পাক-আফগান সঙ্ঘাত ও ভারতের চাণক্যনীতি

কট্টর হিন্দুত্ববাদী ও মুসলিমবিদ্বেষী বিজেপি সরকারের চাণক্যনীতি যাতে দু’টি মুসলিম দেশের সম্পর্কে ফাটল ধরাতে না পারে, সে জন্য উভয় দেশকে পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ও সচেতন হতে হবে, পর্যবেক্ষক মহল এমনটিই মনে করে।

সম্প্রতি যুদ্ধবিরতি কার্যকর হওয়ায় দীর্ঘ দুই বছর পর বিচ্ছিন্ন কয়েকটি হামলার ঘটনা বাদ দিলে গাজায় গণহত্যা আপাতত বন্ধ হয়েছে। শান্তিতে নোবেল পাওয়ার তীব্র বাসনা থেকে গাজা শান্তিচুক্তির উদ্যোগ নিলেও নিঃসন্দেহে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের এটি একটি প্রশংসনীয় উদ্যোগ। গাজা যুদ্ধ বন্ধ হলেও হঠাৎ করে আমরা দেখলাম দু’টি প্রতিবেশী মুসলিম দেশ- পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের মধ্যে রক্তক্ষয়ী সঙ্ঘাত শুরু হয়েছে। পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের মধ্যে নতুন করে সীমান্ত সংঘর্ষে ১৫ জন নিহত ও শতাধিক আহত হয়েছেন। এ সঙ্ঘাত দুই দেশের মধ্যে ক্রমবর্ধমান শত্রুতার ইঙ্গিত দিচ্ছে। এক সময় মিত্র হিসেবে কাজ করা এ ভ্রাতৃপ্রতিম দুই প্রতিবেশী রাষ্ট্র কেন এখন সামরিক সঙ্ঘাতে জড়িয়ে পড়েছে? পাকিস্তানের চিরশত্রু ভারত কী এ সঙ্ঘাতে ইন্ধন জোগাচ্ছে?

পাকিস্তান ও বর্তমান আফগান নেতৃত্ব নিকট অতীতে ছিল একে অন্যের ঘনিষ্ঠ মিত্র। ধর্ম, সংস্কৃতি, ভাষা ও ভৌগোলিক দিক দিয়ে উভয়ে ছিল দুঃসময়ের বন্ধু। বিশেষ করে ১৯৭৯-৮৯ সাল পর্যন্ত আফগানিস্তানে সোভিয়েত আগ্রাসন রুখতে আফগান মুজাহিদদের পাশে থেকে পাকিস্তান যুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়েছে। ১৯৭৯ সালের ২৪ ডিসেম্বর সাবেক পরাশক্তি সোভিয়েত ইউনিয়ন আফগানিস্তানের সমাজতান্ত্রিক সরকার রক্ষায় দেশটিতে সেনাবাহিনী পাঠায়। তখন অপর পরাশক্তি যুক্তরাষ্ট্র তা মেনে নিতে পারেনি। মস্কো-ওয়াশিংটনের স্নায়ুযুদ্ধে জড়িয়ে পড়েন পাকিস্তানের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জেনারেল জিয়াউল হক। তিনি আমেরিকার সহায়তায় আফগান মুজাহিদদের প্রশিক্ষণ, অস্ত্র ও আর্থিক সহায়তা দেন। এ সহযোগিতার মাধ্যমে পাকিস্তান আফগান যুদ্ধের ঘাঁটি হয়ে ওঠে। সৌদি আরব, যুক্তরাষ্ট্র ও পাকিস্তান আফগানিস্তানে রাশিয়ার মোকাবেলায় ঐক্যবদ্ধভাবে এগিয়ে আসে। তখন লাখ লাখ আফগান শরণার্থী পাকিস্তানে আশ্রয় নেয়। কিন্তু ১৯৮৮ সালের ১৭ আগস্ট এক রহস্যময় বিমান দুর্ঘটনায় পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জিয়াউল হক নিহত হন। তার মৃত্যুর পরও পাকিস্তানের অন্যান্য সরকার আফগান যুদ্ধে সহায়তা অব্যাহত রাখে।

