যুক্তরাষ্ট্র ও ইরানের মধ্যে পাল্টাপাল্টি হামলার পর অবশেষে তেহরান-তেলআবিব যুদ্ধবিরতি কার্যকর হয়েছে। এর আগে গত ২৩ জুন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ঘোষণা করেন, ‘সম্পূর্ণ ও সার্বিক’ যুদ্ধবিরতি, ধাপে ধাপে কার্যকর হবে; আগে ইরান (৬-১২ ঘণ্টা), পরে ইসরাইল (১২ ঘণ্টা পর), আর ২৪ ঘণ্টার মধ্যে সঙ্ঘাত শেষ হবে। ইরান ও ইসরাইল থেকে এখন পর্যন্ত কোনো আনুষ্ঠানিক সম্মতি পাওয়া না গেলেও দুই পক্ষ এ বিষয়ে একমত হয়েই যুদ্ধবিরতি কার্যকর করেছে বলে মনে হয়। যদিও যুদ্ধবিরতির ঘোষণা দেয়ার পরও ইরানি ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন হামলা এবং ইসরাইলের বিমান হামলা চলেছে।
প্রশ্ন হলো, এই যুদ্ধবিরতি কতটা স্থায়ী হতে পারে? এ ব্যাপারে দুই পক্ষের আনুষ্ঠানিক সম্মতি বিশেষভাবে প্রয়োজন। আনুষ্ঠানিক সম্মতি না এলেও দেশ দু’টির কর্মকাণ্ড থেকে মেনে নেয়ার বিষয়টি স্পষ্ট। এই যুদ্ধবিরতি দুই পক্ষের মধ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষণও হতে পারে, আবার সীমিত সময়ের জন্য দু’পক্ষ ‘বিশ্রাম’ চাইছে বলেও যুদ্ধের বিরতির ব্যবস্থা হতে পারে। ইরান বলছে, ‘ইসরাইল যদি আক্রমণ বন্ধ করে, তবেই তারা বিরতি দেবে।’ অর্থাৎ এখন পরিস্থিতি এক ধরনের অবাধ্য দ্বিপক্ষীয় বিশ্রাম-সমঝোতার মতো।
এর পেছনে অস্থায়ী রাজনৈতিক কূটনীতি কাজ করেছে বলেও মনে হয়। মার্কিন-কাতার মধ্যস্থতায় আলোচনায় যুদ্ধ ঘিরে বেশ চাপ সৃষ্টির আলামত ছিল যার বাস্তব প্রভাব মাঠে আলাদাভাবে দেখা গেছে। এমনকি ইরানের পরমাণু কেন্দ্রসমূহে যুক্তরাষ্ট্রের বোম্বার বি-২ এর হামলা এবং কাতারের মার্কিন ঘাঁটিতে পাল্টা হামলার মধ্যেও গোপন বোঝাপড়া থাকতে পারে বলে মনে হয়। দু’পক্ষের জনগণকে শান্ত করার জন্য এই ধরনের প্রকাশ্য কিছু ইভেন্টের প্রয়োজন হয়ে থাকতে পারে।
কী হবে আগামী দিনে
যদি উভয় পক্ষ অব্যাহতভাবে আক্রমণ বন্ধ রাখে, তবে যুদ্ধবিরতি টেকসই হতে পারে। আর যদি আক্রমণ অব্যাহত থাকে, বিশেষ করে একে অপরকে অভিযুক্ত করতে থাকে, তাহলে এই ‘বিরতি’ হতে পারে শুধু একটা কূটনৈতিক বিরতি। তবে সব পক্ষ সম্ভবত এখন যুদ্ধ চালিয়ে যেতে চাইছে না। এর আগে ২২ জুন সকালে, মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ট্রুথ সোশ্যালে একটি পোস্টে, তিনটি ইরানি পারমাণবিক স্থাপনায় তার নির্দেশিত আক্রমণকে অত্যন্ত সফল বলে বর্ণনা করে উল্লেখ করেন যে, ইরানের ফোর্দো পারমাণবিক স্থাপনায় বাঙ্কার বাস্টার বোমা ফেলা হয়েছে। ফক্স নিউজ জানায়, যুক্তরাষ্ট্র ইসফাহান ও নাতানজে পারমাণবিক স্থাপনায় সাবমেরিন থেকে ৩০টি টমাহক ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করেছে।
