ইসলামী ব্যাংকে অবৈধ নিয়োগ বাতিল প্রসঙ্গে

বাজারে ইসলামী ব্যাংকের প্রতিটি শেয়ারের দাম ৪২ টাকা হিসেবে এস আলমের শেয়ারগুলোর বাজারমূল্য দাঁড়ায় পাঁচ হাজার ৫৯৬ কোটি টাকা। ব্যাংকটি এখন পর্যন্ত সেগুলো বিক্রি বা বাজেয়াপ্ত করার কোনো পদক্ষেপ নেয়নি।

ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ পিএলসিতে বিশেষ অঞ্চলের একচ্ছত্র অবৈধ নিয়োগ বাতিল ও মেধাভিত্তিক নিয়োগের খবরে সারা দেশে ব্যাপকভাবে সাড়া পড়েছে। গ্রাহক, শুভাকাক্সক্ষী ও গ্রাহক ফোরামসহ বিনিয়োগকারীদের মধ্যেও বিষয়টি আলোচিত হচ্ছে। আমানতকারীরা ও ব্যবসায়ীদের পক্ষ থেকেও ইতোমধ্যে অবৈধ নিয়োগ বাতিল ও সারা দেশ থেকে মেধাবীদেরকে এ বৃহৎ আর্থিক প্রতিষ্ঠানে নিয়োগের দাবি উঠেছে। ইতোমধ্যে ব্যাংক অবৈধভাবে নিয়োগপ্রাপ্তদের জন্য মূল্যায়ন পরীক্ষার আয়োজন করলে প্রায় চার হাজার ৯৫৩ জন পরীক্ষায় অংশগ্রহণ না করায় তাদেরকে বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা বা ওএসডি করে। ব্যাংকের আইন অমান্য করায় তাদের অধিকাংশকে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে। এদিকে ছাঁটাইয়ের পাশাপাশি ব্যাংকটি নতুন করে জনবল নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ মেধাবীদের মধ্যে ব্যাপক সাড়া পড়েছে। ব্যাংক ব্যবস্থাপনাকে ইতোমধ্যে অনেক আমানতকারী ও তাদের সংগঠন ধন্যবাদ দিয়েছে।

২০১৭ সালে ইসলামী ব্যাংক দখল করে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত এস আলম গ্রুপ। এরপর ব্যাংকটি থেকে বড় অঙ্কের অর্থ ধাপে ধাপে বের করে নিয়ে যাওয়া হয়। গত বছর ৫ আগস্টের আগ পর্যন্ত ব্যাংকটি থেকে প্রায় এক লাখ কোটি টাকা বের করে নেন এস আলম গ্রুপ ও আওয়ামী লীগ-সমর্থিত ব্যবসায়ীরা। এসব টাকা এখনো ফেরত আসছে না; বরং খেলাপি হয়ে বড় ধরনের সঙ্কটের মধ্যে ফেলেছে ব্যাংকটিকে। বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে, গত ডিসেম্বর শেষে ব্যাংকটির খেলাপি ঋণ বেড়ে হয়েছে ৬৫ হাজার ৭১৬ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ৪২ দশমিক ২২ শতাংশ। পাশাপাশি ব্যাংকটিতে কোনো নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ ও পরীক্ষা ছাড়াই প্রায় ১০ হাজার কর্মকর্তা নিয়োগ দেয়া হয়, যা এখন গলার কাঁটা হয়ে পড়েছে ব্যাংকটির জন্য।

স্বৈরাচারী আমলে এস আলম গ্রুপ চট্টগ্রামের পটিয়া, আনোয়ারা, বাঁশখালী উপজেলাভিত্তিক আলাদা বক্সে জীবনবৃত্তান্ত জমার বক্স স্থাপন করে এবং বক্সে জীবনবৃত্তান্ত জমা পড়লেই তখন ইসলামী ব্যাংকে চাকরি দেয়া হতো। পাশাপাশি এস আলমের গৃহকর্মী ও তার স্বামীকেও ব্যাংকে উচ্চ বেতনে চাকরি দেয়া হয়। এ ছাড়া আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতা ও মন্ত্রীদের পাশাপাশি বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা থেকে কোনো জীবনবৃত্তান্ত পাঠালেও নিয়োগ দেয়া হয়েছে। এমনকি বাংলাদেশ ব্যাংকের সুপারিশেও বড় নিয়োগ হয়। নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা ছাড়াই এগুলো হয়েছিল।

