রোহিঙ্গা সঙ্কটের সমাধান কোন পথে

বাংলাদেশের বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের হাতে সম্ভবত আর বেশি সময় নেই। ফেব্রুয়ারিতে একটি অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে এই সরকার বিদায় নেবে। তার আগেই রোহিঙ্গা সঙ্কট সমাধানের একটি পথরেখা ড. ইউনূস তৈরি করে যেতে পারলে সেটি হবে বাংলাদেশের জন্য একটি বড় অর্জন।

বাংলাদেশ যেভাবে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের আশ্রয় দিয়েছে তা নিঃসন্দেহে মানবিকতার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। কিন্তু রোহিঙ্গা সঙ্কটের কোনো সমাধান না হওয়ায় এ সঙ্কট এখন বাংলাদেশের গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রধান উপদেষ্টা নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অচিরেই এই সঙ্কট সমাধানের কোনো সম্ভাবনা কি দেখা যাচ্ছে?

এখন পর্যন্ত রোহিঙ্গাদের তাদের স্বদেশে ফিরে যাওয়ার কোনো বাস্তবসম্মত আশা নেই। কিন্তু বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা রক্ষাকারী হিসেবে তার ভূমিকা পুনর্নির্ধারণের সুযোগ রয়েছে, যা মিয়ানমার এবং রোহিঙ্গা উভয়ের ভবিষ্যৎকে প্রভাবিত করতে সক্ষম।

বর্তমানে এই অঞ্চলজুড়ে গভীর অস্থিরতা বিদ্যমান। মিয়ানমারের এক সময়ের প্রভাবশালী সামরিক সরকার দেশের অধিকাংশ এলাকার নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেছে, বিশেষ করে রাখাইন রাজ্যে। সেখানে আরাকান সেনাবাহিনী এখন বেশির ভাগ শহরের ওপর তাদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে রেখেছে। এই নতুন বাস্তবতা সব কিছুকে বদলে দিয়েছে। তাই রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের প্রশ্নটি কেবল নেপিদোর সাথে আলোচনার মাধ্যমে সমাধান করা সম্ভব নয়। এতে অবশ্যই নতুন অভিনেতাদের সম্পৃক্ত করতে হবে, কারণ বাস্তবে এখন তারাই হচ্ছে প্রকৃত কর্র্তৃপক্ষ।

কিন্তু বাংলাদেশের জন্য এটি বিপদ এবং সুযোগ- দুটোই নিয়ে আসতে পারে। বিপদের বিষয়টি স্পষ্ট। সীমান্তে বরাবর যে অস্থিতিশীলতা তা কক্সবাজারেও ছড়িয়ে পড়তে পারে। আন্তর্জাতিক তহবিল হ্রাস পাওয়ার কারণে ইতোমধ্যোই শরণার্থী শিবিরগুলোতে হতাশা দেখা দিয়েছে। বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি সেখানে প্রতিদিনের খাদ্য বরাদ্দ হ্রাস করেছে। সে কারণে অপুষ্টি, পাচার এবং সহিংসতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। প্রত্যাবাসন এবং অর্থনৈতিক সঙ্কট সমাধানের জন্য একটি বিশ্বাসযোগ্য পরিকল্পনা শিগগির নেয়া না হলে শিবিরগুলোতে বিশৃঙ্খলা ছড়িয়ে পড়বে।

তবুও এখন একটি সুযোগ আছে। ড. ইউনূসের নেতৃত্বে বাংলাদেশ বিদেশে তার বিশ্বাসযোগ্যতা পুনর্নির্মাণ করতে সক্ষম হয়েছে। কারণ পূর্ববর্তী সরকারের দুর্নীতি ও দমন-পীড়নের কারণে তারা সরকারের ওপর থেকে আস্থা হারিয়ে ফেলেছিল। এ ছাড়াও ড. ইউনূস চীনের সাথে একটি ভারসাম্যপূর্ণ ও ভালো সম্পর্ক তৈরি করেছেন। কারণ মিয়ানমারের ভবিষ্যতের ব্যাপারে চীনের কৌশলগত ও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। ভারতের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ আগের অবস্থান থেকে সরে এসেছে। নয়াদিল্লি ও বেইজিংয়ের সাথে বিরল কূটনৈতিক সম্পৃক্ততা ঢাকাকে প্রতিক্রিয়া দেখানোর চাইতে নেতৃত্বদানের সুযোগ এনে দিয়েছে। মূল কথা হলো- বাংলাদেশই এই সঙ্কট মোকাবেলায় কিভাবে এগিয়ে যাবে ড. ইউনূস সেটি পুনর্বিবেচনা করতে ইচ্ছুক কিনা। বছরের পর বছর ধরে ঢাকার নীতি রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে মিয়ানমারের জান্তার ওপর চাপ সৃষ্টি করার ওপর নিবন্ধ ছিল। কিন্তু সেই কৌশল ব্যর্থ হয়েছে।

