বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাস সবসময় ঘটনাবহুল ও সঙ্ঘাতপূর্ণ এবং রক্ত দিয়ে লেখা। আমরা একটা জাতি দু’বার স্বাধীনতা লাভের আনন্দ-উচ্ছ¡াস উপভোগ করেছি। একবার ১৯৪৭ সালে রক্তপাতহীনভাবে, আরেকবার ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর রক্তের বিনিময়ে। আবার জুলাই বিপ্লব আমাদের নতুন এক স্বাধীনতার কথা জানান দিয়ে গিয়েছে; কিন্তু এক একটা সাফল্যের পর কেন যেন বারবার হোঁচট খাচ্ছি আমরা।
সেই যে জন্মের পর থেকে রাজনীতিবিদদের মুখ থেকে যেমন আমরা শুনে আসছি যে, দেশ আজ ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে। এখনো সেই একই কথাই শুনছি। আমাদের জাতীয় জীবন থেকে এ ক্রান্তিকাল হয়তো আর কখনো শেষ হবে না। এক একটা বিপ্লব হয়, গণজাগরণ হয়, সরকারের পরিবর্তন ঘটে, মানুষ আশায় বুক বাঁধেন; কিন্তু ঘুরে ফিরে যে তিমিরে ছিলাম সেখানে থেকে যাচ্ছি আমরা। এক পা এগিয়ে গেলে যেন দু’পা পিছিয়ে যাওয়া। কেন যেন সঙ্ঘাত ও অনিশ্চয়তার আবর্তে ঘুরপাক খেয়ে চলছে এদেশ।
আমাদের জাতীয় জীবনের প্রধান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, আমরা একটি সঙ্কট থেকে উত্তরণের পর খুব বেশিদিন যেতে না যেতে আরেকটি নতুন সঙ্কট তৈরি করে ফেলতে পারি। এ নতুন সঙ্কট আমাদের লক্ষ্যচ্যুত করে। আমাদের আবার পেছনে নিয়ে যায়। আমরা ফিরে যাই প্রচলিত সেই পুরনো পথে। যেমন অনেকে বলে থাকেন, ভূতের নাকি পেছনের দিকে পা আছে। তাই তারা পেছনে চলে। আমাদের অবস্থা অনেকটা সেরকম হয়েছে।
যেমন একটা নতুন জাগরণে আমরা ঐক্যবদ্ধ হয়ে আনন্দে উচ্ছ¡াসে ফেটে পড়ি। দেখতে থাকি নতুন জীবনের স্বপ্ন। আর সে স্বপ্ন দেখতে না দেখতে শুরু হয় স্বপ্নভঙ্গের পালা। হয়তো একটা বিশাল পরিবর্তনের অভিঘাত সহ্য করার মতো ধৈর্য আমাদের থাকে না বলে এমনটা ঘটে। সে জন্য হয়তো আমরা কায়েমি স্বার্থের পুরনো পথে চলতে কেমন যেন ব্যাকুল হয়ে পড়ি। যে বিপ্লব জাতীয় জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রকে আবেগ, উচ্ছ¡াসে উদ্বেলিত করেছিল তা ভ্রান্ত পথে চলার কারণে তার আবেদন দ্রুত ¤øান হতে থাকে। এই যে জুলাই বিপ্লব নিয়ে আমরা বিপ্লব বিপ্লব বলে নতুন একটা বাংলাদেশের কথা ভাবছিলাম, তাও খুব অল্প সময়ের মধ্যে কেমন যেন হ য ব র ল মনে হচ্ছে। কারণ ফ্যাসিবাদবিরোধী পক্ষগুলো ঐকতান হারিয়ে ফেলেছে। তারা পরস্পরের বিরুদ্ধে বাক্যবাণ নিক্ষেপ করে চলেছে। অথচ গণ-অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার নিপীড়নমূলক লৌহকঠিন শাসনের পরিসমাপ্তির পর প্রয়োজন ছিল দেশপ্রেমিক সব রাজনৈতিক দলের মধ্যে সুদৃঢ় ঐক্য গড়ে তোলা; কিন্তু তা তো হলোই না, বরং পরস্পরের মধ্যে এই কাদা ছোড়াছুড়ির ঘটনা পরিস্থিতি কোন দিকে নিয়ে যাবে সেটি নিয়েও একধরনের শঙ্কা তৈরি হয়েছে।
