ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের মুর্শিদাবাদের ভরতপুরের বিদ্রোহী ও বিক্ষুব্ধ তৃণমূল বিধায়ক হুমায়ুন কবির নিজের এলাকা বেলডাঙাতে ৬ ডিসেম্বর বাবরি মসজিদের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন নিয়ে কেন্দ্র, গদি মিডিয়া ও কিছু মানুষের গেল গেল রব যেন ধ্বনিত হচ্ছে। কিন্তু কলকাতা হাইকোর্ট স্পষ্ট করে দিলেন, মসজিদ নিয়ে আদালতের কোনো আপত্তি নেই। আইনশৃঙ্খলা দেখার দায়িত্ব রাজ্য সরকারের। স্মরণযোগ্য যে, ২০২৪ সালে বেলডাঙার ভারত সেবাশ্রম সঙ্ঘের কার্তিক মহারাজের উদ্যোগে ওই জেলার সাগরদীঘিতে রামমন্দির হয়। তখন কেউ তার বিরোধিতা করেননি। এত গেল গেল রব ওঠেনি। হুমায়ুন কবিরের বাবরি মসজিদের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন নিয়ে আশপাশের এলাকার মুসলিমরা যখন ব্যস্ত; তখন হিন্দু সংগঠনের উদ্যোগে মুর্শিদাবাদের বহরমপুরে রামমন্দির ও মালদহ জেলায় আদিনা মন্দিরের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হয়েছে। তা নিয়ে গেল গেল রব ওঠেনি। আশঙ্কা ছিল, অঘটন ঘটার, কিন্তু তা হয়নি। সব কিছু ছিল শান্তিপূর্ণ।
পশ্চিমবঙ্গে যখন রাজ্যের শীর্ষ বিজেপি নেতারা চিৎকার করে রামমন্দির বানানোর হুঙ্কার দেন, তখন কিছু হয় না, সদাসর্বদা মুসলিমদের নিয়ে কটূক্তি করেন বিজেপির নেতারা; তখনো কিছু হয় না। রাজকোষের অর্থ ব্যয় করে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যখন দিঘায় জগন্নাথ মন্দির তৈরি করেন বা শিলিগুড়িতে আইটি পার্কের জায়গায় জয়কালী মন্দির ও কলকাতার উপকণ্ঠে রাজারহাট নিউটাউনে দুর্গাঙ্গন করার ঘোষণা দেন, তখন গেল গেল রব ওঠে না। সব দোষ যেন হুমায়ুন কবিরের বাবরি মসজিদের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনে। যেন হুমায়ুন কবির কোনো রামমন্দির ধ্বংস করে বাবরি মসজিদ বানাচ্ছেন। পরিস্থিতি এমন জায়গায় চলে গেছে, এখন এই আবেগ যেন চলমান। প্রত্যেক ক্রিয়ার একটি সমান ও বিপরীত প্রতিক্রিয়া আছে। তাই পশ্চিমবঙ্গে একাধিক বাবরি মসজিদ হলে অবাক হওয়ার কিছু নেই। ইতিহাসের স্বাভাবিক শিক্ষা এটি। বিষয়টি একটু আলোচনা-সাপেক্ষ। তা হলো, পশ্চিমবঙ্গের মুসলিম সমাজ বুঝতে পারছে, এই রাজ্যে মুসলিমরা যেন শুধু ভোট ব্যাংক। ৭০ শতাংশ মুসলিম অধ্যুষিত মুর্শিদাবাদও এর ব্যতিক্রম নয়। তাই হুমায়ুনের এ দ্রোহের সাথে মুর্শিদাবাদে তৃণমূলের বিদ্রোহ আরো বাড়বে বলে মনে হয়। মুর্শিদাবাদের উন্নয়নে লবডঙ্কা বলে তৃণমূলের দলের মধ্যে টানাপড়েন। নদীভাঙন, কৃষিক্ষেত্র, শিক্ষার প্রসার সব কিছুতে নবাবী মুর্শিদাবাদ বঞ্চনার শিকার। এর উপর ওয়াক্ফ সংশোধনী আইন কার্যকর করা তৃণমূল সরকারের প্রতি মুসলিমদের বিরূপ মনোভাব তৈরি করেছে।