ইরানে আমেরিকার সরাসরি আক্রমণে যুদ্ধ ‘আঞ্চলিকীকরণ’ পর্যায়ে পৌঁছে যায়। এর মাধ্যমে আবারো প্রমাণ হয় যে, আমেরিকায় যে-ই ক্ষমতায় থাকুক না কেন তার ওপরই ইসরাইলের নিয়ন্ত্রণ রয়েছে। এতে বোঝা যায় ট্রাম্প মুখে যাই বলুক, বাস্তবে তারা ইহুদি লবির কাছে আত্মসমর্পিত।
ইরান এই আক্রমণে আত্মসমর্পণ করেনি, পাল্টা হামলা চালিয়েছে মার্কিন ঘাঁটিতে। দেখা যাচ্ছে, এই পাল্টাপাল্টি আক্রমণে যুদ্ধের বিস্তার না ঘটে সমঝোতার পথ তৈরি হয়েছে। এতে স্পষ্ট যে, আমেরিকাকে একটি ধ্বংসাত্মক যুদ্ধে টেনে এনে দুর্বল করার পরিকল্পনার ফাঁদে ট্রাম্প পড়তে চাননি। যুদ্ধ দীর্ঘায়িত হলে ইরানকে সব ধরনের সহায়তা দিতে পারে চীন ও রাশিয়া। রাশিয়ার সাবেক প্রেসিডেন্ট মেদভেদেভ এমনও বলেছিলেন, অনেক দেশই ইরানকে পারমাণবিক ওয়ারহেড দেয়ার প্রস্তাব করেছে।
ইসরাইলের উপর ইরানের আক্রমণ শুরু থেকেই প্রত্যাশার বাইরে ধ্বংসাত্মক ছিল। যুদ্ধ অব্যাহত থাকলে আক্রমণ পাল্টা আক্রমণ আরো ধ্বংসাত্মক হয়ে উঠতে পারে। ইরান আক্রান্ত হওয়ার পর আমেরিকান স্থাপনায় আঘাত করেছে। এর আগে, দেশটি বলেছে আমেরিকান সব ধরনের স্থাপনা ও স্বার্থে আঘাত করার আইনি অধিকার এখন ইরানের সৃষ্টি হয়েছে। এটি তেহরান সংরক্ষণ করবে এবং সময়মতো ব্যবহার করবে।
ইরানের সামনে দুই বিকল্প
নতুন পরিস্থিতিতে ইরানের সামনে এখন দু’টি বিকল্প ছিল। যুদ্ধে আমেরিকাকে আরো বেশি করে জড়িত করা অথবা কেবল ধ্বংসাত্মক আক্রমণের জন্য ইসরাইলকে আঘাত করে যাওয়া। দ্বিতীয় বিকল্পটি ইরানের জন্য অধিকতর কার্যকর ফলাফল বয়ে আনতে পারত। ইরান সেই বিকল্পটিকে অগ্রাধিকার দিতে চায় যাতে ইরান আক্রমণ অব্যাহত রাখলে ইসরাইলিদের জীবন অসহনীয় হয়ে ওঠে। এ জন্য রাশিয়া, চীন এবং আঞ্চলিক দেশগুলো ইরানের বিমান প্রতিরক্ষাব্যবস্থা শক্তিশালী করার জন্য আলোচনা শুরু করে।