এস আলমের দখলের আগে ২০১৬ সাল শেষে ব্যাংকটির জনবল ছিল ১৩ হাজার ৫৬৯ জন। এর মধ্যে চট্টগ্রাম জেলার ছিল ৭৭৬ জন। বর্তমানে ব্যাংকটিতে প্রায় ২২ হাজার কর্মকর্তা-কর্মচারী রয়েছেন। এর প্রায় ১১ হাজার কর্মকর্তা-কর্মচারী চট্টগ্রাম বিভাগের। অবশ্য বর্তমানে ব্যাপক হারে এ ছাঁটাইয়ের পর কর্মকর্তা-কর্মচারীর সংখ্যা কমে আসবে। অবৈধভাবে নিয়োগ পাওয়াদের মধ্যে কিছু যোগ্য কর্মকর্তা থাকলেও অধিকাংশই অযোগ্য। এতে ভবিষ্যতে ব্যাংক বড় ধরনের আর্থিক লোকসানের মধ্যে পড়তে পারে। এ জন্য সতর্ক পদক্ষেপ হিসেবে নিয়ম মেনে ছাঁটাই ও নিয়োগের পদক্ষেপ নিতে হচ্ছে।

অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেয়ার পর নতুন পরিচালনা পর্ষদ একাধিক নিরীক্ষা প্রতিষ্ঠান দিয়ে ব্যাংকটির ঋণ, বিনিয়োগ ও জনবল পরীক্ষা করে। তাতেই উঠে আসে এস আলমের দখলে থাকার সময় নিয়োগপ্রাপ্তদের অযোগ্যতা, সনদ জালিয়াতিসহ নানা বিষয়। এসব নিয়োগ পাওয়া কর্মকর্তাদের বেশির ভাগের সনদ চট্টগ্রামের বিভিন্ন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের। আবার অনেকেরই সনদে জালিয়াতির তথ্য উঠে এসেছে। নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ ও পরীক্ষা ছাড়া চাকরি পাওয়াদের মধ্য থেকে পাঁচ হাজার ৩৮৫ জনের যোগ্যতা মূল্যায়ন পরীক্ষার উদ্যোগ নেয় ব্যাংকটি। গত ২৭ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত মূল্যায়ন পরীক্ষায় চার হাজার ৯৫৩ জন অংশ নেননি, তাদেরকে চাকরিবিধি লঙ্ঘনের দায়ে ছাঁটাই করা হচ্ছে। এদিকে ব্যাংকটিতে সারা দেশ থেকে মেসেঞ্জার কাম সিকিউরিটি গার্ড নিয়োগের পাশাপাশি ট্রেইনি অ্যাসিস্ট্যান্ট অফিসার (ক্যাশ) পদের জন্য স্নাতক উত্তীর্ণ ও ট্রেইনি অ্যাসিস্ট্যান্ট অফিসার পদের জন্য স্নাতকোত্তর উত্তীর্ণরা আবেদন করতে পারবে মর্মে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশিত হয়েছে যা চাকরিপ্রার্থীদের মধ্যে ব্যাপক সাড়া জাগিয়েছে। ইসলামী ব্যাংকের মতো এত বড় ব্যাংকের শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা ও আমানতের ঊর্ধ্বমুখিতা দেশের অর্থনীতিতে ও ব্যাংক খাতে আশার সঞ্চার করেছে। সেপ্টেম্বর মাসে রেকর্ড পরিমাণ অর্থাৎ আট হাজার ৭৮০ কোটি টাকার রেমিট্যান্স শুধু ইসলামী ব্যাংকের মাধ্যমে এসেছে।

ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ পিএলসির বর্তমান ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো: ওমর ফারুক খান এক দৈনিক পত্রিকায় সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘গত কয়েক বছরে ইসলামী ব্যাংকের যে পরিমাণ ক্ষতি হয়েছে, তা অন্য কোনো ব্যাংকে হলে সেটি ঘুরে দাঁড়াতে পারত বলে আমার বিশ্বাস হয় না।

বিস্ময়কর হলেও সত্য, ব্যাংকটি অল্প সময়ের মধ্যেই ঘুরে দাঁড়িয়েছে। সিআরআর হিসাবে বাংলাদেশ ব্যাংকে আমাদের ছয় হাজার ৩০০ কোটি টাকা জমা থাকার কথা। কিন্তু গত বছরের ৫ আগস্ট সিআরআর জমা তো দূরের কথা, উল্টো দুই হাজার ৩০৮ কোটি টাকা ঘাটতি ছিল। সে ঘাটতি আমরা এরই মধ্যে কাটিয়ে উঠেছি।’ বর্তমানে ব্যাংকটি তারল্য সঙ্কট কেটে ওঠায় গ্রাহক নির্বিঘেœ লেনদেন করতে পারছেন। বিশ্লেষকদের মতে, ব্যাংকের যে হারে বর্তমানে ডিপোজিট বাড়ছে এখন দরকার বিনিয়োগ বাড়ানো ও বিনিয়োগের মুনাফার হার কমানো। বিনিয়োগ বৃদ্ধি না হলে অর্থনীতির চাকা গতিশীল হবে না।