ধর্মের ভিত্তিতে ভারত ও পাকিস্তান দু’টি পৃথক রাষ্ট্র হয়। ভারত শুরু থেকে ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র। ভারতের সংবিধানের প্রস্তাবনায় খুব স্পষ্ট ‘উই দ্য পিপল অব ইন্ডিয়া’। ভারতের বহুত্ববাদী সংস্কৃতি খুব স্পষ্ট। ভারতীয় সংবিধানে ধর্মের অধিকারও স্পষ্ট। এতে কোনো অস্পষ্টতা নেই। সেখানে বলা হয়েছে, ধর্ম পালন, ধর্মীয় প্রচার ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান করার অধিকার সবার রয়েছে। আবার বলা হয়েছে, রাষ্ট্রের কোনো ধর্ম থাকবে না। ধর্মীয় ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় আনুগত্য থাকবে না। কোনো ধর্মের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের বা সরকারি অর্থ খরচ করা চলবে না। এমনকি ধর্মীয় প্রচারে অন্য কোনো ধর্মকে আঘাত করা যাবে না।
কিন্তু ভারতে ধর্মীয়-উন্মাদনা ও বিদ্বেষ কখন থেকে তৈরি হলো? আমাদের দেশটা যখন ধর্মের ভিত্তিতে ভাগ হয়, তখনই কিন্তু দুটো দেশে ধর্মীয় বিভাজনের বীজ রোপিত হয়েছে। ক্ষমতাসীন দল ধর্মকে ব্যবহার করেছে অন্য কায়দায়। ভিন্ন কৌশলে। রাষ্ট্রযন্ত্র ব্যবহার করে একের পর এক দাঙ্গা বাধানো হয়েছে; যাতে ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা দেশ ছেড়ে পালান। দেশ ছেড়ে পারস্পরিক পালিয়ে আসার মধ্যে কিন্তু বিভাজনের বিষ আরো নিহিত। দেশ ভাগের আগে ১৯৪৬ সালের দাঙ্গা ভারত ভাগ ও বঙ্গ বিভাজনকে ত্বরান্বিত করেছিল। দেশ ভাগের পর ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে দাঙ্গা হয়েছিল। পশ্চিমবঙ্গে ছোট-বড় দাঙ্গা হয়েছিল অনেকগুলো। কিন্তু ১৯৬৪ সালের দাঙ্গা সব হিসাব পাল্টে দেয়। একের পর এক মুসলিমদের বড় অংশ পশ্চিমবঙ্গ ছাড়ে। একই অবস্থা পাকিস্তান বা পূর্ব পাকিস্তানে হয়েছে। ফলে সেখানকার ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা পশ্চিমবঙ্গসহ ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে চলে আসেন। দেশ ভাগের ফলে পারাপারটা একপক্ষীয় ছিল না, ছিল দ্বিপক্ষীয়।
ভারতের বা এমনকি পাকিস্তানে বা বাংলাদেশে নির্বাচনী প্রচারে ধর্ম খুব বেশি প্রাধান্য পায়নি। ভারতে নব্বইয়ের দশকে বিজেপি সভাপতি লালকৃষ্ণ আদভানির সেই যে রামরথ যাত্রা বা বাবরি মসজিদ-রামমন্দির আমাদের জীবনের এক মহা ক্ষতচিহ্ন, ভারতের কোণায় কোণায় দাঙ্গা বাধিয়ে দিলো। সেই দাঙ্গা ভারতকে অন্ধকারের দিকে নিয়ে যায়। ১৯৯০ সালে দেশের ধর্মনিরপেক্ষতা রক্ষা করতে গিয়ে তৎকালীন জনতা সরকারের প্রধানমন্ত্রী বিশ্বনাথ প্রতাপ সিংয়ের সরকারের পতন ডেকে আনে। তখন থেকে ভারতে তীব্রভাবে ধর্মীয় উন্মাদনা ও উত্তেজনার শুরু, যা রাজনীতিতে ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করেছে। যার জেরে ১৯৯২ সালের ৬ ডিসেম্বর উন্মত্ত করসেবকরা বিজেপির শীর্ষ নেতাদের সামনে বাবরি মসজিদ ধূলিসাৎ করে দেয়। মসজিদটি ধ্বংসের আগে ও পরে দেশব্যাপী দাঙ্গা ভারতের জনজীবন বিধ্বস্ত করে দিয়েছে।