ইরান ট্রাম্পের চাপে নতি স্বীকার করেনি। আমেরিকান বিশ্লেষক ফরিদ জাকারিয়া মনে করেন, ট্রাম্পের দরকষাকষির প্রস্তাবে রাজি না হওয়ায় ইরানের পরমাণু প্রকল্পে যুক্তরাষ্ট্র আঘাত করেছে। ইব্রাহিম কারগুলের মত অনেক বিশ্লেষক মনে করেন, নতুন পরিস্থিতিতে ইরান যদি পিছিয়ে পড়ে, তাহলে এটি ভেঙে পড়বে। আর ইরানের পিছিয়ে পড়া এ কারণে উচিত নয় যে, ইসরাইল দীর্ঘ সময় ধরে এ ধরনের যুদ্ধ চালিয়ে যেতে পারবে না। এর জন্য তাকে চড়া মূল্য দিতে হবে।
তুরস্ক এমনকি পাকিস্তানও জানে যে সমস্যাটি কেবল ইরানের নয়, বরং সমগ্র অঞ্চলের। আমেরিকা ইসরাইলের ইচ্ছা পূরণে ইরানে বোমা বর্ষণ করেছে। ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রীর আরেকটি ঘোষিত ইচ্ছা হলো পাকিস্তানকে পরবর্তী লক্ষ্যবস্তু করা। আর অব্যাহত ইসরাইলি নেতিবাচক মন্তব্যের পর তুর্কি প্রেসিডেন্ট এরদোগান তার দেশকে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। এই বাস্তবতা আঞ্চলিক স্তরে কিছু প্রতিরোধের ভিত্তি দ্রুত স্থাপন করার দাবি রাখে।
ইরান এর মধ্যে হরমুজ প্রণালী বন্ধের ইঙ্গিত দেয়। যা বিশ্ব অর্থনীতিতে আঘাত হানতে ও যুদ্ধের গতিপথ নির্ধারণ করতে পারে। এ ছাড়া ইরানি সংসদ পরমাণু প্রতিরোধী চুক্তি (এনপিটি) থেকে বেরিয়ে আসার সিদ্ধান্ত অনুমোদন করে। রাষ্ট্রপতি ট্রাম্পের দাবির সাথে ‘আপস’ করার পরিবর্তে, ইরানের নেতৃত্ব পারমাণবিক অস্ত্রবিস্তার রোধ চুক্তি থেকে সরে আসা এবং আন্তর্জাতিক পারমাণবিক শক্তি সংস্থার পরিদর্শকদের বহিষ্কার করার মতো আক্রমণাত্মক পদক্ষেপ নেবে বলে ধারণা করা হয়। এ ধরনের পদক্ষেপ নেয়া হলে, ইরানি জনগণের মধ্যে জাতীয়তাবাদী মনোভাব জেগে উঠবে এবং সরকারের জনপ্রিয়তা বাড়বে। এর ফলে সাম্প্রতিক ইসরাইলি ও আমেরিকান হামলার ফলে ব্যাপক মানবিক, সামরিক এবং বস্তুগত ক্ষতি সত্ত্বেও সরকার তার ক্ষমতা বজায় রাখতে পারবে।
আল-আহরাম সেন্টার ফর পলিটিক্যাল অ্যান্ড স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ইউনিটের প্রধান ড. আহমেদ কান্দিল উল্লেখ করেন, সাম্প্রতিক মার্কিন আক্রমণ তেহরানের শাসকগোষ্ঠীর ওপর একটি ‘শক্তিশালী আঘাত’ হলেও এতে সম্ভবত সরকারের পতন ঘটবে না। এতে ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি সাময়িক ‘নিষ্ক্রিয়’ হলেও তা অব্যাহত থাকার সম্ভাবনা রয়েছে। ফলস্বরূপ, মধ্যপ্রাচ্য আরো অস্থিতিশীল এবং বিশৃঙ্খল হয়ে উঠবে।