রোহিঙ্গা শরণার্থীদের ফিরে যাওয়া, নিরাপত্তা অথবা নাগরিকত্ব নিশ্চিত করার ইচ্ছা বা ক্ষমতা জেনারেলদের নেই। কিন্তু আরাকান আর্মি ও তার রাজনৈতিক শাখা ইউনাইটেড লিগ অব আরাকান, ভিন্ন মনোভাব দেখিয়েছে। রোহিঙ্গাদের সম্পূর্ণ অন্তর্ভুক্তির প্রতিশ্রুতির বিষয়টি তারা নিশ্চিত করতে না পারলেও অন্তত স্থানীয় শাসন এবং আঞ্চলিক সহযোগিতার ব্যাপারে আগ্রহ প্রকাশ করেছে। তাদের এই আগ্রহ বা প্রস্তাবটি ছোট হলেও কিন্তু একটি উল্লেখযোগ্য সুযোগ বা সূচনা বলা যায়।

বাংলাদেশ যদি আরাকান আর্মি এবং জাতীয় ঐক্য সরকার তথা নির্বাসিত বেসামরিক কোয়ালিশনের সাথে নীরবে যোগাযোগ রাখতে পারে তা হলে সঙ্ঘাত স্তিমিত হয়ে পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হলে নিরাপদ এবং পর্যায়ক্রমে প্রত্যাবাসনের একটি কাঠামো তৈরি করা শুরু করতে পারে। এ ধরনের যোগাযোগ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে একটি বার্তাও পাঠাবে; ঢাকা অন্যদের সমস্যার সমাধানের জন্য অপেক্ষা করছে না; বরং একটি টেকসই সমাধানের জন্য সক্রিয় পদক্ষেপ নিচ্ছে।

এটি মিয়ানমারের চলমান বৃহত্তর রূপান্তরের সাথেও সামঞ্জস্যপূর্ণ হবে। কেন্দ্রীয় রাষ্ট্র দুর্বল হওয়ার সাথে সাথে স্থানীয় প্রশাসনগুলো বিভিন্ন মাত্রার স্বায়ত্তশাসন নিয়ে আবিভর্ূত হচ্ছে। এই খণ্ডিত পরিবেশে ভবিষ্যতের যেকোনো নিষ্পত্তি সম্ভবত একটি একক জাতীয় চুক্তির পরিবর্তে স্থানীয় চুক্তির একটি সমষ্টির ওপর নির্ভর করবে। সীমান্তের নৈকট্য এবং মানবিক অংশীদারিত্বের কারণে বাংলাদেশ এই ব্যবস্থাগুলোর কিছু মধ্যস্থতা করার জন্য অনন্য অবস্থানে রয়েছে।

অবশ্য এ ধরনের কূটনীতি জটিল হবে। অ-রাষ্ট্রীয় শক্তির সাথে সম্পৃক্ততা, বিশেষ করে যদি বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনকে বৈধতা দেয়ার জন্য বলে বিবেচিত হয় তাহলে সঙ্কট আরো গভীরতর হবে। তাই এসব বিষয়ে অত্যন্ত সতর্কতার সাথে পদক্ষেপ নিতে হবে।