নব্বইয়ের দশকে তালেবান আফগানিস্তানের ক্ষমতায় আসে। এর পেছনে পাকিস্তানের বড় ভূমিকা ছিল। তখন দুই দেশের মধ্যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। ২০০১ সালে আমেরিকা আল কায়েদার সূত্র ধরে ‘ওয়্যার অন টেরর’ শুরু করে। আমেরিকা ও তার মিত্র তথা ন্যাটো আফগানিস্তানে সেনা পাঠায়। তালেবানকে ক্ষমতাচ্যুত করে পশ্চিমাদের তাঁবেদার সরকার প্রতিষ্ঠা করে। কিন্তু আফগানিস্তানে শান্তি আসেনি। চলে প্রচণ্ড যুদ্ধ- আফগানিস্তান হয় রণক্ষেত্র। আবার সাধারণ আফগানরা পাকিস্তানে গিয়ে আশ্রয় নেয়।

দীর্ঘ ২০ বছর ধরে যুদ্ধ চলার পর ২০২১ সালের আগস্টে তালেবান আবার ক্ষমতায় আসে। ওই সময় আমেরিকানদের সাথে ভারতীয় কূটনীতিকদেরও আফগানিস্তান ছাড়তে হয়। ইসলামাবাদের শাসকগোষ্ঠী ওই সময় বেশ খুশি ছিল। কিন্তু ২০১১ সালে আফগানিস্তানে তালেবান সরকার শক্তিশালী হওয়ার সাথে সাথে পাকিস্তানেও তালেবান প্রভাবিত বিভিন্ন গোষ্ঠী একই আদর্শের জন্য জোর প্রচেষ্টা শুরু করে। এতে উভয় পক্ষে ভুল বোঝাবুঝি শুরু হয়। এ ছাড়া ভারতের সাথে আফগান সরকারের নতুন করে সম্পর্ক তৈরির চেষ্টা- সব মিলিয়ে এখন দুই দেশের মধ্যে যুদ্ধাবস্থা তৈরি হয়েছে।

পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের মধ্যে দুই হাজার ৬০০ কিলোমিটার দীর্ঘ সীমান্ত থাকলেও অনেক এলাকা এখনো অনির্ধারিত। এসব এলাকায় দুই পক্ষের নিরাপত্তা বাহিনীর মধ্যে প্রায়ই সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। তবে এবার সীমান্তে সবচেয়ে মারাত্ম সঙ্ঘাতক শুরু হয়েছে। সম্প্রতি পাকিস্তানে উগ্রবাদী হামলার ঘটনা অনেক বেড়েছে। বিশেষ করে, দেশটির উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলীয় খাইবার পাখতুনখাওয়া প্রদেশে এসব হামলায় সামরিক বাহিনীর বহু সদস্য নিহত হয়েছেন। এসব হামলার জন্য আফগানিস্তান থেকে আসা উগ্রবাদীদের দায়ী করে পাকিস্তান। ইসলামাবাদের অভিযোগ, আফগানিস্তানের নিষিদ্ধ আস্তানা থেকে এসে উগ্রবাদীরা পাকিস্তানে হামলা চালাচ্ছে। এই উগ্রবাদী গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে আফগানিস্তানকে ব্যবস্থা নিতে চাপ দেয় ইসলামাবাদ। কিন্তু পাকিস্তানের ওই অভিযোগ অস্বীকার করে আফগানিস্তানের তালেবান সরকার জানায়, আফগানিস্তানে কোনো পাকিস্তানি উগ্রবাদী নেই। পাকিস্তানের বিভিন্ন সংস্থা তালেবান সদস্যদের নিজেদের ভূমিতে গত ৪১ বছর ধরে আশ্রয় ও প্রশিক্ষণ দিয়েছে। ফলে নিজ দেশেও এর বীজ রোপিত হয়েছে তাদের অজান্তে। এখন তারা পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ফণা তুলে ধরেছে।