ভাগলপুর, আহমেদাবাদ ও সুরাট দাঙ্গা, নেলি গণহত্যা, মুম্বাই দাঙ্গা, কানপুর, মিরাট, মুজফ্ফরনগর দাঙ্গা ভারতের সুস্থ চেতনা রক্তাক্ত করেছে। ২০০২ সালের গুজরাট গণহত্যা সব হিসাব ওলটপালট করে দেয়। যে সময় ঘটনাটি ঘটে, তখন কেন্দ্রে অটলবিহারি বাজপেয়ির নেতৃত্বে বিজেপি ভারতের ক্ষমতায়। আজকের যিনি প্রধানমন্ত্রী সেই নরেন্দ্র মোদি ছিলেন তখন গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী। সে দিন অমিত শাহও গুজরাটে মোদির মন্ত্রিসভার অন্যতম সদস্য।
গুজরাট গণহত্যায় খুন হন দুই হাজার মানুষ। বেসরকারি হিসাবে এ সংখ্যা আরো বেশি। ওই গণহত্যায় সাতবারের জাতীয় কংগ্রেসের সংসদ সদস্য ও প্রবীণ গান্ধীবাদী নেতা এহেসান জাফরি নৃশংসভাবে খুন হন। তার বিচার আজো হয়নি, বরং অটলবিহারি বাজপেয়ি মোদিকে রাজ ধর্মপালনকারী হিসেবে বিশেষিত করেন। সে সময় পশ্চিমবঙ্গের তৃণমূল নেত্রী ও আজকের যিনি রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মোদিকে পুষ্পস্তবক পাঠান। তখন তৃণমূল কংগ্রেসের বয়স মাত্র চার বছর। বিজেপির জোটসঙ্গী।
১৯৯৮ সালে তৃণমূল কংগ্রেস গঠনের পর দলটি ঘোষণা দেয়, বিজেপিকে ফ্রন্টে এনে পশ্চিমবঙ্গ থেকে বামফ্রন্টকে হটাতে হবে। গুজরাটে মুসলিম গণহত্যার পর পশ্চিমবঙ্গে যেহেতু বামফ্রন্ট সরকার ক্ষমতায় ছিল, তাই এখানে বিজেপি-তৃণমূল খুব সুবিধা করতে পারেনি। অধ্যাপক ইমানুল হকের ভাষা ও চেতনা সমিতি কলকাতার পার্কসার্কাস ময়দানে একটি প্রতিবাদ সমাবেশ করে। ওই সমাবেশে ক্ষুরধার বক্তব্য দেন বলিউড অভিনেত্রী শাবানা আজমি ও তার স্বামী কবি, গীতিকার জাভেদ আখতার, অর্থনীতিবিদ অশোক মিত্র, লেখিকা মহাশ্বেতা দেবী ও প্রখ্যাত সাংবাদিক বিশ্বজিৎ রায়।
রাজনীতিতে সরাসরি ধর্মের ব্যবহার করেছে বিজেপি ও আরএসএস, যা পশ্চিমবঙ্গে বাইনারি হিসেবে ব্যবহার করেছে তৃণমূল-বিজেপি। তা না হলে পশ্চিমবঙ্গের তৃণমূল সরকার পূজার সময় ক্লাবগুলোতে কয়েক কোটি টাকা অনুদান দেয় কিভাবে? কেন সরকারি খরচে ইফতার পার্টি হয়? বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারি কেন মুসলিমদের পাকিস্তানে পাঠানোর নিদান তোলেন? তার পাল্টা হুমায়ুন। ভারত সেবাশ্রম সঙ্ঘের কার্তিক মহারাজ রামমন্দির করবেন। হুমায়ুনের পাল্টা বাবরির ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন। একেই বলে, টিট ফর ট্যাট। মুসলিমরা এখন শুধু ভোট ব্যাংক নন। তারাও তাদের অধিকার বুঝে নিতে চান।
কেন মুর্শিদাবাদের আহিরনে আলিগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসের পরিকাঠামোগত উন্নয়ন হয় না? কেন সাচার কমিটির রিপোর্টের সুপারিশ কার্যকর হয় না? কেন মুর্শিদাবাদে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস আলাদাভাবে করা হয় না? কেন ওই জেলার বেলডাঙা থানার ভাবতায় হাজী পরিবারের দানের জায়গায় কলেজের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনের ১৫ বছর পর আর কোনো কাজ হয় না? কেন এত বঞ্চনা? তাই বিদ্রোহের আগুন হুমায়ুনের মতো তৃণমূলের অনেকের মধ্যে জ্বলছে। এত গেল গেল কেন?
লেখক : পশ্চিমবঙ্গের কলামিস্ট, প্রাবন্ধিক ও কবি



