এশিয়ায় ঘুরছে জেন-জি ভূমিকম্প

বলা হচ্ছে, শ্রীলঙ্কা, বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের মতো প্রতিবেশী দেশগুলোতেও একই ধরনের আঞ্চলিক অস্থিরতা দেখা গেছে।

জেন-জির বিস্ফোরণে দক্ষিণ এশিয়া প্রকম্পিত। এখন পর্যন্ত মুক্ত কেবল ভারত। তবে শঙ্কামুক্ত নয়। শনির চক্কর তার ওপর। জেন-জি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের সংযুক্তিতে বেড়ে ওঠা এক আধুনিক নতুন প্রজন্ম। তাদের ক্ষোভের সর্বশেষ শিকার নেপালের একরোখা সরকার। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম নিষিদ্ধ করার সিদ্ধান্ত ছিল এই বিক্ষোভের সূচনা। অল্প সময়ের মধ্যেই তা রূপ নেয় দুর্নীতিবিরোধী অভ্যুত্থানে। তাদের চাপে বাংলাদেশের শেখ হাসিনা বা শ্রীলঙ্কার রাজাপাকসের মতো পরিণতি হয় নেপালের প্রধানমন্ত্রী কে পি শর্মা অলির।

২০২২ সালে শ্রীলঙ্কা থেকে শুরু। এরপর বাংলাদেশ, সবশেষ নেপাল। শ্রীলঙ্কায় রাজাপাকসের পতন হয়েছিল জুলাই মাসে, বাংলাদেশে হাসিনা সরকারের পতন হয় আগস্ট মাসে, আর নেপালে অলি সরকারের পতন হয়েছে সেপ্টেম্বর মাসে। মাসের এই ধারাবাহিকতাও বেশ মজার।

দেশে দেশে বেড়ে ওঠা জেন-জির জন্ম নব্বই দশকের শেষ থেকে একবিংশ শতাব্দীর শুরুর মধ্যে। জেন-জি দাবি করে তাদের কোনো রাজনৈতিক সম্পৃক্ততা নেই। তারা চায় বৈষম্যের অবসান, সুশাসন, স্বচ্ছতা ও চিন্তার স্বাধীনতা। নেপালের ঘটনা আকস্মিক নয়। বাংলাদেশে ছাত্রদের কোটা সংস্কার আন্দোলন দ্রুত রূপ নেয় গণ-অভ্যুত্থানে। হাসিনা ভারতে পালিয়ে জান বাঁচান। শ্রীলঙ্কায় তীব্র অর্থনৈতিক সঙ্কট, খাদ্য ও জ্বালানির ঘাটতি এবং লাগামহীন মুদ্রাস্ফীতির কারণে সাধারণ মানুষের জীবন দুর্বিষহ হয়ে ওঠে। প্রতিবাদে রাস্তায় নামে তরুণরা। সরকারের পতন ঘটে। পরে ২০২৪ সালের নির্বাচনে অনুরা কুমারা দিশানায়েকের নেতৃত্বে বামপন্থী জোট ক্ষমতায় আসে।

জেন-জির তোপে পড়া দেশগুলো ছিল প্রভাবশালী প্রতিবেশী ভারতের করদরাজ্যের মতো। ভারতের জন্য এটি হলুদ সঙ্কেত। নেপালের সহিংসতা ও প্রাণহানির নিন্দা জানিয়েছে ভারত। একই সাথে পশ্চিমবঙ্গ, বিহার ও উত্তরপ্রদেশের সীমান্ত এলাকায় অতিরিক্ত নিরাপত্তা নিয়েছে। আশঙ্কা নেই দাবি করলেও এমন সতর্কতা প্রকারান্তরে ভারতের আশঙ্কার বার্তাই দেয়।

শ্রীলঙ্কা, বাংলাদেশ মাড়িয়ে নেপালের এ অস্থিরতা দক্ষিণ এশিয়ার ভূ-রাজনীতিকে যে নতুন চাপে ফেলেছে তা ভারতের নিরাপত্তা, আঞ্চলিক অর্থনীতি এবং রাজনৈতিক ভারসাম্যে প্রভাব না ফেলে পারে না। তরুণ প্রজন্ম যেভাবে একের পর এক দেশের শাসনব্যবস্থায় কাঁপন ধরাচ্ছে তা যেকোনো শাসকের মনেই উদ্বেগের জন্ম দিতে পারে। দেশগুলোতে ক্ষোভের প্রেক্ষাপট ভিন্ন। তবে, তেতে ওঠার দৃশ্যপটে মিল আছে। গেল বছর নেপালের সুপ্রিম কোর্ট রায় দিয়েছিল, ফেসবুক, ইউটিউব, এক্সসহ আন্তর্জাতিক সব সোস্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মকে দেশে রেজিস্ট্রেশন করতে হবে; কিন্তু নির্দেশ মানেনি এসব প্রতিষ্ঠান। এর জেরে চলতি বছরে সরকার আকস্মিকভাবে ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম, ইউটিউব, এক্স নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। নেপালে শুধু ফেসবুক ও ইনস্টাগ্রামের সক্রিয় ব্যবহারকারীই প্রায় এক কোটি ৮০ লাখ। অনেকেই ব্যবসায়, শিক্ষা কিংবা দৈনন্দিন যোগাযোগে এই প্ল্যাটফর্মগুলোর ওপর নির্ভরশীল। এগুলো বন্ধ করায় সাধারণ মানুষ ক্ষুব্ধ হয়। ছোট উদ্যোক্তারা ব্যবসায় বন্ধ হওয়ার শঙ্কায় পড়েন। তরুণরা এটিকে স্বাধীন মতপ্রকাশের ওপর হস্তক্ষেপ হিসেবে দেখে। প্রথমে আন্দোলন ছিল কেবল সোস্যাল মিডিয়া খোলার দাবিতে। দ্রুত সেটি রূপ নেয় দুর্নীতিবিরোধী সর্বাত্মক আন্দোলনে।