পাকিস্তানের চিরশত্রু ভারত। কয়েক মাস আগেও ভারত-পাকিস্তান ভয়াবহ যুদ্ধ হয়েছে। যুদ্ধে ভারত পাকিস্তানের কাছে নাকানি-চুবানি খেয়েছে। তাই পাকিস্তানকে বেকায়দায় ফেলতে ভারতের চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। আর পাকিস্তান-ভারত সঙ্ঘাতের মধ্যে সম্প্রতি আফগান পররাষ্ট্রমন্ত্রী দিল্লি সফরে গিয়ে যেন আগুনে ঘি ঢেলে দিলেন। ভারত এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে তালেবান সরকারকে স্বীকৃতি না দিলেও দিল্লিতে আফগান পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে উষ্ণ অভ্যর্থনা জানিয়েছে। ভারত ঘোষণা করেছে, কাবুলে নিজেদের অফিসকে পূর্ণাঙ্গ দূতাবাসের মর্যাদা দেবে। এ ধরনের পদক্ষেপ ভারতের নীতিতে বড় পরিবর্তনের ইঙ্গিত দেয়। কারণ, এক সময় ভারত তালেবানকে পাকিস্তানের প্রক্সি বলে অভিহিত করলেও এখন ইসলামাবাদকে ঘায়েল করতে কৌশলে তালেবানকে ব্যবহার করতে চায়।

পাকিস্তানের সেনাবাহিনীকে দেশের অখণ্ডতা রক্ষায় দু’টি শক্তিশালী গেরিলাযুদ্ধ সামলাতে হচ্ছে। এক দিকে বেলুচিস্তানের বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন, অন্য দিকে পশতুভাষীদের টিটিপি। তারা চার দশকের যুদ্ধে অভিজ্ঞতাসম্পন্ন। টিটিপি বা পাকিস্তান তেহরিকে তালেবান আফগান তালেবানের মদদে যে তারা পাকিস্তানে যুদ্ধ চালাচ্ছে- এটি একেবারে যেমন উড়িয়ে দেয়া যাবে না, আবার পাকিস্তানের সমাজে যে তালেবান আদর্শের পক্ষে ভালোই জনমত রয়েছে তাও অস্বীকার করার উপায় নেই। পাকিস্তানের দীর্ঘ দিনের অভিযোগ হচ্ছে- নয়াদিল্লি বালুচদের বিচ্ছিন্নতাবাদী কাজে সহায়তা দিচ্ছে। এখন যদি আফগানিস্তানের সাথেও দিল্লির সখ্যতা গড়ে ওঠে- তা অবশ্যই পাকিস্তানের জন্য তীব্র মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়াবে।

গত ১১ অক্টোবর রাতে সীমান্তে পাক-আফগান লড়াই শুরু হয়। তালেবান সরকার দাবি করে- তারা ৫৮ জন পাকিস্তানি সেনাকে হত্যা করেছে। আর পাকিস্তান দাবি করে- তারা দুই শতাধিক তালেবান যোদ্ধাকে হত্যা করেছে। পরে পাকিস্তান স্বীকার করে, তাদের ২৩ জন সেনা নিহত ও ১৯ জন আহত হয়েছেন। তারা দাবি করে, তাদের বাহিনী আফগানিস্তানের অভ্যন্তরে ২১টির বেশি সীমান্ত চৌকি দখল করে নিয়েছে। কাবুল তাদের পক্ষে হতাহতের সংখ্যা নিশ্চিত করে জানায়নি। এ সঙ্ঘাতের পর দুই প্রতিবেশী নিজেদের অনেকগুলো সীমান্ত পারাপার বন্ধ করে দেয়। এতে দুই দেশের ব্যবসায়-বাণিজ্য ও পণ্য সরবরাহ বন্ধ হয়ে গেছে।

