যারা বিপ্লবের আগুন জ্বালিয়েছিল, সনদ স্বাক্ষরের মহাকাব্য রচনায় তারা কলম ধরতে অস্বীকৃতি জানাল জুলাই বিপ্লবের আঁতুড়ঘর থেকে উঠে আসা ছাত্র-নেতৃত্বাধীন দল ন্যাশনাল সিটিজেন্স পার্টি-এনসিপি। ১৭ অক্টোবর ২০২৫ জুলাই সনদে তারা স্বাক্ষর করেনি। এনসিপি স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিয়েছে, জুলাই সনদের বাস্তবায়ন-প্রক্রিয়া সম্পর্কে সুস্পষ্ট রূপরেখা না থাকলে তারা সনদ অনুমোদন করবে না। ছাত্রদের আশঙ্কা ছিল, যদি জুলাই সনদ বাস্তবায়নে সুস্পষ্ট কোনো প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা নির্ধারিত না হয়, তাহলে পরবর্তী সরকার ক্ষমতায় এসে প্রতিশ্রুত সংস্কারগুলো উপেক্ষা করতে পারে। তাদের এ অস্বীকৃতি একধরনের সাংবিধানিক সঙ্কট সৃষ্টি করেছে, কারণ এনসিপির অনুমোদন ছাড়া সনদটি প্রকৃত অর্থে জনগণের ইচ্ছার প্রতিফলন বলা যায় না। ছাত্ররা তো ছিলেন সেই চালিকাশক্তি, যারা শেখ হাসিনার সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করে অন্তর্বর্তী সরকার প্রতিষ্ঠার পথ তৈরি করেছিলেন। সংস্কার কমিশনগুলো, অন্তর্বর্তী সরকারের বৈধতা, এমনকি সনদ নিয়েও তাদের কর্তৃত্বের ভিত্তি খুঁজে পায় ওই ছাত্র আন্দোলন থেকে। এ প্রেক্ষাপটে, জুলাই সনদ স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে এনসিপির অনুপস্থিতি সনদের সাংবিধানিক বৈধতা সম্পর্কে গভীর সংশয় ও বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। এ অনুপস্থিতি এখন অন্তর্বর্তী সরকারকে বাধ্য করেছে জুলাই সনদ বাস্তবায়নে একটি আইনগত কাঠামো প্রণয়নে জরুরি পদক্ষেপ নিতে। এ প্রবন্ধে আমরা বিশ্লেষণ করব- জুলাই সনদ বাস্তবায়ন নিয়ে এনসিপির প্রধান দাবিগুলো কী এবং সেগুলো কিভাবে অন্তর্বর্তী সরকারের নীতিনির্ধারণে প্রভাব ফেলতে পারে।
অধ্যাদেশ নয়, প্রয়োজন একটি আদেশের
এনসিপির অন্যতম প্রধান দাবি হলো- জুলাই সনদ বাস্তবায়নে যে আইনগত দলিল প্রণয়ন করা হবে, তা যেন অধ্যাদেশ (অর্ডিন্যান্স) নয়; বরং অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে জারি করা একটি আদেশ (অর্ডার) হিসেবে বিবেচিত হয়। যদিও আদেশ-অধ্যাদেশের এই পার্থক্যটি আপাতদৃষ্টিতে কেবল একটি কারিগরি বিষয় মনে হয়, তথাপি এর সুদূরপ্রসারী সাংবিধানিক তাৎপর্য রয়েছে। যদি জুলাই সনদের সংস্কারগুলো অধ্যাদেশের মাধ্যমে জারি করা হয়, তাহলে তা স্বাক্ষর ও ঘোষণার দায়িত্ব বর্তাবে রাষ্ট্রপতির ওপর, যিনি বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের চেতনার অংশ তো ননই; বরং শেখ হাসিনার শাসনব্যবস্থার ধারাবাহিকতা বহন করেন। ফলে তিনি সেই জনগণের ইচ্ছার প্রতিনিধিত্ব করেন না, যাদের গণ-সাংবিধানিক ক্ষমতার ভিত্তিতে অন্তর্বর্তী সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। তা ছাড়া বর্তমান সংবিধানের অধীনে অধ্যাদেশ জারি হয় অনুচ্ছেদ ৯৩-এর ভিত্তিতে, যা এ দলিলকে বিদ্যমান সাংবিধানিক কাঠামোর অধীনস্থ করে তুলবে। কিন্তু জুলাই সনদে যে সংস্কারগুলোর প্রস্তাব করা হয়েছে, সেগুলো সংবিধানের মূল কাঠামো পরিবর্তন করতে চায়। অর্থাৎ- এমন মৌলিক পরিবর্তন বাস্তবায়নের আইনি দলিল যদি বিদ্যমান সংবিধানের ওপর নির্ভরশীল হয়, তবে তা একধরনের আইনি