ন্যায়ভিত্তিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় সততা-নৈতিকতা

এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণ পেতে সমাজের শিক্ষিত, বিবেকবান, সৎ ও দেশপ্রেমিক রাজনৈতিক নেতৃত্ব এবং রাষ্ট্র যন্ত্রের সাথে সংশ্লিষ্টদের সততা ও নীতিনৈতিকতা নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে। অন্যতায় অভ্যুত্থানের চেতনা বাধাগ্রস্ত যেতে পারে।

চব্বিশের অভ্যুত্থানের গৌরবগাথা বিজয়ের মধ্য দিয়ে অবশেষে ৫ আগস্ট জাতির কাঁধে চেপে বসা ফ্যাসিস্ট সরকারের প্রধান শেখ হাসিনা পালিয়ে ভারতে আশ্রয় নেন। ৮ আগস্ট নোবেল লরিয়েট ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হলে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র পুনর্গঠনের এক ঐতিহাসিক সুযোগ সৃষ্টি হয়। জাতির এই মাহেন্দ্রক্ষণে গণ-অভ্যুত্থানের সাথে সংশ্লিষ্ট ছাত্র-জনতার পক্ষ থেকে নতুন করে সংস্কারের দাবি উঠেছে।

ছাত্র-জনতার আন্দোলন চলাকালে গণ-অভ্যুত্থান-পরবর্তী রাষ্ট্রব্যবস্থার স্বরূপ কী হবে তার লিখিত কোনো ইশতেহার বা দলিল না থাকলেও রাজপথে মিছিলে, স্লোগানে, বক্তৃতায়, দেয়াললিখনে জনপ্রত্যাশাগুলোর একটি চিত্র ফুটে ওঠে, যার সারকথা ছিল বৈষম্যহীন রাষ্ট্রব্যবস্থা। আর এ ব্যবস্থা প্রবর্তনের লক্ষ্যে অন্তর্বর্তী সরকার মোট ১১টি কমিশন এবং বেশ কিছু টাস্কফোর্স ও কমিটি গঠন করে।

গঠিত এসব কমিশনের মধ্যে সংবিধান, নির্বাচনব্যবস্থা, বিচার বিভাগ, দুর্নীতি দমন কমিশন ও জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের সুপারিশের আলোকে ১৬৬টি প্রস্তাব বাস্তবায়নে গঠিত হয় জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। এ কমিশন রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে ধারাবাহিক আলোচনা শুরু করে।

আলোচনায় প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদকাল, সংসদীয় কমিটির সভাপতিত্ব, বিচার বিভাগের বিকেন্দ্রীকরণ, পুলিশ কমিশন গঠন এবং রাষ্ট্রপতি পদে নির্বাচনসহ কিছু গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে ঐকমত্যে পৌঁছালেও সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ সংশোধন, প্রধানমন্ত্রীর একাধিক পদে থাকার বিধান, দ্বি-কক্ষবিশিষ্ট সংসদ গঠন, পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন ও ক্ষমতা, রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা ও দায়িত্ব, তত্ত¡াবধায়ক সরকারের রূপরেখা ইত্যাদি বেশ কিছু বিষয়ে ভিন্নমতসহ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। ভিন্নমত রয়েছে বাস্তবায়নের পদ্ধতি নিয়েও। সুস্পষ্ট মতপার্থক্য রয়েছে নির্বাচনে পিআর পদ্ধতি নিয়ে। জামায়াত-এনসিপি পিআর পদ্ধতি নিয়ে জোরালো অবস্থান নিলেও বিএনপি এর বিরুদ্ধে।