আমাদের স্মরণ করে দিচ্ছে, ১৯৫৪ সালের বিশাল বিজয়ের করুণ সমাপ্তির কথা। তখন প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনে মুসলিম লীগের বিরুদ্ধে যুক্তফ্রন্টের বিজয় ছিল অসাধারণ। ৩০৯ আসনের মধ্যে যুক্তফ্রন্ট ২১৫ আসনে জয় লাভ করে। স্বতন্ত্রভাবে বিজয়ী সাতজন যোগদান করলে মোট আসন সংখ্যা দাঁড়ায় ২২৩। কিন্তু দুর্ভাগ্য এ দেশের মানুষের। জোটের নেতাদের কামড়াকামড়িতে যুক্তফ্রন্ট সরকার ৫৪ দিন ক্ষমতায় থাকতে পেরেছিল। পরিণামে যে রাজনৈতিক অস্থিরতা সৃষ্টি হয়েছিল তার সুযোগ নিয়ে তৎকালীন সেনাপ্রধান জেনারেল আইয়ুব খান ১৯৫৮ সালের অক্টোবর মাসে ক্ষমতা দখল করেন।
ঠিক আবারো আরেকটি বিশাল কোনো আন্দোলনে বিজয়ের পর একইভাবে ফ্যাসিবাদবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে যে অনৈক্য পরিলক্ষিত হচ্ছে তা দেশের পরিস্থিতি কোন দিকে নিয়ে যাবে; তা নিয়ে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা প্রকাশের অবকাশ রয়েছে। কারণ নির্বাচনের সময় ঘোষণার পরও রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যকার এ অনৈক্য একটি অশনি সঙ্কেতের বার্তা বহন করছে।
এ প্রসঙ্গে একটি গল্প মনে পড়ে গেল। গল্পটি হচ্ছে : তিন বেকার বন্ধু মরুভূমির মধ্য দিয়ে হেঁটে চলছেন এক অজানা গন্তব্যে। হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ তারা স্বর্ণের বড় একটি স্তূপ দেখতে পান। এটি পেয়ে তারা আনন্দে আত্মহারা হয়ে ওঠেন। তারা ভাবতে থাকেন, তাদের জীবনের সব দুঃখ কষ্ট এখন কেটে যাবে। ইতোমধ্যে তাদের বেশ ক্ষুধা লাগে। তারা এক বন্ধুকে পাঠান বাজারে খাবার আনতে। বন্ধুটি বাজারে খাবার আনতে গিয়ে ভাবলেন- যদি তিনি খাবারে বিষ মিশিয়ে নিয়ে যান, তাহলে বাকি দুই বন্ধু সে বিষ মিশ্রিত খাবার খেয়ে মারা গেলে সব স্বর্ণের মালিক তিনি হয়ে যাবেন। যেমন চিন্তা তেমন কাজ। তিনি নিজেকে বাকি দুই বন্ধুর জন্য খাবার কিনলেন এবং তাতে বিষ মিশিয়ে দিলেন। তারপর ফিরে গিয়ে দুই বন্ধুকে বিষমাখা খাবার দিলে তারা তা খেয়ে সাথে সাথে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন।
জীবিত বন্ধুটি তখন স্বর্ণের স্তূপ জড়িয়ে ধরে আনন্দে দিশাহারা হয়ে সুখস্বপ্ন দেখছিলেন। তখন ওখান দিয়ে একদল ডাকাত পার হচ্ছিল। তারা দেখল, একটি লোক স্বর্ণের একটি স্তূপ জড়িয়ে ধরে বসে আছেন। তারা একটুও দ্বিধা না করে লোকটিকে হত্যা করে স্বর্ণগুলো লুট করে দ্রুত প্রস্থান করে। লোভ আর কামড়াকামড়ির ফল এ গল্পের মধ্যে দিয়ে চমৎকারভাবে ফুটে উঠেছে। তবে আমরা জানি না বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক গল্পের ফল কী হতে যাচ্ছে। সেটি দেখতে হয়তো আরো কিছুদিন অপেক্ষায় থাকতে হবে।