প্রয়োজন একজন নাদির শাহের

ইরানি নেতৃত্বের স্থিতধী নেতৃত্ব-প্রজ্ঞা এবং সুচিন্তিত সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত এবং তার বাস্তবায়ন আবার নতুন করে নাদির শাহের জাগরণের কথাই স্মরণ করিয়ে দেয়। মুসলিমবিশ্ব এখন একজন নাদির শাহের আবির্ভাবের অপেক্ষায়। যিনি শুধু উপসাগরীয় ও মুসলিম জনপদ নয়, গোটা বিশ্বকে নতুন করে শান্তির সুবাতাসে ভরিয়ে দিতে পারবেন। যুদ্ধের দামামা স্তব্ধ করে দিয়ে নতুন যুগের নতুন দিনের নতুন সম্ভাবনার সূচনা করতে পারবেন।

নয়া দিগন্ত গ্রাফিক্স

‘তোমরা আল্লাহর রজ্জুকে শক্তভাবে ধরে রাখো এবং পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়ো না।’ সূরা আল ইমরানের এই নির্দেশনা ইসলামী সমাজ, রাষ্ট্রীয় এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ে মুসলিম সমাজ ও সভ্যতার ভিত রচনা করেছে। এই নীতিমালা মুসলিম জনগোষ্ঠীকে ইতিহাসের এক স্মরণীয় অধ্যায়ে রূপান্তরিত করেছিল। ফলে মুসলমানরা অর্ধেক পৃথিবীর বেশি অংশকে শাসন এবং ইসলামী সভ্যতা ও সংস্কৃতির সোনালি যুগের সূচনা করেছিলেন। জ্ঞান, বিজ্ঞান, রাজনীতি, সমরনীতি, চিকিৎসা, শিক্ষা, গবেষণায় মুসলমানরা সাফল্যের চরম শিখরে উঠে পৃথিবীকে পথ দেখিয়েছিলেন। মানবজাতির জন্য খুলে দিয়েছিলেন মানবিকতা ও সভ্যতার দুয়ার। অন্ধকারের অমানিশা পেরিয়ে খুলে দিয়েছিলেন নতুন আলোর বাতাবরণ।

‘তোমরা অবিশ্বাসীদের বন্ধুরূপে গ্রহণ করো না’ মহান আল্লাহর এ পথনির্দেশনাকে মুসলমানরা যতদিন জীবনাচারের সাথে একীভূত করে রেখেছিলেন ততদিন বিশ্বজুড়ে মুসলমানরা সভ্যতা নির্মাণের অগ্রপথিক ছিলেন। যখন এই মৌলিক নীতি থেকে তারা সরে গেছেন তখনই মুসলমানদের পতনের শুরু। নিজেদের ভেতর কলহ কোন্দল রেষারেষির পথে পথচলা শুরুর সাথে সাথে নিজেদের শৌর্য, বীর্য, ঐশ্বর্য সবই হারিয়ে অন্যের করুণার পাত্রে পরিণত হয়েছেন। অবিশ্বাসী, যারা হিংস্র শ্বাপদের মতো ওঁৎ পেতে ছিল; তারা এই সুযোগকে নিজ স্বার্থসিদ্ধির মোক্ষম হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে মুসলমানদের বিভেদ ও অনৈক্যকে আরো বাড়িয়ে দেয়ার পথ প্রশস্ত করে দেয়। এর পরিণতিতে মধ্যপ্রাচ্য তথা মুসলিম দুনিয়া আজ অগ্নিগর্ভ, অন্যের গলগ্রহ। নিজ ঘর থেকে তারা আজ বিতাড়িত।