গণভোট প্রশ্নেও ভিন্নমত স্পষ্ট। জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি নিয়েও মতবিরোধ বিদ্যমান। এর মধ্যে গত ৫ আগস্ট গণ-অভ্যুত্থানের বর্ষপূর্তি উদযাপন উপলক্ষে জাতির উদ্দেশে দেয়া ভাষণে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস ফেব্রুয়ারিতে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের ঘোষণা দেন। এর আলোকে নির্বাচন কমিশনও প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছে। ইতোমধ্যে এনসিপি প্রধান নাহিদ ইসলাম বলেছেন, নির্বাচন হয়তো ফেব্রুয়ারিতে হচ্ছে না। এর আগে নির্বাচন নিয়ে এনসিপির মুখ্য সমন্বয়ক নাসিরুদ্দীন পাটওয়ারী সাফ জানিয়ে দিয়েছেন, ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন হবে না। জামায়াতে ইসলামী এবং চরমোনাই পীরের ইসলামী আন্দোলন নির্বাচনের আগে পিআর পদ্ধতিতে ভোট, সংস্কারের জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি, মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার, লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড ইত্যাদি ইস্যু নিয়ে রাজনৈতিক মাঠ সরগরম করে চলেছে। দলগুলো প্রকারান্তরে বলার চেষ্টা করছে, এ দাবি আদায়ে প্রয়োজনে কর্মসূচি ঘোষণা করা হবে এবং দাবি না মানলে নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করার ইঙ্গিত দিয়েছে। এতে নির্বাচন নিয়ে জনমনে একধরনের বিভ্রান্তি ও ধোঁয়াশার সৃষ্টি হচ্ছে। অর্থাৎ অভ্যুত্থানের শক্তিরগুলোর মধ্যে অনৈক্যের সুর পরিলক্ষিত হচ্ছে, যা বাংলাদেশের রাজনীতিতে নতুন সঙ্কট তৈরি করতে পারে। এর ফলে করে সংস্কার ও বহু কাক্সিক্ষত গণতন্ত্রের অগ্রযাত্রা বাধাগ্রস্ত হতে পারে। বাস্তবতা হচ্ছে- জন-আকাক্সক্ষা বাস্তবায়নে গণতন্ত্রের অগ্রযাত্রা প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে সংস্কার অত্যাবশ্যক। তবে সংস্কারের সুফল পেতে সততা ও নীতিনৈতিকতা এবং দেশপ্রেমের বিকল্প নেই ।

শুধু সংস্কার কিংবা ভালো আইন প্রণয়ন করলে সমাজ ও রাষ্ট্রের রন্ধ্রে রন্ধ্রে প্রোথিত অনিয়ম, দুর্নীতি, ব্যক্তিস্বার্থ, অগণতান্ত্রিক ফ্যাসিবাদী শাসনব্যবস্থার মানসিকতা বন্ধ করা সম্ভব হবে কি না সে প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে।

দেশের বর্তমান প্রচলিত আইনে খুন ও ধর্ষণের শাস্তি মৃত্যুদণ্ড- তাই বলে খুন ও ধর্ষণ বন্ধ হয়েছে? ঘুষ, চাঁদাবাজি, দখল, দণ্ডনীয় অপরাধ, ধর্মীয় দৃষ্টিতে পাপ; তবু ঘুষ-দুর্নীতি কি বন্ধ হয়েছে? হয়নি। ফ্যাসিবাদী আচরণ নির্মূল করতে একই সাথে সবধরনের অনিয়ম, ঘুষ-দুর্নীতিমুক্ত রাষ্ট্র ও সমাজ প্রতিষ্ঠা করে সত্যিকারের গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র কায়েম করতে হলে শিক্ষিত সমাজ ও রাজনৈতিক নেতৃত্বে সততা, নীতিনৈতিকতা ও দেশপ্রেম নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে।

কারণ কানাডায় বেগমপাড়া, মালেশিয়ায় সেকেন্ড হোম ও ব্যাংক-বীমা লুট করে বিদেশে অর্থপাচার কোনো কৃষক-শ্রমিক খেটে-খাওয়া মানুষ করেননি। এর সাথে দেশের একটি শিক্ষিত অংশ জড়িত।

কাজেই এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণ পেতে সমাজের শিক্ষিত, বিবেকবান, সৎ ও দেশপ্রেমিক রাজনৈতিক নেতৃত্ব এবং রাষ্ট্র যন্ত্রের সাথে সংশ্লিষ্টদের সততা ও নীতিনৈতিকতা নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে। অন্যতায় অভ্যুত্থানের চেতনা বাধাগ্রস্ত যেতে পারে।

লেখক : আইনজীবী ও কলামিস্ট