তিনি মনে করেন, যদি ইরানি শাসনব্যবস্থা টিকে থাকে এবং সীমিত পারমাণবিক কর্মসূচি অব্যাহত থাকে, তবে তেলআবিবে রচিত এবং ওয়াশিংটন কর্তৃক বাস্তবায়িত ব্যর্থ পরিকল্পনা থেকে বিপদ বাড়তে পারে। এমনকি যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরাইল ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি ধ্বংস করা এমনকি ইসলামী প্রজাতন্ত্রকে উৎখাতের স্বল্পমেয়াদি লক্ষ্য অর্জনে সফল হলেও, এগুলো মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদে ‘অলীক’ এবং অস্থায়ী অর্জন হতে পারে। ধ্বংসপ্রাপ্ত পারমাণবিক সরঞ্জাম ও স্থাপনাগুলো পুনর্নির্মাণ করা যেতে পারে এবং বর্তমান ইরানি নেতৃত্ব আরো চরম এবং আক্রমণাত্মক নেতৃত্ব দ্বারা প্রতিস্থাপিত হতে পারে।
এ কারণে যুক্তি দেয়া যেতে পারে যে, ইরানের পারমাণবিক স্থাপনায় আক্রমণ চালানোর ট্রাম্পের সিদ্ধান্ত একটি ‘বিশাল ঝুঁকি’ যা আঞ্চলিক এবং আমেরিকান নিরাপত্তাকে একটি ‘বেপরোয়া জুয়ার’ ফলাফলের ওপর নির্ভরশীল করে তুলবে। এটি যুক্তরাষ্ট্রকে মধ্যপ্রাচ্যে টেনে আনতে পারে এবং আরেকটি বৈদেশিক নীতিগত বিপর্যয় তৈরি করতে পারে, যা কয়েক দশক ধরে আমেরিকানদের তাড়া করবে।
ইরানের পরমাণু সক্ষমতা
ইরানের পরমাণু সক্ষমতা নিয়ে এখনো ধোঁয়াশা আছে। ইরানে ১৫টি পারমাণবিক অস্ত্রের জন্য পর্যাপ্ত পরিমাণে সমৃদ্ধ ইউরেনিয়াম মজুদ থাকার খবর পুরনো। এমনকি দেশটির ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র উৎক্ষেপণ অঞ্চলে সাম্প্রতিক ৫-এর অধিক মাত্রার অপ্রাকৃতিক ভূমিকম্পকে ইরানের পরমাণু পরীক্ষা চালানোর কারণে ঘটে থাকতে পারে বলে ধারণা করা হয়। আর সেটি হলে ইরান যেকোনো সময় নিজেকে পরমাণু শক্তিধর হিসেবে ঘোষণা করতে পারে। ধারণা করা হয়, ট্রাম্প পাকিস্তানি ফিল্ড মার্শাল আসিম মুনিরকে হোয়াইট হাউজে ভোজে আমন্ত্রণ করে ইরানি পরমাণু ও ব্যালিস্টিক কর্মসূচি নিয়ে আপসরফার প্রস্তাব দেন। ইরান সে প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করায় তার পরমাণু কেন্দ্রে আমেরিকান হামলার ঘটনা ঘটে।
নেতানিয়াহু জানতেন, দুই শতাধিক ইসরাইলি বিমান, ৩৩০টি যুদ্ধাস্ত্র এবং ১০০টি লক্ষ্যবস্তু নিয়ে হামলা ছিল সর্বাত্মক যুদ্ধের ঘোষণা। ডোনাল্ড ট্রাম্প হামলা করে কেবল ইসরাইলের হামলায় সমর্থন দেননি; বরং এটিকে ‘চমৎকার’ এবং ‘খুব সফল’ বলেও বর্ণনা করেন। ট্রাম্প ইরান সঙ্কটকে ব্যবহার করেছেন তেহরানকে আলোচনায় চাপ দেয়ার জন্য। বলেছিলেন, ‘এখনই আমার সাথে কথা বলুন, নইলে আমার অস্থির মিত্রের কাছ থেকে আরো আক্রমণের মুখোমুখি হোন।’ এটি এমন ধরনের জবরদস্তিমূলক কূটনীতি যা কাজ করতে পারে, তবে এটি দর্শনীয়ভাবে বিস্ফোরিতও হতে পারে।