ভারতের সাথে আফগানিস্তানের তালেবান সরকারের নতুন যে চুক্তি হলো তাকে অনেকে ‘শত্রুর শত্রুই বন্ধ’-এ নীতির বাস্তবায়ন হিসেবে দেখছেন। পাকিস্তান এখন আফগানিস্তানের সাথে বিরোধে জড়িয়েছে। তাই ভারত পাকিস্তানের প্রতিপক্ষ তালেবানের সাথে হাত মিলিয়েছে। বর্তমান আঞ্চলিক রাজনীতিতে এটি বিস্ময়কর কিছু নয়। বর্তমানে ভারতের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক তেমন ভালো নয়। অন্য দিকে, সৌদি আরবের সাথে পাকিস্তান প্রতিরক্ষা চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। তাই ভারত তার চিরশত্রু পাকিস্তানকে ঘায়েলের সুযোগ খুঁজছিল। এ ক্ষেত্রে সহজে আফগানিস্তানকে নতুন বন্ধু হিসেবে পেয়ে গেছে। এটি নিঃসন্দেহে ইতিহাসের এক পরিহাস। সেখানে সহযোগিতা রূপ নিয়েছে সন্দেহে। বন্ধুত্ব পরিণত হয়েছে শত্রুতায়। এতে মনে হয়, রাজনীতিতে কেউ চিরকাল বন্ধু নয়, কেউ চিরকাল শত্রুও নয়- শুধু স্বার্থই স্থায়ী। কিন্তু স্বার্থের খেলায় হারিয়ে যায় মানবিক সম্পর্ক, যা এক সময় ধর্ম, ভাষা ও ইতিহাসের বন্ধনে আবদ্ধ ছিল।

পাকিস্তান-আফগানিস্তান কয়েক দফা সংঘর্ষের পর আবার নতুন করে যুদ্ধবিরতি ও সঙ্ঘাত বন্ধের চেষ্টা চলছে। কাতারের রাজধানী দোহায় দুই দফা শান্তি আলোচনার মাধ্যমে ইতোমধ্যে দ্রুত যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হয়েছে পাকিস্তান ও আফগানিস্তান। এ শান্তি আলোচনার উদ্যোক্তা কাতারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ১৯ অক্টোব ঘোষণা দিয়েছে। এক সপ্তাহ ধরে দক্ষিণ এশিয়ার এই দুই প্রতিবেশীর মধ্যে সীমান্তে কয়েক দফা ভয়াবহ সঙ্ঘাত চলার পর প্রাথমিক যুদ্ধবিরতির মেয়াদ বাড়িয়ে শান্তি আলোচনায় বসে উভয় পক্ষ। কাতারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, কাতার ও তুরস্কের মধ্যস্থতায় শান্তি আলোচনা চলাকালে পাকিস্তান ও আফগানিস্তান একটি আনুষ্ঠানিক যুদ্ধবিরতির বিষয়ে সম্মত হয়। যুদ্ধবিরতির স্থায়িত্ব নিশ্চিত করতে এবং টেকসই ও নির্ভরযোগ্যভাবে এর বাস্তবায়ন যাচাই করতে দুই দেশ ফলোআপ বৈঠক করতেও সম্মত হয়েছে বলে জানা গেছে। এ শান্তি আলোচনায় আফগান প্রতিরক্ষামন্ত্রী মোল্লা মুহাম্মদ ইয়াকুব আফগান প্রতিনিধিদলের এবং পাকিস্তানের পক্ষে দেশটির প্রতিরক্ষামন্ত্রী খাজা মুহাম্মদ আসিফ প্রতিনিধিদলের নেতৃত্বে দেন। ভ্রাতৃপ্রতীম দুই দেশের মধ্যকার সঙ্ঘাত বন্ধের এ উদ্যোগ প্রশংসনীয়। আশা করা হচ্ছে, উভয়পক্ষ ইতোমধ্যে বিষয়টি উপলব্ধি করতে সক্ষম হয়েছে। ভবিষ্যতে দুই দেশ নিজেদের মধ্যকার সঙ্কট নিরসন করে পুনরায় ঐক্যবদ্ধভাবে এগিয়ে যাক- এটিই মুসলিম উম্মাহর প্রত্যাশা। কট্টর হিন্দুত্ববাদী ও মুসলিমবিদ্বেষী বিজেপি সরকারের চাণক্যনীতি যাতে দু’টি মুসলিম দেশের সম্পর্কে ফাটল ধরাতে না পারে, সে জন্য উভয় দেশকে পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ও সচেতন হতে হবে, পর্যবেক্ষক মহল এমনটিই মনে করে।