও নয়। সে হচ্ছে অর্থ ও নৈতিক মর্ম বহনকারী রাষ্ট্র (সবধহরহম-নবধৎরহম ঢ়ড়ষরঃু)। যা মানুষের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করে। সে মানুষকে জিজ্ঞাসা করে তুমি কতটা নিরাপদ? কিন্তু আধুনিক রাষ্ট্রের মতো সে এতেই থেমে যায় না। বরং সে জানতে চায়, তুমি কীভাবে মানুষ হয়ে উঠছ?

অতএব ইসলামী রাষ্ট্র নিছক ক্ষমতার নয়, দায়িত্বের রাষ্ট্র। নিছক আইনের নয়, ন্যায়ের রাষ্ট্র।

লেখক : কবি, গবেষক