অসামঞ্জস্যতা সৃষ্টি করবে। এনসিপির যুক্তি হলো জুলাই সনদ বাস্তবায়নে প্রণীত দলিলটি প্রচলিত সাংবিধানিক শৃঙ্খলা থেকে নয়; বরং জনগণের গণ-সাংবিধানিক ক্ষমতা (যা একটি উচ্চতর কর্তৃত্বের উৎস) থেকে তার বৈধতা আহরণ করতে হবে। এটি সেই জনগণের ক্ষমতা, যা পূর্ববর্তী সরকার ও শাসন শাসনব্যবস্থাকে উৎখাত করে অন্তর্বর্তী সরকার প্রতিষ্ঠা করেছে। এনসিপির মতে, জুলাই সনদ বাস্তবায়নে প্রণীত আইনগত দলিলটি বর্তমান সংবিধানের সীমাবদ্ধতা অতিক্রম করে জনগণের সার্বভৌম ইচ্ছার প্রতিফলন হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হওয়া উচিত।
এ কারণে এনসিপি দৃঢ়ভাবে দাবি করছে, জুলাই সনদ বাস্তবায়নে যে আইনি দলিল জারি করা হবে, তা যেন একটি ‘আদেশ’ আকারে হয়, যা অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষে প্রধান উপদেষ্টা স্বাক্ষর করবেন। এটি নিছক একটি প্রশাসনিক পদ্ধতির প্রশ্ন নয়; এটি গভীরভাবে বৈধতার সাথে সম্পর্কিত। অন্তর্বর্তী সরকার এবং এর নেতৃত্বদানকারী প্রধান উপদেষ্টা তাদের কর্তৃত্ব পুরনো সংবিধান থেকে নয়; বরং জনগণের সার্বভৌম ক্ষমতা থেকে অর্জন করেছেন। অতএব, প্রধান উপদেষ্টার স্বাক্ষরিত যেকোনো আদেশও সেই একই জনগণের সার্বভৌম ক্ষমতা থেকে তার বৈধতা পাবে। এটি হবে জনগণের পক্ষ থেকে গৃহীত একটি সাংবিধানিক পদক্ষেপ, পুরনো সাংবিধানিক ব্যবস্থার কোনো অধীন দলিল নয়। সুতরাং, এটি বিদ্যমান সংবিধানের ‘অধীনস্থ’ কোনো দলিল হিসেবে বিবেচিত হতে পারে না। এনসিপির মতে, এ পদ্ধতিই একমাত্র উপায় যার মাধ্যমে নিশ্চিত করা যাবে, জুলাই সনদ সত্যিকার অর্থে জনগণের ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটাবে এবং পুরনো শাসনব্যবস্থার আইনি সীমাবদ্ধতা থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত থাকবে।
গণভোট প্রসঙ্গে
পরবর্তী গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুটি হলো- সব প্রধান রাজনৈতিক দল এ মর্মে একমত হয়েছে, ‘জুলাই সনদ’ জাতীয় গণভোটের মাধ্যমে জনগণের সামনে পেশ করা উচিত। এর মাধ্যমে জনগণ এ সনদের প্রস্তাবিত সংস্কারগুলো কার্যকর করতে চান কি না, সে বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত দেয়ার সুযোগ পাবেন। তাত্তি¡কভাবে এটি একটি গণতান্ত্রিক অগ্রযাত্রা হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। তবে, গণভোট পরিচালনার পদ্ধতি নিয়ে প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ইতোমধ্যে স্পষ্ট বিভাজন ও মতবিরোধ দৃশ্যমান হয়ে উঠেছে। যদিও অধিকাংশ দল আনুষ্ঠানিকভাবে জুলাই সনদে স্বাক্ষর করেছে; কিন্তু সেটি করেছে কিছু আপত্তি বা শর্তযুক্ত মন্তব্য সংযুক্ত করে (নির্দিষ্ট সংস্কারের বিরোধিতা করে মতবিরোধের নোট সংযুক্ত করে), যেখানে নির্দিষ্ট কিছু সংস্কারের প্রতি অসম্মতি জানিয়েছে। এখন এ দলগুলো দাবি করছে, তাদের আপত্তিগুলো যেন গণভোটের প্রশ্নের অংশ হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। অর্থাৎ- জনগণ যদি সনদের পক্ষে ভোট দেয় (হ্যাঁ বলে), তবু যেন মনে হয় তারা ওই আপত্তিগুলোকেও সমর্থন দিয়েছে। অন্যভাবে বললে, সংশ্লিষ্ট দলগুলো গণভোট প্রশ্নে নিজেদের আপত্তিগুলো অন্তর্ভুক্ত করে জনগণের রায়কে প্রভাবিত বা বিকৃত করতে চায়, যা গণতান্ত্রিক স্বচ্ছতার পরিপন্থী।