এশিয়ায়ও এর ব্যত্যয় নয়। এখানেও মুসলমানরা আজ নিগৃহীত, অত্যাচারিত, নির্যাতিত। পৃথিবীতে এখন গৃহহীনের (রিফিউজি) প্রায় ৮০ শতাংশ মুসলিম জনগোষ্ঠী। মুসলমানরা মিয়ানমার থেকে বিতাড়িত, ভারত থেকে নিয়তই পুশইন ও বৈষম্যের শিকার। আসাম ও কাশ্মিরের মুসলমানরা নিজ দেশেই পরবাসী। ফিলিস্তিনের জনগণ শুধু উদ্বাস্তুই নয়; ওষুধ, খাবার পানি, শিশুখাদ্য ও খাদ্য সরবরাহ বন্ধ করে তিলে তিলে তাদের হত্যা করা হচ্ছে। হত্যা করা হচ্ছে প্রকাশ্যে পাখির মতো গুলি করে। কোথাও কোনো নিন্দাবাক্য উচ্চারিত হচ্ছে না; বরং ফিলিস্তিনের চতুর্দিকের মুসলিম শাসকরা ইসরাইলের দোসর হয়ে একটি জাতির, একটি জনপদের নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়াটাকে যেন উপভোগ করছে। ফিলিস্তিনি জনগোষ্ঠীর ব্যাপারে তারা নির্বিকার। সাথে সাথে কে কার চেয়ে উঁচু ইমারত তৈরি করবে তার প্রতিযোগিতায় লিপ্ত। মুসলমানদের সার্বিক কল্যাণের লক্ষ্যে গঠিত ওআইসির ৫৬ সদস্য দেশ ও ২.০৪ বিলিয়ন জনসংখ্যা গাজার জনগণের জন্য, ফিলিস্তিনের গণহত্যার ব্যাপারে, মিয়ানমারের মুসলিম বিতাড়নযজ্ঞ, কাশ্মিরের নির্যাতিত মুসলিম জনপদের জন্য কার্যকর কিছু করা তো দূরের কথা, দৃঢ়কণ্ঠে কোনো প্রতিবাদ বাণীও উচ্চারণ করতে পারেনি। জিসিসি নামক প্রতিষ্ঠান, যা পৃথিবীর অথনীতির বেশির ভাগ নিয়ন্ত্রণ করে বোবা হয়ে আছে।

ইসরাইলের ইরান আক্রমণ এবং তাদের পরমাণুবিজ্ঞানীদের হত্যা ও নির্বিচার গণহত্যা, পারমাণবিক স্থাপনা ধ্বংসের সময় উপসাগরীয় দেশগুলোর ক্ষমতাধর শাসকরা চোখে কালো পট্টি বেঁধে কানে তুলো দিয়ে রাজকীয় জীবন যাপনে ব্যস্ত। ‘তোমাদের কী হয়েছে, তোমরা কেন লড়াই করছ না আল্লাহর পথে এবং অসহায় নর-নারী ও শিশুদের জন্য?’ সূরা নিসার আল্লাহ পাকের এই নির্দেশনা আজ মুসলিম শাসকদের কাছে চরমভাবে উপেক্ষিত। কাতারে আমেরিকার সেনাঘাঁটি আক্রান্ত হওয়ার সাথে সাথেই মাত্র কয়েক ঘণ্টার নোটিশে জরুরি জিসিসি শীর্ষ সম্মেলন ডেকে আমেরিকা মুখ খোলার আগেই ইরানের নিন্দাবাদে মুখর হয়ে উঠল। অথচ এদের হাতেই মুসলিম দুনিয়ার নেতৃত্ব! এদের কথা মনে পড়লেই জাতীয় কবির কথা মনে হয়- ‘কোথা খুঁজো মুসলিম? শুধু বুনো জানোয়ার। বেঈমান জানে শুধু জানটা বাঁচানো সার।’ জি-সেভেনের ছদ্মাবরণে প্রায় পুরো পাশ্চাত্য আজ ইরানের বিরুদ্ধে একীভূত। দেখে মনে হচ্ছে- এ যেন প্রাচ্য-প্রতীচ্যের লড়াই-Clash of Civilization. তাদের প্রতিক্রিয়া এবং গাজা ভূখণ্ড অধিকৃত পশ্চিমতীর, ইরাক, সিরিয়া, লেবাননসহ ইরানে তাদের সমন্বিত ধ্বংসলীলা দেখে স্রষ্টার কাছে ফরিয়াদ করতে ইচ্ছে করছে- ‘যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিবাইছে তব আলো, তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ? বেসেছ তাদের ভালো?’

এ দিকে ইরানি নেতৃত্বের স্থিতধী নেতৃত্ব-প্রজ্ঞা এবং সুচিন্তিত সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত এবং তার বাস্তবায়ন আবার নতুন করে নাদির শাহের জাগরণের কথাই স্মরণ করিয়ে দেয়। মুসলিমবিশ্ব এখন একজন নাদির শাহের আবির্ভাবের অপেক্ষায়। যিনি শুধু উপসাগরীয় ও মুসলিম জনপদ নয়, গোটা বিশ্বকে নতুন করে শান্তির সুবাতাসে ভরিয়ে দিতে পারবেন। যুদ্ধের দামামা স্তব্ধ করে দিয়ে নতুন যুগের নতুন দিনের নতুন সম্ভাবনার সূচনা করতে পারবেন।

লেখক : চক্ষুরোগ বিশেষজ্ঞ
[email protected]