বহুমাত্রিক সঙ্ঘাত ছড়িয়ে পড়া
যুদ্ধবিরতি ভেঙে গেলে ইরান ইরাক, সিরিয়া এবং উপসাগরে মার্কিন ঘাঁটিতে বড় আকারের ক্ষেপণাস্ত্র এবং ড্রোন হামলা চালানোর পাশাপাশি তার মিত্রদের নিয়ে হরমুজ প্রণালী অবরোধ করতে পারে। এর পাশাপাশি এই অঞ্চলে মার্কিন ও ইসরাইলি দূতাবাস ও স্বার্থে আক্রমণ করার নির্দেশ দিতে পারে। এতে কয়েক দিনের মধ্যে তেলের দাম ১৫০ ভাগ বাড়বে। ইরানের পারমাণবিক স্থাপনায় বোমা হামলায় (যেমনটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র করেছে), যদি আমেরিকা কোণঠাসা বোধ করে তবে অপ্রচলিত অস্ত্র ব্যবহারের সম্ভাবনা রয়েছে। এতে আমেরিকা সর্বাত্মক যুদ্ধের অবস্থায় প্রবেশ করবে, ইরানের অবকাঠামো, বিমান হামলা এবং বিমানবাহী বাহক ব্যবহারের ওপর বৃহৎ আকারের সাইবার আক্রমণ ছাড়াও, ব্যাপক হতাহতের ঝুঁকি রয়েছে।
সীমিত যুদ্ধের পর ইরান ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে যদি সরাসরি যুদ্ধ হয়, তা হলে পুরো অঞ্চলজুড়ে এক বহুমাত্রিক সঙ্ঘাত ছড়িয়ে পড়তে পারে। রাশিয়া ও চীন ইরানের পক্ষে অবস্থান নিতে পারে এবং জাতিসঙ্ঘ নিরাপত্তা পরিষদে যুক্তরাষ্ট্রের পদক্ষেপের বিরোধিতা করতে পারে। এমনকি ইউরোপ বিভক্ত প্রতিক্রিয়া দেখাতে পারে। কেউ মার্কিন হামলা সমর্থন করবে, কেউ শান্তির আহ্বান জানাবে।
ইরানের পারমাণবিক বা সামরিক স্থাপনায় মার্কিন হামলার দিনই জাতিসঙ্ঘ, চীন, রাশিয়া, ইইউ তীব্র প্রতিক্রিয়া জানায়। ইরান সরকার ও রেভুল্যুশনারি গার্ড জরুরি বৈঠকে বসে। হুতি ও অন্যান্য প্রক্সি বাহিনী সক্রিয় হয়ে ওঠার ঘোষণা দেয়। সপ্তাহ কালের মধ্যে ইরান ব্যাপক সাইবার আক্রমণ শুরু করতে পারে আমেরিকার আর্থিক ও জ্বালানি খাতে। এর মধ্যে মার্কিন কংগ্রেস সদস্য ও সিনেটররা ট্রাম্পের ইরান আক্রমণের সিদ্ধান্তের সমালোচনা শুরু করেছেন। ট্রাম্পের আমেরিকা ফার্স্ট বলয় থেকেও যুদ্ধে জড়ানো নিয়ে সমালোচনা বাড়ছে।
তিন সম্ভাবনা
ইউনিভার্সিটি অব উইসকনসিন-ম্যাডিসনের ইনস্টিটিউট অব রিজওনাল অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজের উপদেষ্টা সুলতান মুহাম্মদ জাকারিয়ার একটি মন্তব্য বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। তিনি মনে করেন, যুক্তরাষ্ট্র ইসরাইল-ইরান যুদ্ধে যোগ দিলে তিনটি বড় ঘটনা ঘটতে পারে।