রোহিঙ্গা সঙ্কটের সমাধান এবং রোহিঙ্গাদের সার্বিক সহায়তার জন্য আন্তর্জাতিক সহায়তা অপরিহার্য। জাতিসঙ্ঘ এবং প্রধান দাতাদের অবশ্যই স্বীকার করতে হবে যে, বাংলাদেশের মানবিক সঙ্কটকে মিয়ানমারের রাজনৈতিক সঙ্কট থেকে আলাদা করা যাবে না। তহবিল ঘাটতির কারণে ইতোমধ্যে সাহায্য সংস্থাগুলোকে খাদ্য, স্বাস্থ্য ও শিক্ষা পরিষেবা কমাতে বাধ্য করা হয়েছে। নতুন করে সহায়তা না পেলে উগ্রবাদ এবং সহিংসতার ঝুঁকি বাড়বে। ড. ইউনূস তার বিশ্বব্যাপী সুনাম ব্যবহার করে বিশেষ করে ইউরোপ ও আমেরিকাসহ অন্যান্য দেশের মনোযোগ আকর্ষণের প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। সম্প্রতি কানাডার সিনেটর আতাউল্লাহজান এবং দু’জন সংসদ সদস্য ড. ইউনূসের সাথে বাংলাদেশ সফরে এসে সাক্ষাৎ করলে তিনি তাদের সামনেও রোহিঙ্গা সঙ্কটের বিষয়টি তুলে ধরেছেন।

ড. ইউনূস রোহিঙ্গা সঙ্কট নিরসনে সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। আমরা দেখেছি, গত বছর তিনি জাতিসঙ্ঘ মহাসচিবকে নিয়ে কক্সবাজারে রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবির পরিদর্শন ও তাদের সমস্যা সমাধানের সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা চালানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। তিনি জাতিসঙ্ঘ সাধারণ পরিষদে চলতি বছর রোহিঙ্গা ইস্যুটি তুলে ধরেছেন এবং বিশ্ব নেতাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়েছেন। এটি ছিল একটি অনন্য সাধারণ ও ব্যতিক্রমী উদ্যোগ।

রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের জন্য কখনো শতভাগ অনকূল পরিবেশ সৃষ্টি হবে, এমন আশা করা ঠিক হবে না। চলমান পরিস্থিতির মধ্যেই এর সমাধান খুঁজতে হবে। আন্তর্জাতিক আদালতে মিয়ানমারের গণহত্যার বিচারের ব্যাপারে ওআইসিকে সাথে নিয়ে বাংলাদেশকে যেমন তৎপর হতে হবে, তেমনি জাতিসঙ্ঘ, যুক্তরাষ্ট্র ও চীনকে সম্পৃক্ত করে মিয়ানমারের ওপর চাপ সৃষ্টির ব্যাপারেও বাংলাদেশকে সোচ্চার হতে হবে। এখানে একটি ঐতিহাসিক সুযোগ রয়েছে। বাংলাদেশ বিশ্বব্যাপী সহানুভূতির নিষ্ক্রীয় গ্রাহক থেকে আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার সক্রিয় স্থপতিতে রূপান্তরিত হতে পারে। দীর্ঘদিন ধরে মানবিক ট্র্যাজেডি হিসেবে দেখা রোহিঙ্গা সমস্যাটি বর্তমান বাস্তবতা, অন্তর্ভুক্তি ও দূরদর্শিতার ওপর ভিত্তি করে একটি নতুন ধরনের কূটনীতির ভিত্তি হয়ে উঠতে পারে।

বাংলাদেশের বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের হাতে সম্ভবত আর বেশি সময় নেই। ফেব্রুয়ারিতে একটি অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে এই সরকার বিদায় নেবে। তার আগেই রোহিঙ্গা সঙ্কট সমাধানের একটি পথরেখা ড. ইউনূস তৈরি করে যেতে পারলে সেটি হবে বাংলাদেশের জন্য একটি বড় অর্জন। যদি তার সরকার রোহিঙ্গাদের জন্য একটি নতুন পথ তৈরি করতে এবং মিয়ানমারের পশ্চিম সীমান্তকে স্থিতিশীল করতে সাহায্য করতে সফল হয়, তা হলে এটি কেবল বিশ্বব্যাপী বাংলাদেশের ভাবমর্যাদাই বদলে দেবে না, আশা জাগাবে যে; এই বিভক্তির যুগেও নীতিগত নেতৃত্ব এখনো গুরুত্বপূর্ণ।