দেশে কর্মহীন মানুষের সংখ্যা বেড়েছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ ত্রৈমাসিক শ্রমশক্তি জরিপের তথ্য অনুযায়ী, চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের দ্বিতীয় প্রান্তিকে (অক্টোবর-ডিসেম্বর) দেশে বেকারত্বের হার বেড়ে ৪ দশমিক ৬৩ শতাংশ। ১০ বছর ধরে সদ্যবেকার বা নিষ্ক্রিয় তরুণ-তরুণীর সংখ্যা এক কোটির মতো রয়েছে। এর মানে, দেশে সংজ্ঞা অনুসারে ২৭ লাখ বেকার আছেন। এর সাথে সদ্যবেকার এক কোটি যুক্ত হলে দেশের প্রায় সোয়া এক কোটি মানুষকে বেকার বলা যায়। তাই এ সময়ে ইসলামী ব্যাংকের নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি বেকার যুবকদের মধ্যে নতুন আশার সঞ্চার হয়েছে। আশা করি, ব্যাংক চৌকস ও মেধাবীদের নিয়োগ দিয়ে তার পুরনো ঐতিহ্যে ফিরে আসবে। ইসলামী ব্যাংকের সাথে দেশের অর্থনীতি ও প্রায় পাঁচ কোটি মানুষের জীবন-জীবিকাসহ ভালো-মন্দ জড়িত। তাই আগামী দিনের ব্যাংকিংয়ে যেন আমানতকারীদের আস্থার জায়গা তৈরি হয়, পাশাপাশি বিনিয়োগের অনুকূল পরিবেশ ও বাজারভিত্তিক মুনাফার হার নির্ধারিত হয়। আর একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো- এস আলমের শেয়ার বাজেয়াপ্ত করতে হবে। আমরা জানি, বাংলাদেশ ব্যাংক আদালতের মাধ্যমে এস আলমের শেয়ার বিক্রি বা হস্তান্তরের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে। কিন্তু পরিতাপের বিষয় হলো- এক বছরেরও বেশি সময় পার হয়ে গেলেও এখন পর্যন্ত এস আলমের শেয়ার বিক্রি করে ব্যাংকের দায় পরিশোধের কার্যত কোনো উদ্যোগ নেয়া হয়নি। এটি দেশের জন্য ও ব্যাংকের জন্য গুরুতর ঝুঁকি। কারণ এস আলম বিদেশে পালিয়ে গেলেও শেয়ার মালিকানার মাধ্যমে এখনো ইসলামী ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণ কাঠামোয় তার উপস্থিতি রয়ে গেছে। অর্থনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, এ অবস্থায় এস আলম যেকোনো সময় পুনরায় ব্যাংকের মালিকানা পুনর্গঠন করে ফিরে আসতে পারে, যা দেশের ব্যাংকিং খাতের জন্য বিপর্যয়কর পরিস্থিতি হতে পারে। পুঁজিবাজারের তথ্য অনুযায়ী, ইসলামী ব্যাংকের মোট শেয়ার ১৬১ কোটি। এর মধ্যে এস আলম গ্রুপ এখন নিয়ন্ত্রণ করছে ১৩১ কোটি ৩৫ লাখ ৯৯ হাজার শেয়ার, যা মোট শেয়ারের ৮১.৫৯ শতাংশ।

বাজারে ইসলামী ব্যাংকের প্রতিটি শেয়ারের দাম ৪২ টাকা হিসেবে এস আলমের শেয়ারগুলোর বাজারমূল্য দাঁড়ায় পাঁচ হাজার ৫৯৬ কোটি টাকা। ব্যাংকটি এখন পর্যন্ত সেগুলো বিক্রি বা বাজেয়াপ্ত করার কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতি অনুযায়ী, কোনো বড় খেলাপি বা অপরাধীর মালিকানা থাকলে সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের শেয়ার বাজেয়াপ্ত করে দায় পরিশোধে ব্যবহার করা যায়। কিন্তু ইসলামী ব্যাংকের ক্ষেত্রে এই আইন প্রয়োগ হচ্ছে না কেন, তা নিয়ে আমানতকারীদের মধ্যে নানা প্রশ্ন তৈরি হচ্ছে। এটি নিয়ন্ত্রক সংস্থার বড় ধরনের ব্যর্থতা। দেশের মানুষ, আমানতকারীরাসহ সব শুভাকাক্সক্ষী চায় অতি দ্রুত এস আলমের শেয়ার হস্তান্তর, অর্থাৎ- বিক্রি করে খেলাপি ঋণ সমন্বয় করা হোক।

লেখক : অর্থনীতি বিশ্লেষক ও ব্যাংকার