ন্যাশনাল সিটিজেন্স পার্টি-এনসিপি এ প্রস্তাবের তীব্র বিরোধিতা করেছে। তাদের মতে, গণভোট হতে হবে একটি সরল ও স্পষ্ট প্রশ্নের ওপর ভিত্তি করে- জনগণকে কেবল জিজ্ঞাসা করা উচিত, তারা জুলাই সনদকে অনুমোদন করেন কি না। রাজনৈতিক দলগুলোর ভিন্নমত বা ‘নোট অব ডিসেন্ট’ গণভোটে অন্তর্ভুক্ত করা হলে পুরো প্রক্রিয়া অর্থহীন হয়ে পড়বে। জনগণকে কেন রাজনীতিকদের মতামত নিয়ে মন্তব্য করতে বাধ্য হতে হবে? বর্তমান রাজনৈতিক বাস্তবতায় জনগণের মধ্যে রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতি আস্থার সঙ্কট প্রকট, কারণ জনগণ মনে করে রাজনৈতিক দলগুলো ক্ষমতা লাভ ও তা আঁকড়ে রাখার প্রতি অতিমাত্রায় আগ্রহী। এসব বিবেচনায় রেখে এনসিপি মনে করেছে, গণভোটের উদ্দেশ্য কোনো রাজনৈতিক দলের কৌশলগত হিসাব-নিকাশকে গুরুত্ব দেয়া নয়; বরং জনগণের ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটানো। আর রাজনৈতিক শ্রেণীর দায়িত্ব হলো জনগণের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করা, সেটিকে বিকৃত বা প্রভাবিত করা নয়।
স্বয়ংক্রিয় বাস্তবায়ন ধারা
এখানে একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক রয়েছে, যা ন্যাশনাল সিটিজেন্স পার্টি-এনসিপি নিজে উপেক্ষা করেছে অথবা ভুলক্রমে এড়িয়ে গেছে। তাদের দাবি করা উচিত ছিল, যদি জুলাই সনদ গণভোটে অনুমোদিত হয়, তবে নির্দিষ্ট সময়সীমার মধ্যে তা বাস্তবায়ন করতে হবে। যদি পরবর্তী সংসদ (যা একই সাথে সংবিধান সংস্কার পরিষদ হিসেবে কাজ করবে) নির্ধারিত সময়ে তা বাস্তবায়নে ব্যর্থ হয়, তবে সনদটি স্বয়ংক্রিয়ভাবে সংবিধানের অংশে পরিণত হবে। এ রক্ষাকবচটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যে রাজনৈতিক দলই পরবর্তী সরকার গঠন করুক না কেন, তারা এমন সংস্কার বাস্তবায়নে অনিচ্ছুক থাকবে, যা তাদের নিজস্ব ক্ষমতা হ্রাস করে। জুলাই সনদে প্রস্তাবিত বিকেন্দ্রীকরণ ও নির্বাহী বিভাগের ক্ষমতা সীমিতকরণের বিষয়টি কার্যত কোনো শাসকদলের স্বতঃস্ফূর্ত আগ্রহের বিষয় নয়। এ বাস্তবতা বিবেচনায়, আইনের মাধ্যমে একটি স্বয়ংক্রিয় বাস্তবায়ন ধারা সংযুক্ত করা সাংবিধানিকভাবে এখন অপরিহার্য। যদি বাংলাদেশের জনগণ গণভোটে জুলাই সনদ অনুমোদন করেন, তবে তা বাস্তবায়নে বিলম্ব বা অজুহাতের কোনো সুযোগ থাকা উচিত নয়। জনগণের ইচ্ছা কখনো রাজনীতিবিদদের সুবিধা বা স্বার্থের ওপর নির্ভরশীল হতে পারে না।
জনগণের ম্যান্ডেট চূড়ান্ত হতে হবে
অন্তর্বর্তী সরকারের কাঁধে এখন ঐতিহাসিক দায়িত্ব হলো জনগণের এ ম্যান্ডেট আইনে রূপান্তরিত করা। জুলাই সনদের চূড়ান্ত সাফল্য বা ব্যর্থতা সম্পূর্ণরূপে নির্ভর করবে এর বাস্তবায়ন পদ্ধতির ওপর। সংবিধানের কাঠামোর মধ্যে জুলাই সনদে প্রকাশিত জনগণের ইচ্ছা অন্তর্ভুক্ত করার পথ সুগম করতে অন্তর্বর্তী সরকারের উচিত অবিলম্বে একটি সুনির্দিষ্ট আইন প্রণয়ন করা। এ আইন নিশ্চিত করবে যেন বিপ্লব-জাত আকাক্সক্ষা কেবল দলিলবদ্ধ হয়ে না থাকে; বরং দেশের মৌলিক বিধানে স্থান করে নেয়।
লেখক : বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী এবং দ্য হেগের আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের নিবন্ধিত কৌঁসুলি