প্রথমত. ইসরাইলের কোন দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধে জেতার সম্ভাবনা শূন্যের কাছাকাছি। তারা সর্বশেষ বিকল্প হিসেবে (স্যামসন অপশন) ইরানে পারমাণবিক বোমা হামলা চালাতে পারে। তবে তা তাদের চূড়ান্ত পরাজয় ঠেকাতে পারবে বলে মনে হয় না।
দ্বিতীয়ত. প্রলম্বিত যুদ্ধে ইরান একটি অকার্যকর রাষ্ট্র হয়ে পড়তে পারে। এর সব গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামো ধ্বংস হয়ে যেতে পারে। কিন্তু ‘মাটির নিচের ইরান’ প্রতিরোধ যুদ্ধ চালিয়ে যাবে, যার প্রভাব হবে সুদূরপ্রসারী।
তৃতীয়ত. আমেরিকান সাম্রাজ্যের পতন হবে এবং আমেরিকা একটি দীর্ঘস্থায়ী অভ্যন্তরীণ ভ্রাতৃঘাতী সঙ্ঘাতে জড়িয়ে পড়বে। আমেরিকান জায়নবাদের যবনিকাপাত হবে ও তারা নতুন আশ্রয়ের সন্ধানে ছুটবে। প্রতিটি ঘটনার পরিণতি হবে সুদূরপ্রসারী।
সুলতান জাকারিয়া মনে করেন, যুক্তরাষ্ট্র বছরের পর বছর যুদ্ধ চালিয়ে ইরাক ও আফগানিস্তানের মতো ইরানের ব্যাপারেও রণে ক্ষান্ত দেবে ইরাক যুদ্ধের চেয়ে কয়েকগুণ বেশি ক্ষয়ক্ষতি মেনে নিয়ে। মনে রাখতে হবে, ইরাক যুদ্ধে আমেরিকা প্রায় দুই ট্রিলিয়ন ডলারের বেশি খরচ করেছে; অর্থাৎ একটি প্রলম্বিত ইরানযুদ্ধে আমেরিকাকে ৮-১০ ট্রিলিয়ন ডলার খরচ করতে হতে পারে। এই অঙ্কটি আমেরিকার বর্তমান জিডিপির প্রায় এক-তৃতীয়াংশ। আর সেটি করলে আমেরিকান অর্থনীতি কার্যত দেউলিয়া হয়ে যাবে। অনুমান করা যায় যে, আমেরিকা যদি ইরানযুদ্ধে জড়িয়ে বড় ধরনের ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হয়, আমেরিকার প্রগতিশীল ও রক্ষণশীল উভয় অংশ মিলে সারা আমেরিকায় জায়নবাদের বিরুদ্ধে প্রচণ্ড ঘৃণা উৎপাদন করবে।
আমেরিকার পরাজয়ে কেবল আমেরিকান সাম্রাজ্য ক্ষতিগ্রস্ত হবে না, এটি আমেরিকার অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে বিপজ্জনক পরিস্থিতি তৈরি করবে। তাতে আরেকটি ওয়াইমার রিপাবলিক পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে, যেখানে সাধারণ আমেরিকানরা ইসরাইলের এই যুদ্ধে আমেরিকাকে জড়ানো ও রাষ্ট্রকে দেউলিয়া করার ‘অপরাধে’ জায়নবাদীদের দায়ী করবে এবং তাদের ওপর প্রচণ্ড আক্রোশ নিয়ে হামলে পড়বে। ঠিক যেমনটি হিটলারের সময় জার্মানিতে ঘটেছিল।
[email protected]