শ্রীলঙ্কা, বাংলাদেশ ও নেপালের সাম্প্রতিক ইতিহাস প্রমাণ করেছে, যেখানে জনগণের আস্থা ভেঙে পড়ে, সেখানেই ক্ষমতাধর শাসকের পতন অনিবার্য। এখন প্রশ্ন, দক্ষিণ এশিয়ার এই তরঙ্গ থামবে কোথায়? অক্টোবর কি সত্যিই নতুন কোনো সরকারের পতন দেখতে যাচ্ছে? নাকি এই চক্রাকার প্রভাব অন্য কোনো দিকে মোড় নেবে? তবে নিশ্চিতভাবে বলা যায়, তরুণ প্রজন্মের কণ্ঠস্বর অবহেলা করলে যেকোনো সরকার বিপদে পড়বে। আর তাই উৎসুক মহলে অপেক্ষা, এরপর কোন দেশ এর শিকার হতে যাচ্ছে?

জেন-জির নেতৃত্বে জনগণ একের পর এক সেসব সরকারকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দিচ্ছে যারা দীর্ঘ দিন ক্ষমতায় ছিল। আরো নির্দিষ্ট করে বললে, এ আন্দোলনের মূল চালিকাশক্তি তরুণ প্রজন্ম। নেপালের চিত্রের বেশকিছু অংশ বাংলাদেশের সাথে মেলে। দেশটিতে তরুণদের দুই দিনের বিক্ষোভের পর ‘পরিস্থিতির নিয়ন্ত্রণ’ নিয়েছে সেনাবাহিনী। তারা আহŸান জানিয়েছে সবাইকে শান্ত থাকার। সেনাবাহিনী বলেছে জাতীয় ঐক্য ও সম্প্রীতি রক্ষা করতে এবং জনজীবন স্বাভাবিক করতে। সেখানেও আনুষ্ঠানিকভাবে সেনাবাহিনীর ওপর প্রেসিডেন্টের অবস্থান। তবে তরুণ আন্দোলনকারীরা তাকে মেনে নেয়নি। পরে নতুন প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব নিয়েছেন সাবেক প্রধান বিচারপতি।

ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি নেপালের প্রধানমন্ত্রী কে পি শর্মা অলির পদত্যাগের ঘটনায় শোক ও উদ্বেগ জানাতে গিয়ে বলেছেন, এই প্রতিবেশী দেশের স্থিতিশীলতা, শান্তি ও সমৃদ্ধি ভারতের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এ দিকে শিবসেনার এক এমপির হুঁশিয়ারি ভারতের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে কৌতূহল জাগিয়েছে। ভারতের ব্যাপারেও একই সতর্কবার্তা দিলেন শিবসেনা নেতা ও সংসদ সদস্য সঞ্জয় রাউত। তিনি বলেছেন, ভারতের ক্ষমতাসীন রাজনীতিবিদরা যদি এখনই নিজেদের না সামলায়, তবে নেপালের মতো পরিস্থিতি এ দেশেও দেখা দিতে পারে। সঞ্জয় রাউতের দাবি, নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বাধীন কেন্দ্রীয় সরকারও গভীরভাবে দুর্নীতিগ্রস্ত। ভারতের অর্থ বিদেশে পাচার হয়ে যাচ্ছে। কারো সন্তান দুবাই-সিঙ্গাপুরে বিলাসবহুল জীবন কাটাচ্ছে, কেউ আবার ক্রিকেট বোর্ডের চেয়ারম্যান হচ্ছে- এটিই বাস্তব। সঞ্জয় রাউত বলেন, একসময় নেপাল আমাদের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিল, তারা ভারতকে বড় ভাই মনে করত; কিন্তু তাদের সঙ্কটে ভারত সাহায্যের হাত বাড়ায়নি। এটিই আমাদের পররাষ্ট্রনীতির স্পষ্ট ব্যর্থতা। ভারতের রাজনীতি-কূটনীতি-ব্যবসায়ী সব মহলেই এ নিয়ে ব্যাপক আলোচনা। গণমাধ্যম বলছে, নেপালের অস্থিরতা থেকে ভারতের শিক্ষা নেয়া উচিত। এই অস্থিরতার কারণ বেকারত্ব ও মানুষের ক্ষোভ। ভারতেও একই ধরনের সমস্যা, যেমন কর্মসংস্থান হ্রাস ও গণতন্ত্রের দুর্বলতা রয়েছে।

বলা হচ্ছে, শ্রীলঙ্কা, বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের মতো প্রতিবেশী দেশগুলোতেও একই ধরনের আঞ্চলিক অস্থিরতা দেখা গেছে। সংবাদপত্রে ভারতের বৈদেশিক নীতির সমালোচনা করে বলা হয়, নেপালের চীনের সাথে সম্পর্ক বৃদ্ধি পাচ্ছে। নেপালের ভূখণ্ডের দাবি এবং সাম্প্রতিক প্রতিবাদগুলোও ভারতের উদ্বেগের কারণ। ভারতে ক্ষুধা, বেকারত্ব ও দুর্নীতির সমস্যা সমাধান করা হয়নি, যার ফলে সংসদ ‘জনগণের কাছে অকেজো’ হয়ে পড়েছে। এতে সতর্ক করা হয়েছে, বেকারত্ব, ‘গণতন্ত্র ধ্বংস’ এবং ক্রমবর্ধমান জাতি ও ধর্মের রাজনীতি ভারতের জন্য খুবই বিপজ্জনক।

লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট